জলবনহুর
এক ফোঁটা অঙ্গজল তুমি নিয়ে এসেছো আমায় এই ধাবমান নদীর কিনারে; তুমি উন্মোচিত করে দিয়েছো আমার সুমহান অভিমান, এক ফোঁটা অঙ্গজল তুমি দুর্দান্ত ডিগবাজি খাও আমার মাথার খাড়িতে, নেমে আসো খাড়া এই গ্রীবা বেয়ে কালো কশেরুকায়; তুমি জল, অঙ্গ এককণা, নেচে নেচে চলে যাও, করো না পরোয়া কোনো আমার আবদার, অথচ আমার ঘুম পুড়ে যায়, তোমার নাচের প্রতি মূদ্রা আমাকে পেঁচিয়ে ধরে নাড়িতে শিরায়; মেরু পথে জমে থাকো জল, এক ফোঁটা অঙ্গ, তুমি অনঙ্গ সাধনারত, বসে থাকো পিঠ জুড়ে অটল, অথচ আমি সত্তাময় শ্রী জ্ঞান খুঁজি, হয়েছি অতীশ।
শৈশব উন্মোথিত হয়ে ওঠে রম্য কোলাহলে, তোমারো যোগে আছে নৈঃশব্দের সৃষ্টিমুখ এক অর্থময় স্মৃতিসম্ভার, হিরন্ময় ইচ্ছাজুড়ে বেজে ওঠে তরল মন্দিরা, নাচের আয়োজন করে বৃষ্টি ও ডাহুক।
ভাবনার সাথে সাথে ঘন হয়ে আসে জল, জলাঙ্গ এক ফোঁটা, জমে ওঠে বেশ ভাবুক; আর গা ভর্তি অনুভুতি নিয়ে গড়াগড়ি যায় যেন পুরোনো গলির গান বেজে চলে বরযাত্রীর নৌকায়।
একটি শৈশব উঠোনে লুটোপুটি খেতে খেতে, দৌড়োতে দৌড়োতে, হেলে দোলে জিকিরের মতো পড়া মুখস্ত করতে করতে ধরে ফেলে কৈশোরকে; আর মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢেউ খেতে খেতে কেমন ডিঙিয়ে যায় কৈশোর অনায়াসে, ঠোঁটের উপর লাগিয়ে নেয় এক গোছা কালো চিকন ফিনফিনে গোঁফ; রহস্যগল্প পড়তে পড়তে, চুরি করে সময়কে নিজের পকেটে পুরতে পুরতে ভিতরে ভিতরে নিজেই হয়ে ওঠে দক্ষ এক চোর; জলবনহুর।
জলের যুবতী
এককণা অঙ্গজল, তুমি সাগরসংশ্লিষ্ট
বয়ে এসেছো আমার উৎসাহের তোড়ে
গড়াগড়ি করছো আমার উদরে
সবুজ সরীসৃপের প্রাণে উঠে এসেছো আমার বুকে।
এ বড়ো অপরূপ অভিজ্ঞতা—
তুমি একটি জলকণা, রূপ নিয়েছো
আমার আকাক্সক্ষার রঙে
মেরুদন্ড বেয়ে বেয়ে উঠে এসেছো
তুমি অবাক কিশোরী
এ বড়ো অপরূপ অভিজ্ঞতা—
সময় ও চিন্তার দুইপাশে
আমি তোমার পিতা ও প্রেমিক।
তুমি আমার বুকে লাটিয়ে পড়ছো
স্পর্শের স্পর্ধায়,
তোমার দেহের ঘন বন মন উন্মন করে
এক কণা জলের যুবতী
সমুদ্র মন্থন করে পরে
তোমার শরীর নিয়ে প্রথাসিদ্ধ চর্চা শুরু হয়।
আর আমাদের সম্পর্কের মানে
প্রথাসিদ্ধ কামের প্রজ্ঞানে।
অনুশীলন
অনুভবে ধরো, করো কামনা
রূপের লতিকা পেখম খোলো
চড়ুই প্রহরে গোলাপজাম
ফুটে কি ওঠেছে? ফুলেছে মেঘ?
যেভাবে উড়েছে সরিসৃপেরা
যেভাবে মাছেরা ওঠেছে মাটিতে
অনুভব করো জলের জিহ্বা
জলের তাড়না, কোঁকড়ানো জল
উৎসাহিত জলের আত্মায়
জ্বলছে তৃষ্ণা, অন্ধ দ্যোতনা
মাথার খাড়িতে ঝর্নার গান
অনুভব করো গানের শিকড়
অন্ধকারের অশ্বের জিন
ধরে রাখো আর অনুভব করো
খুরের ধ্বনিকে, রূপের রমণী
ধমনি থেকে কণ্ঠ অবধি
আনন্দ আনো, নাভিমূল থেকে
জাগাও করুণা, মধ্যমন্ত্র, সপ্তসুর…
সর্বনাম
সমস্ত প্রতীকেরই নিজস্ব ও একান্ত উদ্ধৃতিময় প্রতীতি আছে
প্রতিটি মুহূর্ত ব্যক্তিত্ববান—
এক কণা কাল সে উঠে আসে মঞ্চে
আর জানিয়ে দেয় তার অসম্ভব ইচ্ছার কথা
ভালো ভাষায়;
কৈশোরের কল্পবৃষ্টির ভেতর ঝাঁকের কৈয়ের মতো উঠে আসে
রোদপোহনো বই-পুস্তক
……………. তস্করের দল
আর
বোধোদয় হরকরা;
রঙমহলের কোনো এক নর্তকীর নৈসর্গিক ডুমুরবালক যেন নৃত্যপর
গেয়ে চলে কালের কোরাস;
সর্বনাম, নামের বসন খোলে অপেক্ষমান উরুর মতন বালিহাঁস।
জন্মদিন
দেয়ালে ঝুলছে জন্মদিন। তার ’পরে আঁকা আছে
লাল-হলুদ সুগন্ধী। ওগো, শুভেচ্ছামুখর
পাঁপড়িসকল, ওগো, মোমের দীপালিসম
জ্বলন্ত পঁচিশ, কী নিদারুণভাবেই না তোমরা
আক্ষরিক! পার হয়ে গাণিতিক প্রহরাব্দ,
গত হয়ে সমূহ পঁচিশ, অবশেষে তুমি বৃত্তাবদ্ধ
চিহ্নিত চরশ।
জানালার গ্রিল গলে হেসে খেলে
আধিপত্যবাদী রোদের মতো ঢুকে তো পড়েছো,
ভেঙে তো দিয়েছো আমার আত্মরক্ষার অভিমানখানা।
বাঘিনী
বাঘিনীর পরাশ্রয়ে না-কি প্রশ্রয়ে
………… রহিমেরা বাড়ে মালঞ্চে
রূপবান, সে এক বাঘিনী বটে;
অরূপকথার বনে বারো দিনের স্বামী তার
………………… উঠিলে চিতায়
বাঘিনী বনেই যেতে হয় তাকে;
দাঁতে কেটে সমূহ শৃংখল সে দাঁড়ায়
………………… এসে দ্যূৎসভায়—
স্বয়ম্বরে রহিমেরা বুঝে নেয়
কতটা কোমল এই বাঘিনীর নারী-হৃদয়!
অ্যান ওশান অব মেমোরিজ
মনে রেখো সুতপা ফুলের কাঁটা
মনে রেখো রক্ত সাক্ষী গড়াই।
পৃথিবীর প্রতিটি নদীর জলে রক্তাক্ত এমন কাঁটা
কাঁদে, গড়িয়ে পড়ে, হারিয়ে যায়।
এক শতাব্দী পর আজ এই মুমূর্ষু সন্ধ্যায়
একটি দারুণ তীর এসে বিঁধেছে পদ্মার কাতর পলিতে।
হায়, আমার যুবতী পিতামহী মরেছে কলেরায়
হায়, আমার বৃদ্ধা মাতামহী ডুবে আছে আলঝেইমারে—
অ্যান ওশান অব মেমোরিজ, ভালোবাসা মরে না রে!
মনে আছে সুতপা ফুলের কাঁটা
মনে থাকে রক্তে লাল সন্ধ্যার গড়াই।
সপ্তশ্বাস
আমি শ্বাস নিই আর অন্তর্গত এক মুহূর্তের জল
ভিতরে ভরে ওঠো তুমি,
নিঃশ্বাস ফেলি
বাইরে বিস্তৃত হয় তোমার অভিমান পরাহত
থির অধীরতা।
আমি শ্বাস নিই আর ভেতরে ভরে ওঠে ধাতুরূপে ক্রিয়াশীল
অভিধানগুলি,
নিঃশ্বাস ফেলি
সম্পর্কিত হতে থাকে শব্দমূল কর্মে ও কারকে
সমাসবদ্ধ হতে থাকে জন্ম, অধিজন্ম।
আমি শ্বাস নিই আর ফোলে ওঠে গোপন কৌটাটি
………………অস্তিসমুদ্রের গভীরে যে পড়ে থাকে
……………………………. পরাবাস্তবতায়
পড়ে থাকে কোডে ও ডিজিটে
………..মাইটোকন্ড্রিয়ায়,
নিঃশ্বাস ফেলি
আর খুলে যায় তার ছিঁপি
ভাষা পেয়ে যায় ভুলে যাওয়া সব মেটাফর
রক্তে, অভিজ্ঞানে, ধমনি-শিরায়, শুক্রে, বীজে, ক্রোমোজোমে
চক্রে চক্রে সমাসবদ্ধ হতে থাকে
ধাতুরূপী ক্রিয়াভিত্তিক ন্যারেটিভগুলি।
আমি শ্বাস নিই আর ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে
দূরবর্তী সব জন্মের বিস্মরিত বর্ণলিপি
নিঃশ্বাস ফেলি
ফিরে পাবার আনন্দে ফুটতে থাকে উপাখ্যানগুলি
প্রাচীন পুঁথির ছন্দে শহরময় বর্ণমালার ক্যারিওগ্রাফি
এভাবেই লেখা হয় আমাদের অভিন্ন আত্মজীবনী।
আমি শ্বাস নিই আর ধৈর্যের মতো ধুসর রঙের চাবিগুলো
তালা ঝুলায়ে দেয় মেঘেদের মুখে
আর ধৈর্যকে ধারণ করে বজ্রের হৃদয়
শীতে জমতে থাকে বজ্রের ফণা ও অস্থিরতা,
নিঃশ্বাস ফেলি
পাড়া ভরে ছড়িয়ে পড়ে বজ্রপুত্র আর বৃষ্টিভাষার কন্যারা।
এদের মুখে কে আঁটে আর চাবি
এদের পায়ে কে পরাবে রীতির বাড়াবাড়ি
ধৈর্য্যকে ওরা হারিয়ে কেবল ফেলে।
আমি শ্বাস নিই আর সমস্ত ঢেউ ও বাঁকসহ এক নদী
ঢুকে পড়ে ঘরে, নিজেরি ঘরে
আমি সাঁতরে কিনারা পাই না আর
ভেসে যেতে থাকে আমার খেয়ে না-খেয়ে কেনা সব বইপুস্তক
ভেসে যেতে থাকে কায়ক্লেশে গুছিয়ে তোলা ছন্ন গেরস্থালি,
নিঃশ্বাস ফেলি
আমার বিহ্বলতার নীচে বেহুলার মতো ভেসে ওঠো তুমি।
আমি শ্বাস নিই আর জল, অঙ্গ এক কণা
মগজে মুগ্ধবোধ তুমি,
(উম্মিলিত শস্যের রেণু সপ্রকাশ্যে নৃত্যপর
যেন ইচ্ছাফড়িং এক ভাবনাহীন খেলে যায়
উম্মাতাল বাযুচক্রে লীলাচ্ছলে খেলে যায়
সারাগায় ইচ্ছাফড়িং এক খেলে যায়),
নিঃশ্বাস ফেলি
ভেতরে জয়শঙ্খ বেজে ওঠে মুগ্ধডানা উড়ার উৎসবে।
ফলশ্রুতি
যখন অনেক দূরবর্তী কোন জন্ম তার
রৌদ্র ও সন্তাপ নিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছিল
যখন প্লাবনের পুরাকীর্তি নিয়ে
স্মরণীয় কোনো নদী ঢুকে পড়ছিলো কাব্যভাবনায়
যখন প্রকৃতি খুলে দিচ্ছিল তার
একান্নবর্তী যৌথতার সবুজ চড়াই
যখন সময় ঝরে পড়ছিল অন্তহীন সময়প্রপাতে
আর জল সঞ্চয় করছিলো কিছু চুম্বন আর জিজ্ঞাসার বিদ্যুত
একটি গলিত সূর্যাস্ত ঢাকা পড়ছিলো ভোরের হুল্লোরে;
যখনো নদীরা কোনো স্ত্রীবাচক নামে খন্ডিত হয়ে যায়নি
সর্বোপরি মানুষের মাঠ ছিলো মৌমাছির প্রজাতন্ত্র ;
যখনো গোত্রের সকল পুরুষ ছিলো
আমাদের বাবা আর সকল যুবতী মা
যখনো চুম্বনই ছিলো মানুষের সবচেয়ে গভীর স্বীকৃতি
যখনো পাঁজরের হাড় ভেঙে মানুষেরা গড়ে নিত প্রাজ্ঞ প্রতিমা
পানির প্রহারে-নাচা রমনীর শিৎকারে লাল হয়ে যেতো রাতের বাতাস
বৃষ্টির পীড়নে চিরে যেতো জুঁইফুলের মধ্যরাত্রি;
যখনো মাঠে মাঠে সবুজ বিপ্লবের মতো ছিলো
ঘাসেদের গল্প বলার তাড়না
মেয়েদের উড়ন্ত যৌবনে ছিলো লতার কল্পনারীতি
আর পাতার উড়ে থাকার সবুজ অভিলাস লেগে থাকতো তাদের
গোল গোল দুধে
হরিণপ্রহরে তারা কুড়িয়ে নিত বাতাসের হাতখরচ;
যখনো কবিতা হয়ে ওঠেনি কোকিলের কানকথা
শব্দেরা কাকের কালো রঙই কেবল গায়ে পরতো না
……………..ধারণ করতো তার কড়া সত্যবাদিতা;
তখন আমার ধমনীর লাল অন্ধকারে বেজে ওঠে পাঠশালার ঘন্টা
আর যৌথতার সফেদ চুক্তির মতো লেখা হয় চিরবর্ষার গীতিকা
এ কোনো উদবোধন নয়
নয় নূতন কোনো পরিচয়।
বজ্রযান
জেনেছি তুমি আলোর অভিধান
আর জেনেছি তোমার সম তাপ
প্রতি জন্মে নির্ধারিত পাপ
বজ্রে আমার এমনি উদ্গান।
যেমন জল আদপে জল নয়
তেমন তুমি জানার বিস্ময়
তোমারি এক পরম হাহাকার
আমি, তাই তোমার অধি-আকার।
বজ্র অর্থ জেনেছি শূন্যতা
আমার গান জেনেছি বজ্রযান
আমি কি তবে শূন্যেরই ভিন্নতা
আমার গতি বজ্রে বহমান?
বিদ্যুতের ভিতরে যাওয়া যাক
কেবল গতি শুধুই ঘূর্ণন
একটি ‘আমি’ অন্য ‘আমি’র মন
বলেছেন তো প্রফেসর ডিরাক।
শূন্য হইতে আমি শূন্য হলে
বজ্র অর্থ পরম নির্বাণ
দিব্যজ্ঞান আলোর মতো জ্বলে
অগ্নিমন্ত্রে বুদ্ধ ভগবান।

জন্ম ২৫ আগস্ট ১৯৭০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার হাজীপুর গ্রামে। তাঁর পিতা আবদুল মজিদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর খলিল মজিদ পেশায় একজন ব্যাংকার। বর্তমানে তিনি কবিতা ও নন্দনভাবনার ছোটোকাগজ ‘একবিংশ’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই ২টি: পালকাপ্য (প্রকাশক: নিসর্গ, বগুড়া, ২০০০) ও তরল মন্দিরা ((প্রকাশক: কবি প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২৪)। লিটলম্যাগাজিনই তাঁর লেখালিখির প্রধান ক্ষেত্র।