মঙ্গলবার, এপ্রিল ৩০

অঘ্রাণ : আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

0

Eid Motifআমার জন্ম কলাভবনের মাঝখানে, বদ্ধ আঙিনায়। তিনদিকে পাঁচতলা বারান্দা, আরেকদিকে একটার উপর একটা ক্লাসরুম উঠে গেছে। সারাদিন আমাকে তাকিয়ে থাকতে হয় নিচতলার একজোড়া জানলার দিকে। বাতাস এখানে খুব একটা পৌঁছায় না। বাইরে তুমুল ঝড় বয়ে গেলেও টের পাই কম। দেখা যায় বৃষ্টির প্রচণ্ড তোড়ে ভেসে যাচ্ছি, তখনও চারপাশে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।

পাশাপাশি চারটা ফুলের গাছ। এর মধ্যে তিনটাই গন্ধরাজ। চৈত্র-বৈশাখে এদের কয়েকটা ডালে শত শত ফুল ফোটে। এই ডালটাতেই যেমন আমরা এখন কলিসহ অন্তত চল্লিশজন। মানুষ আমাদের বিরক্ত করে কম। এমনকি মালিও খুব একটা আসে না। গাছ তিনটার পায়ের কাছে তাই অসংখ্য ঘাস, আগাছা। সেখানেও ছোটো ছোটো রঙিন ফুল ফুটে আছে। তাদের গায়ে যদিও কোনো গন্ধ নাই।

কালেভদ্রে দুই একজনকে ছাত্রছাত্রীদের কেউ এসে তুলে নিয়ে যায়। বারান্দা, জানলার গণ্ডি পেরিয়ে গেলে তাদের পাপড়িতে বাইরের হাওয়া এসে লাগে। কেউ কেউ আবার ক্যাম্পাস পার হয়ে শহরের পথে নেমে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য বাইরের যাত্রা মানেই মরণযাত্রা!

অল্প কয়েকদিনের আয়ু আমাদের এই গন্ধরাজ জীবনের। বেশিরভাগেরই বাইরের দুনিয়া দেখার ভাগ্য হয় না। কালেভদ্রে দুই একজনকে ছাত্রছাত্রীদের কেউ এসে তুলে নিয়ে যায়। বারান্দা, জানলার গণ্ডি পেরিয়ে গেলে তাদের পাপড়িতে বাইরের হাওয়া এসে লাগে। কেউ কেউ আবার ক্যাম্পাস পার হয়ে শহরের পথে নেমে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য বাইরের যাত্রা মানেই মরণযাত্রা! গাছ থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই জীবনপ্রদীপ নিভতে শুরু করে। বেশিরভাগ ফুলেরা বেঁচে থাকতে চায়, যতদিন, যত মুহূর্ত সম্ভব। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস অকাল মৃত্যুর চেয়ে এই বন্ধ-জীবন বহুগুণে ভালো। আমার তা মনে হয় না। কয়েক প্রহর বেশি বেঁচে থাকার মধ্যে আমি কোনো কৃতিত্ব দেখি না। বরং চোখ-কান খোলা রাখি সময় থাকতেই আমাকে ছিঁড়ে নেবে এমন আগ্রহী হাতের অপেক্ষায়। দীর্ঘ মরণযাত্রার ভাগ্য হাজারে একজনের হলেও, তা যেন আমার হয়— এই প্রার্থনা করি দিনরাত।

অবশেষে একদিন ভরদুপুরে আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। মাথায় ক্যাপ, কাঁধে সাইডব্যাগ আর চোখে চশমা পরা একটা চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী ছেলে দোতলার বারান্দা থেকে আমাদের দিকে কয়েক মিনিট একটানা তাকিয়ে থাকল। মাত্র দুইদিন আগে ছিল রোজার ঈদ, তাই পুরো কলাভবন বলতে গেলে জনশূন্য। সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ শুনছি প্রতিধ্বনির মতো, আর আমার অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। ছেলেটার চলায় গতি কম। খুব ধীরে হেঁটে আসছে। বারান্দার অর্ধেক দেয়াল টপকাতে গিয়েও একবার থেমে গেল। ব্যাগ হাতড়ে কিছু একটা খুঁজল, পেল কি না বোঝা গেল না। তবে এইবার গতি বাড়ল। লাফ দিয়ে একদম আমাদের ডালের কাছে চলে আসল। কোন ফুলের পাপড়ি কত সতেজ, কার গন্ধ কত বেশি বেশি— এইসব ভাবার সময় তার হাতে নাই। সোজা আমাকে তুলে নিল দুই জোড়া পাতাসহ। মৃত্যুর তীব্র কষ্ট মুহূর্তেই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় ততক্ষণে আমি পুরো মাতাল। মন পড়ে আছে এই ভবনের বাইরে, খোলা দুনিয়ায়।

একটা বিশাল মোড়ে এসে দাঁড়ালাম আমরা। তেমন ভিড় নাই মানুষের। ডানপাশে গোল ইটের দেয়াল ঘিরে চায়ের দোকান। বেশিরভাগই বন্ধ। রাস্তাগুলোর মধ্যেখানে উঁচু একটা ভাস্কর্য। একটা বললে ভুল হবে প্রায় আট-দশজন সাদা পাথরের মানুষ একজন আরেকজনের হাত, বাহু শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চল, প্রাণহীন; আবার মনে হচ্ছে সবাই যেন পায়ে পা মিলিয়ে একসাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

রিকশায় উঠে আরও সুন্দর একটা রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বড়ো পথের বাতাস, তাই এলোমেলো। শরীরের ব্যথা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। গায়ে রোদ লাগলে মনে হচ্ছে পোড়া শরীর আরও পুড়ে যাচ্ছে। তবু একবারও চোখ বন্ধ করব না বলে প্রতিজ্ঞা করলাম। জীবনের তো আর খুব বেশি বাকি নাই।

রাজপথে ওঠার পর প্রবল শব্দে রীতিমতো চমকে উঠতে হচ্ছে বারবার। ছোটো, বড়ো, মাঝারি গাড়িগুলো পাল্লা দিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে। অখণ্ড আকাশ দেখি। দেয়ালে টাঙানো পোস্টারে, বিলবোর্ডে প্রচুর অক্ষর, ছবি। ফুটপাতে অল্প কিছু মানুষ হাঁটছে। কাছাকাছি কোথাও মিছিল, মিটিং চলছে বোধহয়। এক পর্যায়ে গাড়ির শব্দ ছাপিয়ে মানুষের শোরগোল কানে বিঁধল। আমাদের রিকশা তবুও এগিয়ে যাচ্ছে। ওইতো দেখা যাচ্ছে আকাশ ছোঁয়া একেকটা দালান।

অসহায় আঙুলের ফাঁক দিয়ে আমি দেখছি মত্ত জনতার ক্রোধ, জিঘাংসা। পথের উপর পড়ে যেতে যেতে ছেলেটি বাধ্য হয়ে হাতের মুঠো খুলে দিল। তার কানের পেছন থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে রক্তের স্রোত। মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না বোধহয়। ছেলেটি ‘আমাক হাসপাতালে নিয়্যা যাও, আমাক বাঁচাও, আল্লার কসম লাগে’ বলে চিৎকার করছে।

মিনিট দশেক পর হঠাৎ রিকশা থেকে নেমে দৌড় দিতে হলো ছেলেটাকে। হাতের মুঠায় আমাকে শক্ত করে ধরে কোনো একটা গলিতে ঢুকে যেতে পারলেই বিপদ এড়ানো যাবে এই আশায়। কিন্তু মানুষের ঢল, যেন সমুদ্র উপচানো স্রোত। ঝড়ের বেগে আছড়ে পড়ল তার গায়ের উপর। তিনটা ইটের টুকরা এসে শরীর বিক্ষত করে দিয়ে গেল। অসহায় আঙুলের ফাঁক দিয়ে আমি দেখছি মত্ত জনতার ক্রোধ, জিঘাংসা। পথের উপর পড়ে যেতে যেতে ছেলেটি বাধ্য হয়ে হাতের মুঠো খুলে দিল। তার কানের পেছন থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে রক্তের স্রোত। মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না বোধহয়। ছেলেটি ‘আমাক হাসপাতালে নিয়্যা যাও, আমাক বাঁচাও, আল্লার কসম লাগে’ বলে চিৎকার করছে।

চশমাটা এরইমধ্যে মানুষের পায়ের চাপে অসংখ্য টুকরা হয়ে গেছে। মরণযাত্রী ছেলেটার হাতের কোলে আমি তবু অক্ষত পড়ে আছি। সাদা পাপড়িগুলো লাল হয়ে যাচ্ছে বলে কোনো আফসোস নাই; কিন্তু বারুদ, ধুলা, রক্তের গন্ধে আমার শরীর থেকে তুমুল গর্বের ঘ্রাণ কীভাবে এতো দ্রুত ফুরিয়ে গেল!

 

০২.
আমার বয়স তখন বড়োজোর ষোল। রোজায় ততদিনে আর শীত নামে না। বরং পূর্ণ বসন্ত। মানুষের গলা শুকিয়ে কাঠ হয় দুপুর হওয়ার আগেই। সেবার ঈদের দুই দিন পর সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা শহরে ঘুরলাম। রোদের তেজ এতো বেশি যে ছাতার নিচেও কপাল, পিঠ, নাক ঘামছে। তারপরও দুইজন পায়ে পা মিলিয়ে এক দৃষ্টিতে যমুনার ঘোলা ঢেউ দেখলাম অন্তত দুই ঘণ্টা। চোখের মুগ্ধতা হয়তো ফুরায় কিন্তু মন ভরে না। রিকশা নিয়ে ফিরে এসে আবার হাঁটতে শুরু করলাম গ্রামের পথে। মাগরিবের আজানের আগের সময়টায় আমাদের স্কুল প্রায় নির্জন। মাঠের উত্তর কোণা দিয়ে একটা পথ নেমে খাল পার হয়ে সোজা চলে গেছে জঙ্গল পর্যন্ত। জঙ্গলটা তখনও কেবল বাড়ছে। বাবলা, গাব, জারুল, শ্যাওড়া গাছগুলো সব উঠতি বয়সী। ভূত বাস করার মতো পুরোনো কোনো গাছ নাই। তাই প্রায় ভয়হীন পদক্ষেপ আমাদের। একমাত্র ঝামেলা হয়ে দাঁড়াল বাবলার কাঁটা। জঙ্গলে পা ফেলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার প্রিয় নতুন ওড়না কাঁটায় আটকে, শরীর থেকে খুলে পড়ে গেল।

কলাপাতা রঙের জর্জেটের ওড়না তুলতে যাব হঠাৎ চোখ পড়ল বেলিফুলের ঝাড়ে। এখন তো আমি যতদূর জানি বেলি ফোটার সময়। বেশ বড়ো ঝাড়, হাজার হাজার পাতা অথচ ফুল মাত্র দুইটা। এমনকি আর কোনো কলিও নাই। বড়ো ফুলটায় আমার হাত লাগা মাত্র সবগুলো পাপড়ি একসাথে ঝরে পড়ল। পরের ফুলটা তখনও অর্ধেক কলি, একটু নিচ থেকে কয়েক জোড়া পাতা সহ সাবধানে ছিঁড়ে হাতে রাখলাম।

আমার বামহাত তখনও তার হাতের মুঠোয়। কী বলে, কোন উপায়ে, কত মায়া জড়িয়ে সাদা ফুলটাকে তার হাতে দেব ভাবছি। সে তাকিয়ে আছে অন্য কোথাও। আর টানা বলে যাচ্ছে একটার পর একটা ঘটনা। সব কাহিনিই ঢাকা শহর ঘিরে। অতো বড়ো শহর আমি কোনোদিন দেখি নাই বলে প্রত্যেকটা শব্দ ছবিকে অনেক দূরের মনে হচ্ছে।

আমার বামহাত তখনও তার হাতের মুঠোয়। কী বলে, কোন উপায়ে, কত মায়া জড়িয়ে সাদা ফুলটাকে তার হাতে দেব ভাবছি। সে তাকিয়ে আছে অন্য কোথাও। আর টানা বলে যাচ্ছে একটার পর একটা ঘটনা। সব কাহিনিই ঢাকা শহর ঘিরে। অতো বড়ো শহর আমি কোনোদিন দেখি নাই বলে প্রত্যেকটা শব্দ ছবিকে অনেক দূরের মনে হচ্ছে। এই ছেলে বয়সে আমার চেয়ে অন্তত পাঁচ বছরের বড়ো। অথচ চোখে মুখে এখনও কৈশোরের দোলা। কথা বলতে গেলে সে এতো অস্থির আর উদ্বেল হয়ে ওঠে যে কী বলছে তার চেয়ে বেশি নজর চলে যায় কীভাবে বলছে সেইদিকে। কথা বলতে গিয়ে সবার সাথেই কি এতো মুগ্ধ, এতো আপ্লুত হয়ে পড়ে? এবং একবার বলতে শুরু করলে সে আর থামতে চায় না। আমারও কোনোদিন তাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছা করে নাই। আমি প্রতিবারই তার কথা ফুরানোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

অন্ধকার হয়ে আসছে, দ্রুত ফিরতে হবে। এদিকে তার কথা ডানা মেলতে থাকে। এক পর্যায়ে সে গ্রীক দেশের অদ্ভুত এক গল্প বলতে শুরু করে। সেই দেশে হঠাৎ শুরু হয় মহাখরা, দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ। জনগণ দলে দলে গিয়ে হাহাকার করতে থাকে রাজপ্রাসাদের সামনে। সমাধান চায় রাজার কাছে। রাজা তলব করে রাজ্যের সবচেয়ে জ্ঞানী অন্ধ গণককে। দেবতাদের রাগের কারণ জানতে চায়। কোন পাপীর পাপে পুড়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম? কোন অভিশাপের তাপে শহরে শহরে মহামারীর গরম বাতাস বইছে? গণক উত্তর দিতে চায় না। রাজ-আদেশ অমান্য করার শাস্তি তো সর্বোচ্চ। অতএব একসময় তার মুখ খুলতে হয়। জানা যায় পাপী আর কেউ নয় স্বয়ং রাজা। নিজেই সে চরম অভিশপ্ত।

কী হেই পাপ যে পুরা দ্যাশে বিপদ নাইমল? কীসের এমন অভিশাপ?

আমি জানতে চাই। এবার সে আমার হাত থেকে হাত খুলে নেয়। মুখের উপর অন্ধকারের ছায়া। এবার চোখ নামিয়ে তাকায় পাতা-জমা মাটির দিকে।

থাইকগ্যা, তোমাক কেবা কইরা কই?

কিন্তু সে বলতে থাকে। বলায় কোনো জড়তা, লজ্জা কিছু নাই। একটা বাক্যের পরেই আবার আমার কাজল দেওয়া চোখের দিকে তাকায় সে। স্যান্ডেল খুলে আমার পায়ের উপর পা রাখে। ডান হাত এসে পড়ে থাকে ঘাড় বেয়ে আমার বুকের উপর। তার ঘন নিশ্বাসে প্রায় উড়তে শুরু করে আমার কলাপাতা ওড়না।

ওই রাজার বউ আসলে তার মা। ছোটোকালে হারায়্যা যায়। মা-বাপের চেহারা, নাম, পরিচয় কিচ্ছুই মনে থাকে না। বাপ আছিলো রাজা। যুবক বয়সে দ্যাশে ফির‌্যা ক্যামনে ক্যামনে জানি অচেনা বাপেক মাইরা নিজেই রাজা অয়। আর তহনকার নিয়ম আছিলো নতুন রাজা রাজ্যের সাথে রানিকও পায়। তাই অটোমেটিক বিয়া অয়্যা যায়। মায়ের প্যাটে তার দুইডো বাচ্চাও পয়দা…

বোধহয় এই প্রথম আমি তাকে কথা শেষ হওয়ার আগেই থামিয়ে দেই। মোটামুটি অন্ধকার হয়ে যাওয়া নির্জন রাস্তা ধরে ফিরে আসি চুপচাপ। আমার শরীরের চামড়া, রক্ত জুড়ে কেমন একটা অস্বস্তি বইতে থাকে। আমি কথা বলি না। তার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, দৌড়ের গতিতে হেঁটে বড়ো রাস্তায় উঠে আসি। পৌঁছানোর মিনিট কয়েক আগে হাত নেড়ে তাকে বিদায় দিয়ে, বাড়ির ঢালে উঠতেই কানে আসে পরিচিত কয়েকটা কণ্ঠ থেকে একযোগে একটানা কান্নার শব্দ।

সেই বড়োচাচার একমাত্র ছেলে ঢাকার মতিঝিলে একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন। পার্টটাইম কাজ। মাস্টার্স এখনও শেষ হয় নাই। আজ তিনটায় পল্টনের দিকে দুই দলের মারামারির মধ্যে পড়ে যান তিনি। ইটের তিনটা টুকরা এসে তাঁর শরীরে লাগে। সবচেয়ে বড়োটা লাগে ডান কানের ঠিক পেছনে। ডুবন্ত আত্মা নিয়ে তবু অনেকক্ষণ পড়েছিলেন রাস্তায়। ‘আমাক হাসপাতালে নিয়্যা যাও, আমাক বাঁচাও, আল্লার কসম লাগে’ বলে চিৎকার করছিলেন যতো জোরে সম্ভব। কিন্তু উন্মত্ত শত শত নেতাকর্মীদের একজনেরও সেদিকে খেয়াল করার মতো ফুরসত ছিল না।

‘মাইয়্যা মানুষ বেলা ডুইব্যা যাওয়ার পর বাইরে ক্যা?’ সবার আগে যে আগুন-কণ্ঠে বলবে বলে ভয়ে ছিলাম সেই বড়োচাচার একমাত্র ছেলে ঢাকার মতিঝিলে একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন। পার্টটাইম কাজ। মাস্টার্স এখনও শেষ হয় নাই। আজ তিনটায় পল্টনের দিকে দুই দলের মারামারির মধ্যে পড়ে যান তিনি। ইটের তিনটা টুকরা এসে তাঁর শরীরে লাগে। সবচেয়ে বড়োটা লাগে ডান কানের ঠিক পেছনে। ডুবন্ত আত্মা নিয়ে তবু অনেকক্ষণ পড়েছিলেন রাস্তায়। ‘আমাক হাসপাতালে নিয়্যা যাও, আমাক বাঁচাও, আল্লার কসম লাগে’ বলে চিৎকার করছিলেন যতো জোরে সম্ভব। কিন্তু উন্মত্ত শত শত নেতাকর্মীদের একজনেরও সেদিকে খেয়াল করার মতো ফুরসত ছিল না।

আমি চোখের সামনে যেন সেই রক্তের ধারা দেখতে পাচ্ছি। চোখের চশমা খুলে পড়ে গেছে দূরে। ঢাকার রাজপথের ময়লা লেগে ভাইয়ের লাল রক্ত মুহূর্তেই কালচে হয়ে উঠছে। অথচ আমার নাকে এসে আচমকা বিঁধল সাদা ফুলের ঘ্রাণ। এতোক্ষণে মনে পড়ল বেলিফুলটার কথা। অসময়ে জন্ম নিয়ে আমার মুঠোয় পিষ্ট হয়ে অকালে মরে যাওয়া ফুল। ছিঁড়ে, চূর্ণ হওয়া অর্ধেক ফোটা পাপড়িগুলো কখন হাত গলে পড়ে গেছে খেয়ালও করি নাই। ঘামে ভেজা তালুতে কেবল দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গন্ধ লেগে আছে। আতরে ভেজা তুলার মতো উদাস আমার পাথর-সমান হাত।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের জন্ম সিরাজগঞ্জে, ১৯৯০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছোটগল্প ও কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ২০১০ সালে । এখন পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বই দুইটা, অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান  (২০১৬) ও যুদ্ধ যুদ্ধ রুদ্ধ দিন (২০২০)। প্রথম গল্প সংকলন বছরের দীর্ঘতম রাত  প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।