বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৪

হেনরী স্বপনের দীর্ঘ কবিতা : কীর্তনখোলা

0

কুশলের দিন নেই। মৃত্তিকা উর্বর নারী; রুগ্ন গাঙচিল।
অদ্ভুত জমাট; মাঝি ডিঙার বৈঠায় ভাঙ্গে বালু ঘোলা জল।

ধুঁকে ধুঁকে ক্রোধেও ঘুণের কাঁচাহাড়। গাঙ ঝিনুক মেললে;
ক্লেদঅশ্রু লোনা; আজো গোঁয়ার বর্গীর ভয়ে ব্যঙ্গ প্রতিদিন;
ছিন্ন উজানির হাঁকে; বিচ্ছেদ আক্রোশে কূলপ্লাবী—কল্পলতা।

 

 

জোনাকী দুপুর ঘুঙুর দুপায়ে হাঁসগুলো
……………….খরগোশ কবি—মৃত্যুর ঝিনুক
……………….পুনর্জন্ম ট্রামে…
বাদামি বসন্ত নিতম্বিনী; রক্ত গালিচায় মৌনধ্যানে।

অবসর দিন। তৃণের মৃত্যুর কথা থাক।
সবুজ গোধূলি রঙধনু গারুড় পারদ।
কীর্তনখোলার ভরাগাঙে কাঁকড়া সঙ্গমি;
সাত রঙে ঝাঁপ দিয়ে—
—মৎস্য কন্যাদের রূপকথা ভেজাঅঙ্গে
উঠে আসে মনোরমা মাসিমার ডাক।

বেগম সুফিয়া, দেবেন দাদুর বয়সে রৌদ্রের
……….খরতাপ। ভোরের উঠোনে
মনসামঙ্গলে পয়ারসন্ধ্যার ফুল ঝরে।
আকাশ ইলশেগুঁড়ি। মেঘকেশ
ধানক্ষেতে বিবস্ত্র মূর্ছায় ১৯৭০-এর জলোচ্ছ্বাসে।

অতল অদ্ভুত প্রতারণা; নগ্নিকা বয়স
…………অলৌকিক দোতারার সুর
………………….অজস্র ঢেউয়ে…
বার্ধক্য উজিয়ে ওঠে; মাঝির পাঁজর নিকানো গলিতে।
চাঁদমারি প্রতিদিন মহাশূন্যে পাড়ি দেয় খেয়া,
চাঁদোয়া পালক পালকি বেহারা। শাদাথান
মুহূর্তের কালস্রোতে ছলচ্ছল—ঘুণ পরমায়ু
বিবর্ত বর্শিতা ফোঁসে
……………….নাগফণা ধনিচা বাতাস।
এমোন কি দুঃখ। অভিশাপ গ্রন্থি
……………….অপরাহ্ন স্মৃতি সাঁতরায়
……………….ইলিশের ঝাঁক। পাখি গেরস্থালি।
ঢাকাগামী যাত্রী; অসভ্য ক্লান্ত বিশ্রামাগার বিলিকাটে,
অমিয় বাবুর মিহি বেহালার সুর
ব্যাকুল যাত্রী ও কুলি কোলাহল।

তুলসী বসন ছন্দত্রিপদি হাওয়ায়
……………….উড়ছে দীঘল স্বপ্ন—মহাশ্বেতা।
……………….পাঁক আচ্ছাদিত
……………….কিশোর-কিশোরী
……………….পুজো প্রেমিক খদ্দের
জেলে নাও ভর্তি… মেছোঘ্রাণ।

মুমূর্ষু জলের গোপন সোহাগ।
ভাসমান ছায়ায় বিচ্ছিন্ন বর যেনো অঙ্গ জুড়োবার,
সমস্ত বিকেল ব্যস্ত,
মন্থর ঢেউয়ে ভাসে কচুরির স্তন।
রৌদ্রে পোড়ে ডানা। জেলেবউ গাঁতিজাল
……………….মেলে দেয় মাছের পালক।
খড়চিন্তা। সারাক্ষণ বেলোয়ারি মন
যৌনব্যস্ত ভাসে জেলেদের সপ্তডিঙা।
ক্লান্ত সন্ধ্যা।
লঞ্চঘাট ব্যাপ্ত। শরীর দোলায় বস্তির খুবরি,
চাদ্দিকে আলোর কৃষ্ণপক্ষ;
ভ্রমণ বাতাস।
তামস ডিঙায় বাণিজ্যিক ডগরির ছাও
মাঝি-মাল্লার বৈঠার ঘায়ে
ছুটে চলে হোসেন মিয়ার নাও।

অলীক স্বপ্নের গুহাবাস। দিগম্বরী নোঙর ডাঙায়
নির্জন ওপার গোসাপ বাজার।
খেয়াঘাটে আড্ডা। খৈনিপাতার হলুদ ধোঁয়াঘ্রাণ।
সিঁদুর কুমারী তিমিত চড়ায় ওঠে
জোছনাচাঁদ নাওর চলেছে।
অচেনা চাঁদের মুখবন্ধ। সার্কাস ভল্লুক পশমের ঝুপি।
আগাছায় উদ্ভিন্ন আলোক। কুমিরের দাঙ্গা লোলুপ ঠোক্কর।
উপকূলে—কূলভাঙ্গে চালাঘর শপথ উচ্ছ্বসি কোলাহল,
ক্ষ্যাপাবুকে তর্কের সম্ভোগ। ঈর্ষাভাগ্য। ধ্রুপদী সংগীত অথৈ।

হৃদপিণ্ডে বিস্তীর্ণ ক্ষরণ। চারণ প্রপাত।
খল জটিল নিশ্বাসে…
পুরুত অশ্বিনী ভক্তিযোগ।
ধ্যানীমগ্ন।
শিলালিপি খোদাই শিল্পের কারিগর।
দমকা সন্ত্রাস রেশম গুটিতে ঘোরপ্যাঁচ
অতীত জড়ানো গন্ধ;
জানালায় উঁকি দেয়,
পেখম ময়ূর নিভৃত বাসর ৮-ই ডিসেম্বর একাত্তর।

শিকারী শিকার খোঁজে। ভাঙন নদীর খরস্রোতে।
শরীর গলিত নষ্ট-পচা
খলসে থিতায়
সর্বাঙ্গ বেহুলা…
অতীত ছায়ার ছিদ্র খোঁজে ভয়। সাপেরা খোলস পাল্টে ফেলে;
বৃক্ষের বল্কল কষ—কামিজের লাল রঙে সূর্যের মূর্ছিত
ম্লান ভালোবাসা। ঝুপঝাপ ঝরে ঘাম—বৃষ্টি বকুলের
চৈতি হাওয়া।
ফের ডুমুরের ফুল। বাগানবাড়ির লুকনো ছায়ায়। স্বপ্ন।
কল্পনা সবুজ বুনোঅগ্নি জ্বলে; আলিঙ্গন অশ্বত্থশরীরে,
বিধবা চিতার নির্জনতা।

তারপর,
হাটবার শুরু হলো;
কীট-পতঙ্গের মধুচাষ।
মাতাল মুখোশ; ইতিহাস কামড়ায়
……………….বেহদ্দ গোক্ষুর।
এলোকেশ কাউনের ঘ্রাণ,
মুখের লালায়
এ্যাসিড তরল চো… চো…
অগ্নিক্ষত ডেটল তুলোয় ভেজানো মেঘের রক্তস্নান।
শেষ হলো :
নাবালিকা ধর্ষণ পরখ।
বুনোমোষ ক্লান্ত।
অক্ষম বীর্যের বিষে;
……..যন্ত্রণার
……………আহ্লাদে গোঙানি,
স্বাদ। লঙ্কা আদার সোয়াদ।
লঘুজোছনায় আমানতগঞ্জে চরের ভেড়ার
……………মাংসভোজ।
শোকদগ্ধ নগরীর দুঃখ ইথারে ইথারে ভেংচিকাটে।

গলিঘুঁজি কীর্তনখোলার ডাকাতেরা; কুমোর বাড়ির মাটি
……..শাড়ির……..আঁচল
……..কবির……..কবিতা
……..গন্দম……..স্বাচ্ছন্দ্য
……..কেড়ে……..নেয়…
কয়েসের…ভীম…রথে।

পার্কের উচ্ছিষ্টে বিবর্ণ জারজ; হেলেঞ্চার কুঁড়ি,
দীর্ঘশ্বাস থেঁতলে বেরয় হাতুড়ির ঘায়ে;
সোসাইটির পিরিচে কবিতা বমন।
আড্ডায় তর্কের টুংটাং। জীর্ণশব্দ ভাঙে।
পার্বন পতিত জমিনে মুকুন্দদাস।
……..ঋণগ্রস্ত—
……..উর্বর প্রসব ভ্রুণে
……..ব্যর্থতার কালোথাবা।
আবাহন সভ্যতার পরিচয়পত্র হাতে
কাউনিয়া থেকে কবিরা আসেন সাহিত্য বাসরে,
চেকপোস্ট চোখ বোলায় খচিত গাঙচিল।

শাওনের ঢল উজানিয়া—খনন পেশিতে কালিদাহ হাড়।
তুষঠোঁটে শিসদেয় যুবতী দোয়েল অহংকার…।
তৃণঘাস। মিহিন কামিজ তপ্ত। ক্লান্ত ছায়াস্তন।
সোমত্ত পাঙাস চুমো দেয় বেচে,
পৌরকর হুকো টানে; কালেকট্রি পাড়।
বাতাসে ভাটির নাঙাপাল ওড়ে
জীর্ণ অভিমান।
কাঁচা কৈশোর রোদ্দুরে
মুখ গুঁজে মুখের লালায় ভুড়ভুড়ি দেয়
…………………………..হালের মহেশ।
গাঢ়দগ্ধ গনগনে ঘামে; ইট তাতানো শ্রমিক
দেহব্রহ্ম। উজানে ডোবায়
অন্তর্গত আষাঢ়ের তামসিক তিলবন—
……..ছনক্ষেত…
ক্লেদ-ক্ষতের অর্ধেক।
ছায়াবীথি আদিম কার্পাস।
……..অনিশ্চিত ভবিষ্যত
……..নালা-খালেবিলে
……..কাজলি মাছের
……..মখমল;
কালো ধোঁয়ায় মেলালো স্পষ্ট সব
……..প্রতারণা।
ভুলব্যাখ্যা আর স্বপ্নের নোঙর তুলে
জাহাজের সমস্ত কুলিরা হাঁক দেয়;
একঝাঁক বেলেহাঁসের প্রণতি।

নিরুপায় নিসর্গের ক্ষীণস্বর; ভাসমান।
……..ভাসমান…
……..দুপুর-বিকেল
……..ক্ষোভে নিরুত্তর।
সন্দীপন পাঠশালা বকুলের শাখাপূর্ণিমায়
……..আয় আয় ডাকে ঝিঁ ঝিঁ।
………………গর্ভবতী—
মিথুন মুনিয়া বেঁধেছে খড়ের লালঝুঁটি…!
তানপুরা প্রিয় কাবেরীর মুখ
জয়াদিদির ড্রিলক্লাশে কিচিরমিচির
পরাণের পাঁজর খাঁচায় একছুট
……..ইঁদুর-বেড়াল খেলা।
বিবর্ণ খসড়া খেরোখাতা—হামাগুড়ি দেয় ছুটি
পাঠশালা… কাশবন চরে,
উদোম গোধূলি জানুজলে শ্যামলিমা ভুঁই-জংলা;
……..ভাটিয়ালী মন—
……………..তীর্থস্নান
আশ্চর্য অমরতার পার্বণ প্রস্তুতিহীন
উর্মিময় জনমনুষ্যের জীবন অপার।

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জীবনানন্দের শহর বরিশালে থাকেন। কবিতা চর্চা করেন। সম্পাদনা করেন ‘জীবনানন্দ’ নামের একটি ছোটোকাগজ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।