শুক্রবার, জুলাই ৪

গি দ্য মোপাসাঁর গল্প : দুই বন্ধু

0

অবরুদ্ধ প্যারিস আকালের তীব্রতায় একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ছাদে বসবাসরত চড়ুই আর নর্দমার ইঁদুরগুলো পর্যন্ত দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছিল। সময়টাই এমন মানুষ যা পাচ্ছিল তাই খেতে বাধ্য হচ্ছিল।

জানুয়ারির এক উজ্জ্বল সকালে মঁসিয়ে মরিসো, পেশায় যিনি ঘড়ি নির্মাতা, অলস বসে না থেকে রাস্তায় হাঁটছিলেন, তাঁর হাতদুটো প্যান্টের পকেটে পোরা। চিন্তাক্লিষ্ট চোখমুখ, এবং পেট দানাপানিহীন। পথে হঠাৎই তিনি তাঁর মৎস্য শিকারের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মঁসিয়ে সোভাজের মুখোমুখি হলেন।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, মরিসো প্রতি রবিবার সকালে একটি মাছ ধরার বড়শি এবং পিঠে একটি টিনের বাক্স নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে তিনি আর্জেন্টেউলের ট্রেনে উঠতেন, নামতেন কলম্বসে। এবং সেখান থেকে আইল মারান্তে হেঁটে যেতেন। তাঁর আরাধ্য সেই জায়গায় পৌঁছানোর পর তিনি মাছ ধরা শুরু করতেন এবং রাত পর্যন্ত মাছ ধরতেন।

প্রায়শই তাঁরা দিনের অনেকটা সময় পাশাপাশি বসে কাটিয়ে দিতেন। সেই সময় তাদের হাতে মাছ ধরার বড়শি, আর পানির ওপর দুজনের দোলায়মান পদযুগল পেন্ডুলামের মতো ঝুলে থাকত, আর এভাবেই তাদের বন্ধুত্ব গভীরতায় পৌঁছে ছিল।

প্রতি রবিবার তাঁর সাথে মজবুত কাঠামোর বেঁটেখাটো, আমুদে, রিউ নটরডেম ডি লোরেতের কাপড় ব্যবসায়ী এবং মৎসশিকারে অনুরক্ত মঁসিয়ে সোভাজের সাক্ষাৎ ঘটত। প্রায়শই তাঁরা দিনের অনেকটা সময় পাশাপাশি বসে কাটিয়ে দিতেন। সেই সময় তাদের হাতে মাছ ধরার বড়শি, আর পানির ওপর দুজনের দোলায়মান পদযুগল পেন্ডুলামের মতো ঝুলে থাকত, আর এভাবেই তাদের বন্ধুত্ব গভীরতায় পৌঁছে ছিল।

কোনো কোনো দিন তাদের মধ্যে হয়তো কোনো কথাই হতো না। আবার একেক সময় দুজনে গালগল্পে মশগুল থাকতেন। কোনো রকম শব্দের সাহায্য ছাড়াই তাঁরা একে অপরকে পুরোপুরি বুঝতেন, পরস্পরের পছন্দ আর আবেগ-অনুভূতির ক্ষেত্রে ছিল দারুণ বোঝাপড়া।

বসন্তকালে, সকাল দশটা নাগাদ, যখন সূর্যের নরম আলো জলের ওপরে হালকা কুয়াশা তৈরি করত এবং দুই উৎসাহী মৎস্যশিকারির পিঠে কোমল উষ্ণতা ছড়িয়ে দিত, তখন সেই আরামদায়ক আমেজ অনুভব করতে করতে মরিসো কখনো কখনো তার পার্শ্ববর্তীজনের উদ্দেশে মন্তব্য করতেন, ‘আমার কিন্ত এখানকার আরামদায়ক পরিবেশটা চমৎকার লাগে।’

উত্তরে অন্যজন বলতেন, ‘এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে বলে আমি ভাবতে পারি না!’

এই অল্প কয়েকটি কথায় তাদের মধ্যকার সমঝোতা এবং পারস্পরিক ভালোবাসার গভীরতা টের পাওয়া যেত।

 

শরৎকালে দিনের আলো নেভার সময় ঘনালে, অস্তগামী সূর্য যখন তার রক্তিম আভা পশ্চিমাকাশে ছড়িয়ে দিত, আর লালাভ মেঘের প্রতিফলন পুরো নদীজুড়ে এনে দিত লালচে আবেশ, তার ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠত দুই বন্ধুর মুখ এবং শীতের প্রথম স্পর্শে গাছের পাতারা সোনালি হয়ে যেত—সেসব দৃশ্যের সাক্ষী মঁসিয়ে সোভাজ তখন মাঝে মাঝে মরিসোকে লক্ষ্য করে হাসি মুখে বলতেন, ‘কী অপূর্ব দৃশ্য!’

মরিসো তার ছিপের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে উত্তর দিতেন, ‘জায়গাটা বুলেভার্ডের চেয়ে অনেক ভালো, তাই না?’

চরম পরিবর্তিত একটা পরিস্হিতিতে এভাবে হঠাৎ দেখা হওয়ায় একে অন্যকে চিনতে কষ্ট হলো।

না। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে দুই বন্ধু হাত মেলালেন।

মঁসিয়ে সোভাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করলেন, ‘এখন দুঃসময়।’

মরিসো ভারাক্রান্ত মনে সে কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

‘তবে আবহাওয়া মন্দ নয়! বছরের সবচে’ সু্ন্দরমত দিন আজ।’

‘আকাশটা সত্যিই মেঘমুক্ত ঝকঝকে নীল।’

তাঁরা পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন, দুজনের অবয়ব জুড়ে বিষণ্নতা আর চিন্তাগ্রস্ততা ঝুলে থাকে।

‘আমাদের মাছ ধরার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে!’ মরিসো বলে উঠলেন। ‘কত ভালো সময় কেটেছে আমাদের!’

‘আবার কবে আমরা মাছ ধরতে পারব?’ মঁসিয়ে সোভাজ প্রশ্ন করলেন।

কথা বলতে বলতে তাঁরা একটা ছোট্ট ক্যাফেতে ঢুকলেন এবং দুজনে এক পাত্র করে সোমরস নিলেন।

পানীয় শেষ করে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে আবার হাঁটতে থাকেন দুজনে।

হঠাৎ মরিসো থমকে দাঁড়ালেন। ‘আমরা কী আরেক পাত্র সোমরসের স্বাদ নিতে পারি?’ প্রশ্ন করলেন মরিসো।

‘তুমি যদি চাও, কেন নয়!’ সম্মতি জানালেন মঁসিয়ে সোভাজ।

ইচ্ছা পূরণের খাতিরে তারা অন্য আরেকটি মদের দোকানে ঢুকে পড়েন।

একে তো খালি পেট, তার ওপর অ্যালকোহল পড়ায় যখন তারা দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন দুজনের অবস্থায়ই বেশ বেসামাল।

দিনটা ছিল চমৎকার আর শান্ত, বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগে দুজনের মুখে।

তাজা হাওয়ার স্পর্শে মঁসিয়ে সোভাজের নেশা যেন পূর্ণতা পেল। তিনি সহসা হাঁটা থামিয়ে বললেন, ‘ধরো আমরা সেখানে গেলাম?’

‘কোথায়?’

‘মাছ ধরতে।’

‘কিন্তু কোথায়?’

‘কেন, সেই পুরোনো জায়গায়। ফরাসি চৌকিগুলো কলম্বসের বেশ কাছাকাছি। কর্নেল দুমুলাঁকে আমি চিনি, কাজেই আমরা সহজেই ছাড়পত্রের অনুমতি পেয়ে যাব।’

মরিসো শরীরে হিল্লোল তুলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। আমি রাজী।’

কাজেই কালবিলম্ব না করে মাছ ধরার ছিপ, বড়শি আনতে দুজনে আলাদা আলাদা পথে রওনা দিলেন।

ঘণ্টাখানেক পর তারা পাশাপাশি প্রধান সড়ক ধরে হেঁটে গেলেন। অল্প সময়ের ভেতর তারা কর্ণেলের বাগান বাড়িতে পৌঁছালেন।

দুই বন্ধুর অনুরোধ শুনে কর্ণেল হাসলেন এবং তা মঞ্জুর করলেন।

কর্ণেলের কাছ থেকে গুপ্তসংকেতটি নিয়ে তারা আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলেন।

দুজনে অতি দ্রুত ফরাসি চৌকিগুলো পেছনে ফেলে জনশূন্য কলম্বস পেরিয়ে, সেইনের সীমান্তবর্তী ছোটো ছোটো আঙুর বাগানের কাছে গিয়ে পৌঁছালেন। ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা ছুঁইছুঁই।

এগোতেই সামনে পড়ল আর্জেন্টেউল নামের আপাত নিস্তব্ধ গ্রাম। অর্গমেন্ট এবং স্যানোয়া পাহাড় পুরো দৃশ্যপট জুড়ে নিজেদের দাপট জানান দিচ্ছে। বিশাল সমতল ভূমি, নঁতের পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহৎ সমভূমিটি ছিল ফাঁকা, একেবারে ফাঁকা—ধূসর মাটির বালুকাময় প্রান্তর আর পাতা ঝরানো চেরি গাছ।

মঁসিয়ে সোভাজ উঁচুভূমির দিকে ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ওখানেই আছে প্রুশিয়ানরা!’

স্বভাবতই পরিত্যক্ত গ্রামের দৃশ্য তাদের দুজনের মনে অস্পষ্ট এক শঙ্কা সৃষ্টি করল।

অবরোধকারীরা ফ্রান্স ধ্বংস করছে, লুট করছে, হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, তাদের না খাইয়ে মারছে। এই অজানা, বিজয়ী জাতির প্রতি যে ঘৃণা তাঁরা আগে থেকেই অনুভব করছিলেন, তার সঙ্গে এক ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভয় মিশে গেল।

প্রুশিয়ানরা! তাঁরা কখনো তাদের দেখেননি, কিন্তু প্যারিসের আশপাশে তাদের উপস্থিতি মাসের পর মাস অনুভব করেছেন। অবরোধকারীরা ফ্রান্স ধ্বংস করছে, লুট করছে, হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, তাদের না খাইয়ে মারছে। এই অজানা, বিজয়ী জাতির প্রতি যে ঘৃণা তাঁরা আগে থেকেই অনুভব করছিলেন, তার সঙ্গে এক ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভয় মিশে গেল।

‘ধরো যদি আমরা তাদের কারো সামনে পড়ে যাই?’ মরিসো বললেন।

‘তাহলে আমরা তাদের কিছু মাছ খেতে দেবো,’ মঁসিয়ে সোভাজ উত্তর দিলেন। তাঁর কণ্ঠে সেই চিরপরিচিত প্যারিসীয় আনন্দময়তার ছোঁয়া, যা কোনো কঠিন বাস্তবতাও পুরোপুরি নিভিয়ে দিতে পারে না।

তবুও তারা উন্মুক্ত প্রান্তরে বেরিয়ে আসতে দ্বিধা করলেন, চারপাশের গভীর নিস্তব্ধতা তাদের ওপর এক ধরনের আতঙ্কের ছায়া ফেলেছিল।

অবশেষে মঁসিয়ে সোভাজ সাহসের সঙ্গে বললেন, ‘চলুন, আমরা শুরু করি; তবে সাবধান থাকতে হবে!’

তাঁরা একদম নিচু হয়ে, লতাগুল্মের আড়ালে লুকিয়ে, চোখ-কান খোলা রেখে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আঙুর বাগানের ভেতর দিয়ে এগোতে লাগলেন।

নদীর তীরে পৌঁছানোর আগে তাদের একটি খোলা জমি পার হতে হবে। তাঁরা দৌড়ে সেটি পার হয়ে গেলেন এবং তীরের কাছে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই শুকনো নলখাগড়ার মধ্যে লুকিয়ে পড়লেন।

মরিসো কান পাতলেন মাটিতে, কোনো পদধ্বনি আসছে কি না তা বোঝার জন্য। কিছুই শোনা গেল না। আশপাশে কেউ কোথাও নেই। মনে হলো তারা একেবারে একাকী।

আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন তাঁরা এবং মাছ ধরা শুরু করলেন।

তাদের সামনে নির্জন আইল মারন্ত দ্বীপ, যা তাদের দূরের তীর থেকে আড়াল করে রেখেছে। ছোট্ট রেস্টুরেন্টটি বন্ধ এবং দেখে মনে হচ্ছিল বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত।

মঁসিয়ে সোভাজ প্রথম গজার মাছ ধরলেন, মঁসিয়ে মরিসো ধরলেন দ্বিতীয়টি। প্রায় প্রতি মুহূর্তেই কেউ না কেউ ছিপ তুলে আনছিলেন, যেখানে একটুখানি চকচকে রূপালি মাছ ছটফট করছিল। তাঁরা দারুণ আনন্দ উপভোগ করছিলেন।

ধরা মাছগুলো তাঁরা পায়ের কাছে রাখা একটি সূক্ষ্ম জালের ব্যাগে আলতো করে রেখে দিচ্ছিলেন। আনন্দে মেতে উঠলেন তাঁরা, অতি প্রিয় শখে মগ্ন থাকার এই সুখ তাঁরা বহুদিন হয় হারিয়ে ফেলেছিলেন।

সূর্য তাদের পিঠে উষ্ণ আলো ঢালছিল; তাঁরা আর কিছু শুনতে বা ভাবতে পারছিলেন না। পুরো পৃথিবী ভুলে গিয়ে তাঁরা শুধু মাছ ধরায় মগ্ন ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মাটি কেঁপে উঠল, যেন পৃথিবীর গভীর থেকে কোনো গর্জন উঠছে: কামানের শব্দ আবার তর্জন-গর্জন শুরু করল।

মরিসো মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন, নদীর তীরের ওপারে, বাম দিকে, মন্ট-ভ্যালেরিয়েনের বিশাল ছায়া। তার চূড়া থেকে একগুচ্ছ সাদা ধোঁয়া উড়ছিল।

পরের মুহূর্তেই আরেকটি ধোঁয়ার মেঘ প্রথমটির পিছু নিলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যে নতুন এক বিস্ফোরণ মাটিকে কাঁপিয়ে তুলল। এরপর একের পর এক বিস্ফোরণ হতে থাকল, এবং প্রতি মিনিটে পাহাড় তার প্রাণঘাতী নিশ্বাস ছাড়তে লাগল, সাদা ধোঁয়ার মেঘ ধীরে ধীরে ওপরে উঠে শান্ত আকাশে ভেসে বেড়াতে লাগল।

মঁসিয়ে সোভাজ কাঁধ ঝাঁকালেন।

‘তারা আবার শুরু করল!’ তিনি বললেন।

মরিসো, যিনি তার ভেসে থাকা ছিপের ওপর লক্ষ রাখছিলেন, হঠাৎ এক শান্তিপ্রিয় মানুষের ক্রুদ্ধ অস্থিরতায় ভুগতে লাগলেন তাদের প্রতি, যারা এভাবে উন্মত্তের মতো গুলি চালাচ্ছে। তিনি ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, ‘এভাবে একে অপরকে হত্যার জন্য মরিয়া, কতটা নির্দয়, মূর্খ তারা!’

‘পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট,’ মঁসিয়ে সোভাজ উত্তর দিলেন।

মরিসো, তখন একটি ছোটো মাছ বড়শিতে গেঁথে ফেলেছেন; বললেন, ‘আর ভাবো তো, যতদিন সরকার থাকবে, ততদিন এটাই চলবে!’

‘প্রজাতন্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করত না,’ মঁসিয়ে সোভাজ মন্তব্য করলেন।

মরিসো তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘রাজত্ব থাকলে ভিনদেশের সঙ্গে যুদ্ধ হয়; আর প্রজাতন্ত্র থাকলে গৃহযুদ্ধ।’

তারা দুজন শান্তভাবে রাজনৈতিক সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন, একদম সাধারণ নাগরিকের মতো বাস্তববাদী মনোভাব নিয়ে। একটি বিষয়ে দুজনেই একমত হলেন যে তাঁরা কখনোই সত্যিকার অর্থে মুক্ত হবেন না।

এদিকে মন্ট-ভ্যালেরিয়েন তার গর্জন থামায়নি, কামানের গোলা ফরাসি বাড়িগুলো ধ্বংস করছিল, মানুষের জীবনকে ধূলিসাৎ করছিল, বহু স্বপ্ন, বহু আকাঙ্ক্ষা, বহু ভবিষ্যৎ সুখ ভেঙে দিচ্ছিল; নির্মমভাবে স্ত্রী, কন্যা, মায়েদের হৃদয়ে সীমাহীন দুঃখ ও কষ্ট তৈরি করছিল।

‘জীবনই এমন!’ মঁসিয়ে সোভাজ বললেন।

‘বরং বলুন, মৃত্যুই এমন!’ হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন মরিসো ।

কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে পায়ের শব্দ শুনে তাঁরা আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন। ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন, খুব কাছেই চারজন লম্বা, দাড়িওয়ালা পুরুষ। তাদের পরনের পোশাক ভৃত্যদের মতো এবং মাথায় চ্যাপ্টা টুপি। তারা মাছ শিকারি দুজনের দিকে রাইফেল তাক করে রেখেছিল।

ছিপগুলো দুজনের হাত থেকে পিছলে নদীতে ভেসে গেল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুইবন্ধুকে ধরে ফেলা হলো, বেঁধে ফেলা হলো এবং একটি নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হলো ইল মারন্ত দ্বীপে। যে বাড়িটিকে তাঁরা পরিত্যক্ত ভেবেছিলেন, তার পেছনে প্রায় বিশজন জার্মান সৈনিকের দেখা মিলল।

একটি চেয়ারে দুই পা ঝুলিয়ে বসা, এলোমেলো চুলওয়ালা এক দৈত্যের মতো লোক, যার মুখে লম্বা মাটির পাইপ, চমৎকার ফরাসি ভাষায় তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘তাহলে, ভদ্রলোকদ্বয়, মৎস শিকার কেমন কেটেছে?’

এক সৈনিক তাদের ধরা মাছভরতি ব্যাগটি দৈত্যরূপী অফিসারের পায়ের কাছে এনে রাখলো, যা সে যত্ন করে নিয়ে এসেছিল। প্রুশিয়ান অফিসার মুচকি হাসলেন।

শোনো, তবে ভয় পেয়ো না, আমার দৃষ্টিতে, তোমরা দুইজনই গুপ্তচর, আমাকে এবং আমার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে এসেছো। স্বাভাবিকভাবেই তাই আমি তোমাদের ধরেছি এবং দণ্ড হিসেবে গুলি করব। আদতে তোমরা মাছ ধরার ভান ধরেছো নিজেদের আসল কাজ ঢাকতে।

‘মন্দ নয়, দেখছি। তবে আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে হবে। শোনো, তবে ভয় পেয়ো না, আমার দৃষ্টিতে, তোমরা দুইজনই গুপ্তচর, আমাকে এবং আমার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে এসেছো। স্বাভাবিকভাবেই তাই আমি তোমাদের ধরেছি এবং দণ্ড হিসেবে গুলি করব। আদতে তোমরা মাছ ধরার ভান ধরেছো নিজেদের আসল কাজ ঢাকতে। এখন তোমরা আমার হাতে পাকড়াও হয়েছ, এবং তার ফল তোমাদের ভোগ করতে হবে। যুদ্ধ এমনই।’

‘যেহেতু তোমরা আউটপোস্ট পার হয়ে এখানে এসেছ, তোমাদের ফেরার জন্য কোনো পাসওয়ার্ড থাকতেই হবে। আমাকে সেই পাসওয়ার্ড বলে দাও, তাহলে তোমাদের ছেড়ে দেবো।’

দুই বন্ধু মৃতের মতো ফ্যাকাসে মুখে একসঙ্গে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাদের হাতের সামান্য কম্পনই শুধু তাদের ভীতির প্রমাণ দিচ্ছিল।

‘কেউ কিছুই জানতে পারবে না,’ অফিসার বলে চললেন। ‘তোমরা শান্তিতে তোমাদের বাড়ি ফিরে যাবে, আর গোপন কথাটি তোমাদের সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে। আর যদি না বলো, তবে তার মানে মৃত্যু, তাৎক্ষণিক মৃত্যু। বেছে নাও!’

তারা স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন, মুখে কোনো কথা নেই।

প্রুশিয়ান অফিসারটি খুব শান্তভাবে নদীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘একবার ভাবো, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তোমরা এই নদীর তলায় থাকবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই! তোমাদের আত্মীয়-স্বজন আছে নিশ্চয়ই?’

মন্ট-ভ্যালেরিয়েন তখনও গর্জন করে চলেছে।

মৎস্য শিকারি দুজন নীরবই রইলেন। জার্মান অফিসার ঘুরে নিজের ভাষায় একটি নির্দেশ দিলেন। এরপর কিছুটা দূরে সরে চেয়ারে বসলেন, যাতে বন্দিদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পারেন।

এক ডজন সৈনিক সামনে এগিয়ে এলো, রাইফেল হাতে, এবং বিশ কদম দূরে অবস্থান নিলো।

‘তোমাদের এক মিনিট দিচ্ছি,’ অফিসার বললেন, ‘আর এক মুহূর্তও নয়।’

এরপর তিনি দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন, মরিসোর কাছে গিয়ে তাঁকে হাত ধরে কিছুটা দূরে নিয়ে গেলেন এবং নিচু গলায় বললেন, ‘তাড়াতাড়ি! পাসওয়ার্ড বলো! তোমার বন্ধু কিছুই জানতে পারবে না। আমি ভান করব যে মনের পরিবর্তন করেছি।’

মরিসো একটিও কথা বললেন না।

এরপর প্রুশিয়ান অফিসার মঁসিয়ে সোভাজকে একইভাবে একপাশে নিয়ে গেলেন এবং একই প্রস্তাব দিলেন।

মঁসিয়ে সোভাজও কোনো উত্তর দিলেন না।

আবার তাদের পাশাপাশি দাঁড় করানো হলো।

অফিসার আদেশ দিলেন; সৈন্যরা তাদের রাইফেল উঁচু করল।

তখন হঠাৎ ঘাসের ওপর পড়ে থাকা গজার মাছভরতি ব্যাগটির দিকে মরিসোর চোখ পড়ল, তাদের থেকে কয়েক ফুট দূরে সেটি পড়ে ছিল। সূর্যের একটি তীর্যক রশ্মি মাছগুলোকে রূপোর মতো চকচকে করে তুলেছে। দৃশ্যটা দেখে মরিসোর হৃদয় ভেঙে গেল। নিজেকে সামলানোর সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর চোখে জল এলো।

‘বিদায়, মঁসিয়ে সোভাজ,’ অস্ফুটভাবে শেষবার তিনি বন্ধুকে সম্ভাষণ জানালেন।

‘বিদায়, মঁসিয়ে মরিসো,’ উত্তর দিলেন সোভাজ

তাঁরা হাত মেলালেন, পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপছিলেন দুজনই, এমন এক ভয়ে যা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

অফিসার চিৎকার করলেন, ‘গুলি করো!’

বারোটি গুলি একসঙ্গে চলল।

মঁসিয়ে সোভাজ মুহূর্তেই সামনের দিকে লুটিয়ে পড়লেন। মরিসো, যিনি লম্বা ছিলেন, সামান্য দুললেন এবং তাঁর বন্ধুর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, মুখ আকাশের দিকে, কোটের বুকের কাছটায় রক্তের ছোপ।

জার্মান অফিসার নতুন নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলো দড়ি এবং বড়ো পাথর নিয়ে। তারা দুই বন্ধুর পায়ে সেগুলো বেঁধে নদীর তীরে নিয়ে গেল। মন্ট-ভ্যালেরিয়েন, যার চূড়া তখন ধোঁয়ায় ঢাকা, গর্জন করে চলল।

দুজন সৈনিক মরিসোর মাথা এবং পা ধরল; অন্য দুজন সোভাজের শরীরটা একইভাবে ধরল। শক্ত হাতে দোল দিয়ে তাদের নদীতে ছুড়ে ফেলা হলো। দুটো দেহ বৃত্তাকারে উড়ে পায়ের দিকটা আগে নদীতে গিয়ে পড়ল।

পানি ওপরে ছিটকে উঠল, ফেনা হলো, ঘূর্ণি তৈরি হলো, তারপর শান্ত হয়ে গেল; ছোটো ছোটো ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পড়ল।

নদীর বুকে রক্তের চিহ্ন ফুটে উঠল।

অফিসার, যিনি শুরু থেকে শান্ত ছিলেন, স্মিত হেসে বললেন; ‘এবার মাছদের পালা!’

এরপর তিনি বাড়ির দিকে এগোলেন।

হঠাৎ তাঁর নজর পড়ল ঘাসের ওপর পড়ে থাকা মাছভরতি জালের দিকে। তিনি সেটি তুলে নিয়ে দেখলেন, হাসলেন এবং চিৎকার করে ডাকলেন, ‘ভিলহেম!’

একজন সাদা অ্যাপ্রোন পরা সৈনিক তাঁর ডাকে সাড়া দিলো। প্রুশিয়ান, দুই নিহত মানুষের ধরা মাছ তার দিকে ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘এই মাছগুলো এক্ষুনি ভাজো, যতক্ষণ ওরা লাফাচ্ছে, দারুণ স্বাদ হবে!’

এরপর তিনি তাঁর পাইপে আবার আগুন ধরালেন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ঢাকায়। বর্তমান আবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মূলত একজন গল্পকার এবং অনুবাদক। পাশাপাশি প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র-সাহিত্য সমালোচনা লিখে থাকেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭টি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।