শনিবার, এপ্রিল ২০

ইউসুফের স্বপ্ন

0

ইউসুফ লাইব্রেরির ক্যারোলে দীর্ঘ সময় কঠোর মানসিক শ্রমের পর ঘুমিয়ে পড়েছিল। বইয়ের স্তূপের পাশে ঘুমিয়ে, কিংবা হয়তো কোনো একটা মোটা বই ছিল তার মাথার নিচে, সে স্বপ্নে দেখল: একটা সিঁড়ি উঠে গেছে আকাশের দিকে, সাদা সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে সিঁড়িটার পাশ দিয়ে এবং সাদা গাউন পরা ফেরেশতারা ওঠানামা করছেন সেই সিঁড়ি দিয়ে। এমন একটা স্বপ্ন, হুবহু এক রকম না হলেও, দেখেছিলেন ইয়াকুব নবী যখন তিনি বিরসেবা থেকে যাচ্ছিলেন হারানের দিকে, পথে সূর্য ডুবে গেলে থেমেছিলেন একটা জায়গায় এবং ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মাথার নিচে একটা পাথর রেখে, এবং স্বর্গের সিঁড়িটা দেখেছিলেন স্বপ্নে, যেটা দিয়ে সাদা গাউন পরা ফেরেশতারা ওঠানামা করছিলেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি জায়গাটার নাম রেখেছিলেন বেথেল, কারণ ওই জায়গাটাকেই তিনি ভেবেছিলেন ঈশ্বরের বাসভূমি।

লাইব্রেরির ক্যারোলে দেখা স্বপ্নে ইউসুফ সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিল এবং দু’পাশে সাদা গাউন পরা ফেরেশতা আর সাদা মেঘের ভেতর দিয়ে ক্রমাগতভাবে উপরে উঠে গিয়েছিল যতক্ষণ না সে একটা চৌকাঠ পেরিয়ে যায়, এবং সেই চৌকাঠের ওপাশেই, তার ধারণা স্বর্গটাকে, মানে সেই মায়াবাস্তবের জগৎটাকে সে অনুভব করেছিল।

লাইব্রেরির ক্যারোলে দেখা স্বপ্নে ইউসুফ সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিল এবং দু’পাশে সাদা গাউন পরা ফেরেশতা আর সাদা মেঘের ভেতর দিয়ে ক্রমাগতভাবে উপরে উঠে গিয়েছিল যতক্ষণ না সে একটা চৌকাঠ পেরিয়ে যায়, এবং সেই চৌকাঠের ওপাশেই, তার ধারণা স্বর্গটাকে, মানে সেই মায়াবাস্তবের জগৎটাকে সে অনুভব করেছিল। চৌকাঠের ওপাশে পা দিয়েই সে একটা ‘উদ্যান’ কিংবা একটা ‘আগোরা’ বা সেটা যাই হোক, দেখতে পেয়েছিল, তবে সেই বাস্তবকে স্থান যেমন বলা যায় তেমনি কালও বলা যায়, কারণ সে স্থান-কালের একটা একীভূত অবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, সেখানে যাকিছুই সে অনুভব করুক, সেই ‘কোনোকিছু’ ছিল আসলে ‘অন্যকিছু’, যেমন উদ্যানে যে গোলাপটাকে সে দেখল সেটা একইসঙ্গে ছিল জবা বা বাগানবিলাস এবং তার গোলাপী রঙটাও আসলে ছিল নীল, সবুজ কিংবা সাদা। যাকে সে দূরে দেখছিল, সেটা একইসঙ্গে ছিল কাছেই, কারণ সেখানে যা দূরের তাই কাছের; আবার যাকে সে ‘পরে’ দেখছিল, সেটাকেই সে দেখতে পাচ্ছিল ‘আগে’, কারণ আগে-পরের ভেদ ছিল না সেখানে। কোনো সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর কাছে যেমন যে-কোনোকিছুই যে-কোনোকিছু, ইউসুফ তেমনই অনুভব করছিল এবং পরিপার্শ্বটাকে মনে হচ্ছিল এক অবিরাম শৈশব, যেখানে সব ঋতুই একটি মাত্র ঋতু এবং দৃশ্যগুলো চিরবর্তমান, যেখানে জীবন ও মৃত্যু, সুন্দর ও অসুন্দর এবং থাকা-না-থাকায় কোনো ভেদ নেই, হয়তো পিতা আদম এবং মাতা হাওয়া এরকম একটা অবস্থার মধ্যেই ছিলেন, সদসদ জ্ঞানবৃক্ষের ফল তারা খাননি তখনও, জানেন না পরিবর্তন কী, অসুন্দর কী, লজ্জা কী, নগ্নতা কী জিনিস, তাই ফল খাওয়ার পর যেইমাত্র তাদের জ্ঞান হলো, অমনি তারা ঝোপঝাড়ের ভেতর লুকিয়ে পড়লেন, বুঝতে পারলেন তারা নগ্ন— দুজনেই তখন জীবন-মৃত্যু আর ভব-নির্বাণের সংসারে পতিত হলেন।

ইউসুফ পরিস্থিতিটাকে বৌদ্ধিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, কারণ যা অসীমভাবে পূর্ণ তাকেই মনে হলো অসীমভাবে শূন্য— একটা ভ্যাকুয়াম, কিন্তু সবই ওখানে আছে।

ইউসুফ পরিস্থিতিটাকে বৌদ্ধিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, কারণ যা অসীমভাবে পূর্ণ তাকেই মনে হলো অসীমভাবে শূন্য— একটা ভ্যাকুয়াম, কিন্তু সবই ওখানে আছে। হয়তো এমন একটা অবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, ঢুকে পড়েছিলেন তাঁর কুকুরটাকে নিয়ে। কিন্তু এই ‘ঢুকে পড়া’ ক্রিয়াটি ওখানে প্রবেশের পর, শুধু আর ক্রিয়া থাকে না, সেটাই তখন বিশেষ্য, আবার সেটাই বিশেষণ কিংবা ক্রিয়া বিশেষণ, অন্তত এমনটাই অনুভব করছিল ইউসুফ। ধরা যাক, ওখানে কেউ একটা চৌবাচ্চায় নামলো, এই ‘নামা’ ক্রিয়াটি একইসঙ্গে ক্রিয়া বিশেষণও কিংবা বিশেষ্য কিংবা অব্যয়…, এবং সেটা যখন নিছক একটা ক্রিয়া তখন অসীম সংখ্যক ক্রিয়া, যেমন লাফিয়ে-ঝাপিয়ে পড়া, পিছলে যাওয়া, ঘুম থেকে শিশুর জেগে ওঠা, শিশিরের শব্দের মতো পতন কিংবা আসলে উচ্ছ্বসিত হওয়া কিংবা সেটাই উচ্ছ্বাস, সেটাই গান, সেটাই উল্লসিত গান, মশগুল হওয়া…, আর সেই যে চৌবাচ্চা সেটা একইসঙ্গে একটা লেগুনা, মাতৃগর্ভ, একটা শীত-গ্রীষ্মকাল— উষ্ণতা-শৈত্য, আবার আরাম বোধ হওয়া— সবই, তবু সেটা কিন্তু একটা চৌবাচ্চাই। আর সব মিলিয়ে যে অসীম এবং যে শূন্য তা একটা বিন্দু এবং একইসঙ্গে সিন্ধু, অসীম বিস্তার নিয়ে একটা সিঙ্গুলারিটি, একটা অনন্ত।

তারপর ইউসুফকে কেউ নাম ধরে ডাকে, তিনি হয়তো লাইব্রেরির কিউরেটর, কিংবা অন্য কেউ, কিন্তু সেই ডাকে তার ঘুম ও জাগরণ আলাদা হয়ে যায় এবং সে ভাষার জগতে প্রবেশ করে অর্থাৎ জেগে ওঠে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ৮ মার্চ ১৯৭১, সিরাজগঞ্জ। রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ এবং সম্পদনা—সব মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনেরোর অধিক। ‘আগুন ও ছায়া’ উপন্যাসের জন্য ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪২০’ এবং ‘বাংলার দর্শন: প্রাক-উপনিবেশ পর্ব’ বইয়ের জন্য ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪২৫’ পুরস্কার পেয়েছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।