কিন্নরলোক
মর্মের মন্দির থেকে তুলে আনা
রক্তাভ যতো ধ্বনি—তুমি,
তাকে নৈঃশব্দ্যে পৌঁছাও
তবু, ঠেকাতে পারো অই চির অমেয় রুধির প্রবাহ?
ঝড়ের অলিন্দ থেকে; যে কোনো গভীর আড়াল থেকে
জেগেছে যে মায়াবী মর্মর—
যেন যতো ভারি পাথরের ছিল, সেসব—
নাদ
কত দিন সন্ধ্যার ঝোপে আলো জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়েছে জোনাকিরা, তারপর—
পায়রার খোপের মতো ছোট ঘর;
ডালপালার সোনালু ফুলগুলো শুধু বিষণ্ণ ফুটে আছে।
আর বুনো মাঠের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তুমি ভাবছো—
নক্ষত্রঝরা দিগন্তের পার থেকে ভেসে আসা মায়ের আবছা মুখ!
শীতের রুক্ষ পথটা ক্রমে ঢেকে গেছে দেবদারু ঝাড়ে—
আভোগ
গাছের আড়াল থেকে, চিররুদ্ধ ওই
ঝোপজঙ্গলের ফাঁক দিয়ে, যে আলো ফুটে ওঠে
তোমার ধ্যানের মন্ত্রখানি তাতে, কিছুটা দেখা যায় মাত্র।
আমরা অনুভব করি ওই প্রোজ্জ্বল বর্ণের ঐশ্বর্য—
যেন ছায়াঘন বীথিকাসকল পরস্পর কথোপকথনে মগ্ন;
একটা গভীর খাদের ভেতর লাফিয়ে পড়ছে
জলের কলধ্বনি—
আলোকলতা
মাড়িয়ে যাওয়া অসংখ্য ধুলোর মহল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছ তুমি—
হে অরণ্য-কুহক!
তারপর উড়ে গেছো আনগ্ন কালপুরুষের দিকে—
স্বপ্নের ভেতর তোমার দগ্ধ ডানা দুটি শুধু যেন খসে খসে গেছে;
যত উড্ডীনতা, আজ চাপা পড়ে আছে ওই দিগন্ত পাতালে—
বাসকলতার পাশে
কেহ নাই তাঁর—নীলাভ আকাশের তলে ঝরা পলাশের ধূসর বিষণ্ণতার মতো
সে ব্যথা; থরথর করে কাঁপছে—
তবু—হে অনালোক, তোমার পদপ্রান্তে বসি কিছুটা হাঁটু গেঁড়ে; দু-একটি রক্তগাঁদার পাপড়ি
তুলে নিই হাতে—
রূপ
কেবলই বুকের ভেতর পাড় ভাঙার শব্দ হয়।
কারো ফেলে যাওয়া হাতের কাঁকন
সিঁদুরের কৌটা, আলতা-পায়ের ছাপ।
আর তারালতার ডালে ডালে তখন
রাত্রি দুপুর—
আমি দেখি—
উঠোনের এক কোণে মেঘেদের ছায়া এসে নামে।
বেলা পড়ে এলো
বিকেলটা ক্রমে নিঝুম হয়ে পড়েছে।
চাঁপা গাছের ডালে ডালে লুটিয়ে পড়েছে রোদ্দুর,
ওই দূর শালুকের বন,
সুপুরি গাছের সারি,
তারপর—হয়তো-বা—
ঘোর হয়ে এসেছে সন্ধ্যা।
একটা ঝাঁকড়া অশ্বত্থ গাছের ছায়ায়
জোনাকি উড়ছে।
যেন কিছু নক্ষত্রের হরিৎ আভা এসে নেমেছে
পৃথিবীর পথে।
কোমল বিষাদ
কেমন সূর্যাস্তের ভেতর ধীরে মুছে যাচ্ছে বিষণ্ণ তালবীথি—
জলপালকের মাথায় থোকা থোকা শিশিরের কুঁচি লেগে আছে;
আর উঠোন ভর্তি করবীর ঘনকালো ছায়া,
হয়তো-বা একটা ঝরে পড়া বেল ফুলের পাশে
এসে থেমেছে সন্ধ্যার ম্লান আলো—
যেন;
যেন সে কবেকার পুরনো বিষাদ, রক্তের মতন গাঢ়
কোনো নৈঃশব্দ্যের কাছে লুকিয়ে রেখেছে—
গোধূলি
কে এসে দাঁড়ায় অমন, কুয়োতলার মলিন অন্ধকারে—
রাত্রি দুপ্রহর—
রাধাচূড়া গাছটির মাথায়,
থান কাপড়ের মতো এক বুক শুভ্র জ্যোৎস্না মেখে আছে
যেন গেরস্ত উঠোন জুড়ে, ওই কার বিষণ্ণ
বিষাদ, ঝরা বকুলের মতো শুয়ে আছে আড়াআড়ি
কে যেন
যেন তরঙ্গেরা ফিরে যেতে যেতে রেখে যাচ্ছে, সমস্ত গর্জনরাশি;
নিশ্বাস দূরত্বে দাঁড়িয়ে যে ডাল ভাঙা অশোক, নিম্নকণ্ঠে আমি কি তাকে বলবো—
বলে উঠবো—তোমার বিষাদের কিছু কিছু আমি বুঝি!
জটানিঃসৃত তাঁর জলধারা তুলে নিই আনমনে, করতলে—
আর দেখি আমার তৃষ্ণার শেকড় বেয়ে ওরা নেমে যাচ্ছে পাতালের পথে।
জন্ম ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৮; কৃষ্ণনগর, খুলনা। সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় শিক্ষক।
প্রকাশিত বই : ডাকিনীলোক [কবিতা, চৈতন্য, ২০১৬], অহম ও অশ্রুমঞ্জরি [কবিতা, অগ্রদূত, ২০১৮], নিঃসঙ্গ কেতকীর মতো [কবিতা, বিদুর, ২০২১]
ই-মেইল : anupamsoc@gmail.com