সোমবার, ডিসেম্বর ২

নির্বাচিত দশ কবিতা : এমরান কবির

0

মহিলা পুলিশ


কিসের যেন ছায়া থাকে
পোশাকের মধ্যে
…………প্রতিবিম্বহীন
বৃক্ষ খুঁজি বস্তু খুঁজি
……………..নিশিদিন

শহরে শহরে কেন বেড়ে যায় এত বিবমিষা!
নহরে নহরে তবু দেখা যায় অন্য মনীষা
এত যে গুপ্তলীলা—আজ থেকে তুমি রয়ে যাও থানা
ব্যক্তির মধ্যে তোমায় আত্মায় কে দেবে আজ হানা!
বেড়েছে আজ এত যে বাজ কেউ কি তা জানে
চোখের মধ্যে হাতকড়া নাচে নেই কোনো এর মানে!

এ শহরের প্রান্তরে—
তোমাকে দেখলে বড্ড চোর হতে ইচ্ছে করে।


রোগী


সেবিকার চোখে ইহকাল জাগে তার। শহরে শহরে গড়ে ওঠা বৃদ্ধ পিরামিড থেকে চুরি হয়ে যায় চুড়ি—বিমানবালিকা! মনোবিজ্ঞান পড়েনি সে, শুধু বিমূর্ত সূচের অগ্রভাগে দেখে নিয়েছে চোখ। এখন মৃতবালিকার লাশ হয়ে অ্যাপ্রোন জাগে না। মনে হয় ব্যবহৃত জোসনা মেখে চলে আসেন মিস পূর্ণিমা চ্যাটার্জি

জোয়ার আসেনি এখনো। দৃশ্যবাদী কাগজ ঢুকে গিয়েছে প্রেসক্রিপশনে। অনন্ত গর্ত হতে বেরিয়ে আসে প্রদত্ত স্বপ্ন, আর স্বপ্নের ভিতরে ক্রীড়াশীল দুটো টিকটিকি…

আসুন মহামান্য ফ্রয়েড, সংস্কারের অর্থমূল্যে কিনে নেব সেবিকার হাত, বিমানবালিকার চুড়ি…


কী সুন্দর মিথ্যাগুলো— মাছ ও কাজলাক্ষী


বসে আছি চর্যাপদের আলোয়, সম্মুখে আধো চেনা, আধো অচেনা দৃশ্য। মনে পড়ে মনে পড়ে-না এমন জায়গা। বৃষ্টি হয়েছে মূর্ছিত মাছের মতো। আকাশে মেঘ-মেদুর দৃশ্যের মাঝে বৃষ্টির করতালি। দূর আকাশে শৈশবের হারানো আধুলি ডাকে। আমি দেখি আমার পাশে তিলোত্তমা বৃষ্টির মতোই শাদা পোশাকে বসে আছে। চোখে তার রাহস্যিক ছায়া। আমি দেখি চারিদিকে স্থির জল। জলের ভেতর স্বচ্ছ শাদা মাছ। ছোট মাছ। ছোট মাছ বড় হচ্ছে… বড় মাছ ছোট হচ্ছে…। এমত মিথ্যাময় পরিবেশে বড় হতে হতে একটি মাছ অনেক বড় হয়ে যায়। কাজলাক্ষী তার শান্ত অনুভবের চোখ দিয়ে ঘন ইশারা করে। আমি বুঝে ফেলি মাছটিকে ধরতে হবে। বুঝে ফেলি এই ঘূর্ণিতে নিজেকে জড়ানো মানে অসুস্থ হয়ে যাওয়া। বুঝে ফেলি সে-এক অদ্ভুত অসুখ।

মাছটা জলের ভেতর চক্কর খেতে থাকে আর বড় হতে হতে জল ভেদ করে উপরে উঠতে থাকে তার পিঠ। আমি দাঁড়িয়ে গেছি ততক্ষণে। মাছটাকে ধরতেই হবে এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে দাঁড়ানো আমি হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে চাই। না, মাছটাকে ধরব না। কারণ এই মাছ পানিপ্লাবী হয়ে বাতাসচারী হয়ে দৃষ্টির প্রখর ভঙ্গিকে অতিক্রম করে মাছ হয়ে উঠছে…

কাজলাক্ষী ক্ষুব্ধ-অভিমানে দাঁড়িয়ে যায়, অন্যরকম এক বন্য অথচ শান্ত চোখে তাকায় আমার দিকে। আশ্চর্য! সে-তো এমন নেশালু কিংবা পাহাড়ী গানের মতো চোখে তাকায় না কখনো! আমি বুঝি ফেলি ওই চোখের সান্ধ্য-ব্যকরণ। কালবিলম্ব না করে মাছটার দিকে তাকাতেই দেখা যায় শাদা জল ভেদ করে উচ্চে ওঠা তার পিঠের মিনার। অর্ধেক জল অর্ধেক বাতাসে দৃশ্যমান সেই মাছ খানিক দূরে চলে গেছে। এক দৌড়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়তেই মনে হলো—আমি কতদিন ঘুমাই না! ক্লান্ত হাত আমার মাছটির পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে ধরবে কি ধরবে-না এমন ভাবনার দোলাচলে দুলতে না-দুলতেই শার্পটার্ন নিয়ে ঘুরে চলে যায় কাজলাক্ষীর দিকে। কাজলাক্ষীর চোখ তখন জানান দিচ্ছে কেন তাঁর ঠোঁটকে সুহাসিনী বলে!

আমি ফিরে তাকাই। দেখি মাছটির পিঠ উপরে উঠতে উঠতে ক্রমশই চিতাবাঘ হয়ে গেল। আর পেছনে তিলোত্তমা হয়ে হেল ভার্সাই নগরীর ঢেউ। বাঘটির কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কমপক্ষে দৌড় দিতে হয়…

কিন্তু, কে জানে না—স্বপ্নে কখনো দৌড়ানো যায় না! আমিও জেনে গেলাম, ‘শস্য কাটা হয়ে গেলে পড়ে থাকে হাহাকার’…


পালকভরা সূর্যাস্ত : চৌদ্দ


কোন সে গভীরতা এঁকে দিচ্ছো তুমি ঘুমের ভিতর? যুগল নিঃশ্বাস থেকে উড়ে যাচ্ছে বৃক্ষের জীবন! তুমি বলছো ঘুম ও জাদু বিষয়ক আততায়ীদের কথা। বলছো, পাখিরা যখন ওড়ে তখন প্রতিটি সড়কদ্বীপে খুলে যায় দেবতাদের মুখ। মুখোশে মুখোশে রূপান্তরের কাঠিগুলো ওড়ে। পরী তখন জীবনকাঠি, কবিকে দাফন করে নীল কাপড়ে

দ্বিধা নেই তবুও। কারণ কলসভর্তি আগুন, দিনভরতি মমি মাখা মিথ্যা চাবি আর পোশাকভরা শিমুল সংবহন। বলি তাহাকে, প্রণামীতে খসে যায় বীজ, মেরু থেকে উড়ে যায় খনন করা স্রোত, স্রোত থেকে উঠে আসে আগ্নেয় ছলনার পাখি

মিথ্যার আকাশে তাকে পুনরায় কেমন করে রাখি!


কী সুন্দর মিথ্যাগুলো— জলেশ্বরী


আবার এসেছে ওই অচেনা বিকেল। বহুদিন আগে শৈবালের পিঠে দাঁড়িয়ে যা দেখেছিলাম আমি, আজ মুহূর্তের ঘোরে, রোদের কোমল তীরে বিকশিত হতে হতে, পুনরায়, দেখলাম আমি আকাশের এক ফাঁকে জলেশ্বরীর জল-গণিত

যেমন ধরো, ছাপচিত্রের কোলাহল পেরিয়ে হঠাৎ চলে গেলাম অরণ্যে, ফিরে এসে দেখি ছাপচিত্র আর ছাপচিত্রের জায়গায় নেই। সেখানে দেখা যাচ্ছে ছোট কাটরার বিশাল দরোজা। যেমন ধরো, ঘাসদানি থেকে নেমে আসছে আলো-অন্ধকার-আয়ু, বাতাসে তাহার তীব্র আলোড়ন। আমি চোখ থেকে যেই চশমা খুলেছি, দেখি চারিধারে রমণীর নাভীর মতো সুগভীর নির্জনতা। আমি যেন ভাগশেষ কিংবা কল্পিত ভগ্নাংশের মতো দাঁড়িয়ে আছি

প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের মধ্যে বিকেল কোথায়! আছে। আমি যখন ছাপচিত্র থেকে অরণ্যে গেলাম, তখন সেই সুতীব্র আলোর ভেতরে সূর্য হেলে পড়েছিল তাহার দিকে। কেউ তা দেখেনি। আমি যখন ঘাসদানির সামনে দাঁড়িয়ে তখন আলো আর আয়ুর মাঝখানে কেটে গেছে কয়েকশ মুহূর্ত

এই সব কলরব যখন চারিদিকে, তখন মুহূর্তের চোখে চোখ রেখে ভাবছিলাম শৈশবে দেখা সমুদ্রের হাহাকারের কথা। ভাবছিলাম তুমুল গর্জনের মতো এই আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া প্রাচীন পুকুরের কথা

আবারো শৈবালিনী! আবারো ছায়া ঘেরা প্রাচীন রোদ! আবারো স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ ধারার মাঝে বকুল-সাধনা! তাহার ভেতরে আরেক আকাশের কথা! তাহার ভেতরে জেগে ওঠা জল-গণিতের কথা! তাহার ভেতরে আরেক সমীকরণের কথা!

পুকুর এবং আকাশ, কে নিকটে? এই প্রশ্ন রেখে যাই শৈবাল আর শৈবালের পিঠে দাঁড়ানো সংশয়ী জলেশ্বরীকে


কী সুন্দর মিথ্যাগুলো— শহর


আলোর স্কুল থেকে বের হতেই দেখা হয়ে গেল পথের সঙ্গে, তার সাথে রথের সহযোগী। যাত্রা থেমে গেছে যাবতীয় মাছ ও ধুলোর। কিংবা মুছে গেছে বৃষ্টির মিথ্যা শাদা রং । রথের চাকা বলে— বড় ক্লান্ত ক্লান্ত লাগে এ শহরে…

এ শহর মানে কলকাতা নগরীর শব্দ-দূষণ। রিকশার টুংটাং, বাতাসের ঝাপটা, রথের চাকায় পিষ্ট হওয়া ধুলো, মাছ আর বৃষ্টির শাদা রং। আরো দেখো আমার ফতুয়ার পকেট— কী অবলীলায় একাকার হয়ে যায় তারা!

একাকার হয়ে যাওয়া মানে সাত বীরশ্রেষ্ঠের মাঝে পড়ে থাকা পাথরের ভগ্নাংশ। সে-ও ধুলোর বন্ধু— ঝড়বন্ধু। তার সামনে কত আলোর খেলা! তার সামনে সাতমাথার সাত নিদ্রা ও জাগরণ, তার সামনে ম্যান্ডোলিনের ঘোড়ার হ্রেষা, তার সামনে সপ্তপদীর সপ্তর্ষী, তার সামনে এ শহরের সে-শহরের কিংবা পৃথিবীর যে-কোনো শহরের সূর্যাস্ত শাদা ফারুক সিদ্দিকী কিংবা আন্ওয়ার আহমদের দীর্ঘশ্বাস…

দীর্ঘশ্বাস মানে কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক। কিংবা সেই সড়কের সোডিয়াম বাল্ব। না, ওই দীর্ঘশ্বাস মানে এক নিরুদ্দেশ ঘোড়ার গাড়ি…


এই মায়াশস্য


এই মায়াশস্যের নিশ্চুপ হাওয়া
এলোমেলো করে দেয়,
যা কিছু থাকে
রাতের নির্জনে গোপন দুঃখের মতো ঝরতে ঝরতে
মিশে যায়
হিম হিম বাষ্প হাওয়ায়

বহুদিনপর এতদিনে জানা হয়ে যায়
বিগত দিনের অজ্ঞাত অনুভূতি
কতটা প্রজাপতি হয়ে আসে হাতের ছায়ায়
চোখের ভেতরে চোখ নিয়ে বয়স বেড়ে যায়

ঘাস কলম ও বৃক্ষদানি জানে
বসন্তের সাথে ডালিমের মানে


বেড়ে ওঠা বেড়ালের গোপন শহর


রাজা এসেছিল
সঙ্গে ছিল মৃত কুমারীর আংটি
তার গোলকের ভেতরে
কিশোরী কালের চোখ
উদিত শিখার হালকা সাঁতার
আর গোপন রক্তের হাসি

পাথর না থাকলে সবই তো গোলক
ভাঁজের জ্যামিতি খুলে দেখে সেই বালক
বলে, আঙুলের নেশায় আছে রহস্যের ঠিকানা
অনামিকা ছুঁয়ে বহুকাল চিঠি আসে না

এসেছিল রাজা
সঙ্গে ছিল বেড়ে ওঠা বেড়ালের
……………..গোপন শহর


আমি খুব হারিয়ে গেলাম


কদমপাতায় ফেলে দেয়া হলো আগুন
রাত যখন সকাল ছুঁইছুঁই
দেখা গেলো পুড়ছে না কিছুই
শুধু হেঁটে আসছেন তারা
কদম ফুল মুখে নিয়ে আগুনেরা

তারা
আগুনেরা
হেঁটে এসে বলল
তোমরা কি জেনেছ হলুদ ফুলের নাম
হাজার হাজার পথ বেয়ে আমরা এলাম

পথ বেয়ে চলে গেছি
বইয়ের মলাট থেকে শিশিরের জলে
শিশিরের জল থেকে শেষ পৃথিবীর ঠিকানায়
আমরা বললাম
তবু পাই না তো সেই ফুলের নাম
শুধু
আলোর শাখায় খেলা কওে পালকেরা
রেনুর গন্ধ বুকে নিয়ে তবু
আমরা চললাম

আমাদেও ফুলগুলো বেসামাল বন্ধনী
মনে পড়বে নাম তার এক্ষুণি


এমরান কবির


এবং আমার জন্মের সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করেছিল প্রত্ন-সকালের রংধনু
হলুদ বর্ণ ধারণ করেছিল মেঘের স্বাপ্নিক স্তর
বিবর্ণ বক্ষদেশের মতো দুঃখচারী হয়েছিলো মনোনীত ক্ষুধা
অথচ খুব চিরহরিৎ হবার বাণী ছিল, প্রত্যাশা ছিল
কলেজ ক্যাম্পাসের মতো মুখরিত হবে আমাদের কোলাহল

অর্ধ্যসত্যের আবহ নিয়ে এইখানে এসেছিলো কেউ
তৃতীয় প্রহরের কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেলো সে
প্রাক্তন ঠোঁটের মতো
আর রেখে গেলো কিছু বিমূর্ত ভাবনার মানচিত্র

কত-না প্রাচীন আঁকিবুঁকি খেলা করে মাথার ভেতরে
পবিত্র মাতালের মতো দাঁড়িয়ে থাকি সুসহায়
জোসনা রঙের চোখে শতচ্ছিন্ন অলৌকিক বেদনার ভার
…………………………………..নিঃসঙ্গ, একা

অথচ আমি এবং আমার মৃত্যু একই পতাকার নিচে ঘুমাই
আমাদের মাঝে সেতু বন্ধন গড়ে তোলে জাগতিক নিঃশ্বাস
দূরের কোনো স্বপ্ন-সত্যের দিকে তাকিয়ে কেটে যায়
……………………….এই পবিত্র মাতালের ঐকিক জীবন

এভাবেই শেষ প্রচ্ছদের রংতুলিতে দেখা যাবে গোধূলি স্থবির
আসবে নক্ষত্র, আসবে জীবনানন্দ, আসবে আমাদেও এমরান কবির

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ৫ এপ্রিল ১৯৭৯, বগুড়ার কৃষ্ণপুরে। পড়লেখা করেছেন রসায়ন শাস্ত্র ও মার্কেটিংয়ে। সম্পাদনা করেন ‘থার্ডম্যাগ’ নামে লিটল ম্যাগাজিন। পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার, ২০১০ ও পাঠকপণ্য সম্মাননা ২০১২। বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।