শনিবার, জুলাই ২৭

গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে : ঋতুপর্ণ ঘোষ

0

(আমার বন্ধু তৃষাকে লেখাটি নিবেদন করলাম। তাঁর মতো করে ঋতুদাকে ভালোবাসা আমার হলো না। —সৈকত দে)

 

১.
‘শিল্প ডেফিনিটলি, নিশ্চিতভাবেই… শিল্পের জন্যই শিল্প। শিল্প কারো কোনো উপকার করতে পারে না। কোনো সমাজ-বিপ্লব করতে পারে না। কিন্তু শিল্পই একমাত্র পারে, যা দেখা যাচ্ছে না, সেটাকে দেখাতে। সেই কারণেই ১৮১৪-১৫ সাল থেকে লেরমেনতভ, পুশকিন, গোগোল এই দিয়ে, দস্তয়েভস্কি-তলস্তয় দিয়ে… এই করতে করতে আপনি যদি ১৮৯২-এ আসেন… যখন চেখভ এবং গোর্কি একই সঙ্গে লিখতে লিখতে বিংশ শতাব্দীতে ঢুকছেন তাহলে আমি একটা গ্রাফ দেখতে পাই…’আমি’ শব্দটার উপর জোর দিচ্ছি… আরেকজন না-ও জোর দিতে পারেন…যে… এই প্রসেসের ভিতর দিয়ে যে পাঠক যাচ্ছে… তার ছেলে যাচ্ছে… তার মেয়ে যাচ্ছে… তার বংশানুক্রম যাচ্ছে… তার পরিবেশ যাচ্ছে… সে পাঠক ১৮৯২-এ লেনিন না হয়ে পারে না। কারণ ইতিমধ্যে তার চৈতন্যের জগৎ বদলে গেছে। এইটাই শিল্প-সাহিত্য করতে পারে। একা না… একটা উপন্যাসে না… কিন্তু শিল্প-সাহিত্যই করতে পারে… ‘

(দেবেশ রায়/ জারি বোবাযুদ্ধ ২০১০ এর সাক্ষাৎকারের টুকরো)

 

২০০৬-এর ডিসেম্বর থেকে ২০১৩-এর দোসরা জুন, প্রতি রোববার, ওপার বাংলার দৈনিক পত্রিকা সংবাদ প্রতিদিনের রবিবারের সাময়িকী ‘রোববার’-এর সম্পাদকীয় লিখতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাঁর শরীরের অর্থে মহানিষ্ক্রমণের পর ‘ফার্স্ট পার্সন’ শিরোনামাঙ্কিত যে দুটি খণ্ড গ্রন্থে সেসব সংকলিত হয় তা প্রকাশের পরে বন্ধু ঋপণ পরামানিকের কাছ থেকে নিয়ে পড়ি। আরও অনেকদিন পর আর্যু ভাই উপহার দেন বই দুখানি। সেই থেকে মাথার পাশে থাকে। আবার পড়ছিলাম, পড়তে গিয়ে দেবেশ রায়ের উদ্ধৃতাংশ স্মরণে এলো। কারণ? বলছি। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছোটোবেলার স্কুলে ক্লাস নিতেন স্বয়ং কমলকুমার মজুমদার। হাইস্কুলে ক্লাস নিতেন উদয় শংকর। তাঁর দিদিমা পেতলের গোপালের জন্যে ছোটো সাইজের সোয়েটার বুনতেন। এই স্মৃতি ঋতু চিরকাল স্মৃতিতে লালন করেছেন। ভাদ্রমাসে কুমোর পাড়ায় যখন দুর্গা প্রতিমার বক্ষদেশ, জঘনাংশ গড়ে উঠতে থাকে সেটিকেও তিনি ভারতীয় হয়ে বেড়ে ওঠার অত্যন্ত মূল্যবান গর্ব হিসেবে ভেবেছেন। স্কুলে ছেলেদের স্বাভাবিক দৌড়ে তাঁকে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি, ‘ফ্যাট রেসে’ অংশ নিতেন। মেয়েলি বলে সারাজীবন যে অপমান সইতে হয়েছে, মোটা বলে তার চেয়ে কম হয়নি। এই সমাজের অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল, মুক্তমনা ও এমনকি বামপন্থী বলে পরিচিত মানুষও ‘বডি শেমিং’ করে বিকৃত আনন্দ পান।

ritu_Add 5


উত্তম কুমার অপর্ণা সেন অভিনীত ‘জয়-জয়ন্তী’ সিনেমার অপর্ণার উপর আজকালকার ভাষায় ‘ক্রাশ’ খেলেন এবং কোনো দরকার ছাড়াই ভারী ফ্রেমের চশমা পরা শুরু করলেন; কেন না অপর্ণার চরিত্রটি ভারী ফ্রেমের চশমা পরেছিল। পরে, ভুল পাওয়ারের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ঠিক পাওয়ার চশমা উঠল তাঁর চোখে। ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ার সময় স্কুলফেরতা কবরস্থানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করার সময় পুত্রহারা মায়ের ব্যাকুল কান্না দেখে মৃত্যু সম্পর্কে ধারণা হয়। বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকে, সত্যজিৎ রায়ের মতোই, সিনেমা পরিচালনায় গিয়েছিলেন তিনি। ‘চোখের বালি’-র চিত্রনাট্য ঠিক করার সময়, এক বিশিষ্টজন তাঁকে বলেন, ঐ সময় বাংলায় ‘মিছিল’ শব্দটি ছিল না, ছিল ‘শোভাযাত্রা’। ভাবতে অবাক লাগে, আনন্দমেশা সার্বজনীন শব্দ ‘শোভাযাত্রা’ কেমন করে ‘মিছিল’-এর মতো এক মাল্টিপারপাস রাজনৈতিক শব্দে বদলে গেল! ভারতীয় সংবিধানের ৩৭৭ ধারা মার্জিত করে সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য ‘অপরাধ’ থেকে রেহাই দেওয়া হলো আর তিনি দেখলেন দিল্লির এক অধ্যাপক মা মিছিলে ‘প্রাউড মাদার’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাঁটছেন। ঋতুপর্ণের নিজের মা’কে মনে পড়ে: ‘কিন্তু, আমি মনে মনে জানি, অন্তরীক্ষ বলে যদি কোনও নিঃসীমা পথ থাকে সেখানে ক্লিষ্টপায়ে অশক্ত শরীরে দুর্বল হাতে PROUD MOTHER প্ল্যাকার্ড নিয়ে হেঁটে চলেছে আমার মা। আমার সব নিভৃত বিজয়মিছিলের সঙ্গী।’

বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকে, সত্যজিৎ রায়ের মতোই, সিনেমা পরিচালনায় গিয়েছিলেন তিনি। ‘চোখের বালি’-র চিত্রনাট্য ঠিক করার সময়, এক বিশিষ্টজন তাঁকে বলেন, ঐ সময় বাংলায় ‘মিছিল’ শব্দটি ছিল না, ছিল ‘শোভাযাত্রা’। ভাবতে অবাক লাগে, আনন্দমেশা সার্বজনীন শব্দ ‘শোভাযাত্রা’ কেমন করে ‘মিছিল’-এর মতো এক মাল্টিপারপাস রাজনৈতিক শব্দে বদলে গেল!

‘চোখের বালি’-র ডিরেক্টরস কাটে একটা দৃশ্য আছে। এক ন্যুড মডেলকে শুইয়ে ছবি তোলা হয়। তিনি শুটিং থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি পেতে চাইছিলেন কারণ বিকেল চারটায় স্কুলে ছেলেকে আনতে যেতে হবে। তখন ঋতুপর্ণের মনে হয়, ছেলেটি কী জানলে কষ্ট পাবে— মা কিছুক্ষণ নিষ্পন্দ মৃত পড়েছিলেন এই সংবাদে, নাকি কিছু মানুষ তার মায়ের নগ্ন ছবি তুলেছে এই খবরে? আমার এই অংশ পড়ে মনে পড়ল, ঋতু অভিনীত ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ সিনেমাটা। সেখানে যিনি মা, তিনি কেন কষ্ট পান? পুত্র মৃত, সেজন্য? না পুত্র সমকামী, সে কথা জেনে!

 

২.
[দিনপঞ্জি থেকে, ঈষৎ সম্পাদিত)]

‘অসুখ’ দেখলাম।
ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি। সেই বামপন্থী দাদাটির জন্য খুব করুণা হলো যিনি এই পরিণত, মানবিক সম্পর্কে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় আলোমাখা এই ছবিকে ভালগার বলেছিলেন। হাসি পাচ্ছে সেই দাদাটির জন্য যার গোষ্ঠীস্বার্থে ঘা লাগায় তিনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। আচ্ছা, আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, এই দেশের বামপন্থীদের চলচ্চিত্র আর সাহিত্য নিয়ে সত্যিকারের এনালাইসিস কি আছে? (তৃণমূল, সমগীত আর সংস্কৃতি পত্রিকার অনিয়মিত উদাহরণ বাদ দিলে নিয়মিত উদ্যোগ কি আছে? অখন্ড বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পত্রিকাটি এসইউসির পত্রিকা পথিকৃৎ এর ফটোকপি যা একচোখো যাদের মতে সমরেশ বসু প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাদি ইত্যাদি)

সেই বামপন্থী দাদাটির জন্য খুব করুণা হলো যিনি এই পরিণত, মানবিক সম্পর্কে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় আলোমাখা এই ছবিকে ভালগার বলেছিলেন। হাসি পাচ্ছে সেই দাদাটির জন্য যার গোষ্ঠীস্বার্থে ঘা লাগায় তিনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। আচ্ছা, আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, এই দেশের বামপন্থীদের চলচ্চিত্র আর সাহিত্য নিয়ে সত্যিকারের এনালাইসিস কি আছে?

ওয়েল, আপনি যখন কোনো ছবিকে ভালগার বলেন কেন বলেন? অশ্লীল পোস্টারে কালি লেপেই আপনার দায়িত্ব শেষ? মুক্তমতকে গলা টিপে মেরে, কোনো কমরেড অন্য ভাবনার চর্চা করলে তাঁর সাংস্কৃতিক মান নিয়ে ক্রিটিক করে আপনাদের বাম আন্দোলন আর কতো এক বৃত্তে ঘুরপাক খাবে? কম বেশি সব বামপন্থী দলেই নেতা কর্তৃক অনুজ কমরেডের নতুন চিন্তা বিধ্বস্ত করবার ইতিহাস সুবিদিত।

ritu_Add 4


‘অসুখ’ ছবিতে যখন মায়ের চরিত্রে গৌরী ঘোষ বলেন তাঁর ইনসুলিন ব্যবহার করতে বাধে, কেননা তিনি কাজের মহিলার কাছে শুনেছেন ইনসুলিনের মাসিক খরচ বারো শ টাকা হচ্ছে মহিলাটির সারা মাসের সংসার খরচ। এই ছোট্ট একটা অনুষঙ্গে আপনারা কি গণমানুষের প্রতি দায়িত্ব, চলচ্চিত্রকার হিসেবে দায়িত্ব যে ঋতুপর্ণ তাঁর মতন করে পালন করছেন তা কি ভুলে গেছেন?

হ্যাঁ, আমিও মনে করি একজন চলচ্চিত্রকার শুধুই কেচ্ছা আর ‘এ বয় মিটস এ গার্ল’ দেখাবেন না। তাঁর কিছু দায় আছে যে সমাজে তিনি বেড়ে উঠেছেন তাঁর প্রতি। কিন্তু হে কমরেডগণ আপনারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন তাঁর জন্য আপনারা, নেতারা-সংগঠকরা সেই বেড়ে উঠতে চাওয়া ভাবুকের প্রতি কি দায়িত্ব পালন করছেন? একবার চোখ মেলে আপনার সংগঠনে এইমাত্র যে ছেলেটি ভীরু পায়ে কিছু জানতে এলো, বুঝতে এলো, প্রবল আবেগে আপনার লাইব্রেরির বইগুলি দেখছে, আপনাকে প্রশ্ন করছে— যে মেয়েটি এলো নাটক জিনিসটা বুঝতে, সাহিত্য উপলব্ধি করতে আপনার শিখিয়ে দেওয়া পার্টি দৃষ্টিতে তাঁর জন্যে আপনি, আপনার পার্টি কি করছেন?

প্লিজ, এড়িয়ে যাবেন না। উত্তর দিন প্রিয় কমরেডগণ!

 

৩.
ঋতুপর্ণ ঘোষের ফিল্ম ও জীবন সম্পর্কে একটি আলোচনার অংশবিশেষ। পড়বার অনুরোধ রইল। সময় পেলে মন্তব্য। অখণ্ড বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল ছিল মূলত শিবদাস ঘোষ প্রবর্তিত এস ইউ সি আই (সোসালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া)-এর ফটোকপি মেশিন। কোনো এক উদ্ভট কারণে সমপ্রেম/ সমকামকে তাঁরা দেখতেন অসুস্থতা হিসেবে অথচ এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক এক যৌন অভ্যাস/ আচরণ। এবং প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। আলোচনাটি এখানে একটু বিশদে আনার কারণ, এখনো এই উপমহাদেশের বাম আন্দোলন শুচিবায়ুগ্রস্থ রয়ে গেছে। অবশ্য হবে না-ই বা কেন, সরকারি প্রচারযন্ত্রের নাটকগুলোতে তো স্বামী-স্ত্রী স্বাধীনতার আগে থেকেই তখনকার বানানো খাটে ভাইবোনের মতো দেড় মাইল দূরত্বে শুয়ে থেকে ব্লু টুথ পদ্ধতিতে প্রেম করেন। এবং পুষ্প পরাগায়ণের কায়দায় আপামর সুশীল মধ্যবিত্ত রাবীন্দ্রিক বাঙালির সন্তান উৎপাদিত হয় অথচ এ উপমহাদেশেই কামসূত্র শীর্ষক মহাগ্রন্থের উদ্ভব এবং অজন্তা ইলোরা কোনার্ক খাজুরাহোর কথা বাদ দিলাম না হয়। হায়! বাঙালি এখনো পর্দায় ফুলের ঠোকাঠুকি, মাথার পেছন দিকের বিগ ক্লোজ আপরহিত চুমু খেতে পারল না! দেবেশ রায় বলেছিলেন, যে ভাষায় লিঙ্গের ডাক নাম নেই সে ভাষা ফ্যাসিবাদী হতে বাধ্য। এসব ভেবেই আলোচনাটা এখানে আনতে হলো।

সরকারি প্রচারযন্ত্রের নাটকগুলোতে তো স্বামী-স্ত্রী স্বাধীনতার আগে থেকেই তখনকার বানানো খাটে ভাইবোনের মতো দেড় মাইল দূরত্বে শুয়ে থেকে ব্লু টুথ পদ্ধতিতে প্রেম করেন। এবং পুষ্প পরাগায়ণের কায়দায় আপামর সুশীল মধ্যবিত্ত রাবীন্দ্রিক বাঙালির সন্তান উৎপাদিত হয়

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘পথিকৃৎ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, গড়ে উঠেছিল কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এবং প্রথম দিন থেকেই এই পত্রিকার সম্পাদক মাননীয় মানিক মুখোপাধ্যায়।

তাঁর রচনা ‘বাংলা সিনেমার পটভূমি ও ঋতুপর্ণ ঘোষ’ যা কিনা উক্ত পত্রিকার অক্টোবর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তার তিনটি অংশ উদ্ধার করি:

(ক) চরিত্রচিত্রণে সত্যজিতের একটা দুর্বলতা ছিল মনে হয়। এজন্যই রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’ ছবিটি বাদে জটিল চরিত্র নিয়ে ছবি করেননি তিনি।

(খ) ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারলেন কী করে? রবীন্দ্রনাথের ফিলজফির প্রশ্নে আমাদের সমালোচনা যাই থাক নারী স্বাধীনতা বা বিধবাবিবাহকে রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করলেও এই প্রশ্নে তাঁর রচনায় মানবতাবাদী পরিমণ্ডলের মধ্যেও আপসমুখিতা আছে। কিন্তু তিনি কি তাঁর কাহিনিতে প্রতিনিয়ত নগ্ন নারীদেহ দেখাতে চেয়েছেন নাকি? কিন্তু শুধু এই জন্যই ঋতুপর্ণকে ঐশ্বর্য রাইদের মতো বিশ্বসুন্দরীকে হাজির করতে হয়েছে। সময় সময় তাঁর কাঁধের কাপড় পড়ে যাচ্ছে। রাইমা সেনকে দিয়েও পরিচালক এটাই করিয়েছেন। আসলে এটা অভিনেত্রীর বিষয় নয়, পরিচালক কাঁধের কাপড় ফেলিয়েছেন। যাতে দেহের একটা দিক অনাবৃত করা যায়। অভিনেত্রীও কাপড় ফেলেননি, রবীন্দ্রকাহিনিতেও তা নেই। এ কাজ করেছেন ‘রবীন্দ্রপ্রবক্তা’ ঋতুপর্ণ ঘোষ।

(গ) ঋতুপর্ণের নিজের জীবনেই যৌনতা নিয়ে অত্যন্ত বিকৃতি ছিল। যেটা ‘চিত্রাঙ্গদায়’ এসে পরিস্ফূট হয়। এই চিত্রাঙ্গদা হলো তাঁর ‘ফিলজফি অফ লাইফ’। ‘চিত্রাঙ্গদা’য় তিনি সেক্স পরিবর্তন করলেন। মেয়েদের জীবনটা কেমন তা আরও গভীরে জানার জন্য সমকামিতা এবং যৌনতা পরিবর্তনের রাস্তা নাকি তিনি নিয়েছিলেন। মানুষ জ্ঞানের জন্য অনেক কিছু করেছে, কিন্তু সূর্য সম্বন্ধে জানতে তাকে সূর্যে হাজির হতে হয়নি। শেক্সপিয়ার থেকে শরৎচন্দ্র যাঁরা অপূর্ব নারী চরিত্র অঙ্কন করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই পুরুষ ছিলেন। নারী চরিত্র গড়ার জন্য তাঁদের নারী হতে হয়নি। নারী হলেই নারী চরিত্র ভালো জানবে নাকি! বড়োমানুষ জ্ঞানের আলোকে চরিত্র জানে। চরিত্র বোঝা, জানা তো একটা জ্ঞান। নারী নারীচরিত্র বুঝবে আর পুরুষরা পুরুষচরিত্র বুঝবে, এ হয় নাকি! এই ধারণাটাই তো পুরোপুরি ভুল।… ‘চিত্রাঙ্গদা’ বসে দেখাটাই একটা অত্যাচার। সমকামিতার ছবি ফ্রেমের পর ফ্রেম। সমকামিতা একটা মানসিক অসুস্থতা।

—-

অংশগুলো তুলে দিলাম। খালি ভাবছি, এ আমি কী পড়লাম!! একজন সমালোচক পুরো ফিল্মে কেবল শাড়ি পড়ে যাওয়াই দেখলেন! নগ্ন কাঁধ দেখলেন! এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে সমকামিতাকে অসুস্থ ভাবেন! ঋতুপর্ণের ফিল্ম নিয়ে আলোচনা করতে বসে তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে ভুলভাল আক্রমণ করেন অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল ভাষায়!

Rituporno


আশা করি, পাঠচক্রে বাম দলগুলো এসব নিয়েও কথা বলবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য এদের পাঠচক্রের ধরণগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না তবে মায়া আছে আজো। নইলে আমার পুরো কৈশোর মিথ্যে হয়ে যায়।

 

৪.
শেষ আলাপ, আপাতত…

বাংলা কবিতার সাথে বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে গভীর প্রেম ঘটেছিল যে চলচ্চিত্রে তার নাম— ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। এই চলচ্চিত্র কবি জয় গোস্বামী আর চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের বন্ধুত্বের স্মারক। এভাবে, কবি ও চলচ্চিত্রকারের মিলেমিশে যাওয়া সেই প্রেমেন্দ্র মিত্রদের চলচ্চিত্র কাহিনিকার, পরিচালক বৃত্তির পর প্রথম ঘটনা।

ক্রমাগত মিথ্যে বলে যাওয়া ছিন্ন প্রেমের জুটি আর টাইটেল সং এ শুভা মুদগলের মথুরানগরপতি কার মনে আছে? ‘রেইনকোট’ সিনেমায় মাত্র দুটি চরিত্রের শমিত অভিনয় কেউ তো ভুলিনি আমরা।

‘হীরের আংটি’ দিয়ে যে যাত্রা তা শেষ হলো পুরোপুরি ‘চিত্রাঙ্গদা’য় আর আংশিক ‘সত্যান্বেষী’তে।

রবীন্দ্রনাথের নবনির্মাণ, মোঁপাসার এডাপ্টেশন, অগাথা কৃষ্টির খোলনলচে পালটে বাংলার স্বাদ এনেছিলেন তিনি।

নারীর অন্দরমহলের ইচ্ছের গল্পের এক দিগন্তবিস্তারী কথক ছিলেন তিনি, সিনেমার মধ্যে নানা অবশ্যপাঠ্য রেফারেন্সও পেয়ে যাই আমরা। যেমন— ‘খেলা’ সিনেমায় অবন ঠাকুরের নালকের কথা কিংবা ‘আবহমান’ সিনেমায় নটি বিনোদিনী আর বিভূতিভূষণের গল্পের উল্লেখ।

নারীর অন্দরমহলের ইচ্ছের গল্পের এক দিগন্তবিস্তারী কথক ছিলেন তিনি, সিনেমার মধ্যে নানা অবশ্যপাঠ্য রেফারেন্সও পেয়ে যাই আমরা। যেমন— ‘খেলা’ সিনেমায় অবন ঠাকুরের নালকের কথা কিংবা ‘আবহমান’ সিনেমায় নটি বিনোদিনী আর বিভূতিভূষণের গল্পের উল্লেখ। একজন পরিচালক আর তার নায়িকার সম্পর্ক নিয়ে এমন টেক্সুয়াল ছবি কী আছে? কিংবা ‘অসুখ’ সিনেমায় অভিনেত্রী কন্যার সাথে বাবামার সম্পর্ক!

একজন অভিনেতার ইনার সেল্ফ নিয়ে কাজ করেছেন ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’-এ। অভিনেতা ঋতুপর্ণকে পাই তিন ছবিতে। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ আর ‘চিত্রাঙ্গদা’য়। প্রেম, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, অপ্রেম সবকিছু নিয়ে নিজেকে, নিজেকে সর্বস্ব বিলীন করে অভিনয় করতে খুব বেশি দেখিনি আমরা।

আমার দেখা শ্রেষ্ঠ বাঙলা প্রেমের ছবি ‘চিত্রাঙ্গদা’। ইচ্ছে এক অসীম ব্যাপার, সেইটাকে ফ্রেমে আটকানো খুব কঠিন। আর সত্যিই তো নিজের শরীর নির্বাচনের স্বাধীনতা মানুষের থাকা উচিত।

Rituporno 2


অঞ্জন দত্ত লিখেছিলেন ঋতুতর্পণে, শুরুতে তিনি ঋতুকে পছন্দ করতেন না, আস্তে আস্তে পরস্পর বন্ধুতে পরিণত হন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, ‘আনন্দভৈরবী’ নামে এক চলচ্চিত্র নির্মাণের, দুই বন্ধুর অভিনয় করবার কথা ছিল, পরে কাজটা অসমাপ্ত থেকে যায়।

বামপন্থী মহলের কাছে তিনি ভালগার থেকে গেলেন। আমজনতা তাঁর মৃত্যুর পর একটিও ছবি না দেখে লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে নামী চলচ্চিত্র সাহিত্যিক আর চলচ্চিত্র আন্দোলনের নেতা স্রেফ আনন্দলোকের রেফারেন্সে তাঁর সম্পাদক হিসেবে দুর্বলতা নিয়ে লিখিত মন্তব্য করে ফেললেন। (১) তিনি ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকার রবিবারের সাময়িকী কোনোদিন উল্টেও দেখেননি বোধ করি।

যৌথ পরিবার বিষয়ে, তার অভ্যন্তরীণ হেলদোল নিয়ে সত্যজিতের পর ঋতুপর্ণই ভালো নির্মাণের পরিচয় রেখেছেন।

মৃত্যুদিনের কথা স্মরণে এলেই মনে পড়ে জন্মদিনের শুভকামনাচিহ্নিত দিনপঞ্জির পাতাটির কথা। ভাবি, জন্ম মৃত্যুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; জীবন ও শিল্প— দুই ক্ষেত্রেই।

 

টীকা

১. বিশিষ্ট চলচ্চিত্র চিন্তক, ভাবুক, চলচ্চিত্র সাহিত্যিক ও নির্মাতা শৈবাল চৌধূরী তাঁর সম্পাদিত ‘নিউ ওয়েভ’ পত্রিকায় লিখিতভাবে এই মতামত ব্যক্ত করেন, ঋতুপর্ণ সম্পাদনা জানতেন না। বিষয়টা ছয় বছর বাদে একটু বিশদে বলা যাক।

শ্রী শৈবাল চৌধূরী লিখেছিলেন ‘নিউ ওয়েভ’ পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যায়: ‘…তবে পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে তিনি সফলতা দেখাতে পারেননি বলে আমার মনে হয়। ঋতুপর্ণের সম্পাদনাকালে চলচ্চিত্র পাক্ষিক আনন্দলোক-এর গুরুত্ব, জৌলুশ আর ঐতিহ্য হারায়। পত্রিকাটি পরিণত হয় এক গসিপ ম্যাগাজিনে।’ ‘লাল জীপের ডায়েরি’ অনলাইনে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি সতেরো তারিখ আমি উক্ত পত্রিকায় এক আলোচনা লিখি সম্পাদকের অনুরোধক্রমেই। নিউ ওয়েভ : সীমাবদ্ধ চেষ্টা অসীমের সন্ধানে —এই শিরোনামে।

আমি লিখেছিলাম : ‘এখানে দ্বিতীয় আর তৃতীয় বাক্য নিয়ে আমার খুব একটা বলার কিছু নেই। কেননা প্রথমত এই কথাটি বিচার করবার কিছু নেই কেননা আনন্দবাজার গোষ্ঠীর এই নরোম অর্ধপর্ণ পত্রিকার নিয়তিই হলো এটা গসিপ ম্যাগাজিন হবে। সুস্থ চলচ্চিত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির পক্ষে তো বটেই, সাধারণ সুস্থ আর স্বাস্থ্যল মগজের পাঠকেরও আনন্দলোকের কাছে এছাড়া কিছু আশা করার নেই। দ্বিতীয়ত, ঋতুপর্ণের আনন্দলোক সম্পাদনাকালে বয়সজনিত কারণে ওটা চেখে দেখার সাধ্য আমার হয়নি। তৃতীয়ত, আমার সংগ্রহে থাকা ফুটপাত থেকে কেনা আটানব্বই সালের দোসরা মে সত্যজিতের জন্মতিথি স্মরণ সংখ্যা আনন্দলোকে ঋতুপর্ণ লিখিত সম্পাদকীয় দেখতে পাচ্ছি— ‘মানিকবাবু’ নামটিও সত্যজিৎ রায়ের আকাশচুম্বী উচ্চতার আদরের অপভ্রংশ। পরিচিত বা অপরিচিত আপামর বাঙালির কাছে মানিকবাবু এমনই একটি মানুষ, যিনি খাদ্যরসিক, নানান ইনডোর খেলায় পারদর্শী, দারুণ আড্ডাবাজ এবং এক অপার কৌতুহলী কিশোরের ছ’ফুট মোড়কের অন্যনাম।’ লেখক তালিকায় দেখতে পাচ্ছি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, মৃণাল সেন, শর্মিলা ঠাকুর, গৌতম ঘোষ, বিলায়েৎ খান, অমিতাভ বচ্চন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সহ আরো কয়েকজনকে। আছে বিজয়া রায়ের সাথে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। আছে সত্যজিতের বিশেষ ও শেষ সাক্ষাৎকার শিরোনামে সাক্ষাৎকার। অগুনতি ছবি আর স্কেচে রীতিমত কালেক্টরস ইস্যু। আমার কিন্তু একটুও ‘গসিপ ম্যাগাজিন’ মনে হলো না। এখন প্রথম বাক্য নিয়ে কথা বলা যাক অর্থাৎ ‘…তবে পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে তিনি সফলতা দেখাতে পারেননি বলে আমার মনে হয়।’ লেখক তাঁর বিবেচনা লিপিবদ্ধের পূর্ণ অধিকার রাখেন। আমরা বাক্যের অন্তর্গত সত্য বিচার করে দেখি। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গের একটা ভিন্ন ধারার দৈনিক ‘সংবাদ প্রতিদিন’। এই পত্রিকার রবিবাসরীয় সাপ্লিমেন্টের নাম ‘রোববার’। প্রয়াত হবার আগ অবধি বেশ কয়েক বছর এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাঁর অকালপ্রয়াণের পর সমূহ সম্পাদকীয় একত্রে, দুই খণ্ডে বিন্যস্ত হয়ে ‘ফার্স্ট পার্সন’ নামে প্রকাশিত হয় দে’জ পাব্লিশিং থেকে। অনলাইনে পত্রিকাটির আর্কাইভ থেকে তখনকার পত্রিকা পাঠ সম্ভব। অথবা, দুই খন্ডের গ্রন্থ তো হাতের নাগালেই। বিষয় বৈচিত্র্য, নতুন বিষয় উদ্ভাবনে তিনি কতোদূর পারঙ্গম ছিলেন এই দুই উৎস থেকে সাধারণ পাঠক জেনে নিতে পারেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘রোববার’ পত্রিকাতেও এই বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে নানাজনের স্মরণকথায়। আমরা অনেকেই জয় গোস্বামীর এখন অবধি প্রকাশিত তিন খণ্ডের গ্রন্থ ‘গোঁসাইবাগান’-এর সাথে পরিচিত। এই খণ্ডগুলোতে জয় তাঁর পাঠের অন্তর্গত কবিতা নিয়ে ভাবনার কথা লিখেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুর পর লেখা জয়ের গদ্যটি কেউ খুঁজে পেয়ে পড়লে ঋতুপর্ণের সম্পাদনা সফলতা সম্পর্কে বা শৈবালকথিত ব্যার্থতা সম্পর্কে কিছু ভাবনা খোরাক পাবেন। আমি কেবল বলতে চাই, শ্রদ্ধাঞ্জলির নামে এমন কন্ট্রোভার্শিয়াল বাক্য নির্মাণে বিরত থাকাই শ্রেয়। তাতে শ্রদ্ধার বদলে অশ্রদ্ধাই প্রকাশিত হয়। এছাড়া তথ্যে, উপাত্তে ঋতুপর্ণের সারা জীবনের শিল্পকাজের বিবরণ এতে উঠে এসেছে।’

ঋতুপর্ণ ঘোষ সংক্রান্ত আলোচনার একটা ধরণের ধরতাই দিতেই অর্ধ যুগ পরে এই ইতিহাস তুলে ধরলাম, ইতিহাসের স্বার্থে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, কথাসাহিত্যিক, ফিল্মক্রিটিক সবকিছু। জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৮১ সালে। পড়াশোনা ইংরিজি ভাষা ও সাহিত্যে। ‘নাব্যিক’ নামে একটা ছোটোকাগজ সম্পাদনা করতেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।