মঙ্গলবার, এপ্রিল ৩০

বিন্দুবাসিনী উদ্যান : আবু হেনা মোস্তফা এনাম

0

দুপুরের বটগাছটিকে নদী মনে হলে সে দেখে তার শরীরে পাতার ঝিকিমিকি। তবু, তখন, আগুনহাওয়ায় প্রতিবিম্বিত ছিল পাখিদের ডাকাডাকি, তার শরীরে। নদীতীরের শালবন ধীরে ধীরে মরণের দিকে যাচ্ছে। মৃত্যুর নিরাময় কীভাবে ঘটে—ভাবতে ভাবতে সেলাইকলের ইলিবিলি শব্দ অথবা পাখিদের কিচিরমিচির মাথায় নিয়ে সে গাছপাথর হারানো মহিমান্বিত বটবৃক্ষ দেখে। আশ্চর্য, তখন! গ্রীষ্ম।

তার বাবা—অন্ধ, নাম বোনো। সে বিন্দুবাসিনী। শুকনো পাতার গন্ধের ভেতর বিন্দুবাসিনী অন্ধ বাবার সুখদুঃখ দেখছিল। বাবা কি অসীম নির্জনতার ভেতর জন্মান্ধ মানুষের মতো শব্দ অথবা গন্ধের জ্ঞানবৃত্তান্ত জানে? বাবা কি নিশ্চুপ ঘাস অথবা গাছের পাতার অজস্র কথার শব্দ শুনতে পায়? তার শরীরে যে নিবিড় উপবনের সকল পাতা, বাবা কি তার সুশোভিত ডালপালার সৌরভ দেখে? সে জানে না। বাবা রুপার নূপুরের নিঃশব্দ সৌন্দর্য ঘুমে শিথিল তার পায়ে সেলাই করে দিয়েছিল, ওই অলংকার নিয়ে বিন্দুবাসিনী একটা বৃক্ষ হয়ে গিয়েছে তার সকল বয়সের কাছে।

শালবনের শুকনো পাতা আর লাল বটফলের কাছে তার কিছু কথা জমা ছিল। রৌদ্রঋতুর দিনে। কুয়াশায়। আঁচলের নিচে স্ফিত যুগলস্তন ফুঁসে উঠলে সে নতুন বৃক্ষ জন্মানোর মমতা টের পায়। সে দেখে মাটির ভেতর তার সুকোমল শিকড় বন-উপবনের ছায়ার সৌরভে ঘুমের ভেতর হেঁটে চলেছে। জংলী ফুলের সকল মধু তার শিকড়ে প্রবাহিত। সে মধুর সুগন্ধ নিয়ে গেছে তার বয়সের কাছে। সে দেখে, তার বয়সের গলিঘুঁজিতে জন্ম নিয়েছে নানান রকম বৃক্ষ। কোনোটিতে ফুল আর ছায়ার নিবিড়তা সুখদুঃখের মতো, কোনোটি বর্ষার বিপুল মেঘ ডেকে আনে, কোনোটিতে তামাটে কচিপাতা, কোনোটি ঘুম ঘুম গানের ভেতর ধূলি উড়িয়ে চলেছে। পাখিদের ওড়াউড়ি তার শরীরে ফুলের শুভ্রতা ছড়িয়ে দিলে সে দেখে তার শরীরজুড়ে ঝরে পড়ছে শুকনো পাতা। যেদিকে তাকায় শুকনো পাতার স্তব্ধতা। ঝনঝন রৌদ্রের নিভৃত গন্ধে তার ক্লান্তি বোধ হলে টুপটাপ শুকনো পাতা তাকে আনন্দ দেয়। ঝনঝন রৌদ্রের নিভৃত গন্ধ নিয়ে সে শরীরের ঝিকিমিকি ঘাসে ঘুমায়।

তার ঘুম তো নদী। সে ঘুমনদী নিয়ে যায় জ্যোৎস্নায়, গোধূলি অথবা নক্ষত্রের গাঢ় অন্ধকারে। সে ঘুমনদীর ভেতর শোনে পাখিদের ওড়াউড়ি। দেখে স্নানের গন্ধ মেখে অসংখ্য পাখি এসে বসেছে তার ডালে। তখন সে একটা বটগাছ।

তার ঘুম তো নদী। সে ঘুমনদী নিয়ে যায় জ্যোৎস্নায়, গোধূলি অথবা নক্ষত্রের গাঢ় অন্ধকারে। সে ঘুমনদীর ভেতর শোনে পাখিদের ওড়াউড়ি। দেখে স্নানের গন্ধ মেখে অসংখ্য পাখি এসে বসেছে তার ডালে। তখন সে একটা বটগাছ। ডাল তার শরীরের সকল পাতা সেলাইকলের ইলিবিলি শব্দে পরিণত করলে পাখিরা লাল বটফল মুখে নিয়ে উড়ে যায়। পাখিরা আবার ফিরে আসে। বিন্দুবাসিনী সেলাইকলের ইলিবিলি শব্দের ভেতর অনুভব করে তার শরীরে উড়ন্ত পাখিদের ডানার বিলীয়মান ধ্বনি। পাখিরা ফিরে আসে শূন্য মুখে। আবার তারা লাল বটফল রঙিন ঠোঁটে নিয়ে উড়ালে যায়। পাখিরা ঠোঁট নিসৃত লাল বটফল ঝরায় অথবা খেয়ে ফেলা ফল পটি করে শুকনো পাতায়, বিন্দুবাসিনীর আঁচলে, নূপুরের নকশায়। লাল বটফল মিশ্রিত পাখির শুকনো মল চন্দনফোঁটার কোজাগরি জ্যোৎস্নার মতো ফুটে ওঠে শুকনো পাতায়, বিন্দুবাসিনীর আঁচলে, নূপুরের নকশায়। তার শরীরে একটি-দুটি বটের চারা অঙ্কুরিত হয়। তখন সে দেখে তার শরীরজুড়ে কত কত পাখিদের উড়ালের ভেতর একটা পাখি নিঃশব্দ। একটা পাখি সেলাইকলের ইলিবিলি টঙ্কারে শিস দিলে বিন্দুবাসিনী দেখে শালবনের শুকনো পাতা মাড়িয়ে অশোক নদীসূর্যনীলিমারৌদ্রের ভেতর দাঁড়িয়ে। অথবা সে দেখে না। অশোক দাঁড়িয়ে। বিন্দুবাসিনী তার শরীরের সব পাখি উড়িয়ে ঘুমায়। অশোক দাঁড়িয়ে। অথবা বিন্দুবাসিনী ঘুমায় না। অশোক দেখে স্রোতস্বিনী নদীর এঁটেল মাটি দিয়ে মাজা, বরফিকাটা রৌদ্রে ঘোলা জলশ্বাসে ভেজা মহিষের মতো আষাঢ়ে এলো চুল বিন্দুর। চুলগুলো ঘাসের ছায়ায় নদী হয়ে বয়ে গেলে উঠোনের কোণে বটঠাকুরের ঝিকিমিকি পাতার ফাঁকে পাখিরা উড়ে আসে বিন্দুবাসিনীর ঘুম ঘুম চুলের ভেতর। তার চুলে রাশি রাশি মেঘ। পাখিরা তার মেঘচুলে ওড়ে, তার ঘুমচুলে ওড়ে। পাখিদের ঠোঁটে লাল বটফল ঝরে পড়ে ঘুমচুলে। অনেক অনেকদিন পর তার ঘুমচুল নদী হয়ে বয়ে গেলে যতদূর গেছে ঢেউ ততদূর জেগে ওঠে বটঝোপ।

সে বাঁশের চ্যাঙারি বুকের ভেতর নিয়ে শালবনে যায়। শালপাতার শুকনো রক্তের গলিঘুপচির ভেতর দেখে তক্ষক, ফড়িং, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি, লাল পোকা, কাচপোকা, কালোপোকা। বিন্দুবাসিনী পোকামাকড়দের বলে ফুল হতে—তারা মগজে বিষের খেলাধুলা ভুলে ফুটবে বিন্দুবাসিনীর শরীরে, তার ডালে ডালে, তার ঘুমচুলের বটঝোপে। তারা উড়বে বিন্দুবাসিনীর শরীরে, পাতায় পাতায়। শুকনো পাতা কুড়াতে কুড়াতে সে গোপন কল্পনার খোলামকুচি জড় করে। আর ঝাঁটের তোড়ে ভাসমান দুর্বিনীত ধুলোর ভেতর সে বাবাকে বলে, বর্ষায় এবার শরীরের সব গাছ রোপণ করুক—গগনশিরিষ, কদম, পিপল, তমাল, তাল, কন্টিকারি, শেয়ালকাঁটা, বনতুলসী, আম, বকুল, বট, নিম, গাব, ডুমুর. হিজল, জারুল, অশোক। শেষে উচ্চারিত গাছটির পরে বিন্দুবাসিনী চুপ। তার সকল চুপ গাছের তামাটে নতুন পাতায় গোপন আনন্দ ছড়িয়ে ঝিকমিক করলে তার বাবা, যে হয় বোনো, দৃষ্টিরহিত, কান্নার স্বরে বলে—পালিয়ে যা বিন্দা… পালিয়ে যা বিন্দা… পালিয়ে যা… বিন্দা…

বিন্দুবাসিনীর ঘুম ভাঙে। সে দেখে তার ঘুম গাছের শিকড়ের সঙ্গে চলে গেছে ঘাসের ভেতর শালবনের দূরে দূরে। এত দূর তার ঘুম ছড়িয়ে গেলে সে ঘাসকন্যা অথবা গাছকন্যা। তার শিকড়ে মাটির গন্ধের স্রোত। শালবৃক্ষবনের যত গাছ তার তত নাম হলে সে নিজেই হয়ে ওঠে নিবিড় বনভূমি। ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে শালবৃক্ষের ছায়া জড়িয়ে আছে তাকে। সে ছায়ার ভেতর ছায়া হয়ে। বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা বলে—শালবৃক্ষের একদা অরণ্য ছিল, আঁধার ছিল; আর রংবেরঙের গন্ধ, জ্যোৎস্নার ফুল, জ্যোৎস্নার পাখি, জ্যোৎস্নার গান, জ্যোৎস্নার শুকনো পাতা। বলে—এখন মরণকে ঐশ্বর্য করা। নদী যদি স্রোতস্বিনী হয়, এখন সে মৃত হাড়ের নিস্তব্ধতায় চুপ। বিন্দুবাসিনী কি নদীকন্যা? করুণ কালো রক্তের হিলহিলে নদীস্রাব বয়ে চলেছে তার এলো চুলে? সে কীভাবে শুকনো পাতা কুড়াবে মৃত নদীর শালবৃক্ষবনে? শালবনে তার হাসি ছিল উপবনের জলের গভীরতা। তার হাসি উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, নৈঋত-ঈষাণে গেলে বনভূমি গিয়েছিল হাসির স্রোতে দিগন্ত ছুঁয়ে। এখন নদীজুড়ে বালুর মরীচিকা। ঝুরঝুর ঝুরঝুর। বিন্দুবাসিনীর পায়ে বালুর ঝুরঝুর। বালুর নূপুর। সে দেখে বালুর নূপুর নদী থেকে ছড়িয়ে পড়েছে তার শিকড়ে। কতদূর গেছে বালুর নূপুর? জানে না সে। কতদূর গেছে নদীর নূপুর? জানে না সে।

ঝুরঝুর বালুর মরীচিকায় থুথু ছিটায়, যে বিন্দুবাসিনী, রৌদ্রছায়ার রোমাঞ্চে বাঁকা কোমর দুলিয়ে ঝাঁটা দেয়। অথবা লুপ্তপ্রায় শালবনে দুপুরের ঝকমকে রৌদ্রকুহরিত বিন্দুবাসিনী থামে। সে থামলে পাখিদের কিচিরমিচির চুপ, মৃত পাতার শুকনো মর্মর চুপ। একবার চুপ, পুনরায় ইলিবিলি কিচিরমিচিরে তার বেশ আনন্দ হয়। হয়তো সে চারপাশের চুপ এবং কিচিরমিচিরগুলোকে আলাদাভাবে চিনতে পারে। হয়তো লাল বটফল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিরাও চিনতে পারে সকল চুপ ও কিচিরমিচির। একবার চুপ, আবার ঝাঁটা দেওয়ায় তার শরীরে নাচ তৈরি হয়। শুকনো পাতা আর ঝুরঝুর বালুর নাচ। পাখিদের লাল বটফল ঝরানোর নাচ। রৌদ্রছায়ার নাচ। তার ঘুমচুলে বটঝোপের নাচ। বটঝোপের সন্ধ্যায় জোনাকির নাচ। নাচ আর ঝাঁটের তোড়ে ঘোরলাগা ধূলিকুণ্ডলি। বিন্দুবাসিনী দেখে, এইসব ধূলিনাচের তরঙ্গে ভেসে চলেছে রৌদ্রের জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্নায় তার রূপালি কোমরবন্ধনির নাচ তৈরি হয়। বিন্দুবাসিনী ধূলিজ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে রাজহংসীর পেখম মেলে দেয়। ধূলিমাখামাখি তার কালো পায়ে রুপাধূলির নূপুর নাচের শব্দ তৈরি করে। শুকনো পাতার মর্মর অথবা নূপুরের রুনুরুনু কলরোলে পাখিরা তাদের ঠোঁটের লাল বটফল ঝরিয়ে দেয়। নাচের সূক্ষ্ম ধ্বনিখঞ্জন ঝিল্লিরবের মতো অশোকের বিকারকে কাতর করেছিল।

ধূলিমাখামাখি তার কালো পায়ে রুপাধূলির নূপুর নাচের শব্দ তৈরি করে। শুকনো পাতার মর্মর অথবা নূপুরের রুনুরুনু কলরোলে পাখিরা তাদের ঠোঁটের লাল বটফল ঝরিয়ে দেয়। নাচের সূক্ষ্ম ধ্বনিখঞ্জন ঝিল্লিরবের মতো অশোকের বিকারকে কাতর করেছিল।

শালবৃক্ষের শুকনো পাতা কুড়িয়ে কুড়িয়ে বিন্দুবাসিনী ছড়িয়ে দেয় কুটিরের সামনে, উঠোনে। কুটির বটঠাকুরের নৈসর্গিক ছায়ায়। কুটিরে থাকে সে আর তার বাবা। উঠোনে শুকনো পাতা ছড়িয়ে দিলে দৌড়ে আসে নদীর হাওয়া। তখন তার শরীরের সকল পাতার ছায়ায় জেগে ওঠে ঘৃতকুমারী ঝোপ, তুলসীর ঘুম ঘুম গন্ধ। আর একটা লেবু গাছ। লেবুফুলের শ্বেতগন্ধ নয়, বিন্দুবাসিনী ভালোবাসে লেবুগাছের কাঁটা। তার বাবা ভালোবাসত কাপড় সেলাইয়ের কল চালাতে। গ্রামের লোকেরা বলে, সে সেলাইকে রেখেছিল সম্পর্কে। পাতার ছায়ায় সকল ঘুম। ঘুমের সঙ্গে নদী। নদীর সঙ্গে সকল শরীর শালবনে ছড়িয়ে গেলে বোনো দেখেছিল সকল সম্পর্কের ভেতর সাঁকে গড়েছে বটবৃক্ষ। বটঠাকুরের শরীরে অজস্র শিকড় ছড়িয়ে সেলাই করেছে শালবনভূমি। বোনো বুঝতে পারে, শিকড়ের সেলাইয়ে যেসব পাখির উড়াউড়ি তাদের গানের তরঙ্গ ফুল হয়ে ফল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিন্দুবাসিনীর শরীরে। এখন, যখন বোনো অন্ধ ও নির্বিকার হয়ে গেলে সেলাইকলের ইলিবিলি ইলিবিলি শব্দে অনুভব করে সন্ধ্যার মসৃণতা, যেন সন্ধ্যা একটি বৃক্ষ, রাত তার ডালে ডালে নক্ষত্রের ঝিকিমিকি ফুলপাতা। এখন, যখন বিন্দুবাসিনী শরীরের সকল পাতা সেলাই করে, পাতাগুলো চিরল চিরল। সে চিরল চিরল পাতার ভেতর নক্ষত্রের ঝিকিমিকি জগতে যায় ফুলের সন্ধানে। তার ডালে ফুল আর পাখিদের উড়াউড়ি। ফুল আর পাখিদের উড়ালের অনুভূতি তার শরীরে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের লোকেরা হাঁটতে হাঁটতে রাত অতিক্রম করে। হয়তো রাতের অন্ধকার ও উত্তেজনা কৌতুকের মতো সংক্রামক। হয়তো রাতের অন্ধকার ও উত্তেজনায় সকল নিস্তব্ধতা অতিক্রম করে চিরল চিরল পাতার আনন্দে বিন্দুবাসিনী ঘুমায়।

 

Motif_Abu Hena Mostofa Enamঅনেক অনেকদিন পর, গ্রামের লোকেরা আসে সেলাইয়ের নিবেদন নিয়ে। তারা দেখে বিন্দুবাসিনী সেলাই করে চলেছে শালফুলের সুগন্ধ আর ঘুম ঘুম পাখিদের ভ্রূকুটি। তার সেলাইয়ের ফোঁড়ে জেগে ওঠে ছোট ছোট ফুলের জ্যোৎস্না, ঝিমঝিম সবুজ, শিশিরের গুঞ্জন আর পাখিদের গানের কম্পন। গ্রামের লোকেরা মুগ্ধ হয়। তারা বলে, সে এতসব সেলাইয়ের সূক্ষ্মতা কীভাবে তৈরি করে? তার সেলাইয়ের সৃজনশীলতা অদ্ভুত শৈল্পিক ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে দেয়, তখন গ্রামের লোকেরা সেসব পদ্ধতি জানতে চাইলে দেখে সেলাইয়ের ভেতর বিন্দুবাসিনী ছোট ছোট রৌদ্রছায়ার উদ্যানের নতুন শৈলী ছড়িয়ে। নানান টুকরো সেলাইয়ের আনন্দে সে বিহ্বল। কখনো পুরোনো সেলাই খুলে নতুন নতুন সেলাইয়ে গেঁথে দেয় চোখ-নাক-কান-মুখ-জিভ-মগজের ঘন নীল মেঘপুঞ্জ, হলুদ মেঘপুঞ্জ, বেগুনি মেঘপুঞ্জ, লাল মেঘপুঞ্জ। সেলাই তার কাছে বর্ণময় জ্যোৎস্নার ঢেউ আছড়ে পড়া সমুদ্র। তার ঘুমের ভেতর, তার ডালে সাজানো পাতার ভেতর লুকানো মনোরম সন্ধ্যা। সেখানে ছড়ানো প্রশান্তির স্বচ্ছ নৈঃশব্দ্য। গ্রামের লোকেরা এমন চিরল চিরল সূচিকর্ম শহরে নিয়ে যায়। তারা বলে শহরের বাজারেই কেবল এমন সূচিকর্ম বিকোতে পারে। বিন্দুবাসিনী শহর চেনে না। জানে না সে শহরের সূর্যোদয়, বিকেল ও রাত। তার শরীরে যে পাখি গান গায়, তার সুরের তরঙ্গ উপবন হয়ে তার বুকের ভেতর ঠান্ডা জলরাশির আনন্দ ছড়ায়। কীভাবে সে যাবে শহরের বাজারে তার সূচিশিল্প নিয়ে? তখন অনেক অনেকদিন পর শহরের লোকেরা আসে। তারা বাজারের সকল ঘুম নিয়ে আসে। সেসব ঘুমের ভেতর বিন্দুবাসিনী দেখে, তারা সেলাই ভালো জানে। তাদের জানা সেলাইয়ে পৃথিবীর সকল কিছু গেঁথে ফেলা যায়। যেমন কাটাছেঁড়া মানুষের শরীর, যেমন উপড়ানো বৃক্ষ, বইয়ের বিচ্ছিন্ন পৃষ্ঠা, হত্যা করা পাখি-পতঙ্গ-ঘাস। শহরের লোকেরা গাছের ডাল সেলাই করলে বিন্দুবাসিনী দেখে তার শরীর থেকে পাতা ঝরে গেছে। পাতা ঝরা মানে স্তব্ধতা। তারা পাখির কিচিরমিচির সেলাই করলে সে দেখে তার শরীরের সকল শিকড়ের মৃত্যু হয়েছে। তারা নদী সেলাই করলে সে দেখে শালবন লুঠ হয়ে গেছে। আর সেখানে বসন্তের আবছা জ্যোৎস্নায় শিল্প গড়ে উঠছে। তারা শিল্পের নাম দেয়—স্থাপত্যশিল্প, কারুশিল্প, দারুশিল্প, বালুশিল্প, ভারীশিল্প। এরকম অজস্র শিল্পের শহর বিস্তৃত হলে বিন্দুবাসিনীর শিকড় ডালপালা, চিবুক, চুল, নূপরধ্বনি, কোমরবন্ধনী, ফুলফলে আটক হয়। মুমূর্ষু গাছের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে গন্ধ অনুভব করে। অথবা ঝরে পড়া শুকনো পাতায় পাখিদের শুষ্ক হাগু—যেখানে সুপ্ত হয়ে আছে লাল বটফল, যে বিন্দু বিন্দু লালফল বিপুল বনভূমির গন্ধ লুকিয়ে রেখেছে ঘুমের ভেতর। হঠাৎ কখনো ভয় হয়, মনে হয়—তারও কি তবে বাবার মতো অন্তহীন অন্ধত্ব শুরু হল? না কি আটক হওয়া শিকড়বাকড়, ডালপাতা মানেই দৃষ্টিহীনতার অনন্ত অন্ধকার? গ্রাম অথবা শহরের লোকেরা বিন্দুবাসিনীর সকল সেলাইয়ের ভেতর শালফুলের স্মৃতি স্পর্শ করে, রক্তের শিশির স্পর্শ করে, পাখিদের উড়াউড়ি স্পর্শ করে, উড়ালের ভেতর নূপুর স্পর্শ করে, নক্ষত্রের ফুল স্পর্শ করে, ফুলের ভেতর মসৃণ ডাল স্পর্শ করে, তার ঘুমচুলের ভেতর বটঝোপ স্পর্শ করে। এতসব স্পর্শে বিন্দুবাসিনী ঝুরঝুর বালির মতো ভেঙে পড়ে। অথবা ভেঙে পড়ে না। তখন তার সেলাইয়ের ভেতর গ্রামের প্রান্ত ছুঁয়ে থাকা লুপ্ত বনভূমি অথবা বনের বিরলতার ভেতর গ্রামের যে ইতিহাস, ঘরের যে আঁধার, আঁধারের ভেতর যে অন্ধ বোনো, অন্ধের ভেতর শুকনো পতার সমারোহে যে নিদ্রা, নিদ্রার ভেতর গ্রাম অথবা শহরের লোকেরা ঢুকে পড়ে। তাদের ঢুকে পড়া বারবার ঘটতে থাকলে বিন্দুবাসিনী পাতা কুড়ানো ঝাঁটা দেখিয়েছিল। সে কণ্টকশোভিত লেবুগাছের ফুল ছুঁয়েছিল—গাছ আমারে আশ্রয় দাও। শ্বেতপুষ্পগন্ধে আকুল লেবুগাছের নতুন ডাঁটো ডাল জড়িয়ে ধরতেই বিন্দুবাসিনী কচি সবুজ পাতায় তীক্ষ কাঁটায় ঝামরে ওঠা লেবুগাছ হয়ে যায়।

গ্রাম অথবা শহরের লোকেরা লেবুগাছের চারপাশ ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা নামে, জ্যোৎস্না নামে। জ্যোৎস্নায় পাখিদের উড়াল ছিল। হয়তো তারা লাল বটফল ঠোঁটে নিয়ে ফিরছিল গাছের ডালে বিপুল পাতার সমারোহে। গ্রামের লোকেরা মেঘের বিস্তারের মতো অসংখ্য পাখির উড়ালের ভেতর ধন্দে পড়ে। তারা ভাবে, কেন তারা এমন জ্যোৎস্নায় কণ্টকশোভিত লেবুগাছের চারপাশে ঘোরে? অথবা তারা হয়তো বর্ষার অকাল মেঘের গর্জন শোনে। গ্রাম অথবা শহরের লোকেরা লেবুগাছ ছেড়ে দূরে গেলে অজস্র পাখির শিস দৌড়ে যেতে দেখে। বটঠাকুরের বুড়ো শিকড়বাকড় পেঁচিয়ে আমপাত-বেলাপাতা-সিঁদুর রেখে যেতে দেখে। বটগাছটাকে নদী মনে হলে, তখন, গ্রামের লোকেরা দেখে—নদী কোথায়? তারা ধন্দে পড়ে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজনা থিতু হয়ে আসে। নদী দখলের উৎসব শুরু হলে গ্রামের লোকদের নৌকা ভ্রমণের স্বপ্ন গাছকাটার শব্দে মিশে যায়। কেউ লুপ্ত ঘাসফড়িংয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে কান্না করে। দেখে সারি সারি নতুন ঘরবাড়ি, টুকরো পাথরের স্তূপ, মসৃণ লাল ইটের পাহাড়ের ফাঁকফোকড়ে দু-একটা দলছুট তৃণ উঁকি দিচ্ছে। অথবা একটা মৃদু পাখি উড়তে উড়তে ক্লান্তি নিরাময়ের লতাপাতা না পেয়ে উড়ালের নতুন কৌশল আয়ত্ত করছে। তখন গাছ কাটার শব্দে গ্রামের লোকেরা বটগাছের চারপাশে ঘোরে এবং গ্রামের বুকের ভেতর ঢুকে যাওয়া লুপ্ত শালবনের বিপন্ন লতাপাতার ভেতর বিন্দুবাসিনীকে সন্ধান করে। তারা শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি এড়িয়ে শুনতে পায় অন্ধ বোনো অবিরাম ডেকে চলেছে—বিন্দা… বিন্দা… বিন্দা…

 

Motif_Abu Hena Mostofa Enamহয়তো অনির্ণেয় অপেক্ষার ভেতর, একদিন অশোক আসে, দুপুরে অথবা নক্ষত্রের পূর্বে। হয়তো সে আসে শালমহুয়ার বনে অথবা উঠোনে, কণ্টকশোভিত লেবুগাছের ছায়ায়। এমন নিমেষ আসা-যাওয়া বিন্দুবাসিনীকে ব্যাকুল করেছিল! অনেক অনেকদিন পর তার শরীরে নতুন চারা গজানো চিরল চিরল সবুজ পাতা কেঁপে উঠলে সে অশোককে পাখির ছিন্ন পালকের মতো মৃত বৃক্ষকাণ্ডে বসে থাকতে দেখিয়েছিল। যেমন অশোক, এই লুপ্তপ্রায় বনের প্রতিটি বৃক্ষের ইতিহাস জানে। মর্গে লাশ ব্যবচ্ছেদের মতোই এ তার মুখস্ত বিদ্যা। বনভূমিকে সে বলে মা, গাছগুলো ভাই, ফুলগুলো বোন। আর মায়ের চুলে বিলি কেটে বিন্দুবাসিনী কুড়ায় শুকনো পাতা। সেসব পাতার ঐশ্চর্য, পাতার মর্মর, পাতার গন্ধ ও রং, পাতার জন্ম ও মৃত্যুবিষাদ অশোকের শরীরের অংশ হয়ে যায়। তার নিদ্রা ও জাগরণে বাজতে থাকে পাতা ঝরার গান। তার কল্পনা ও কাজের ভেতর ঝরে পড়ে পাতা কুড়ানোর গুঞ্জন। আর বিন্দুবাসিনী বৃক্ষের নীরবতার চিহ্নমাত্র যেন। অশোক কখনো শোনেনি তার কথা অথবা কণ্ঠস্বর। মনে হয়, সে শুকনো পাতার মতো ঝরিয়ে ফেলেছে তার সকল কথা। তার কণ্ঠস্বর তো নদীর ঢেউ। বাতাসের তরঙ্গে ঢেউ ভেঙে মিলিয়ে যাচ্ছে তার সকল কথা। অথবা তার শরীর থেকে ঝরে গেছে সকল গাছ। জেগে আছে কেবল তীক্ষ কাঁটা। বিন্দুবাসিনী পাতা কুড়ানো ঝাঁটা দেখালে অশোক নির্লজ্জ হেসেছিল। আর কণ্টকশোভিত লেবুগাছটিকে জড়িয়ে ধরেছিল। কাঁটায় তার আঙুল রক্তাক্ত হলে সে হাসে, নির্লজ্জ ও উন্মাদ। হাসির শব্দে বোনো, দৃষ্টিরহিত অশ্রুপাতে কান্নার টুকরো টুকরো অস্ফুট গোঙানি করে—আমি মলে তবে যাস… বিন্দা… ভগমান… মরণ… মরণ… শত্তুর…

কান্নার এরূপ অভিসম্পাত স্রোতস্বিনীর কালো জলে ভেসে গেলে বিন্দুবাসিনী লেবুগাছ থেকে বেরিয়ে আসে। দেখে সোনালি শঙ্খচূড়ের চোখের মতো জ্বলছে দুপুর। মহুয়া আর শালগাছের ছায়ায় শুকনো পাতা কুড়াতে গেলে তার ঘুম পায়। কেন এত ঘুম পায় তার? সে দেখে তার জন্মের ভেতর রয়েছে ঘুমের গল্প। জন্মের সময় তার মা ঘাসের ভেতর ঘুমিয়ে গেলে তার শরীরে সেসব ঘুম আশ্রয় পেয়েছে। আর বাবা তাকে বুকের ওপর রেখে ঘুম ঘুম সুরে গান শুনিয়েছিল। তারপর থেকে সে বড় হতে হতে শরীরকে শুনিয়েছে বাবার ঘুম ঘুম গান। অতঃপর ঘুমকে তার সেলাই মনে হয়। ঘুমসেলাইয়ে শরীরের সকল চলাচল গেঁথে ফেলা যায়। বাবা বলে, তুমি শালবনে হেঁটে বেড়াচ্ছ, কিন্তু তোমার শরীর ঘুমিয়ে। তুমি শুকনো পাতা কুড়োচ্ছ, তোমার হাত ঘুমিয়ে। তোমার ডালে পাখি বসেছে, তোমার চিবুক ঘুমিয়ে। অন্ধ বাবার ডাক দৌড়ে এলে ঘুমের ফিসফিসের ভেতর সে দেখে গাছগাছালির ছায়ায় ব্যাকুল কাঠবিড়ালি, ধানটুনি অথবা ঘাসফড়িং। এসব প্রাণীর শরীরে কি নির্জন ঘুম জমে আছে? এবং ঘুমের ভেতর তারা লাফিয়ে চলেছে? সে জানে না। সে শুকনো পাতা কুড়ায় আর তার নিদ্রাশিথিল নিষ্কম্প গালে, চিবুকে খেলা করে লুপ্তপ্রায় শালমহুয়ার পাতায় ছিটকে পড়া ঘুম ঘুম রোদ। তখন লাল শাড়ির আশ্চর্য; অবিন্যস্ত আলুলায়িত আঁচলের পাহারায় বিন্দুবাসিনী—ঘুম ঘুম মেঘের বজ্র চিরে ঝরে পড়া রক্তজবার মতো ফুটে থাকে। অশোক দেখে লাল আঁচলের নিচে সোনালি বিদ্যুৎ, আঁচলের নিচে রক্তগোলাপ, নীল পুষ্পদল, হলুদ লতাপাতা, বেগুনি পাখার প্রজাপতি। অশোকের কী যে হয়, মৃত বৃক্ষকাণ্ডে বসে দেখে হাতপা মুড়ে কুণ্ডলিত বিন্দুবাসিনী—এক অনাস্বাদিত উপলব্ধি হয় তার। সে দেখে ছায়ার কোজাগরে ঘুমন্ত বিন্দুবাসিনীর শিথিল মুঠোয় রোদের ঝিকিমিকি, পায়ের পাতায় রোদের নূপুর, চিবুকে চোখে কপালে চুলে রোদের কুচি। অশোক দেখে স্বর্গ।

এসব প্রাণীর শরীরে কি নির্জন ঘুম জমে আছে? এবং ঘুমের ভেতর তারা লাফিয়ে চলেছে? সে জানে না। সে শুকনো পাতা কুড়ায় আর তার নিদ্রাশিথিল নিষ্কম্প গালে, চিবুকে খেলা করে লুপ্তপ্রায় শালমহুয়ার পাতায় ছিটকে পড়া ঘুম ঘুম রোদ। তখন লাল শাড়ির আশ্চর্য; অবিন্যস্ত আলুলায়িত আঁচলের পাহারায় বিন্দুবাসিনী—ঘুম ঘুম মেঘের বজ্র চিরে ঝরে পড়া রক্তজবার মতো ফুটে থাকে।

আর যে অশোক, সে ডোমের পুত ডোম। এগার-বার বছরের বাল্যকাল থেকে যে বাবার সঙ্গে মর্গে যায়। গাছ ফাড়ার মতো লাশ ফাড়ে, খুলি ফাটিয়ে মগজ বের করে আনে, বুক পেট চিরে দেখে লাল মাংসের নিচে হলুদ চর্বি। দেখে মৃত বুকের ভেতর রঙের ছড়াছড়ি—নীল, হলুদ, লাল, বেগুনি, পিতাভ কলকব্জা সব ঘুমিয়ে। তার বাবা একবার কালশিটে পড়া এক গর্ভবতীর লাশ ফেড়ে বের করে এনেছিল মৃত শিশু। বাবার অঞ্জলিবদ্ধ মৃত শিশু প্রস্ফুটিত পদ্মের আশ্চর্য! বাবা বলেছিল—আয়, স্বর্গ দেইখা ল! অশোক দেখে সোনার প্রদীপের কোমল উজ্জ্বলতায় শিশুর কুণ্ডলিত মুঠোয় স্বর্গ, দেখে তুলতুলে পদতলে স্বর্গ, দেখে নিশ্চুপ চিবুকে স্বর্গ, নিমিলিত চোখে কপালে স্বর্গীয় চাঁদের কণা। আর বাবার চোখে ব্যথার ঐকতান স্বচ্ছ জল হয়ে ঝরেছিল। অশ্রু এত সংক্রামক যে, শালমহুয়ার রৌদ্রছায়ার টুপটাপ ঝরে যাওয়া শুকনো পাতা আর বুনো ফুলের রেণুর ভেতর অশোকের গোপন কান্না মৃত বৃক্ষের কাণ্ডে বিধুরতা ছড়িয়ে দেয়। সে বিপুল নির্জন বনের আলোছায়ায় ঘুমের কাছে যায়। সে ঘুমের ভেতর বুনো ফুলের রেণু আর গুল্মের সবুজতা দেখে কি? হয়তো দেখে, অথবা দেখে না। দেখে তার বুকের ভেতর লাল নীল হলুদ বেগুনি পিতাভ বিন্দুবাসিনী ঘুমিয়ে। গুঞ্জার মালা, কুচ ফলের সীতাপাটি, ময়ূরপুচ্ছ পরে পদ্মফুলের চৌষট্টি পাপড়ির ওপর তার ঘুম। ঘুমের ছায়ায় তার শরীর থেকে উড়ে যাচ্ছে রংবেরঙের অজস্র পাখি। তার ডাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে আলো হয়ে আছে ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি। তার ঘুমচুল থেকে উড়ালে যাচ্ছে অবিরল প্রজাপতি। পাখি, প্রজাপতি আর জোনাকির উড়াল তার সকল ঘুমে বিহ্বল। অথবা কাঠবিড়ালির লাফে তার ঘুম ঝরে পড়ছে, ঘুমের ভেতর তার শরীর থেকে ঝিকিমিকি লাল নীল হলুদ বেগুনি পিতাভ নদী ঝরছে। তবে কি বিন্দুবাসিনী কোনো নদী? অশোক জানে না। সে কি ঘুমের ভেতর তার শরীরের লাল নীল হলুদ বেগুনি পিতাভ নদী প্রবাহিত করে দেয়? অশোক জানে না। সে দেখে নদীর ভেতর লাল হলুদ নীল বেগুনি পিতাভ জল চুপ হয়ে আছে। তবে কি লাশকাটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে বিন্দুবাসিনীনদী? সে জানে না।

না জানলে অশোক মৃত বৃক্ষকাণ্ডের ওপর বসে বুনোফুল টুকরো করে।

তখন, এই দৃশ্য বিন্দুবাসিনীর বিস্ময় নয়; সে হয়তো উদাস। তাও মুহূর্তের আয়োজন। তার মনে হয়, ঘুম তার সকল চুপ উন্মোচন করে দিয়েছে। অতঃপর ভয়ে কেঁপে সে শুকনো পাতার ঝুড়ি বুকে আঁকড়ে বন পেরিয়ে যায়—শিকারির হ্রেষায় লাফিয়ে পালানো বালিকা হরিণের ঝনঝন বিদ্যুৎবেগে। অশোক এরূপ চঞ্চল হরিণদৃশ্যে চিৎকার করেছিল। আনন্দে।

 

Motif_Abu Hena Mostofa Enamরৌদ্রঋতুর দিন। আর বিন্দুবাসিনী যেন বিন্দুবাসিনী নয়! সে তার শরীরের দিকে তাকায়। দেখে সকল পাতা ঝরে গেছে। সেখানে স্তব্ধতা। ঝরা পাতা কুড়াতে কুড়াতে সে তার শরীর কুড়িয়ে আনলে দেখে একটা ডালে নতুন পাতা জন্ম নিয়েছে। পাতাটির ডগা ছুঁয়ে ফড়িং উড়ে গেলে কেউ অস্ফুটে গান গাইছে, গান তৃষ্ণার্ত পাখিদের বুকে বেজে চলেছে, পাখিদের ডাকাডাকি রৌদ্রঋতুর আগুনহাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। তারপর নতুন পাতার হাওয়ার ভেতর সে দেখে অশোক মহুয়া ফুল আনতে গেছে। রৌদ্রে অশোকের কোঁকড়া চুলের ধূলিঘূর্ণির ভেতর পাখিদের উড়তে দেখে। তার চুলে পাখিদের এত উড়াউড়ি যে শরতের দুপুরে অশোককে দূরের মনে হয়। এখন দেখে অশোকের মদারু চোখে তার লাল আঁচলের উড়াউড়ি। অশোক শরীরে কেরোসিনের গন্ধ, মদের গন্ধ, লাশের গন্ধ নিয়ে বিকেল অথবা নক্ষত্রের ভেতর কণ্টকশোভিত লেবুগাছের চারপাশে ঘুরলে তাকে গন্ধের নদী মনে হয়। নদী শুকিয়ে গেলে বিন্দুবাসিনী কীভাবে যাবে নদীর স্রোতের কাছে? সে জানে না। সে কি যাবে তার সূচিকর্মের ভেতর দিয়ে? সেলাইয়ের ভেতর পৃথিবীর সকল শরীর গেঁথে ফেলা যায়? সে জানে না। সেলাইয়ের ভেতর কীভাবে সকল সম্পর্কের সাঁকো গড়বে সে নদীর মিলিত স্রোতে? সে জানে না।

বিন্দুবাসিনী চুপ! অশোক দেখে তার নিশ্চুপতা এবং দৃষ্টির মধ্যবিন্দুতে বনস্পতির জ্যোৎস্না, দৃষ্টির ভেতর নিশিজাগা পাখিদের গান। জ্যোৎস্নাগুলো, গানগুলো অশোকের আনন্দ দিশেহারা করে। সে মহুয়ার ফুল আনতে গেলে নদীজুড়ে ঝুরঝুর বালির রৌদ্রঝলকিতে বিন্দুবাসিনী চুপ! তার চুপ হয়তো মুখর হয়ে ওঠে পাখিদের উড়াউড়িতে অথবা শুকনো পাতায় পাখিদের লাল বটফল মিশ্রিত মলের গন্ধের ভেতর। অশোক ভাবে, সে কি পাখি যে বিন্দুবাসিনীর চুপ খুলবে? অশোক দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গ্রামের লোকেরা বলে, তুই একটা ডোম, ডোমের পুত ডোম, ডোমগাছ, তোর শিকড় গজাইব। তখন সে দেখে তার শিকড় গজিয়েছে। তার শিকড় যত দূরত্ব অতিক্রম করেছে তত পাতা তার শরীরে। সে চাইল, বিন্দুবাসিনী আসুক ডোমগাছের জ্যোৎস্নায়, শুকনো পাতার ভেতর সে ছড়িয়ে রাখুক তার সকল চুপ। তার চুপ দিয়ে সে বলুক হাজার কথা। লক্ষ কথা। তখন অশোক দেখে সকলের কথার ভেতর আসলে কোনো কথা নেই, পৃথিবীর সব কথা আছে চুপের ভেতর। সেখানে চারপাশে শব্দময় জগত অদৃশ্য; সেখানে ভাষার সকল শৃঙ্খলা অদৃশ্য; সেখানে মনোজগতের যাকিছু ব্যক্ত, যাকিছু অব্যক্ত, যাকিছু ইশারাময়, যাকিছু কটাক্ষের—সবখানেই অস্ফুট ধ্বনির মৃদু কম্পন—কখনো কখনো তা কেবল উপলব্ধি করা যায়। তার বেশি কিছু নয়। গাছের পাতারা চুপ, তাদের শরীরে শব্দময় হয়ে আছে পৃথিবীর সকল সবুজ কথা, নীল কথা, লাল কথা, হলুদ কথা। কথার এত রং যে গাছের চুপের ভেতর গানের তরঙ্গের মতো কথাগুলো অথবা রংগুলো অশোকের বুকের ছায়ায় ছড়িয়ে। তার মনে হয়, কথাও কি তবে শরীরে মাংসের নিচে প্রবহমান বর্ণময় পৃথিবী? বিন্দু তবে সকল চুপ নিয়ে নিদ্রায় থাকুক তার মাংসের নিচে। তখন অশোক দেখে, বিন্দুবাসিনীর চুপের ভেতর পৃথিবীর সকল শব্দ জড় হচ্ছে শালবনে। অশোক শব্দের কাছে যায়, দেখে ছোট ছোট শিল্পনগরী গড়ে উঠছে। ছোট ছোট লাল ইট। ছোট ছোট কাচের জানালা। ছোট ছোট আলো। আর ছোট ছোট অন্ধকার মৃত নদীর ভেতর জমাট বেঁধে থাকলে বিন্দুবাসিনী আর অশোক তাদের সকল চুপ নিয়ে যায় শব্দের উৎসের দিকে, নদীর স্রোতের দিকে, শালবনের ছায়ার খোঁজে। এই প্রথম তারা শরীরের সকল পাতার চিরল চিরল ছায়া ভুলে যায়। অথবা, এই প্রথম তারা শুকনো পাতা কুড়ানোর ভেতর ঘুম ভুলে যায়। তারা দেখে নদীর স্থির জলে তাদের মুখ নীল হয়ে আছে। অথবা তাদের মুখ লাল হয়ে আছে। হয়তো তাদের মুখ হলুদ হয়ে আছে। অনেক অনেকদিন পর তারা দেখে তাদের মুখ ধূসর হয়ে আছে। তারা ভয় পায়। তাদের মনে হয়, তাদের মুখের বিবিধ রং হয়তো মৃত নদী। অথবা তাদের মুখের বিবিধ রং হয়তো মাংসের নিচে প্রবহমান শরীর। হয়তো তাদের মনে হয়, তাদের মুখের বিবিধ রং উপবনজুড়ে ছড়ানো রৌদ্রছায়ায় ঝরে পড়া মৃত ফুল। তারা দেখে, তাদের শিকড় দূরে যেতে পারছে না। অশোক বলে—বিন্দু, ভয় পাস বিন্দুরানি…! বিন্দুবাসিনী বলে—বাবা…! এই প্রথম নিশ্চুপতাবিচূর্ণ ওঙ্কার, সে বাক্যবিনিময় করে। ক্রিয়া এবং অব্যয়শূন্য, সর্বনাম এবং বিশেষণবর্জিত একটি শব্দের ব্যাকরণ উচ্চারণে দ্বিধার জড়তা ছিল, ভয়ের কাঁপন ছিল, গোপন অস্থিরতা ছিল। এরূপ একক শব্দময় বাক্যে বিবিধ অর্থের ব্যঞ্জনা তৈরি হলে অশোক ধৈর্যের গাম্ভীর্য ছুঁড়ে ফেলে—তোর বাবায় একটা বুইড়া বটগাছ, খালি শিকড় গাইড়া রাহে, তোরে হেই শিকড় গাইড়া মাইরা ফেলাইব! তথাপি বিন্দুবাসিনী চুপ। বাবা সম্পর্কে এরূপ উক্তি তাকে দুঃখী করে। সে দেখে নির্জন বনস্থালি প্রবল পরাক্রান্ত কালো কালো ট্রাকের গর্জনে ছিন্নভিন্ন লাশ হয়ে উঠছে।

তারা বলে এভাবে হত্যা বন্ধ হবে না। হবে কি? তারা জানে না। অনেক অনেকদিন পর তারা আসে সেলাইয়ের নিবেদন নিয়ে। তারা হত্যা হয়ে যাওয়া নদী অথবা বনভূমির জ্যোৎস্নার ভেতর সেলাইয়ে ঝুঁকে থাকা বিন্দুবাসিনীকে দেখে।

তবু, প্রতিদিন অশোক আসে—দুপুরে অথবা নক্ষত্রের আগে আগে। তার আসা অনেক জোনাকি আনে, অনেক জ্যোৎস্না আনে, অনেক ভোর আনে। ভোরের পাখিরা শিল্পনগরীরর লাল ইট ছুঁয়ে উড়ে এলে, তখন একদিন লাল বটফলের ঘ্রাণের ভেতর দিয়ে গ্রামের লোকেরা আসে। তারা বিলুপ্ত শালবনের প্রান্ত ছুঁয়ে গ্রামের যে ইতিহাস, গৃহের যে আঁধার, আঁধারে যে সেলাইকল—সেখানে তারা বিন্দুবাসিনীর শরীরে প্রবহমান নদীর মৃত্যু টের পায়। সেখানে তারা বিন্দুবাসিনীর শরীরে বনভূমি হত্যার শব্দ পায়। তারা এসব মৃত্যুর শব্দ থেকে দূরে যেতে চাইলে দেখে অশোক ছিন্নভিন্ন শিকড় জোড়া দিচ্ছে। তারা বলে এভাবে হত্যা বন্ধ হবে না। হবে কি? তারা জানে না। অনেক অনেকদিন পর তারা আসে সেলাইয়ের নিবেদন নিয়ে। তারা হত্যা হয়ে যাওয়া নদী অথবা বনভূমির জ্যোৎস্নার ভেতর সেলাইয়ে ঝুঁকে থাকা বিন্দুবাসিনীকে দেখে। তাদের চোখ যেন সোনামুখী সুই। তারা সূক্ষ্ম সুইচোখে সেলাইয়ের ভেতর স্পর্শ করে নূপুরের গুঞ্জন, পা, বুক, নাক, ঠোঁট। তারা দেখে বিন্দুবাসিনীর সেলাইয়ের জ্যোৎস্নায় ডুবে আছে অশোক। তারা ধন্দে পড়ে বলে—ডোমের পুত ডোম… এসব টুকরো বাক্যে সহসা দুর্বিনীত বিন্দুবাসিনী পাতা কুড়ানো ঝাঁটা ছুঁড়ে মারে। আর অশোক, টুকরো টুকরো ছয়টি শিকড়ের নাম জানে—বাবাশিকড়, মাশিকড়, ঠাকুরদাশিকড়, ঠাকুরমাশিকড়, বড়বাবাঠাকুরদাশিকড়, বড়ঠাকুরমাশিকড়…। লাশ ফেড়ে হত্যাকে জানাই তাদের পেশা। সে জানে নদী হত্যা হয় কীভাবে, বৃক্ষ হত্যা হয় কীভাবে, শিকড় হত্যা হয় কীভাবে। অশোক অট্টহাসি করেছিল; ভেবেছিল—গাঁয়ের লোকেরা কখনো আলুপটল বিক্রি করে, কখনো কাপড় বেচে, কখনো প্লস্টিকের জুতো বেচে, কখনো ট্রাকে নদীর মাটি তোলে, কখনো হেলপারি করে, কখনো রিকসা চালায়, গাঁয়ের লোকেরা কখনো ফেরিওয়ালা। সে ভাবে এসব পেশার কি কোনো বাবা-ঠাকুরদা আছে? সে জানে না। আর সে অশোক, ডাঁটো ঝুরি আর গুচ্ছ গুচ্ছ শিকড় পাকিয়ে পাকিয়ে সে প্রকাণ্ড একটা ডোমগাছ।

অশোক ডোম, হয়তো সে ডোমই; তবে সে একখণ্ড রাতের কাছে গিয়েছে মর্গের সকল বেদনা নিয়ে। সে হত্যা সেলাই করে মর্গে। হত্যার সকল বেদনা সেলাই করে সে মর্গে। অজস্র হত্যা তার মাথার ভেতর চোখের ভেতর স্বাদের ভেতর স্পর্শের ভেতর গন্ধের ভেতর। এতসব হত্যার সেলাই নিয়ে সে এই প্রাচীন আকাশ, প্রাচীন বৃক্ষ, রৌদ্রছায়ার ইন্দ্রজাল, জ্যোতির্ময় গিরগিটি, রংবেরঙের পিপিলিকা, প্রাচীন শ্যাওলা, প্রাচীন নক্ষত্র আর প্রাচীন বটঠাকুরের জীবন দেখেছে। পৃথিবীর অসংখ্য বৃক্ষ, নদী, পাখি আর মানুষ হত্যার বিপন্নতা সেলাই করলে সে বিপন্নতা সেলাইকার। সে হত্যা হয়ে যাওয়া বৃক্ষ, নদী, পাখি আর মানুষের টুকরো টুকরো শরীর সেলাই করে একখণ্ড অবয়ব দেয়, পাতা উন্মোচন করে। এখন বিন্দুবাসিনী তার চুপ খুলে অস্ফুট ‘বাবা’ উচ্চারণ করলে তাকে ডোমগাছের কাণ্ড থেকে গজানো কচি পাতা মনে হয়। ডোমগাছের ডালে পাখিরা লাল বটফল মুখে নিয়ে গান গায়, তাদের কিচিরমিচির ফুল হয়ে অশোকের বুকের ভেতর ফোটে, তাদের গানের তরঙ্গ পাতার জ্যোৎস্না হয়ে ডোমগাছে ছড়িয়ে পড়ে। জ্যোৎস্নার নিশ্চুপতা বিন্দুবাসিনীর চুপ খুলে ছড়িয়ে দেয় শব্দের ভেতর নিবিড় আনন্দের সেলাইশিল্প। তখন অশোক নতুন নতুন সেলাইয়ের জগত গড়তে থাকে পাতা, ঘাস, লাল বটফল আর নদীর বিচিত্র রংবেরঙের রূপের ভেতর। তার সামনে খুলে যায় মর্গের নিশ্ছিদ্র সব দরজাজানলা। সে স্পর্শ করে মাংসের নিচে প্রবহমান রঙের ঘুম ঘুম স্রোত।

গ্রামের লোকেরা লাল শিল্পনগরীর জন্য বিন্দুবাসিনীর শরীরের সব পাতা ফুল ফল শিকড়বাকড় সেলাইয়ের ভেতর পেতে চাইল। তারা সকল সেলাই নিয়ে যাবে শহরে। শহরের শপিংমলে, বাজারে। তারা দেখে বিন্দুবাসিনী সকল সেলাই আড়াল করেছে পাখিদের ঠোঁটে। তবে তারা সকল পাখি নিয়ে যাবে শহরে। তারা দেখে পাখিরা লাল বটফল ঠোঁটে নিয়ে উধাও হয়েছে বিন্দুবাসিনীর শরীরের ঝিকিমিকি পাতায়, তার ঘুমচুলের ঢেউয়ে। গ্রামের লোকেরা ভাবে, শালবন যদি হত্যা হয়ে থাকে তাহলে এত পাতা এই সেলাইশিল্পীর শরীরে কীভাবে ঝিকমিক করে? তখন তারা ডোমের পুত ডোম অশোককে মৃত বৃক্ষকাণ্ডে বসে থাকতে দেখে। অথবা তারা দেখে সে একটি ডোমগাছ, ঘাসলতাপাতা লাল বটফল ইত্যাদির বিবিধ রং আর শব্দের সকল রহস্যের সিঁড়ি বেয়ে মৃত্যুর চূড়ায় বসে আছে। তখন তারা এবং অশোক হত্যা হয়ে যাওয়া শালবনের ঘূর্ণাবর্তে ছুটতে থাকে। তাদের ছোটাছুটি যেন কানামাছি খেলা। বিন্দুবাসিনী তাদের খেলার ভেতর দেখে নদীর ঢেউ ভেঙে যাচ্ছে। ভঙ্গুর ঢেউয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অশোকের মুখ। সে এসব খেলার বাইরে যেতে চাইল। সে দেখে বটঠাকুরের লাল ফলের নিকুঞ্জে পাখিরা আর কণ্টকশোভিত লেবুগাছ এসব খেলা থেকে দূরে। সে দেখে বটপাতার নিকুঞ্জে পাখিরা গানের কম্পন তুলছে। বিন্দুবাসিনী সে কম্পন তার হাড়ের ভেতর নিয়ে অগ্নিবন্দনা করে। ঝুরঝুর বালুর গুঞ্জনে তার নূপুর, শিকড় আর ঝিকিমিকি পাতায় অগ্নিবৈদুর্য, উড়ন্ত চুলে পাখিদের ঠোঁটে লাল বটফল—লেলিহান অগ্নিজিহ্বা। সে কি অশোককে ভালোবাসে? সে জানে না। অগ্নিউপাসক অশোকও কি ঢেউ ভাঙা খেলে তার সঙ্গে? জানে না সে। আর অশোক, মৃত বৃক্ষকাণ্ডে বসে অঞ্জলিবদ্ধ মহুয়াফুল টুকরো করছিল। এখন সেসব খেলা মনে হলে টুকরো মহুয়াফুল পায়ে দলিত করে বিন্দুবাসিনী। পায়ে দলিত করলেই কি শরীর অগ্নিউপাসনার বাইরে যেতে পারে? সে জানে না। এতকিছু না জানলে সে এসে দাঁড়ায় চ–দুপুরে লেবুগাছের কণ্টকশোভিত নিঃসঙ্গ ডালের কাছে।

 

Motif_Abu Hena Mostofa Enamসকল মানুষ সেলাই জানে। গ্রামের লোকেরা কেউ ভোর সেলাই করে, কেউ অন্ধকার। কেউ চাঁদ সেলাই করে, কেউ নদী। অন্ধ বোনোর সেলাইয়ের অভিজ্ঞতা থাকলে সে ছায়াচন্দ্রালোকে হাতড়ে হাতড়ে ছোট কাঠের তোরঙ্গ খুলে বের করে এনেছিল রুপার নূপুর। অলংকারজোড়া সেলাই মনে হলে সে সেলাই করেছিল সম্পর্ক। সন্তান জন্মের সময় ঘাসের ভেতর তার বউয়ের মৃত্যু হলে সে জেনেছিল—ইরাবাসিনী ঘাসের ভেতর সম্পর্ক সেলাই করতে জানে না। তার শরীরে শুকনো পাতার গন্ধ ছিল, শুকনো পাতার মর্মর ছিল। শুকনো পাতার রাজত্ব শেষ হলে উঠোনে কণ্টকশোভিত লেবুগাছ জন্মায়। বিন্দুবাসিনী লেবুগাছের ছায়ায় ঘুমালে অনেক অনেকদিন পর তার শরীরে জ্যোৎস্না ফুটে ওঠে, তার ঘুমচুলের ভেতর পাখিরা ওড়ে। বোনো জ্যোৎস্নায় পাখিদের উড়াউড়ির ভেতর সম্পর্ক সেলাই করতে চাইল। যেন তা ভেঙে না যায়, ছিঁড়ে না যায়। ভাঙতে দিতে না চাইলে সে বিন্দুবাসিনীকে শিখিয়েছে ঘুমসেলাই। তার শিকড় শালবনের দূরে দূরে গেলেও ঘুমসেলাই ছিঁড়বে না। বোনো চেয়েছিল সেলাই থাক শরীরের আড়ালে, নদীর আড়ালে, গাছের আড়ালে, লাল বটফলের আড়ালে। সে শরীর, নদী, বৃক্ষ আর লাল বটফল আড়াল করতে চাইল রুপার নূপরধ্বনি দিয়ে। ইরাবাসিনীর নূপুরধ্বনি নদী ডেকে এনেছিল তাদের গৃহে, ছায়া বয়ে এনেছিল তাদের উঠোনে, বৃষ্টি ঝরিয়েছিল তাদের শরীরে। নূপুরধ্বনি তাদের শরীরে সুখ-দুঃখের গল্প তৈরি করে। নূপুরধ্বনির ভেতর দিয়ে তারা স্বামীস্ত্রী নতুন নতুন সেলাই আবিষ্কার করলে, অনেক অনেকদিন পর, বিন্দুবাসিনীর জন্ম হয়েছিল তাদের গৃহে, গৃহ থেকে দূরে; শালবনের শুকনো পাতার স্তূপে; রোদে, রোদ থেকে দূরে; লাল বটফলের ভেতর, যে ফল পাখিদের মলের সঙ্গে পড়ে ছিল ঘাসের ভেতর। অথবা বটফলকে তাদের রোদ মনে হলে সেখানে পাতা ঝরার ধ্বনি। রোদকে গৃহ মনে হলে সেখানে শুকনো পাতার ছায়া। ছায়াকে তাদের গৃহে ডেকে আনলে ঘাসের ভেতর ইরাবাসিনী লুটিয়ে পড়েছিল। বাবা গো—উচ্চারিত চিৎকারের মর্মান্তিক বিভিষিকা চঞ্চল হয়েছিল। না কি শিশুকণ্ঠের জন্মধ্বনি মিশে গিয়েছিল নূপুরগুঞ্জনে? বোনো জানে না। ইরাবাসিনীর মুখে নদীর ফেণা ছোট ছোট ঢেউয়ে ভেঙে পড়ছিল, চোখে দিকচক্রবাল বিস্তৃত কুয়াশা ছিল? না কি শিশুজন্মের আনন্দ অথবা বিস্ময় ছিল? বোনো জানে না। আলো নিভে আসছিল। ইরাবাসিনীর এলো চুলের নীচে, ঘাড়ে গলগলে দুটি মৃদু ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসছিল চিকন সূচরক্ত? না কি সেলাইয়ের নতুন লাল ফোঁড়? বোনো দেখেছিল একটা সোনালি শঙ্খচূড় ফণায় নূপুরজোড়া কামড়ে উঠে যাচ্ছে বটঠাকুরের ঘন পাতার নিকুঞ্জে। অথবা সে কিছুই দেখেনি। শিশুর কান্না তাকে বিহ্বল করেছিল। অথবা শিশুর কান্না থামাতে সে চেয়েছিল ঘুম আসুক। ঘুমের ভেতর সে খেলবে, হাতপা ছুঁড়বে। ঘুমের ভেতর তার হাসিতে জেগে উঠবে পাখিরা। সেলাইকলের শব্দের ভেতর সে ঘুম ডেকে আনে শিশুর শরীরে। ঘুম সেলাই হলে তারা দুজন অনেক অনেকদিন পর দীর্ঘ উপবন এবং নদী পাড়ি দিয়েছিল। তারা লাল বটফলের নিচে তাদের শরীর মেলে দিয়েছিল। বোনো দেখে, লাল বটফলের মৃদু বীজের মতো তার শিশু—একবিন্দু। তবে কি সে পাখির ঠোঁটে বয়ে এসেছে তাদের গৃহে, তাদের শরীরে? এই কথা ভেবে তার বিপুল আনন্দ হয়। তার আনন্দের মধ্যে ঘাসের ভেতর খেলাধুলায় একবিন্দু শিশুর শরীরে অজস্র সবুজ বৃক্ষ জন্মায়। আর উঠোনের ঘাসশূন্য কোণে একটি লেবুগাছ জন্মালে সে চাইল, তবে তার ঘাসকন্যা বড় হোক লেবুগাছের ডালে ডালে, কাঁটায় কাঁটায়, পাতার ছায়ায়। অনেক অনেকদিন পর ঘাসকন্যার শিকড় শালবনের দূরে দূরে গেলে বোনোর দুচোখের মণি গলে দূরে চলে যায়। গ্রামের লোকেরা বলে, তার চোখ গেছে কি লেবুগাছের কাঁটায়? অথবা তখন বসন্তকাল? তারা অকস্মাৎ অন্ধ হয়ে যাওয়া বোনোর চোখের ভেতর জলবসন্তের বিবিধ সেলাই আবিষ্কার করেছিল। তারা দেখে, দৃষ্টিরহিত বোনো নিঃসঙ্গ, কীভাবে সে একা একা বাঁচে? অকাল অন্ধত্ব মোচনের জন্য বিন্দুবাসিনী আর বোনো দীর্ঘ উপবন এবং নদী পাড়ি দেয়। অন্ধ হাতে স্পর্শ করে শুকনো পাতায় ঝরে পড়া পাখিদের লাল বটফল খাওয়া শুকনো হাগু—যেন প্রতিটি পাতায় চন্দনের ফোঁটা, কোজাগরি আলপনার অলৌকিক জ্যোৎস্নায় সাজানো শুকনো পাতা। অন্ধ হাত চন্দনপাতার জ্যোৎস্না স্পর্শ করে। অন্ধ হাতে ঘাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করে বিন্দুবাসিনীর শরীরে ফুটছে অজস্র তৃণফুল। অন্ধ মন ভাবে, এবার হয়তো নতুন ফুলপাতার মওসুম শুরু হচ্ছে তার গাছে। অন্ধ হাতে সে হয়তো গাছকন্যার শুকনো পাতায় বাতাসের কম্পনে তার বুকের ভেতর শীত ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্ধ হাতে সে হয়তো গাছকন্যাকে আকুল কান্নায় জড়িয়ে ধরে, তখন তার আঙুলে লেবুগাছের কাঁটা ফুটে রক্ত ঝরে। রক্তের জ্যোৎস্নায় সে ছায়াচন্দ্রালোক হাতড়ে হাতড়ে ছোট কাঠের তোরঙ্গ খুলে বের করে আনে রুপার নূপুরজোড়া।

নূপুরের খঞ্জনিক্কন আর জীর্ণ পল্লবলুণ্ঠিত রৌদ্রের ধূলিজ্যোৎস্নায় বাবার পায়ে মাথা রাখে বিন্দুবাসিনী। ঘুমায়। অথবা সে ঘুমায় না। যেন এরূপ নিদ্রাই সে ভালোবাসে—সে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তার শরীর ঘুমিয়ে। নূপুরধ্বনি গুঞ্জরিত হচ্ছে, তার পা ঘুমিয়ে। নদীর ডেউয়ে সে সাঁতার দিচ্ছে, তার চুল ঘুমিয়ে। ঘুমের শিথিল চন্দ্রালোকে বোনো তার পায়ে পরিয়ে দিয়েছিল নূপুরজোড়া। ঘুমের ভেতর যতদূর তার শিকড় ছড়িয়েছে, ততদূর নূপুরধ্বনি। সে এই ধ্বনি থেকে দূরে যেতে না পারলে দেখে পৃথিবীর সকল দূর সেলাই হয়েছে নূপুরধ্বনি দিয়ে। তখন হয়তো অনেক অনেকদিন পর অশোক আসে। অথবা সে আসে না। সে মৃত বৃক্ষকাণ্ডে বসে মহুয়াফুল টুকরো করে। তার চারপাশে শুকনো পাতা ঝাঁটের ধূলিঘূর্ণি। তার শরীর ঘিরে এত ধুলোর উড়াউড়ি, তাকে মনে হয় রোদের জ্যোৎস্না—দিগন্তের দূরে। তাকে মনে হয় কুয়াশা—দিগন্তের দূরে। দূরে তার মুখ ছায়ারোদে ধুলোর উড়াল। বিন্দুবাসিনী ওই ডোমগাছের ছায়া ভেঙে যেতে দেখে কুয়াশায়। অশোক কি তাকে ধুলোর উড়ালে নিয়ে যাবে দূরে? সে জানে না। অথবা সে দেখে তার শরীরের সকল পাতা ঝরে গেছে। সে সকল শুকনো পাতা স্তূপ করে উঠোনে, চুলোর চারপাশে। অতঃপর সে কণ্টকশোভিত লেবুগাছের ডাঁটো ডাল জড়িয়ে ধরে।

গ্রামের লোকেরা বলে, তারা সেলাইকলের ইলিবিলি শব্দ মাথায় নিয়ে আগুনের শিখা দেখেছিল। বটগাছটিকে নদী মনে হলে ঝুরঝুর বালির উপর রোদের ঝিকিমিকি দেখেছিল। অথবা তারা বলে, তারা সেলাইয়ের নিবেদন নিয়ে গেলে দেখেছিল পৃথিবীর সকল সম্পর্ক ভেঙে পড়ার শব্দ। তারা আবিষ্কার করে, সেসব সেলাইশব্দ পাথর ভাঙা মেশিনের হলে তাদের মনে পড়ে পৃথিবীর আদিম মানুষের জীবন। তবে কি তাদের দেখা আগুনের শিখা পাথরের ঠোকাঠুকির ভেতর? তারা জানে না। তারা দেখে আগুনের লকলকে জিহ্বা উঠোনের শুকনো পাতা ছাড়িয়ে ঘরের চাল স্পর্শ করে, খেলার ছলে ভষ্মীভূত করে সকল সেলাইয়ের দিনপঞ্জি, নদীর দিনপঞ্জি, বৃক্ষের দিনপঞ্জি, পতঙ্গের দিনপঞ্জি, শালমহুয়া ফুলের দিনপঞ্জি, ধূলির দিনপঞ্জি, রোদের দিনপঞ্জি। আকাশপ্রবাহী ধূমঅগ্নিপ্রলয়ে বটবৃক্ষের সবুজ পাতার বিচিত্র রং হয়—বাদামি, ধূসর, খয়েরি এবং ক্রমশ কালোর চক্রাকার। অতঃপর হাড়ের বেদনা অশরীরী হয়ে ওঠে। আকাশপ্রবাহী ধূমঅগ্নিপ্রলয়ে বটের সবুজতা বোনোর পৌঢ় নিশ্বাসে ছাইয়ের ঘুর্ণি তোলে। ধমনি-শিরায় রক্তের বিকারে ধুমকুণ্ড নেশার ক্ষতচিহ্ন মিশিয়ে দিলে তার প্রাচীন ত্বক চিত্রিত হতে থাকে—বটপল্লবের সবুজতা কৃষ্ণময় কুঞ্চিত ত্বকে সোনালি সবুজের মসৃণ চক্রাকার বিদ্যুৎগ্রীবা, রক্তাক্ত হাড় নিষপ্রভ হাতপা গলিত অনৈসর্গিক উত্তেজনায় লিকলিকে অগ্নিশিখা আর ধুমকুণ্ডে মোচড়াতে মোচড়াতে বোনো বদলে যাচ্ছে, তার ইতিহাস বদলে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ বদলে যাচ্ছে, বৃক্ষ, চন্দ্রালোক, ছায়ার উন্মীলন, নদীর অনুধ্যান বদলে যাচ্ছে, শালফুলের স্মৃতিচিহ্ন বদলে যাচ্ছে, কান্নার সাধনা বদলে যাচ্ছে… তখন বিন্দুবাসিনী নির্বাক। বিস্ময়ে তার আশ্চর্যের ভেতর একটির পর একটি মৃত্যুরক্তিম অগ্নিকুণ্ড ধ্বসত্ম রেখা টেনে দিয়ে যায়।

ডোমগাছের ডাল ছুঁয়ে অজস্র পাতার চুপ নিঃশব্দ প্রপাতে তাকে নিয়ে গেছে দূরে। তখন তারা চিৎকার করে। তাদের চিৎকারে আকাশ ফুটো হয়ে গেলে তারা দেখে অকাল বাদলের মেঘ থেকে ঝরে পড়ছে লাল বৃষ্টি। এত বৃষ্টি তারা কখনো দেখেনি, এমন লাল বৃষ্টির কথাও তারা কখনো শোনেনি।

তখন গ্রাম অথবা শহরের লোকেরা দেখে শিল্পনগরীর লাল ভবন ছুঁয়ে পাখিরা উড়ালে যাচ্ছে। পাখিদের চোখে জল। অথবা তারা দেখে গ্রীষ্মিত দুপুরের আকাশে হঠাৎ অকাল বাদলের মেঘ জড় হচ্ছে। কেউ বলে এই মেঘ উপবন পুড়ে যাবার পরের, কেউ বলে এই মেঘ বিন্দুবাসিনীর চোখের জল, সকল সেলাই পুড়ে যাবার পরের। তারা সেলাই অথবা মেঘ অথবা হয়তো অশ্রু ছুঁয়ে ছুঁয়ে বিন্দুবাসিনীকে সন্ধান করে। তারা দেখে তাদের সকল স্পর্শ উন্মোচিত হয়ে যাওয়ার পর বিন্দুবাসিনী কোথাও নেই। তারা ভাবে, মেয়েটি নিশ্চয় চুপ হয়ে আছে। ডোমগাছের ডাল ছুঁয়ে অজস্র পাতার চুপ নিঃশব্দ প্রপাতে তাকে নিয়ে গেছে দূরে। তখন তারা চিৎকার করে। তাদের চিৎকারে আকাশ ফুটো হয়ে গেলে তারা দেখে অকাল বাদলের মেঘ থেকে ঝরে পড়ছে লাল বৃষ্টি। এত বৃষ্টি তারা কখনো দেখেনি, এমন লাল বৃষ্টির কথাও তারা কখনো শোনেনি। তারা দেখে বৃষ্টি ঝরছে কেবল কণ্টকশোভিত লেবুগাছের চারপাশে, শুকনো পাতার উপর। তখন গ্রাম অথবা শহরের লোকেরা সকল অনুসন্ধান, সকল সেলাই, সকল হত্যার ভেতর গভীর বিস্ময়ে দেখে কণ্টকশোভিত লেবুগাছের নিচে বৃষ্টির মতো লাল বটফল স্তূপ হয়ে উঠছে। সেই স্তূপীকৃত লাল বটফলের মধ্যবর্তী অংশটি একটি লাল টিলার মতো উঁচু দুটি মানুষের জড়াজড়ি অবয়ব উন্মোচিত করেছে। গ্রাম অথবা শহরের লোকেরা তখন লাল বটফলে ঢাকা যুগল মানুষের অবয়বের দিকে অগ্রসর হলে তারা দেখে বৃষ্টির লাল রং ধূসর এবং ক্রমশ সাদাটে হয়ে উঠছে। তখন তাদের হয়তো এমন স্বাভাবিক বৃষ্টিধূসরতায় স্বস্তি ফিরে আসে এবং তারা দেখে লেবুগাছের চারপাশে ছড়ানো চন্দনফোঁটার কোজাগরি আলপনার অলৌকিক জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত শুকনো পাতা। এমন চন্দনপাতা তারা কখনো দেখেনি, এমন কোজাগরি জ্যোৎস্নাপাতা দেখেনি তারা কখনো। বৃষ্টি থামার পর তারা লাল বটফলে ঢাকা যুগল মানুষের অবয়ব অথবা চন্দনজ্যোৎস্নাপাতার দিকে অগ্রসর হয়। তখন তাদের মাথায় ঝরে পড়ে আঠা-আঠা এবং দুর্গন্ধময় মৃদু উষ্ণ তরল পদার্থ। কী পড়ল? তারা মাথায় আঙুল ছুঁয়ে নাকের কাছে ধরলে তাদের ভুল ভাঙে। তারা দেখে অবিরল ঝরঝর বৃষ্টিধূসরতাগুলো উড়ন্ত পাখিদের আঠালো হাগু। পাখিদের হাগুর দুর্গন্ধে তাদের বিবমিষা হয়। শরীর নিংড়ে বের হয়ে আসা বমির ভেতর তারা ভাবে শালবনভূমি বৃক্ষশূন্য হলে এত পাখি কোথায় থাকে? কোন ডালে বসে তারা? কোন পাতায় ঘুমায় তারা? তখন গ্রাম অথবা শহরের লোকদের মনে পড়ে, বিন্দুবাসিনীর শরীরে পাতার ঝিকিমিকি ছিল, তার ডালে পাখিদের উড়ালের শব্দ ছিল। তখন তারা দেখে হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত রোদ বৃষ্টি নক্ষত্রের গন্ধ ডানার বিলীয়মান ধ্বনির ভেতর গেঁথে গ্রীষ্মিত দুপুরের আকাশে মেঘের মতো ভেসে আছে অজস্র পাখি। পাখিদের ঠোঁটে লাল বটফল। তখন গ্রাম অথবা শহরের লোকেরা উপলব্ধি করে, এত পরিকল্পিত হত্যাদণ্ডের মধ্যেও বটবৃক্ষ বিলুপ্ত হওয়ার নয়। অনেক অনেকদিন পর তারা আবিষ্কার করে শিল্পনগরীর কার্নিশে পাখির হাগুর ভেতর লুকানো লাল বটফল অঙ্কুরিত হচ্ছে। একটা বৃক্ষ। তার ডালে কচি সবুজ পাতার ছায়ায় একটি মৌন পাখি নিঃসাড়। পাখিটির চোখে জল।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক, সাহিত্যসমালোচক। জন্ম ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে, মেহেরপুর শহরে। লেখাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে। ‘ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী’ [২০০৫] প্রথম গল্পগ্রন্থ। ২০১০ সালে প্রকাশ হয় দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘নির্জন প্রতিধ্বনিগণ’। তারপর ‘প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প’ [২০১১], ‘জোনাকিবাবুই’ [২০১৮] এবং উপন্যাস ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’ [২০১৪]। সম্পাদনা : ‘মাহমুদুল হক রচনাবলি’ [বাংলা একাডেমি, ২০২০] সমালোচনামূলক বই ‘মাহমুদুল হক : সৃষ্টি ও শিল্প’ [২০২১]।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।