রবিবার, এপ্রিল ২৮

মাহমুদ দারবিশের তিনটি প্রেমের কবিতা : ভূমিকা ও ভাষান্তর : শাহেদ কায়েস

0
Mahmud Darbish

মাহমুদ দারবিশ (১৩ মার্চ, ১৯৪১—৯ আগস্ট, ২০০৮ খ্রি.)

ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের জন্ম ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ ফিলিস্তিনের গালিলি প্রদেশের বন্দরনগরী অ্যাকারের কাছে আল-বিরওয়া গ্রামে। তাঁর কবিতায় হাতেখড়ি স্কুল জীবনে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের সময় ইজরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের গ্রাম দখল করে নেয়। সেই সময় সপরিবারে পালিয়ে যান লেবাননে। তখন তাঁর বয়স মাত্র সাত। সেই যে উদ্বাস্তু জীবনের শুরু, এরপর মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য দেশে ফিরে এসেছেন, কিন্তু প্রায় সারা জীবনই দেশছাড়া থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। উদ্বাস্তু জীবন থেকে একবার দেশে ফিরে এসে দারবিশ তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করতে যেয়ে লিখেছেন: ‘এক রাতে আমার চাচা এবং একজন পথপ্রদর্শকের সাথে লেবাননের সীমান্ত দিয়ে আমি প্রবেশ করলাম ফিলিস্তিনে। সকালে উঠে দেখি আমি একটি ইস্পাতের দেয়ালের মুখোমুখি : আমি ফিলিস্তিনে। কিন্তু কোথায় আমার ফিলিস্তিন? আমি কখনো আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার গ্রাম বিধ্বস্ত-ভস্ম।’ তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও কবিতার জন্য গৃহবন্দি ছিলেন, জেল খেটেছেন অনেকবার। ১৯৬১, ১৯৬৫, ১৯৬৭ তে তিনি তিনবার জেলে গিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো, মিশরের কায়রো, লেবাননের বৈরুত, সিরিয়ার দামেস্ক, তিউনিসিয়া, ফ্রান্সের প্যারিস, জর্ডানের আম্মানে উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছেন তিনি। সারা জীবন কবি স্বপ্ন দেখেছেন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের।

তাঁর প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা ৩০টি, গদ্যের বই ৮টি। আরবি ভাষায় লিখতেন তিনি। তবে ইংরেজি, ফরাসি এবং হিব্রু ভাষাতেও ভালো দখল ছিল তাঁর। মাহমুদ দারবিশের সাহিত্যকর্ম আরব বিশ্বের বাইরেও সমগ্র দুনিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়। তাঁর সাহিত্য কর্ম ২৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষাতে অনূদিত হয়েছে তাঁর ২০টি গ্রন্থ। ফ্রান্সে বরাবরই বেস্ট সেলারের তালিকায় থাকত তাঁর প্রকাশিত বই।

সাহিত্য জগতে তাঁকে আরব বিশ্বের কণ্ঠস্বর বলা হয়। সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন লোটাস প্রাইজ ফর লিটারেচার, লেনিন পিস প্রাইজ, দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর অ্যারাবিক পোয়েট্রি প্রাইজসহ আরো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার।

মাহমুদ দারবিশের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ইজরায়েলের ইহুদি তরুণী তামার বেন-অমি’র (Tamar Ben-Ami) সঙ্গে। প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে এক সময় তিনি লিখেছিলেন ‘আমি আমার জাতির সঙ্গে বেঈমানি করে, আমার শহর এবং তার পরাধীনতা-শৃঙ্খলের বেদনা ভুলে গিয়ে হলেও তোমাকে ভালোবাসি।’ পরবর্তীতে তিনিই আবার লিখেছিলেন— ‘যে প্রেম তোমার কাছে কিছুই ছিল না, সেটাই আমার কাছে ছিল আমার অস্তিত্ব।’ মাহমুদ দারবিশ যখন জানতে পারলেন তাঁর প্রেমিকা ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর হয়ে কাজ করছেন, লিখলেন বিখ্যাত সেই কবিতা ‘রিটা অ্যান্ড দ্য রাইফেল’। ২০০৮ সালের ৯ আগস্ট কবি পাড়ি জমান অনন্তলোকে। দারবিশ বেঁচে আছেন তাঁর সৃষ্টিতে, তাঁর কবিতায়, হাজারও বিপ্লবী ফিলিস্তিনির অনুপ্রেরণা হয়ে।

ভূমিকা এবং ‘রিটা অ্যান্ড দ্য রাইফেল’ কবিতার ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ: শাহেদ কায়েস। কবিতা তিনটির আরবি ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষার অনুবাদক ফিলিস্তিনি-আমেরিকান কবি ও অনুবাদক Fady Joudah. Source: The Butterfly’s Burden (Copper Canyon Press, 2007)


Rita and the Rifle
রিতা এবং রাইফেল


রিতা আর আমার চোখের মাঝখানে—
……………………………দাঁড়িয়ে আছে একটা রাইফেল

রিতাকে যে দেখেছে, সে-ই মুগ্ধ হয়েছে—
তাঁর মধুময় চোখের অলৌক সৌন্দর্যের স্পর্শে

যখন সে ভরা যৌবনা যুবতী—
আমি তাঁর ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়েছিলাম
কেমন করে যে হেঁটে আসত সে!
এখনো আমার স্মৃতিতে ভাসছে সেই দৃশ্য…

কীভাবে আমার প্রেমময় হাত স্পর্শ করত
………………………….তাঁর চুলের বিনুনি!
আমার কেবলই রিতার কথা মনে পড়ে—
যেভাবে একটি চড়ুই প্রবাহের কথা মনে রাখে

আহ, রিতা!
আমাদের মাঝে উড়ছে—
……………..এক মিলিয়ন চড়ুই ও প্রতিমা
স্থির হয়ে আছে অসংখ্য অভিসারের চিহ্ন
………………….রাইফেল থেকে ছোঁড়া গুলি…

যখনই ‘রিতা’ রিতা’ বলে ডেকে উঠতাম—
অনুভবে আসত সুস্বাদু ভোজের স্বাদ…
রিতার দেহ আমার রক্তে জাগাত উৎসব

দু-বছর আমি হারিয়ে ছিলাম তাঁর গভীরে
এবং দু-বছর সে আমার বাহু জড়িয়ে ছিল
আমরা নিজেদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম…
সৌন্দর্যের সেই পানীয়তে মত্ত হয়ে—
আমরা আমাদের ঠোঁটের মদে পুড়েছি
এবং বারবার আমাদের হয়েছে নবজন্ম

আহ, রিতা!
এই রাইফেল কী তোমার থেকে—
…………………..আমার চোখ ফেরাতে পারে!
চোখ লেগে আসা দু-একটা মুহূর্ত—
……………………কিংবা মধু-রং মেঘ ছাড়া?
সেই যে সময়—
আহা, সন্ধ্যার নীরবতা…

সকালে আমার চাঁদ অনেক দূরে চলে গেল
মধুমাখা সেই চোখ দুটির দিকে—
এবং শহর সমস্ত গায়কদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল
আর তুমি…
রিতা আর আমার চোখের মাঝখানে—
…………………………..রয়ে গেল একটা রাইফেল।


Rita’s Winter
গেল শীতে রিতা


রিতা ফিরে আসে—
তাকিয়ে আছে তোমার ভিনেগার-রং জামার বোতাম
বললে, ‘তুমি কি আমার?
বললাম— হ্যাঁ, আমি তোমার, যদি তুমি অতীতের—
দিকে খুলে রাখো বাতায়ন,
এমন একটি অতীত যেন আমি মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছি—
তোমার অনুপস্থিতি থেকে

এই গোলকধাঁধা সময়ে স্মৃতি খোলার অহেতু হল্লা
সেই যে অতীত— যা আমি এখন নির্জন টেবিলের
………………………..মতো নিজের কাছে বসে দেখতে পাচ্ছি

লবণাক্ত মধু, শিশির, এবং আদার ঝাঁজ
সাবানের গলে যাওয়া দেখতে দেখতে—
বিস্মিত রিতার দু-চোখে জিজ্ঞাসা: কেন এই সমভূমি!
পাথুরে স্বপ্নের খাঁজে-খাঁজে ঝরনার জল
আর তোমার দিকে বয়ে যাওয়া গান, যদি চাও—
………………………………..এই নাও গান আর বিস্ময়

আমি জন্মেছি শুধুই তোমাকে ভালোবাসবো বলে
একটি ঘোড়া বেগানা ছুটে বেড়াচ্ছে বনে-বনে
প্রবালের মধ্যে নিজের অজানাকে আঁকড়ে ধরে
জন্মেছি প্রকৃতি হয়ে— আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল
আমি তোমার গ্লাসে ঢেলে দেবো প্রেমের মদিরা…
সম্পূর্ণভাবে নিজেকে তোমার মাঝে দিয়েছি সঁপে
নিজেকে নিরাময় করো— এসো দয়িতা, এসো
ভালোবাসো আমাকে তোমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে

আমি জন্মেছি শুধুই তোমাকে ভালোবাসবো বলে
আমার মাকে রেখে এসেছি প্রাচীন সেই কুটিরে
তোমার স্বজন আর বিশ্বকে অভিশাপ দিয়ে—
নগর রক্ষীদের দেখেছি কী নিষ্ঠুরভাবে আগুনে
ছুঁড়ে দিতে তোমার-আমার নিষ্পাপ প্রেমকে…
আমি জন্মেছি শুধুই তোমাকে ভালোবাসবো বলে।


It Is Night and She Is Lonely
রাত্রি আর একাকী সে


এখন বেশ রাত আর সে একা
আর আমিও তার মতো একা।
শীতের এই রেস্তোরাঁয়—
আমাদের দুজনের মাঝে মোমের আলোয়
……………………পড়ে আছে দুটি শূন্য টেবিল।
মাঝের নীরবতাকে বিরক্ত করছে না কোনো কিছুই
নিজের গভীরে সে এমনই ডুবে ছিল যে—
যখন আমি তাঁর স্তন থেকে গোলাপ তোলা দেখে ফেলি
সে আমাকে লক্ষই করেনি
এবং আমিও তাঁকে লক্ষ করিনি
মদে চুমুক দেয়ার সময়ে যখন সে—
আমার দিকে গোপনে তাকায়;
পড়ে আছে ব্রেড, ডিনারে মন নেই—
চুপচাপ বসে আছি, ছলকে পড়ে না জল টেবিলক্লথে

কোনো কিছুই আমাদের মাঝে প্রশান্তিকে বিরক্ত করছে না
সে একা এবং আমি তাঁর সৌন্দর্যে মগ্ন হয়ে একার সন্ন্যাসে…
মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছে কেন যে কোনো দুর্বলতা আমাদের
মাঝের নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে না! আমার মন তো চাচ্ছে—
খানখান করে ভেঙে ফেলি এই নীরবতা; নিজেকে প্রশ্ন করি:
কেন আমি হাত বাড়িয়ে তাঁর মদের গ্লাসে চুমুক দিই না?
তাঁর পায়ের সঙ্গে পা যুক্ত করে বসে থাকা যে আমি দেখে
ফেলেছি— সে তো তা লক্ষই করেনি; আর আমিও তাকে
আমার দিকে তাকাতে দেখিনি যখন আমি খুলে ফেলেছি—
আমার কোট; আমার কিছুই তাকে বিরক্ত করছে না,
তাঁর কিছুই আমাকে বিরক্ত করছে না—
……………………………আমরা আছি বিস্মৃতির সম্প্রীতিতে

টেবিলে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে আমাদের সুস্বাদু নৈশভোজ
দুজনেই আমরা নিজেদের মতো করে চুপচাপ—
কিন্তু যখনই ভেসে আসে নীলকণ্ঠী রাতের সুর
তখন আমরা আর সঙ্গীহীন নই, আমাদের কানে
দূরের ম্যাডোস থেকে ভেসে আসে মধুর সুরে গান

কোনো কিছুই আমাদের এই যৌথ রাতকে আর
বিরক্ত করছে না; সে-ও এখন আর বলছে না
প্রেম জন্ম নেয় জীবিত প্রাণীদের মনে; এবং—
ধীরে-ধীরে একটি অলৌক ধারণার জন্ম দেয়
এবং আমিও কী বলছি তা! বিষয়টা রহস্যময়
আমি বলছি না:
ভালোবাসা একটি ধারণায় পরিণত হয়েছে
………………………..কিন্তু এখন তো তাই মনে হচ্ছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মূলত কবি। জন্ম ঢাকায়, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০। পৈতৃক নিবাস, সোনারগাঁয়ের ললাটি গ্রামে। পড়াশুনা কম্পিউটার বিজ্ঞানে, দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই; এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে, চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘হিউম্যান রাইটস’ বিষয়ে মাস্টার্স। কবিতায় হাতেখড়ি নব্বই দশকের শুরুতে। থাকেন নিজ গ্রাম সোনারগাঁয়। পেশা ফ্রি-ল্যান্স গবেষক। তিনি একজন মুক্ত-চিন্তক, সংস্কৃতিকর্মী, কাজ করেন মানুষের অধিকার নিয়ে। শখ ভ্রমণ, সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান দেশ-বিদেশ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা’ (দোয়েল প্রকাশনী, ১৯৯৯) ‘চূড়ায় হারানো কণ্ঠ’ (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩), ‘মায়াদ্বীপ’ (ঐতিহ্য, ২০১৫), ‘কৃষক ও কবির সেমিনার’ (অভিযান, ২০২০), ‘সহজিয়া প্রেমের কবিতা’ (অভিযান, ২০২১), ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’ (চৈতন্য, ২০২৩), ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ (ভাষাচিত্র, ২০২৩)। সম্পাদিত গ্রন্থ: ‘মঙ্গলসন্ধ্যা প্রেমের কবিতা’ (ধ্রুবপদ, ২০১৭)। অন্যান্য গ্রন্থ: ‘এশিয়ার বারটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ (ইংরেজি গ্রন্থ, মে এইটিন মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, দক্ষিণ কোরিয়া, ২০১৫), ‘বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণগ্রন্থ’ (ঐতিহ্য, একুশে বইমেলা, ২০২০)। পুরস্কার ও সম্মাননা: ‘চন্দ্রাবতী সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’ (কবিতায়, ২০২১), শালুক সম্মাননা (২০১৯)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।