রবিবার, ডিসেম্বর ১

টোকন ঠাকুরের ধারাবাহিক : জার্নি অব কাঁটা : ৭ম পর্ব

0

বসন্ত কুমার দাস রোডে, বুড়িগঙ্গা তীরের বাড়িটির বয়স ২৭৮ বছর, ২০১৭ সালে। ফরাসগঞ্জের সেই জরাজীর্ণ বাড়ির প্রায় পরিত্যাক্ত এক অংশে আমি ভাড়াইট্টা ছিলাম, নির্মাণাধীন একটি ছবির জন্য। ওখানে আমাকে রান্না করে দিত প্রথমে গজেন’দা, পরে মোহাম্মদ সেলিম। পহেলা জুলাই বৃষ্টির দিনে আমি চলে আসি মগবাজার। মগবাজারের বাসাটি ছিল একদম নতুন, খুবই চকচকে। সম্ভবত নির্মাণের পরে সেই বাসায় আমিই প্রথম ভাড়াটিয়া হয়ে উঠলাম, মগবাজার চেয়ারম্যান গলিতে। পরিপাটি একটি ফ্ল্যাট। ফরাসগঞ্জ থেকে মগবাজার, একদম রিভার্স বাসা কন্ডিশন। একটা প্রায় পরিত্যাক্ত, প্রাচীন; আরেকটি একদম নতুন, চকচকে। তবু আমার মনে ফরাসগঞ্জ বা বুড়িগঙ্গার জন্য মায়া জড়িয়ে থাকল। থাকলেও, ক্রমশ সামনে এগিয়ে যাওয়াই যেহেতু জীবন কিংবা জীবন এগিয়ে যাবেই যদি অন্ধকার থাকে; যদি সুড়ঙ্গ থাকে সামনে সেই সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়েই। গত কালকের দিনটা তো আমরা পার করে ফেলেছি। কোনোভাবেই আর ফিরিয়ে আনা যাবে না গত কালকের রাত। গত হয়ে যাওয়া এই একটি মিনিট, যখন আমি লিখছি এবং আপনি পড়ছেন, লিখতে লিখতেই গত হয়ে যাচ্ছে, যায়। আপনার পড়তে পড়তেই গত হয়ে যাচ্ছে, যায়। কেউ কিছুতেই আর গত মুহূর্তটি ফেরাতে পারে না, পারবে না। ভবিষ্যৎ আমরা দেখিনি, দেখতে পাই না। ভবিষ্যৎ তো ভবিষ্যতেই থাকে বলে তাকে আমরা বলি ভবিষ্যৎ। আর যে মুহূর্ত পার হয়ে যায়, যে দিন আমরা পার করি রোজ, সেই মুহূর্তকে ঠিক দেখা যায় না। গত মুহূর্তটি এখন অতীত, অতীতকে তো শুধু স্মরণ করা সম্ভব, প্রকাশ্য করা সম্ভব না। ধরা যাক, এই যে কথা বলছি আপনার সঙ্গে, এই মুহূর্তটি বর্তমান।


apuder bari

অপুদের বাড়ি। এই বাড়ির ভেতরে আছে সেই হিডেন জোন, যেখানে আমি ছিলাম


কথা বলতে বলতেই দেখি, মুহূর্তটি গত হয়ে যাচ্ছে। চলমান দিনটি অতীত হয়ে যাচ্ছে। সময় যেন-বা এক হায়ারোগ্লিফিক পাণ্ডুলিপি। কবি বলেছেন, ‘সময়, সবুজ ডাইনি’। আবার কেউ কেউ ভাবেন, সময়কে দেখা যায়। সময় দেখতে একদম ঈশ্বরের মতো! ঈশ্বর দেখতে কেমন? ঈশ্বরকে কি দেখা যায়? না, যায় না। সময়ও দেখা যায় না। সময়কেও দেখা যায় না। কেউ কেউ ভাবেন, ঈশ্বর একটা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা প্রবাহ। কেউ কেউ ভাবেন, কত কিছুই তো ভাবেন। কে কি ভাবেন, তা ভেবে আমার কী হবে? আমি ভাবছি কাঁটার কথা। আমি ভাবছি একটি সিনেমার কথা। আমি একটি জার্নির মধ্যে আছি। নির্মাণের স্বপ্ন মাথায় যেমন, এই প্রোজেক্ট আমি নিজেই প্রযোজনা করব, সেই সিদ্ধান্তও স্থির হয়ে গেছে। বাজারের নটনটী দিয়ে এই প্রোজেক্টর পাত্রপাত্রী করা যাবে না, তাও বুঝে গেছি। এমন কি নির্মাণ সহকারী প্রশ্নেও আমি এই প্রোজেক্টে বাজার নির্ভরতা এড়িয়েই ছবিটি বানাব, সিদ্ধান্ত পাকা। আর কাঁটা ছবিতেও সময় নিয়ে খেলা আছে। সেই সময়-ক্রীড়া ক্রিস্টোফার নোলানের ক্রীড়া নয়, এটি জনাব শহীদুল জহিরের খেলা। সেই খেলা ধরার চেষ্টা করেছি আমরা। যদ্দুর আমি ভাবতে পেরেছি, তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছি। শিক্ষানবিশ সহকারীদেরও অডিশন নিয়ে তাদের আগে কাজ শিখিয়েছি। তারপর তাদের নিয়েই আমি কাঁটা করেছি। সহকারীরা সম্যক অভিজ্ঞ ছিল না, এতে করে প্রোডাকশন পিরিয়ডে আমার যথার্থ প্রাপ্তিতে যা কম হলো, তা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমার এই না পারার ব্যথা একান্তই আমার। কেউ ভাগ নেবে না। তো, যা বলছিলাম, সময়। সময়ের কথা। কাঁটাও একটি সময়-সংক্রান্ত গোলকধাঁধার গল্প। অতীত, বর্তমানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতে প্রবিষ্ট হয়; কাঁটা ছবিতে ভবিষ্যৎ, বর্তমানের ভেতর দিয়ে অতীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়। এই ব্যাপারটাই ঘনীভূত করে গল্পচ্ছলে জাল মেলে ধরেছেন জনাব শহীদুল জহির। আমি সেই গল্পের জালে ঢুকতে চেয়েছি। এবং একটি পরিষ্কার লক্ষমাত্রা আমার, দর্শককে কাঁটা গল্পের জালে আটকে ফেলতে চাই।

ফরাসগঞ্জ এমন একটি এলাকা, যা আমি ফিরে ফিরে দেখব বাকি জীবন। হয়তো চাইলেও আর এরকম মাত্রার জীবন আমার পক্ষে নতুন করে আর পার করা সম্ভব নয়। আমার পিরিওডিক্যাল ছবি বানানোর ইচ্ছা হয়তো আর সহজে হবে না। অবশ্য জীবন এমন, এক কাজ তো দুইবার করাও যায় না। একেকটি কাজ একদিন শুরু হয়ে একদিন শেষও হয়ে যায়। সেই কাজ করার মুহূর্ত বা চলমান দিন আর স্থির থাকে না। অর্থাৎ সময় দাঁড়িয়ে থাকে না। সময় বয়ে যায়। কোথায় যায়? সময় কি ভূতের গলির দিকে যায়? পৃথিবীতে ভূতের গলি কোন দিকে? শহর ঢাকার আদি এলাকায় কোন দিকে আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি? আজিজ ব্যাপারী কেমন মানুষ? এত বড়ো একটা বাড়িতে তিনি একাই থাকেন? কেন? বিয়ে-থা করেননি আজিজ ব্যাপারী? কাঁটা গল্পের ওয়ান অব দ্য লিড প্রোটাগনিস্ট বাড়িওয়ালা আবদুল আজিজ ব্যাপারী যেমন অকৃতদার, কাঁটা গল্পের লেখক শহীদুল জহিরও ছিলেন অকৃতদার। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ২০০৮ সালে আকস্মিক মারা গেলেন জনাব জহির। ভূতের গলির কথক শহীদুল জহিরের অন্যান্য গল্পেও আমরা এরকম সিঙ্গেল কি-ক্যারেক্টার দেখেছি। আবদুস সাত্তার, আবদুল ওয়াহিদ, আবদুল করিম—এরা সিঙ্গেল। ৩৬ ভূতের গলির বাড়িওয়ালা আবদুল আজিজ ব্যাপারী সিঙ্গেল হলেও তার একজন ছুটা বুয়া আছে, নাম নিজামের মা। ব্যাপারীর বক্তব্য শুনি আমরা, ‘নিজামের মার ঠিল্লার পানি খাইয়া বাইচা আছি মিয়া!’ এছাড়াও ব্যাপারীর বাড়িতে আছে এক ভাড়াটিয়া দম্পতি। সেই দম্পতির নামই সুবোধচন্দ্র দাস ও স্বপ্নারানী দাস। একটি পাতকুয়া আছে ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে। আছে একটি মহিলা বিড়াল, আছে ছাদের কোনায় খোপখোপ ঘরভর্তি একঝাঁক কবুতর। উঠোনের শেষে পাঁচিল ঘেঁষে এক ধরনের ‘জঙ্গল-মঙ্গল হইছে।’ সেই জংলার ভেতরে আছে পাতাবাহার, কচু, পেয়ারা গাছ ও ‘এমতে এমতে হয়া যাওয়া’ বিবিধ লতাপাতা-ঘাস। বিড়ালটা দৌড়ে যায় সেই ঘাসের জংলায়। কচুর পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে বিড়ালটি হাঁটতে হাঁটতে পাতকুয়ার ওদিকে যায়। বিড়াল হাঁটে তুলসীগাছের পাশ দিয়ে। তুলসীগাছ কেন আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে? আমরা নিশ্চিত, সেই তুলসীগাছ লাগিয়েছে সুবোধের বউ স্বপ্না। এতে করে কি আজিজ ব্যাপারীর কোনো সমস্যা আছে? না, তা তো আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু মহল্লাবাসীদের সমস্যা আছে—আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে কেন তুলসীগাছ বাতাসে দোল খায়? একদা এ বাড়িতে তুলসীগাছ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের লোকাল মিত্র শান্তি কমিটির নেতা বা রাজাকাদের কাছেও।


forasgonjer sei bari 1

ফরাসগঞ্জের বাসার উঠোনে


যাই হোক, আমার দরকার ছিল এরকম একটা বাড়ি, যে বাড়ির বয়স হবে একশো বছরের অধিক—সেই বাড়ি আমি তখনো খুঁজে পাইনি। ফরাসগঞ্জের দিনগুলোতে লেখক বুলবুল চৌধুরীর বন্ধু ফরিদাবাদ গোসাইবাড়ির মোজাম্মেল ভাই ওরকম বাড়ির সন্ধানে আমাকে অনেক বাড়িতেই নিয়ে গেছেন। অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান কালীচরণ সাহা লেনে ওরকম বাড়ির সন্ধানে নিজে থেকেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। একজন আমাকে বলেছিল, মুনশিগঞ্জে গেলে পাবা। একদিন মুনশিগঞ্জে গেলাম কয়েকজনের একটি টিম নিয়ে। পাইনি। কেউ একজন বলছিল, মানিকগঞ্জে গেলে পাবা। সেই বাড়িও নাকি শতবর্ষী এবং সেই বাড়ির উঠোনেও একটা কুয়া আছে, ছবিতে দেখেছি। কিন্তু কুয়া থাকলেই তো হলো না। কুয়া ভাঙা হবে গল্পের দাবিতে। কোন বাড়িওয়ালা শুটিংয়ের জন্য তার প্রাচীন বাড়িটি ভাড়া দিয়ে উঠোনের কুয়া ভাঙতে দেবে? ওরকম একটি কুয়া থাকা বাড়ির সন্ধানে পুরান ঢাকায় আমাকে নিয়ে কয়েকটি বাড়ি দেখিয়েছে নারিন্দার বাসিন্দা শিল্পী শিবু কুমার শীল। আর্টিস্ট জয়দেব দেখিয়েছে কিছু বাড়ি। আমি নিজেও কিছু বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখে বেড়িয়েছি। পাইনি। পাইনি, পারিনি—এমন কথা সিনেমা নির্মাতার জন্য উপরের নির্দেশে ভাবা নিষেধ আছে। ভাবলে, দর্শক স্যাংশন দিয়ে দেবে। তাই আমকেও বাড়িটি খুঁজে পেতে হবে। তাহলে কোথায় পাব কুয়া থাকা একটি মাটির উঠোনওয়ালা শতবর্ষী বাড়ি?

বালিকার বুকে র‍্যাবোর কবিতা। টি-শার্টে ছাপানো। আমি কি কবিতা পড়ব বালিকার বুকে? কী করব আমি? অস্থির হয়ে পড়ছি। এক বাল্যকাল পার করেছি যখন, তখনো কি এরকম কোনো বালিকার মুখ আমি মনে মনে দেখিনি? যখন কলেজের দিন গেছে, তখনো? যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে গেছি, খুঁজিনি আমি মনে মনে এরকম কোনো বালিকাকে, যার বুকে তরুণ কবির কবিতা ছাপানো থাকে? এখনো কি খুঁজছি না, কবিতা পড়ব বলে সেই বালিকার বুক?

এক আঙুর বিক্রেতা বালিকার নাম রীতা। হতে পারে রিটা। আঙুর ছেঁচে পাওয়া রস পচিয়ে বানানো হয়েছে ওয়াইন। বালিকা আমাকে সেই ওয়াইন পান করতে ইনসিস্ট করছে। আমি কী করব? তাকিয়ে দেখি, বালিকা একটি টি-শার্ট পরে আছে। আমি বালিকার বুকের দিকে তাকাই। দেখতে পাই, বালিকার বুকে র‍্যাবোর কবিতা। টি-শার্টে ছাপানো। আমি কি কবিতা পড়ব বালিকার বুকে? কী করব আমি? অস্থির হয়ে পড়ছি। এক বাল্যকাল পার করেছি যখন, তখনো কি এরকম কোনো বালিকার মুখ আমি মনে মনে দেখিনি? যখন কলেজের দিন গেছে, তখনো? যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে গেছি, খুঁজিনি আমি মনে মনে এরকম কোনো বালিকাকে, যার বুকে তরুণ কবির কবিতা ছাপানো থাকে? এখনো কি খুঁজছি না, কবিতা পড়ব বলে সেই বালিকার বুক? আমি জানি, সেই ঐশী রঙের বালিকাও জানে, তার হাতে ঢেলে দেওয়া ওয়াইন পান করতে করতেই একদিন আমি ঘুমিয়ে পড়ব। হয়তো এক মৌসুম ঘুমিয়েই থাকব। হয়তো আমার ঘুম ভাঙাবে অশিক্ষিত কোনো কোকিল। আমি কি কোকিলকে কিছু বলব? কোকিলের ওপর রাগ দেখিয়ে একবেলা উপোস থাকব? অবশ্য আমি তখন বালিকার সম্মুখে বসে কি বাকি পৃথিবীকে বেমালুম ভুলে যাব না? অপুদের বাড়িতে আমার ভালো ঘুম হতো না। অপুদের বাড়ি ফরাসগঞ্জ। ওখানে ফরাসিরা ছিল একদা, তাই ফরাসগঞ্জ নামায়ণ। অপুদের বাড়ির অপজিটের গলির নাম উল্টিনগঞ্জ। জনাব উল্টিন ছিলেন আদিনীন্তন ফরাসি লোক। আদিনীন্তন আবার কী? তদানীন্তন বললেই চলে না? চলে। আদিনীন্তন অ্যা নিউ ডিকশন। বললাম আর কী! এই ফরাসগঞ্জে একদিন ঘুম এলো ঘনঘোর। ঘুমের মধ্যেই আমি ঘুরতে ঘুরতে দেখে এলাম আঙুরবাগান। দেখা হলো বালিকার সঙ্গে, যার বুকে কবিতা মুদ্রিত হয়ে আছে, সেই কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক হবো বলেই না আমি বেঁচে থাকি, আঙুর-রসের ওয়াইন পান করতে চাই। কিন্তু আমি তো এখন ফরাসগঞ্জে নেই, চলে এসেছি মগবাজারে।


bookshelf

অনেক দিন কার্টুনবন্দি থাকা বইগুলো শেলফে জায়গা পেল


এরই মধ্যে একদিন, আমার এক সাংবাদিক ও মারাত্মক কবিতাপ্রেমী বন্ধু, যিনি আগেও আমাকে নিয়ে নানান জায়গায় গেছেন স্পন্সরের জন্য, যখন আমি এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা ছিলাম; সেই বন্ধু ফোন দিলেন। মোদ্দা কথা, একটি কার্যকর স্পন্সর পেয়ে গেলাম। ভালো লাগল। ধৈর্যের সঙ্গে লেগে থাকার ফল কি এরকম? তাহলে এখন কাঁটার আনুষ্ঠানিক প্রি-প্রোডাকশন শুরু করা যায়! একটি অফিস ও টিম লাগবে। লাগবে পাঁচশো পাত্রপাত্রী, লাগবে প্রচুর প্রপস অ্যান্ড কস্টিউম। আর কোথায় হবে কাঁটার সেন্ট্রাল লোকেশন? ফরাসগঞ্জের সেই ঢিলিমিলি সময় মগবাজারে এসে উড়ে গেল কদিনের মধ্যেই। এলিফ্যান্ট রোড থেকে বেরুনোর পর কিছু দিন মহানগরীর শংকরে ছিলাম, কয়েকমাস ফরাসগঞ্জে থেকে এলাম। আমার যত বইপত্র ছিল, ওই দুই বাসাতে সেগুলো কার্টুনবন্দি ছিল। মগবাজারের বাসায় বইগুলো শেলফে জায়গা পেল, বইগুলো সব গাছ হয়ে গেল। বইয়ের ভেতরে যত পাখি ছিল মুদ্রিত, তারা ডানা মেলে দিল। আমার কত পাখি তখন! আমার কত প্রজাপতি! আমার কত বাগান! সবই আছে, বইয়ের মধ্যে। আর আমি তো ছারপোকার ভাই বইপোকা; সেই কিশোরকাল থেকেই; তাই বই ছাড়া আমার চলে না। ভালো লাগত, যখন মগবাজারের বাসায় আমার বুকশেলফের দিকে তাকাতাম। হাওয়াই উড্ডীন জীবন আমার কিন্তু বইগুলো তখন গোছানো ছিল। তো একদিন, ভাবনা অনুযায়ী প্রথম আলোতে একটা বিজ্ঞাপন দিলাম। বিজ্ঞাপন অনুযায়ী একেবারে নতুন মুখের সন্ধানে আমি প্রস্তুত হয়ে গেলাম। ছোটোবেলায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখতাম সিনেমায় নতুন মুখের সন্ধানে বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। সেই কাজ একদিন আমাকেও করতে হবে, এ হয়তো ভাবিনি। কিন্তু ওই যে, কাঁটার ব্যাপারে কিছু নীতি পালনে বাধ্য হয়েছি আমি—বাজার এড়াব। বাজারি লোকজন দিয়ে কাঁটা প্রোজেক্ট হবে না, সেই বাস্তবতা আমি টের পেয়েছি বাজারে টোকা দিয়েই। কাঁটা বাজারি প্রডাকশন হচ্ছে না, চেষ্টা করব এটা হোক গার্হস্থ্য প্রোডাকশন। তাই নতুন মুখের সন্ধানে বিজ্ঞাপন দিলাম।


93167764_1584417658381656_1559427519084494848_n

আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে প্রোডাকশন মিটিং


বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ইমেইলে বায়োডাটা ও ছবি চলে আসতে শুরু হলো। আট থেকে আশি বছর বয়সী নানানরকম অভিনয়ে আগ্রহী লোকের থেকে ইমেইল এলো। একটি ছোটো টিম তখন কাঁটার পক্ষে কাজ করছে। তাদের নিয়েই মগবাজারের বাসায় প্রি-প্রোডাকশন মিটিং করতে থাকি। প্রথম আলোর সেই বিজ্ঞাপনে প্রায় নয়শো ইমেইল এলো। আমি টিমের লোকেদের বললাম, যাদের নেইমার কাট চুল বা এই টাইপের, তাদের স্রেফ বাদ দিয়ে দাও। যাদের চুল কাটানো খুব নরমাল লুকে, তাদের রাখো ছেলে বা পুরুষদের মধ্যে। মেয়েদের মধ্যে যারা তাদের ভ্রু ও কপালের সামনের চুল কেটে ফেলেছে, তাদের বাদ দাও। না, কাঁটার সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার নেইমারের চুল কাঁটার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বা কোনো মেয়ে ভ্রু উপড়িয়ে ফেললেও আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে, যে ছবির গল্পে পাত্রপাত্রীরা হবে ১৯৬৪, ১৯৭১ বা ১৯৮৯-৯০ সালের লুকের, সেই বাস্তবতায় আমি যা ভেবেছি, সেই অনুযায়ী নয়শো জনের ইমেইল থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ের পর চারশো জনকে আমরা অডিশন দিতে ডাক পাঠাই। কিন্তু অডিশন কোথায় করব? তখনো কাঁটা ক্যাম্প হয়নি, যেটা অডিশনের পরেই হলো, রেললাইনের ধারে, মগবাজারেই, শাহ নুরী স্কুলের অপজিটে। তবে অডিশনের জন্য চার দিন ইস্কাটনের ‘চারুনীড়ম থিয়েটার’ তিন রুমের অফিস একদম ভালোবাসার বিনিময়ে আমাকে দিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক গাজী রাকায়েত। রাকায়েত ভাই ও চারুনীড়ম এর কাছে কাঁটা কৃতজ্ঞ, আমি কৃতজ্ঞ।


IMG_3230

অডিশনের পাত্রপাত্রীদের একাংশ, কাঁটা ক্যাম্প, মগবাজার | ছবি হোসেইন আতাহার


ইস্কাটন ‘চারুনীড়ম’ অফিসে অডিশন শুরু হলো। এভাবে অডিশন করে পুরো একটি ছবি বানানোর কাজ আমি আগে কখনো হতে দেখিনি শহর ঢাকায়। আমি চেয়েছি, সম্পূর্ণ নতুন মুখ নিয়েই তৈরি হোক কাঁটা। ঢাকাসহ দেশের নানান অঞ্চল থেকে অডিশন দিতে আসে লোকজন। তাদের কেউ যেমন ছাত্র বা ছাত্রী আছে, আছে গৃহবধূ, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, চাকরিতে চলমান কেউ কেউ; এবং কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী টেলিভিশনে কাজ করে, তারাও অডিশন দিচ্ছে। বিভিন্ন থিয়েটার দল থেকে অডিশনে পেয়েছি অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী। সে এক এলাহি কারবার। জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তারা একটি সিনেমায় অভিনয় করতে চায়। আমিও তাদের নিয়েই কাজ করতে চাই। এই নতুন অভিজ্ঞতা ছিল আমার জন্য বা কাঁটা টিমের জন্য একদম নতুন কিছু।

মেজমামা কেবিনের বেডে ঘুমিয়ে আছেন বা অচৈতন্যে আছেন। মেজমামী মামার মুখের কাছে গিয়ে বলার চেষ্টা করলেন, ‘বুড়ির ছেলে টোকন এসেছে, তোমার ভাগ্নে।’ মামা সাড়া দিলেন। বিছানায় কোনোরকম নড়াচড়া নেই তাঁর। আমিও মামার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লাম, মামার ঠোঁট ফিসফিস করে নড়ে উঠল, চোখ বন্ধ তখন মেজমামার, বললেন, ‘সিনেমা হচ্ছে?’

মফস্বল থেকে অডিশনে এসেছে লোকজন, এসেছে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাদের চোখে স্বপ্ন, তারা সিনেমাতে অভিনয় করবে। বেশ লাগল ব্যাপারটা। সকাল ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পরপর চার দিন অডিশন প্রক্রিয়া চলে। অডিশন ক্যামেরায় শুট করে রাখা হলো, প্রচুর স্টিল করা হলো। নির্মাতা মুক্তাদির ইবনে সালাম অডিশন শুটের দায়িত্ব নিল। আমার ভাগ্নি বর্ষা বিভাবরীও তখন অডিশনে স্টিল ফটোগ্রাফি করে দিতে এলো চার দিনের জন্য। চার দিনে আট শিফট। আটটি পর্যবেক্ষক প্যানেল করা হলো অডিশনে আগতদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। দুপুরে একঘণ্টার একটা বিরতি। সকাল ও বিকাল দুই সেশন আমরা দারুণ ব্যস্ত তখন। যাদেরকে দেখা যাবে কাঁটা ছবিতে, তাদের নিতেই অডিশন শুরু হলো গাজী রাকায়েত ভাইয়ের অফিসে। এভাবে কি আমি সিনেমা হতে দেখেছি ঢাকায়? না, আমি তা দেখিনি। এত ঝুঁকি নিতে দেখিনি কাউকে, যে, প্রায় পাঁচশো পাত্রপাত্রী সিনেমাতে, যাদের প্রায় সব্বাইকেই অডিশনে করিয়ে নিয়ে কাজ করা!

porrbo 7.1

কাঁটা অডিশনের প্লাকার্ড বিজ্ঞাপন

অডিশনে যাদের পর্যবেক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম, তাদেরও অডিশন করা হয়, এরকম কয়েকটি চরিত্রকে কাঁটা ছবিতে দেখা যাবে। অডিশনের আগে কাঁটা ছবিতে কাজ করার ব্যাপারে যাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, তাদের মধ্যে যারা অডিশনে অ্যাটেন্ড করেছে, তাদের নেওয়া হয়েছে কাঁটায়। অডিশনে আসেনি, কিন্তু আগে কথা হয়েছিল যাদের সঙ্গে, তাদের আর আলাদা করে ডাকিনি আমি। এতে তারা আহত হয়েছে। কষ্ট পেয়েছে। আমার উপরে তাদের হয়তো ক্ষোভও জমেছে। কিন্তু অডিশনে আসেনি কেন তারা? পৃথিবীর অনেক বড়ো বড়ো তারকা অভিনেতাকেও কোনো কোনো নির্মাতার কোনো কোনো কাজে অডিশন দিয়েই কাজ করতে হয়েছে, হচ্ছে, হবে। ক্যারেক্টার নিয়ে একটা বোঝাপড়া এগিয়ে চলে অডিশন প্রক্রিয়ায়। তাছাড়া কাঁটাতে আছে কয়েকশো ক্যারেক্টার। কাজেই কয়েকশো ক্যারেক্টারকে ক্যারেক্টারাইজেশনের একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল কাঁটা টিমের জন্য। ওহ! কী ধুন্ধুমার কারবার! অডিশনে যারা পর্বেক্ষক হিসেবে বিভিন্ন সেশনে বসেছেন, যেমন অভিনেতা এস এম মহসীন, তারিক আনাম খান, শিল্পী মাসুক হেলাল, অভিনেতা আমিনুর রহমান মুকুল, নিয়াজ মোহাম্মদ তারিক, সামির আহমেদ, সেলিম মোজাহার, আনিসুল হক বরুণ এবং আরও কজন। সবার নাম আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

আমরা মগবাজার রেললাইনের পাশে একটা অফিস নিয়ে ফেললাম অডিশনের পরপরই। মগবাজার চেয়ারম্যান গলিতে তখন আমার বাসা, মগবাজার শাহ নুরী হাই স্কুলের সামনে কাঁটা ক্যাম্প—আমাদের অফিস। কাঁটার জন্যই একটা অফিস হয়ে গেল! খুব ভালো লাগল। কাঁটা নির্মাণের পথে ঢুকে অফিসিয়ালি পড়েছি আমরা। আমরা তখন খুব ছোট্ট একটা টিম।

আমার মামাবাড়ি হরিণাকুণ্ডু থানার জোড়াদহ ভায়না গ্রামে। মামাবাড়িতেই আমার জন্ম হয়। মামারা চার ভাই, দুই বোন। আমার মা সবচেয়ে ছোটো তার ভাইবোনদের মধ্যে। আমি মামাদের অনেক স্নেহে বড়ো হয়েছি। মেজমামা কৃষি ব্যাংকের অফিসার ছিলেন, নানান জায়গায় তাঁর পোস্টিং হতো। ছোটোবেলায় মেজমামা ফরিদপুর শহরে ছিলেন, আমিও ফরিদপুর যাই মামার বাসায়। ফরিদপুরে তখন দুইটা সিনেমা হল। ছায়াবাণী ও বনলতা। মামার বাসায় থাকতাম যখন, খুব সিনেমা দেখতাম বাসা থেকে পালিয়ে পালিয়ে। মামা অবসর যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্যারালাইসিস ধরনের অসুখ। অনেক দিন পর তখন ঝিনেদা থেকে মগবাজারের বাসায় এলো আমার মা। আমার মেজমামা তখন বারডেমের কোনো এক কেবিনে, তাঁর চিকিৎসা চলছিল। মা ও আমি গেলাম বারডেমে। মামার পাশে ছিলেন মেজমামী। মেজমামী বললেন, ‘হঠাৎ হঠাৎ জ্ঞান আসে, আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে।’ মেজমামা কেবিনের বেডে ঘুমিয়ে আছেন বা অচৈতন্যে আছেন। মেজমামী মামার মুখের কাছে গিয়ে বলার চেষ্টা করলেন, ‘বুড়ির ছেলে টোকন এসেছে, তোমার ভাগ্নে।’ মামা সাড়া দিলেন। বিছানায় কোনোরকম নড়াচড়া নেই তাঁর। আমিও মামার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লাম, মামার ঠোঁট ফিসফিস করে নড়ে উঠল, চোখ বন্ধ তখন মেজমামার, বললেন, ‘সিনেমা হচ্ছে?’

আমি বললাম, ‘হচ্ছে।’

‘ঝিনেদায় আসবে?’

আমি বলেছি, ‘আসবে,’

মেজমামা আবার ঘুমিয়ে গেলেন কিংবা অচৈতন্যে চলে গেলেন। মেজমামী বললেন, ‘আবার কখন চেতন ফেরে কোনো ঠিক নেই।’


biggapon 1

নতুন মুখের সন্ধানে, প্রথম আলোতে ছাপানো বিজ্ঞাপন


পরের বছর, ২০১৮ তে যখন আমরা নারিন্দায় কাঁটার শুটিং করছি, তখন আমার মা ফোন করে একদিন জানাল, ‘তোর মেজোমামা একটু আগেই মারা গেছে।’ মা খুব কান্নাকাটি করছিল। মেজমামার জন্য চোখ ফেটে লবণ জল বের হচ্ছিল আমারও। কাঁটা ইউনিটের কয়েকশো লোকজনের ম্যানেজমেন্ট ছেড়ে নারিন্দা থেকে তখন আমার ঝিনাইদহ যাওয়া অসম্ভব ছিল, যেতে পারিনি। কাঁটা ইউনিটের সবাই যে যার কাজ করছিল, আমিও কান্না চেপে তাদের সঙ্গেই কাজ করে যাচ্ছিলাম। টিমকে বুঝতে দিইনি যে, মেজোমামা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আমি খুব মনখারাপে আক্রান্ত হয়েছি। ছোটোবেলা থেকেই বড়ো হওয়ার পথে মামাদের সঙ্গে আমার হাজার হাজার স্মৃতি, কিন্তু নারিন্দায় কাঁটা লোকেশন থেকে আমার তখন মনে পড়ছিল শুধু, একজন মুমূর্ষু মানুষ অচৈতন্য মুহূর্ত থেকে চৈতন্যে ফেরার ক্ষণমুহূর্তে তাঁর ভাগ্নেকে বলছেন, ‘সিনেমা হচ্ছে? ঝিনেদায় আসবে?’

মেজমামার সঙ্গে বারডেম হাসপাতালের কেবিন রুমে সেই আমার শেষ দেখা, শেষ কথা। মামাকে সেদিন বারডেমে দেখে ফিরে গেলাম মগবাজার। ভাবনা ছিল, মামা সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাঁর ছোটোবোন বুড়ির ছেলের সিনেমা কাঁটা দেখবেন!


আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব


শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।