বুধবার, এপ্রিল ২৪

কবিয়াল মদন সরকার

0

Startজনগণ কবিয়ালকে ‘সরকার’ ডাকেন; কবির সরকার। সেই লোকধারণা থেকেই মদন মোহন আচার্য লোকসমাজে মদন সরকার হিসেবেই অধিক পরিচিত। শৈশব থেকে কবিগানের একটা তর্কভিত্তিক উদার ও পরমতসহিষ্ণু সংস্কৃতিকে যাপন করে বড়ো হয়েছি। সেই সমাজে, পূজায়-পার্বণে-উৎসবে আমাদের শৈশবে কবিগান ছিল আনন্দ-বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ। শৈশবে আমরা কবিগান বলতাম না, বলতাম ‘কবির লড়াই’। দুই কবির লড়াই। দর্শকেরা কবির লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে পুরাণ পাঠে মগ্ন থাকত। গ্রামবাংলার মানুষ পুরাণের আখ্যান ও চরিত্রগুলো সম্পর্কে এমনিতেই জানতেন। কিন্তু কবিয়ালরা যখন পয়ার, পাঁচালি, টপ্পা, ধুয়ার মাধ্যমে বিষয়গুলোকে লড়াইয়ের মাধ্যমে নিয়ে আসেন, তখন তা হয়ে ওঠে একেবারে জ্যান্ত এবং জীবনের অংশ। লড়াই কবিগানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কবিগান মূলত আসরের গান। পূর্ববাংলার এই নেত্রকোণা এবং পুরো ভাটি অঞ্চলে কবিগানের একটা আলাদা রীতি ও বৈশিষ্ট্য বর্তমান ছিল। পশ্চিম বাংলার নাগরিক সংস্কৃতিজাত কবিগান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং প্রাচীন ছিল এই ধারার গানের রীতি ও স্বর।

শৈশবে আমরা কবিগান বলতাম না, বলতাম ‘কবির লড়াই’। দুই কবির লড়াই। দর্শকেরা কবির লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে পুরাণ পাঠে মগ্ন থাকত।

এটি আমার নিজের বক্তব্য নয়। কবিয়াল বিজয় নারায়ণ আচার্যের গবেষণা এবং অনুসন্ধানের সূত্র ধরেই আমি এই বক্তব্য পেশ করেছি। বিজয় নারায়ণ আচার্যের লেখা থেকেই আমরা প্রথমে জানতে পারি কলকাতায় যখন কবিগানের প্রচলন হচ্ছে তখন পূর্ব-ময়মনসিংহের কবিগান উত্তুঙ্গে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে কলকাতার কবিগান দ্বারা পূর্ব-ময়মনসিংহের কবিগান প্রভাবিত হয়েছে; এমনকি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি ‘কবিগান’ শব্দটিও এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল না। তবে, একটি-দুটি আঙ্গিক কিংবা পরিভাষা যুক্ত হয়েছে দেখে এই কথা বলাও ঠিক হবে না যে, কলকাতার কবিগান প্রচলিত হওয়ার পর পূর্ব-ময়মনসিংহে কবিগান চালু হয়েছে।

মদন সরকারের জেঠামশায় ছিলেন কবিয়াল বিজয় নারায়ণ আচার্য। তিনি নিজেও এই অঞ্চলের বিখ্যাত কবিয়াল ছিলেন। কবিগানের ধারক হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতো দায়িত্ব নিয়ে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় এই অঞ্চলের কবিয়াল ও কবিগানের ইতিহাস লিখেছেন। পূর্ব ময়মনসিংহ তথা নেত্রকোণার এই হাওরাঞ্চলের কবিগানের এই সূত্র ও ঐতিহ্যিক পরম্পরার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর লেখায়।

তাঁর সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে কোনো ভাবেই ‘বাংলাদেশের কবিগানে’র মতো একটি গবেষণাধর্মী লেখা সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। কীভাবে কবিগান পরিবেশিত হয়, কীভাবে কবিয়ালরা আসরে অবতীর্ণ হয়, কবিগানের বিভিন্ন পরিভাষা সবকিছুর একটা প্রত্যক্ষ জ্ঞান মদন সরকার থেকে গ্রহণ করেছি। মদন সরকারের কিছু টপ্পাও আমি গ্রহণ করেছি। একজন কবিয়ালকে সরাসরি সামনে রেখে আমি এই বইটি লিখেছি।

আমি যখন কবিগান সম্পর্কে লেখা কিংবা গবেষণা শুরু করেছি, পূর্ব-ময়মনসিংহের কবিগানের চর্চা তখন অস্তমিত। আমার সামনে সেই অর্থে কোনো কবিয়ালই ছিলেন না। আমি কী করব! আমি গবেষণার কাজে মদন সরকারের সহযোগিতা নিলাম। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে কোনো ভাবেই ‘বাংলাদেশের কবিগানে’র মতো একটি গবেষণাধর্মী লেখা সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। কীভাবে কবিগান পরিবেশিত হয়, কীভাবে কবিয়ালরা আসরে অবতীর্ণ হয়, কবিগানের বিভিন্ন পরিভাষা সবকিছুর একটা প্রত্যক্ষ জ্ঞান মদন সরকার থেকে গ্রহণ করেছি। মদন সরকারের কিছু টপ্পাও আমি গ্রহণ করেছি। একজন কবিয়ালকে সরাসরি সামনে রেখে আমি এই বইটি লিখেছি। মদন সরকারের জেঠামশায় বিজয় নারায়ণ আচার্যের বিভিন্ন লেখার সাহায্যও আমি নিয়েছি। বলতে গেলে পূর্ববাংলার কবিগানের চিন্তার সূত্র ও ধারণা আমি নিয়েছি তাঁর কাছে। এই লেখাগুলো সৌরভ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবির কাছে আমার অনেক ঋণ। তাঁর ধারণাকে ভিত্তি ধরেই গবেষণার কাজ শেষ করেছি। বিজয় নারায়ণ আচার্যের সূত্র ও ধারণাকে বাস্তবিকভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন মদন সরকার। কবিয়াল না পেলে কবিগান নিয়ে আমার গবেষণা কঠিন হতো।

একা একা শিল্প এবং শিল্পী কেউই বাঁচেন না। সমাজ শিল্প এবং শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখেন। যন্ত্রনির্ভর যে সমাজে আমরা বসবাস করি সেই সমাজই কবিগান এবং কবিগানের ধারক এবং গায়কদের কবর দিয়েছে।

কবিগান গাইতে না পারার একটা বেদনা নিয়েই মদন সরকার পৃথিবী থেকে ২০১১ সালে প্রস্থান করেছেন। কবিগানে তাঁর সহচর, বন্ধু, অনুজ, শিষ্য-প্রশিষ্যরাও পৃথিবী থেকে প্রস্থান করেছেন কিংবা গান থামিয়ে গ্রামের গাছতলার কোনো বেঞ্চিতে বসে ঋতু দেখেছেন। আসলে কবিগানের দুনিয়া তখন শেষ হয়ে গেছে। এই শেষ হওয়া দুনিয়াতেই পিঠ বাঁকিয়ে কবি দীর্ঘ দিন বেঁচে ছিলেন। একা একা শিল্প এবং শিল্পী কেউই বাঁচেন না। সমাজ শিল্প এবং শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখেন। যন্ত্রনির্ভর যে সমাজে আমরা বসবাস করি সেই সমাজই কবিগান এবং কবিগানের ধারক এবং গায়কদের কবর দিয়েছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলাদেশের অগ্রগণ্য প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও লেখক।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।