শুক্রবার, ডিসেম্বর ১৯

নির্বাচিত দশ কবিতা

0

অভিষেক


বৃষ্টিজল মাটির ফাটল থেকে আমাকে জাগায়
দিগন্ত বিস্তৃত গমক্ষেতে কে আজ প্রার্থিত
যখন নেমেছে সন্ধ্যা সোনালি ছড়ার শীর্ষে

ঝর্নাজল ধুয়ে দাও এ অপাপবিদ্ধ ছায়া
আর যতো ক্ষুধাক্লান্ত দিন।

এই বৃষ্টিপূর্ণ রাত। গুহার উষ্ণতা ছেড়ে
তবু বেরিয়ে আসছে ঝাঁক ঝাঁক ক্ষুধার্ত শৃগাল
তারা ছিঁড়ে খায় ফলন্ত শস্যের ঋতু
যখন দিগন্তে পলাতক আমি
যখন পাহারাদার আমি এই নৈশ প্রকৃতির।


বন্ধু


হত্যাদৃশ্য হয়ে তুমি বিঁধে আছ কুকুরের পায়ে

তোমার ছায়াকে গেঁথে নিয়ে ছুটে গেছে তীর
আর ছুটে গেছে প্রহরী কুকুর।
সে আজ ক্রন্দনরত
জঙ্গলে জঙ্গলে গোয়েন্দার পায়ে সে আজ তোমাকে খোঁজে
তার চোখ জ্বলে ওঠে গর্তের ভেতর
তার দাঁতে লেপ্টে থাকে ঘন অন্ধকার
প্রভুভক্ত তার জিভ চেটে খায়
দুঃখবোধ, তোমার শোণিত।


উদ্‌গম


আজ এই গাঢ় সন্ধ্যাবেলা যখন প্রান্তর জুড়ে
জমেছে ধূসর ঢেউ। সমাধিস্থ জানালায়
আস্তাবল ভেঙে ছুটে আসে বরফের সাদা ঘোড়া।

ঠান্ডা হিমরাত্রি। আমার এলো না ঘুম,
চামড়ার নিচে পোড়ে ধুধু বনভূমি

হে অশ্বপ্রবণ, হে সমুদ্রগামী ঝড়
শীতের অরণ্য খুঁড়ে কেন নিয়ে যাও ঝরা পাতার
উষ্ণতা আর বহু পুরাতন শ্যাওলা জড়ানো হাড়

আমার জীবাশ্ম থেকে জন্মপ্রাপ্ত
শত শত নতুন কবর খুঁড়ে জানতে পেরেছি
এই জীবন্ত ফসিল, এই কণ্ঠস্বর
অন্ধকার স্তূপে মাটি চাপা থাকবে না একদিন।


পালক


কাকে গেঁথে নিলো ধাতব জ্যোৎস্নার ফলা
ঘাসে ঘাসে তার ব্যথিত পালক পড়ে আছে
যদিও সে মেঘে মেঘে ধাবমান
আড়ালে চলেছে চাঁদ তাকে বিদ্ধ করে ধারালো বর্শায়

চিহ্ন নেই কোথাও মৃত্যুর ঝড় এলে তবু
রক্তচিহ্ন খুঁজে উড়ে যাবে পালকেরা।

তারাও পুড়েছে প্রতারক যে জ্যোৎস্নার আয়নায়
বাতাস ভাঙলো সেই রূপোলি সন্ত্রাস।

তারপর প্রান্তরে আবার উড়েছে পালক
এবং পেছনে ঘাতক জ্যোৎস্নার তীর।


অনন্ত জন্মের আগে


জন্ম মুহূর্তেই যে আমাকে হত্যা করে গেছে
বৃক্ষের পাতায় সংক্রামিত হলো তার ছায়া
কুঠারের দাঁতে গেঁথে পুনর্বার ভেতরে চূর্ণিত হই
যখন গাছের কাণ্ড ঘিরে নামে
লক্ষ পেশির বিস্তার।

আমাকে বিদীর্ণ করে চতুর্ধার করাতের চাকা।
বিখণ্ডিত দেহে থেমে গেলে অসংখ্য পাতার কোলাহল
তবু তুমি একবার বোসো এই
শিলাগুঁড়ি পেতে।

অন্ধকারে চেয়ে দেখো
কিভাবে জাগছে মৃত জলাধার
রাত্রিব্যাপী উড়ে যাচ্ছে ছিন্ন ডানা
নুয়ে পড়া পাতার আড়ালে আবার উঠছে ঝড়।
বহুরাত খণ্ডিত দেহের পাশে জেগে থেকে
তুমি জেনে যাবে অন্ধকারে মৃত্যু নেই কারো


বর্ষামগ্ন


এখন নিঃশব্দে অন্তর্গত, এখন মুদ্রিত আছি মেঘে
তোমাদের বাড়ির উঠোনে ছিলাম বর্ষার জল
শরতের মেঘ ছিন্ন করেছে সকল গ্রন্থি
তার শুভ্র ডানা আমাকে উড়িয়ে নেয় দূরে
তুমি কি ভুলে গেছ ঘন বাদলের দিন।

কোলাহল ছিলো না কোথাও
নিথর জারুলবনে পাতার আড়ালে
একটানা ঝরে গেছে বৃষ্টিপতনের কাল।
দীঘল আঁখির জলাধার থেকে
এখন আমাকে তুলে নেয় মেঘ। ভাসমান মেষ
ধবল চাদরে ঢেকে আমাকে কোথায় নিয়ে যায়
গাছের ভেতর দিয়ে বনপথে ছুটন্ত মাছের সঙ্গে
আর কি হবে ফেরা জলমগ্ন বরষায়।


রাত্রিলিপি


জেগে ওঠে হাওয়া নিথর প্রান্তরে
রাশি রাশি বালিয়াড়ি ভেঙে
মাঠের ওপর দিয়ে বয়ে যায় কালোরাত্রি
চিরায়ত অন্ধকারে যখন ডুবছে মহাকাল
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে থেকে শুনেছি গর্জন নৈঃশব্দের
রাত্রির গহ্বরে আছে কান্না
ছায়াপথে ম্রিয়মাণ জ্যোতিষ্কের নিচে
বিচরণ করে মৃত ঘোড়া
আমি তার পিঠে সওয়ার হয়ে চলেছি অনন্তে।

চরাচরব্যাপী জাগছে মৃতের কন্ঠস্বর
ধ্বংসপ্রাপ্ত কবরের পাশে জন্য নিচ্ছে বোধিবৃক্ষ
অগ্নিবায়ু পেঁচিয়ে উঠছে গাছে গাছে
মাইল মাইল ব্যাপী পুড়ছে রাত্রির বনভূমি
দুই হাতে সেইসব জ্বলন্ত পাহাড় ঘেঁটে
কুড়িয়েছি কয়লার বিষন্ন সৌরভ।

আরও গভীরে নেমে গিয়ে তুলেছি আকর,
তুলেছি কঠিন শিলা
দেহ পেতে নিয়েছি উষ্ণতা দগদগে আগুনের

সেই দগ্ধ দেহ আজ জাগছে হাওয়ায়
শবাধার থেকে জাগছে সকল মৃতের মিছিল

বস্তুত আমিও মৃত
রাত্রির ভয়াল স্রোতে ডুবে থেকে কেটে গেছে বহুকাল
তারপর অগ্নিকুণ্ড পার হয়ে যখন উঠেছি তীরে
হাওয়া এসে আমাকে জাগায়
হাওয়া এসে জ্বেলে দিয়ে যায় অনন্ত আগুন।


রক্তবিন্দু যত


ভেতরে ক্ষরণ নিয়ে পাতার আড়ালে জমে থাকে
যে জল বৃষ্টির অবশেষ হয়ে
ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে রাত্রিদিন
বনভূমি জুড়ে চিরসবুজের অন্তরালে
এই যে দহন ব্যথা হাহাকার

ফড়িংয়ের প্রাণ জবা কুসুমের মন তাকে বোঝে
যেন আছে রক্তপাত কোথাও উড়ন্ত মেঘে
তারই ছায়া হৃদয়ে বিবর্ণ ঘাসে

ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু রক্তবিন্দু যত।


অন্তরাল


শূন্যতায় ভরা মাঠে
বনতলে জীর্ণ পাতার আড়ালে
যে কথা লুকিয়ে আছে
আমি খুঁজি সেইসব বিস্মৃতির দিন
খরতাপে ক্লান্ত পথিকের ক্ষণিক বিশ্রাম
তারপর চলে গেছে দূরে
সেই পথিকের মর্মব্যথা খুঁজি ঘাসের ভেতরে
দিনান্তে সন্ধ্যায়
যখন মিইয়ে আসে আলো।


ছায়ামাত্র


দুঃসহ স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলে
নিদ্রার প্রতিটি ভাঁজে তবু ডুবে থাকে
দুর্বোধ্য অতীতকাল
অক্লান্ত শয়নে বিষাদের অভিসারে
জেগে থাকে নিষিদ্ধ রোমাঞ্চ, মুগ্ধ প্রাচীনতা।

গাঢ় ঘুমের ভেতর
আমি ছিঁড়ে ফেলি বিস্মরণশীল সেই স্মৃতিপঞ্জি
অপার্থিব চিরন্তন রহস্যের জাল
আর আমি চাই
তোমার অরূপ আলো
উদ্ভাসিত হোক দৃশ্যান্তরে
যেহেতু আড়ালে তুমি
মূর্তিমান
ছায়ামাত্র।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম মাদারীপুর জেলার শিবচরে। শিবচর নন্দকুমার ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। চাকুরী করেছেন 'দৈনিক আজকের কাগজ'-এ 'গণ সাহায্য সংস্থা'য়। বর্তমানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদে কর্মরত।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।