শনিবার, এপ্রিল ২৭

জয় মা বাংলা! : জাকির তালুকদার

0

[জয় মা বাংলা!

আমরা তোমার কতিপয় নাদান সন্তান, তুমি যাহা দিয়াছ তাহা দিয়াই তোমার গুণকীর্তন করি। তুমি আমাদিগকে লাঙল-জমি-শক্ত মুঠি দাও নাই, তাই খেতচাষ করিতে পারি না। মেরুদণ্ড দাও নাই তাই বিপ্লবী মুষ্ঠি আকাশপানে উঠাইতে পারি না। আমরা ফেসবুক করি মা। আমরা ফেসবুকে মুহাম্মদ করি মা, মার্কস করি মা, মুজিব করি মা। আমরা যে কেউ-কিছু একটা, এলেবেলে নই, তাহা প্রদর্শনে সদা সচেষ্ট থাকি। কেউ কেউ মাঝেসাঝে ভাইরাল হইয়া যাই। কেউ কেউ সবসময় ভাইরাল থাকিতে প্রাণপাত করি।

তুমি যাহা কিছু জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়াছ তাহা জগৎ-সংসারের কোনো কর্মে লাগে না। আমরা যৌনতা বুঝি না, সুড়সুড়ি বুঝি। পোশাক বুঝি। তাই সমাজের এককোণে পড়িয়া আমরা ‘আর্ট-কুলচুর’ করি যথাসাধ্য। তাহাতেও মাঝে মাঝে বাস্তবতা হানা দিয়া ফেলে। একেবারে ঘরের ভেতর সেঁধিয়া যায় মা, বুকের ভেতর। উহা এমনই জিনিস যাহাকে এড়াতে পারি এমত কোনো পথের দিশা তুমি আমাদিগকে কখনো দাও নাই। তাই আমাদিগের আর্ট-কুলচুরের মধ্যে উহা এক ডাবর সদ্য ধোয়া দুগ্ধের মধ্যে এক বিন্দু গো-চনা হইয়া সকল তপস্যা ব্যর্থ করিয়া দেয়!

তবুও, এটুকুই আমাদিগের ক্ষমতা মা, যাহা তুমি দানিয়াছ।]

 

 

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগপর্যন্ত মদনমোহন তর্কালঙ্কার এক শ বছর ধরে শিখিয়েছেন—‘কানাকে কানা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না। উহারা কষ্ট পায়।’ এই শিক্ষা এত বছর পরে পাশ্চাত্যের মাধ্যমে আমাদের কাছে ফিরে এসেছে, ‘বডি শেমিং খুব খারাপ কাজ’ শিরোনামে। একবার একজন লেখক তার তিন শত্রুকে বাঁটকু শয়তান বলেছিলেন। ঘটনাক্রমে তারা তিনজনই ছিল আকাশের দিকের উচ্চতায় সাধারণ খর্ব বাঙালির তুলনাতেও বেশ খর্ব। তাতে বেশ কয়েকজন নারী তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এই বলে যে তারাও লম্বায় খাটো। তাই এই ধরনের বডি শেমিং-এর নিন্দা জানাচ্ছেন। লেখক সেজন্য স্যরি বলে-টলে অর্ধমাফ পেয়েছিলেন হয়তো। এখন কোনো স্কুলেপড়া কিশোর, সে রাজধানী বা জেলা শহরের হোক, সচরাচর লুঙ্গি পরে বাজারে যেতে চায় না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেরই একটাই প্যান্ট। হ্যাঁ এখনো। তাই তাদের লুঙ্গিপরা বাবার পেছনে কাঁচাবাজারের থলে হাতে লুঙ্গি পরেই সর্বস্থানে যেতে হয় কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে। সেই লুঙ্গিতেও কখনো কখনো ফাটা-ফাঁসা থাকে। লুঙ্গির একটা সুবিধা আছে। যেদিকে ফাটা থাকে সেদিকটা ঘুরিয়ে সামনে এনে বাঁধলে তা কুঁচির মধ্যে লুকিয়ে থাকে। খুব বড়ো পা না ফেললে সেই ফাটা অন্য কারো নয়নগোচর হয় না। কিন্তু এমনই কপাল একদিন থলে হাতে বাজার থেকে ফেরার পথে এক কিশোরের লুঙ্গির পেছনটাও ফড়াৎ শব্দে ফেটে গেল লম্বালম্বিভাবে। তখন সে থলি পথের একটু পরিষ্কার জায়গা দেখে নামিয়ে রেখে লুঙ্গি ঘুরিয়ে পরতে চেষ্টা করল। কিন্তু যেদিকেই ঘুরিয়ে পরে, সেদিকেই পেছন থেকে অমাংসল অসুন্দর নিতম্ব বেরিয়ে পরে! তখন স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময়। একদল কিশোরী এবং তরুণী দল বেঁধে স্কল-কলেজে যাচ্ছিল। তারা কিশোরের লুঙ্গির ফাটা দিয়ে তার নিতম্ব দেখে আর মুখে ওড়না চেপেও এতই শব্দে হাসে যে কিশোর বাড়িতে ফিরে হাউমাউ করে না কেঁদে পারেনি।

সেই লুঙ্গিতেও কখনো কখনো ফাটা-ফাঁসা থাকে। লুঙ্গির একটা সুবিধা আছে। যেদিকে ফাটা থাকে সেদিকটা ঘুরিয়ে সামনে এনে বাঁধলে তা কুঁচির মধ্যে লুকিয়ে থাকে। খুব বড়ো পা না ফেললে সেই ফাটা অন্য কারো নয়নগোচর হয় না।

আর ফেসবুক যতই বলুক বয়স একটি সংখ্যামাত্র, কিন্তু বয়স আসলে কাউকেই ছাড়ে না। কোঁকড়ানো চুলভর্তি হ্যান্ডসাম যুবক টাকলু হয়ে যায়, পরচুলা বা ক্যাপ পরে আরও হাস্যদর্শন হয়ে যায় তারা, নারীরা গাদা গাদা টাকা খরচ করে বিউটি পার্লারে আর পোশাকে, কিন্তু তাদের দেখে দ্বিতীয়বার কেউ তাকায় না। ব্রা-র অনেক বাংলা প্রতিশব্দ আছে। কমলকুমার মজুমদার খুব সুন্দর নাম দিয়েছিলেন— ভেতর পরন। তারপরেও নতুন শব্দ বানানোর ক্ষান্তি নেই। আমাদের নাট্যকর্মী বন্ধু তাপস ব্রা-র নাম দিয়েছিলেন— মাই টাইট। ঝোলা স্তনকে টাইট করে রাখে। কিন্তু তাতেও কি বেশিকিছু লাভ হয়! বিউটি পার্লার যাওয়া-আসা করা ভদ্রনারীরা, অন্তত জনসম্মুখে, অশ্লীল ভাষা বলতে পারেন না। তাই তারা মাত্র ৩৪ বছরে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে যাওয়া সোনাগাছির সরযুবালার মতো খেদ-আফসোসের গান বাঁধতে পারেন না—

যখন ছিল খাড়া চুঁচি
নিত্যি খেতুম ফুলকো লুচি।
এখন আমার ঝোলা মাই
এখন কোনো কদর নাই।

সরযুবালাকে ১৬ বৎসর বয়সে বেশ্যালয়ে আনা হয়েছিল। তখন তাকে বোঝানো হয়েছিল— ‘বেশ্যারা স্বাধীন, ভগবান তাহাদিগকে রূপ দিয়াছেন, পুরুষকে ভুলাইবার কৌশল দিয়াছেন, কিসের জন্য? তাহা দ্বারা জীবিকা অর্জন করিতে। উকিল তাহার বুদ্ধি বিক্রয় করে, পণ্ডিত তাহার বিদ্যা বিক্রয় করে, এমনকি দীক্ষাগুরুও মন্ত্র বিক্রয় করেন; তবে রূপবতী কেন দেহ বিক্রয় করিবে না? বিপদ ভয় সকল ব্যবসায়িরই আছে। দেশের বড়ো বড়ো লোক বেশ্যাদের পায়ে বাঁধা। ধনী লোকদের টাকা বেশ্যাদের ঘরে আসিয়া পড়ে। তাহাদের এক কটাক্ষের মূল্য সহস্র টাকা।’

যে জায়গার যা দস্তুর। বেশ্যাপাড়ায় বিক্রেতাদের লাগে ক্রেতাদের পছন্দমতো শরীর, আর ক্রেতার লাগে পয়সা। পয়সা নাই তো শোওয়া দূরের কথা, দাঁড়ানোরও সুযোগ নাই। সুবল দত্ত নামের অল্পধনী এক বাবু বেশ্যাপাড়ায় পড়ে থাকত বলে তার বউ চলে গিয়েছিল অন্য পুরুষের হাত ধরে। বছর কয়েক মনের মতো মৌজ-মস্তি করে বাবুর টাকা-পয়সা হাওয়া। বেশ্যারা কেউ ঘরে নেয় না। আবার বাড়িতে বউও নাই। বাবুর যন্তোর গরম হওয়া তখনো বন্ধ হয়নি। কিন্তু ঠান্ডা করবে কীভাবে? মনের দুঃখে (আমাদের নিউজিল্যান্ডপ্রবাসী দোস্ত আজমের ভাষায় ধোনের দুঃখে) সুবল বাবুও গীতিকবি হয়ে ওঠে—

যখন ছিল পয়সা-কড়ি
নিত্যি যেতুম রান্ডিবাড়ি
নাইতো এখন পয়সা-কড়ি
নিজের ফুটো নিজেই মারি।

তারমানে কি দুঃখ আর মনের কষ্ট থেকেই কবিতার জন্ম হয়? আহারে রবিবাবুর কত কষ্ট ছিল তাহলে! জীবনবাবুরও! জীবনবাবু তা-ও তো দিল্লির রান্ডিবাড়ি গিয়ে বেশ্যাগমনের স্বাদ নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু রবিবাবু! বেচারা! তিনি টগবগে যুবক বয়সে বউ মরে গেলেও রান্ডিবাড়িতে যাওয়ার সুযোগ করে উঠতে পারেননি। নিমপাতার রস খেয়েই নিজেকে ঠান্ডা রাখতেন। তাই বলাই যায়, রবিবাবুর কষ্ট ছিল জীবনবাবুর চাইতে বেশি। তাই বলা যায় তাঁর দুঃখ অনেক বেশি ছিল। তাই এই সমীকরণ থেকে আমরা দাবি করতেই পারি, রবিবাবু বড়ো কবি ছিলেন জীবনবাবুর চেয়ে।

রবিবাবু ব্রাহ্ম ছিলেন। পারিবারিকভাবে জীবনবাবুও। কিন্তু রামমোহন-কেশব সেনের সারমনগুলো জীবনবাবু মেনে চলতে পারেননি। হয়তো মানতে চান-ই-নি। ইংরেজসভ্যতার জ্যোতিতে আলোকিত হয়ে রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্রাহ্মরা ছিলেন খুব নিষ্ঠাবান, মিথ্যা বলতেন না, নারীদের সুশিক্ষা দিতেন, কোনো অসৎ কাজ করতেন না, খারাপ জায়গায় যেতেন না।

কিছুদূর যাওয়ার পরে ভদ্রলোকের মনে হলো, তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। কারণ সোনাগাছি কোন দিকে তা তিনি এই শহরবাসের সূত্রে জানেন। তখন থুতির কোঁচা ধরে দৌড়ে ফিরতি পথে এসে সোনাগাছিগামী লোকটিকে বললেন— এই শোনো, আমি জানি সোনাগাছি কোন দিকে। কিন্তু তোমাকে সেই পাপস্থানের পথ আমি বলব না।

সেই সময়ে এক ব্রাহ্মকে সোনাগাছি কোনদিকে তা জানতে জিজ্ঞেস করেছিল এক গ্রাম থেকে আসা লোক। ব্রাহ্ম ভদ্রলোক তীব্র ক্রোধে প্রায় অন্ধ হয়েও নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে শান্তকণ্ঠে কিন্তু প্রচণ্ড বিরক্তির সাথে উত্তর দিয়েছিলেন— আমি জানি না!

কিছুদূর যাওয়ার পরে ভদ্রলোকের মনে হলো, তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। কারণ সোনাগাছি কোন দিকে তা তিনি এই শহরবাসের সূত্রে জানেন। তখন থুতির কোঁচা ধরে দৌড়ে ফিরতি পথে এসে সোনাগাছিগামী লোকটিকে বললেন— এই শোনো, আমি জানি সোনাগাছি কোন দিকে। কিন্তু তোমাকে সেই পাপস্থানের পথ আমি বলব না।

এখনকার গবেষকরা খুব নচ্ছার। তারা রামমোহনের জীবনের ঘটনা বেছে বেছে বের করেছে। বলছে রামমোহন বেশ্যাবাড়িতে যেতেন না। তবে সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি, রামবাগান, ফুলবাগান, চাঁপাতলা, আহিরীটোলা, সিমলা, কেরাণীবাগান, জোড়াসাঁকো পতিতালয় থেকে সুন্দরী যুবতী বেশ্যা এনে নিজের বাগানবাড়িতে লীলা করতেন।

বেশ্যার কথা আপাতত স্থগিত থাকুক। এখন আমরা এখনকার রোজকার জীবনের কথায় ফিরে যাই।

রোজ সকালে বাসার গলির মুখে রিকশায় উঠে বাসস্টপে যাই। ভাড়া বিশটাকা। কিন্তু আজ ওঠার আগেই রিকশাঅলা বলল— ভাড়া কিন্তু ছার তিরিশ ট্যাকা?

রাগ ধরবেই। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বিদ্রুপ মিশিয়ে বলি— তেল, অকটেন, পেট্রল, ডিজেলের দাম বাড়ছে রাতারাতি তা জানি। কিন্তু তোমার রিকশাতে তো তেল লাগে না! নাকি তোমারও তেল-ডিজেল কিনতে হয়?

রিকশাঅলা রাগে না। নিচুকণ্ঠেই বলে— ত্যাল কিনা লাগে না ছার। কিন্তু চাইল-ডাইল কিনতে হয়। মোটা চাইল হইছে ৫৫ ট্যাকা কেজি। রোজ বাড়তাছে দুইট্যাকা পাঁচট্যাকা কইরা। চিকন চাইলের কথা আপনেরা কইবার পারবেন।

রিকশাঅলা রাগে না। নিচুকণ্ঠেই বলে— ত্যাল কিনা লাগে না ছার। কিন্তু চাইল-ডাইল কিনতে হয়। মোটা চাইল হইছে ৫৫ ট্যাকা কেজি। রোজ বাড়তাছে দুইট্যাকা পাঁচট্যাকা কইরা। চিকন চাইলের কথা আপনেরা কইবার পারবেন।

জবাব দিতে পারি না। উঠে বসি রিকশায়।

খানিকটা যাওয়ার পরে রিকশাঅলা জিজ্ঞেস করে— কথাডা কি সত্যি ছার?

কোন কথা?

আমগো বাংলাদেশ নাকি ছিরিলঙ্কা হইয়া যাইব?

ধুর মিয়া। এইসব কী কথা কও!

রিকশাঅলা বোধহয় একটু ভয় পায়। হয়তো আমাকে সরকারি দলের পারা-খাওয়া সমর্থক বা সদস্য ভাবে। পেছন ফিরে আমাকে নিরীক্ষণ করে। বলে— অনেক লোকে কইত্যাছে। রাগ নিয়েন না ছার!

আমি হেসে ফেলি। বলি— আরে মিয়া বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে কী করে বলো? শ্রীলঙ্কার পাবলিক আন্দোলন করে। তাদের মন্ত্রী-এমপি আর দালাল সাংবাদিকদের জাঙ্গিয়া খুলে নেয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে অবস্থা ঠিক উল্টা। সরকার রোজ পাবলিকের জাঙ্গিয়া খুলে নেয়। তবু পাবলিক আন্দোলন করতে রাস্তায় নামে না। কিছুদিন পরে এই দেশের পুলিশ-আমলা আর সরকারি দলের ব্যবসায়ী ছাড়া আমাদের কারো জাঙ্গিয়া থাকবে না।

এবার হেসে ফেলে রিকশাঅলাও। বলে— জব্বর কথা কইছেন ছার।

জব্বর কথা তো সব্বাই বলে। তবে জায়গা বুঝে।

আমাদের দেশ নাকি মুক্তবাজার পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মে চালানো হয়। সমাজতন্ত্রের কথা বলে স্বাধীনতা যুদ্ধ হলেও মুক্তিযুদ্ধের দল সমাজতন্ত্র ত্যাগ করেছে। ওটা নাকি এখন অচল। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারে কোনো জিনিসের মূল্য সরকার নির্ধারণ করে না। বাজার চলে ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই নীতিতে। বাজারে যত বেশি মাল আসবে, কমপিটিশন হবে, ডিমান্ড তত কমবে, জিনিসের দাম তত কমবে। কিন্তু আমাদের দেশে ৫০ বছরে কোনোদিন জিনিসের দাম কমেনি। দেশি জিনিসে আর ইন্ডিয়ান জিনিসে মার্কেট সয়লাব। কিন্তু দাম কমে না। বরং হঠাৎ হঠাৎ কোনো কোনো জিনিস মার্কেট থেকে উধাও হয়ে ব্যবসায়ীদের আন্ডারগ্রাউন্ড গুদামে চলে যায়। তিন দিন এমন থাকলেই কয়েক হাজার কোটি টাকা ঢুকে যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে। আর সেই যে ক্রাইসিসের সময় জিনিসের দাম বাড়ল, তা ক্রাইসিস মিটলেও কমবে না। সরকার একটু-আধটু গা নাড়াচাড়া করে। তারপরে পরিস্থিতি একই। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান গুনে দেখেছে— ৩০০ জনের জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ১৮০ জনের বেশি। তাই সরকার মানে আসলে ব্যবসায়ীরাই। এখানে তাই ডিমান্ড-সাপ্লাই থিয়োরি চলে না। ব্যবসায়ীরা যা চায় সেটাই চলে। আর আমরা পাবলিকও সেইরকম। যতই বাঁশ দেওয়া হয়, আমরা ততই নিজেদের ভেতরে গ্রহণ করি। কেউ কেউ বেশি ব্যাদনায় একটু জোরে উহু আহ করলে সরকার এতই গোস্বা করে যে সেই গোস্বার দুই-চারটা নমুনা দেখার পরে জোরে কাঁদতেও ভয় পাই আমরা।

যতই বাঁশ দেওয়া হয়, আমরা ততই নিজেদের ভেতরে গ্রহণ করি। কেউ কেউ বেশি ব্যাদনায় একটু জোরে উহু আহ করলে সরকার এতই গোস্বা করে যে সেই গোস্বার দুই-চারটা নমুনা দেখার পরে জোরে কাঁদতেও ভয় পাই আমরা।

ছোটো রাস্তায় আজকে বেশ জ্যাম মনে হয়। রিকশা মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে থাকছে দুই-চার মিনিট করে। বিরক্তি আসে— আজ হয়েছে টা কী? পাড়ার ভিতরের রাস্তায় এত ভিড় ক্যান?

রিকশাঅলা নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে— গিট্টু বাঁধছে হয়তো সামনের কুনো মোচড়ে।

তাই আমরা টুকটাক কথা বলি— তা ভাই তোমার ছেলেমেয়ে কয়জন?

এক ব্যাডা আর এক বিডি।

কত বড়ো? মানে বয়স কত?

এই ধরেন যে ব্যাডা ৮ বচ্ছরের আর মাইয়া ৩ বচ্ছরে পড়ছে।

তার মানে বউসহ তোমরা মানুষ মোট ৪ জন।

জ্বে।

তোমার পরিবার কি ঢাকাতেই থাকে? নাকি দ্যাশে পাঠাইছ?

দ্যাশে পাডাইছি। করোনার টাইমে। না পাডায়া উপায় কী কন ছার! দুইখান বচ্ছর ইনকামপাতি তো কিছুই আছিল না।

করোনার পরে আর আনোনি কেন ঢাকাতে?

এবার সে আরেকবার ফিরে আমার মুখের দিকে তাকায়। বলে— রোজ জিনিসপত্রের দাম বাড়তাছে। সারাদিন গতর খাটায়া যা পাই, তা দিয়া চাইরজন মানুষের ঢাকাত তিনবেলা খাওয়া জুটবি না ছার। যা জমাইতে পারি, সপ্তাহে সপ্তাহে বিকাশ কইরা পাডাই। অরা ওই টাকাতই পানি-পান্তা খায়া বাঁইচা রইছে।

এমন পরিবারের সংখ্যা অন্তত দেড়লাখ। করোনার সময় অফিস-ব্যাবসা বন্ধ। মাসকাবারি ইনকাম বন্ধ। সেই অভাবে বউ-ছেলে-মেয়েকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে অসংখ্য ছোটো চাকুরে, ছোটো দোকানদার, শ্রমিক। আমাদের অফিসেই আছে এমন কয়েকজন। তারা এখনো শহরে ফেরত আনতে পারেনি পরিবার। ঢাকা শহরে প্রায় সব দালানের গায়ে এখন টু-লেট সাইনবোর্ড। ভাড়াটেরা চলে গেছে শহর ছেড়ে।

আল্লাই জানে এইভাবে আর কতদিন চলব ছার!

আমরা কেউ জানি না কতদিন এভাবে চলবে। তাই আল্লার হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

গায়ে গায়ে দাঁড়ানো রিকশাগুলোর মাঝের সরু ফাঁক দিয়ে কাত-কুত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পথচারীরা। হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে সস্তা সালোয়ার-কামিজ পরা তরুণী আমাদের রিকশাকে পাশ কাটানোর সময় রিকশাঅলা হঠাৎ বলে— কী বাজার করলা?

তরুণী মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। একটু হাসির রেখা ফোটে মুখে। তারপর কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায় উল্টোদিকে।

রিকশাঅলা তবু মেয়েটির উদ্দেশে চিৎকার করে— দুপ্রে খাইতে আমুনে।

আমি খেয়াল করেছি বুঝতে পেরে রিকশাঅলা ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে— আমগো পরতিবেশী ছার। আমার রিকশা-গ্যারেজের পাশেই টিনশেডে থাকে। রান্ধার কাম করে।

ও আচ্ছা।

আমাকে ব্যাখ্যা দেবার কোনো দরকার তার ছিল না। একটু পরেই রিকশা থেকে নেমে যাব আমি। তারপর তার সাথে আবার কোনোদিন দেখাই হয়তো হবে না।

হঠাৎ দেখা গেল সামনের রিকশাগুলো ঘুরে পেছন দিকে ফিরে আসার জন্য হুড়াহুড়ি শুরু করেছে। লোকজনও ত্রস্ত পায়ে পেছন দিকে হাঁটছে। কী হলো? সামনে নাকি খুব মারামারি চলছে। দুই পার্টির ক্যাডারদের মধ্যে। আমার রিকশাঅলাও সেকথা শুনে পেছনে নিতে চায় রিকশা। আমার নিজের বুকের মধ্যেও ধুকপুক শুরু হয়েছে। তবু কেন যেন আমি বলি— আরে পিছনে যেয়ো না। চলো দেখি ঘটনা কী।

রিকশাঅলা কানে তোলে না— না ছার। রিকশা ভাইঙা দিবার পারে।

আমি তখন ভাড়া দিয়ে নেমে যাই। একপাশ দিয়ে এগোই। কথিত মারামারির কাছে গিয়ে দেখি জনা পনেরো লোক দুটি ছেলেকে পেটাচ্ছে। পেটাচ্ছে আর আকাশ ফাটিয়ে খিস্তি করছে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে অন্তত দুই শ জন লোক। একটু দূরেই নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে আছে একটি পুলিশভ্যান আর চারজন পুলিশ। পেটানোতে নেতৃত্ব দেওয়া লোকটাকে আমি চিনি। মহল্লা কমিটির সরকারি দলের সভাপতি। পঞ্চাশ পেরোনো বয়স। পরিষ্কার লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে থাকে সবসময়। মুখে চাপদাড়ি। পান চিবায় সবসময়। ভুঁড়ি, দাড়ি আর চেহারায় চোঁয়াড়ে ভাব মিলে পুরাই খান্নাস লাগে দেখতে। সে চিৎকার করে যাচ্ছে— মার শালা হারামির পুতগো। হাড্ডি-গুড্ডি একখানও য্যান আস্তা না থাকে। লুলা বানাইবি পুরাপুরি। মাইরা ফ্যালা। পুলিশ-র‌্যাব আমি দেখমু। আমাগো নেতৃর নামে মিছা কথা ছড়ায়! এত সাহস!

একে-তাকে জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে। কেউ উত্তর দিতে আগ্রহী নয়। যে দুটো ছেলেকে পেটানো হচ্ছে তাদের বয়স কুড়ি-বাইশের ঘরে।

জনে জনে প্রশ্ন করে চলেছি। একজন জানায়— ছেলে দুটো আগামীকাল তাদের পার্টির ডাকা হরতালের লিফলেট বিলি করছিল। তাতে নাকি প্রধানমন্ত্রীর নামে খারাপ কথা আছে। তাই সরকারি দলের নেতারা তাদের ওপর চড়াও হয়েছে।

জনে জনে প্রশ্ন করে চলেছি। একজন জানায়— ছেলে দুটো আগামীকাল তাদের পার্টির ডাকা হরতালের লিফলেট বিলি করছিল। তাতে নাকি প্রধানমন্ত্রীর নামে খারাপ কথা আছে। তাই সরকারি দলের নেতারা তাদের ওপর চড়াও হয়েছে।

আমি কি এখন লিফলেটটা খুঁজব? নাকি ছেলেদুটোকে বাঁচানোর পথ খুঁজব? কোনোটাই কি করতে পারব?

[আমি চিৎকার করে সভাপতিকে বলি— থামুন! তী করছেন আপনারা? কেন মারছেন ছেলেদুটোকে?
আমার চিৎকারে সবাই সচকিত হয়ে ওঠে। যারা মারছিল তাদের পা-হাতও ক্ষণিকের জন্য থেমে যায়।

আবার উঁচুকণ্ঠেই বলি— কী অপরাধ এই ছেলেদুটোর?

অরা হরতাল করবার চায়। লিফলেট বিলাইতাছে।

বলি— হরতাল করতে চাওয়া অন্যায় নাকি? আপনারা বিরোধীদলে থাকার সময় যে ১৭৩ দিন একটানা হরতাল করেছিলেন সেকথা ভুলে গেছেন?

সবাই একটু বেশি থমকায় এবার।

আপনারা করলে সেটা বৈধ। আর অন্যরা করতে চাইলে অন্যায়?

অহন তো দ্যাশ ভালো চলতাছে। অহন হরতাল ডাকা ঠিক না।

আপনার কাছে মনে হচ্ছে দেশ ভালো চলছে। অন্যের কাছে মনে হচ্ছে জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দাম বেড়ে চলেছে, মানুষের দুইবেলা খাবার কেনার সামর্থ্য হচ্ছে না। তাই তারা হরতাল ডেকেছে। আর আপনারা তো গণতন্ত্রের কথা বলেন। সেই গণতন্ত্রই বিরোধী দলকে হরতাল ডাকার অধিকার দেয়।

কিন্তুক হরতাল মানেই তো মাইনষেরে কষ্ট দেওয়া। গাড়ি-ঘোড়া চলতে পারব না ঠিকমতোন। সেইডা তো হইতে দেওয়া যায় না।

সাথে সাথেই আরেকজন বলে— আর যে বালের দল, পাঁচজন মানুষ নাই, অগো হরতালে কান দিবো কেডায়! হাতির পুটকিত মশায় হুল ফুটাইলে হাতি ট্যারই পায় না।

হাসির হররা ছোটে। আমি শান্তকণ্ঠে বলি— তাহলে তো আপনাদের কোনো চিন্তাই নাই। এই রকম ছোট্ট দলের ডাকা হরতালের ডাক মানুষের কানে পৌঁছাবেই না। তাহলে শুধু শুধু ছেলেদুটোকে মারছেন কেন?

সভাপতি একটু তেড়ে ওঠে— লিফলেটটা পড়ছেন আপনে? লেখছে আমগো পরধানমন্ত্রী স্বৈরাচার। এর চায়ে বড়ো গালি কি হইবার পারে? আমাগো লাখ লাখ নেতা-কর্মী বুকের রক্ত দিবো। কিন্তুক পরধানমন্ত্রীরে অপমান করতে দিমু না।

বলি— যদি প্রধানমন্ত্রীর অপমান হয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে আইন আছে। আপনারা মামলা করতে পারেন ওই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এভাবে মারপিট করতে পারেন না। রাস্তা বন্ধ করে কালকের হরতাল তো আজকে করে দিচ্ছেন আপনারাই।]

থার্ড ব্র্যাকেটের বাক্যগুলি আমার মনে মনে বানানো। এই রকম গরম পরিস্থিতিতে এসব কথা বলার মতো কলজের জোর আমার নেই। ছিল হয়তো একসময়। এখন আর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।

আমি করুণাপ্রার্থীর মতো পুলিশদের দিকে এগিয়ে যাই— ছেলেদুটোকে বাঁচান। অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যান। অ্যারেস্টের কথা বললে ওরা ছেড়ে দেবে।

দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব-ইন্সপেক্টর আমার দিকে তাকায়। কী যেন ভাবে। তারপর তার দয়া হয়। মাথা ঝাঁকিয়ে সঙ্গী পুলিশদের নিয়ে এগিয়ে যায় জটলার দিকে।

পুলিশভ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকি। ছেলেদুটোকে ভিড়ের ভেতর থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনছে চার পুলিশ। টানা-হ্যাচড়ার দরকার ছিল না। ওরা এমনিতেই আসছে।

ভ্যানে পা তোলার সময় ছেলেদুটো আমার দিকে তাকাল। জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক শ মানুষের দিকে একবার ফিরে তাকাল। তারপর থু করে একদলা রক্তমেশানো থুতু ফেলল মাটিতে। অনুভব করলাম থুতু সরাসরি এসে পড়েছে আমার গালে-মুখে। পৃথিবীর কোনো সাবান, কোনো ফেসওয়াশ এই থুতু ধুয়ে ফেলতে পারবে না।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২০ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে, নাটোরে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে। সমকালীন মূলধারার বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর অপরিহার্যতা ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। অনবরত বাঁকবদল তাঁর সাহিত্যিকতার প্রধান বৈশিষ্ট। বিষয় ও আঙ্গিকে, মাধ্যম ও প্রকরণে তাঁর স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত অবস্থান সকল মহলেই স্বীকৃত। বরাবর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত থাকায় তাঁর গদ্যে সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে রাজনীতি ও ইতিহাসচেতনা এসেছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। লেখালেখির শুরু থেকেই তিনি আলাদা এক পথ নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৫টি। তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘পিতৃগণ’ সমকালীন কথাসাহিত্যে একটি অন্যতম সংযোজন। ২০১৪ সালে কথাসাহিত্যে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।