সোমবার, ডিসেম্বর ২

নির্বাচিত দশ কবিতা : এহসান হাবীব

0

কেউ আমাকে ফোন দিতে পারেন


কেউ আমাকে ফোন দিতে পারেন
চ্যাটক্লান্ত রমনীরা ঘুমিয়ে পড়েছে
গোপন প্রেমিকারাও তাদের স্বামী সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।
তাহাজ্জুদ পড়বেন বলে একজন আমাকে অপেক্ষা করতে বলে
নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন।
রাত ঘন হচ্ছে।
দীর্ঘ হচ্ছে।
আমি প্রচণ্ড গরমে ঘামছি।
ভাবছি, একটা শীতল পানীয়র মতো একটা ফোনকল যদি আসে।
যেকোনো বিষয় নিয়ে কথা হতে পারে।
আমি শুনবো।
যে কেউ আমাকে ফোন দিতে পারেন।
রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দিয়ে বেজে উঠতে পারে রিংটোন।
ওপাশ থেকে ভারী বাজখাই গলায় কেউ কথা বলে ভেঙে দিতে পারেন
দীর্ঘকালের এই বধির বদ্বীপের নিস্তব্ধতা।
কেউ মোলায়েম গলায় শুনাতে পারেন নতুন কোন গানের কলি।
কথা বলার যেকোনো বিষয়ই হতে পারে।
আমি শুনবো।
কেউ আগামীকালের গোপন কোনো অপারেশনের পরিকল্পনাও করতে পারেন।
আমি গোপনীয়তা বজায় রাখবো।
কেউ আমাকে ফোন দিতে পারেন।
বন্ধু অথবা শত্রু
শুনাতে পারেন প্রণয়, গোপন প্রেমের কোন কাহিনি
অথবা কেউ বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করতে পারেন আগামীকালের মৃত্যু পরোয়ানা।
তবু কেউ ফোন করুক। এই দীর্ঘ রাতের নির্জনতা ছিঁড়ে
কথারা বলে উঠুক। খলবল করে বেরিয়ে পড়ুক নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে।
অনন্ত বোবা রাত্রির মুখে ভাষা ফুটে উঠুক।
কেউ আমাকে ফোন দিক।
জানি তো, তাদের স্বামী সন্তান রয়েছে। রয়েছে দিনের আলোর বিপুল সম্ভার।
আমি তাদের গোপনীয়তা বজায় রাখবো।


আমাদের দেখা হোক


অনাবশ্যক কোনো তাড়া নেই দেখা হওয়ার
তবু মনে হয়, দেখা হলে ভালো হতো
কতোদিন আমাদের দেখা হয় না।
টেলিফোনের দুই প্রান্তে মুখোমুখি বসে অনেক গল্পই হয়তো করা যায়
তবু চোখের দাবি বাকি থাকে, চোখেরও পিপাসা জাগে।
ঘুমে, স্বপ্নে আমাদের দেখা হয়, হোক।
তবু একবার মুখোমুখি দেখা হোক?
তস্করের ভয়ে অনেকদিন সন্ধ্যায় আমরা হাঁটি না
নগরে বৃষ্টি নেমে এলে আমরা শুধু টেলিফোনে কথা বলে সময় পার করি
আমাদের উৎসুক ঠোঁটের উপর বসে থাকে একজোড়া জুতো
শক্ত, পালিশ করা জুতোর উপর উর্দি ছড়িয়ে থাকে।
দুপুরের রোদে আমাদের আর দেখা হয় না
আমাদের সন্ত্রস্ত করে রাখে সময়,
হাতুড়ি হেলমেট
সাইরেন
মধ্যরাতের কালো গাড়ি।

তবু আমাদের দেখা হোক।

বসন্ত চলে যাচ্ছে
আসছে বর্ষায়
অনেক সন্ধ্যায়
গমগমে দুপুরে
তুমুল জনারণ্যে
মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাতের ভিড়ে
একবার আমাদের দেখা হোক।


টীকাভাষ্য


যা কিছু হারিয়ে ফেলি আমি তা-ই দুর্লভ হয়ে যায়। দামি গহনার বাক্স চুপচাপ পড়ে থাকে আলমিরায়। ধুলো পড়ে পড়ে কেমন মূল্যহীন হয়ে যায়। বিপন্ন কৌতুকে আমি হারিয়ে ফেলি খুচরো জীবন। রৌদ্রের সকাল, ঝিম ধরা দুপুর আর ব্যাক্তিগত বিষণ্ণ সন্ধ্যা– আলস্যে কোথায় ফেলে রেখে আসি! প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছি পুরনো কথা, দূরের সবুজ, মাদলের সুর আর খুব সহজে পাওয়া একটা পুরনো অচল আধুলি। হারিয়ে গিয়ে কেমন দুর্লভ হয়ে গেছে।

হারিয়ে যাচ্ছে ছাই, হারিয়ে যাচ্ছে কথা, হারিয়ে যাচ্ছে ঘোর। প্রতিদিন এইসব ছাইঘোর হারাতে হারাতে কেমন দুর্লভ ফুটে আছে!

২.
মানুষ শেখে না কিছুই, চোখ শুধু দেখে যায় সব। একেকটা চোখ যেন গোপন জাদুঘর, স্বাক্ষী গোপাল। চোখগুলো শুধু জমা করে রাখে নদী, পাহাড়, ধানক্ষেত– চোখগুলিই নিরবে ধরে রাখে আরেকটি চোখের জল, সম্পর্কের সুতো, অবাক তাকিয়ে থাকা অষ্টাদশীর বিস্ফারিত চোখ। আর খুন, গুপ্তহত্যা, সম্পর্কের কাটা-ছেঁড়া, বিভৎস ক্রূরতা– উন্মীলিত চোখে গিঁথে থাকে সবুজ বড়শির মতো।

মানুষ আসলে শেখে না কিছুই, শুধু চোখগুলো জমা করে রাখে এইসব দৃশ্যান্তর।


অগস্ত্য সূর্যের নিচে


পরস্পরের তালুতে আমাদের হাত ঢেকে রেখে
আমরা অনেক রৌদ্রের নিচে
বহুকাল হাঁটছি।
পথে প্রচুর লুব্রিকেন্ট ছড়ানো রয়েছে
খুব পিচ্ছিল।
আমাদের তাড়া ছিলো।
আমরা খুব দ্রুত হাঁটছি
কখনো দৌড়াচ্ছি
পরস্পরের হাত ছেড়ে যাচ্ছে
পড়ে যাচ্ছি।
আমাদের প্রচুর হাসি পাচ্ছে
আমরা খুব হাসছি।
স্বপ্নের ভেতর আমরা কথা বলি
আমরা কথার ভেতর গোঙাই
আমরা গোঙানির মধ্যে মরে যাই।
তবু আজ খুব কথা হবে
আজ খুব হাসি হবে
পরস্পরের তালুতে আমাদের হাত মুঠোবন্দি করে
অনেক দূর অব্দি পৌঁছে যাবো আজ
আমাদের মায়েদের সমস্ত নিষেধ ভেঙে
প্রকাশ্যে চুমু খাবো আজ।


ভয়


কিছু কিছু মানুষের দাগকে খুব ভয় ছিলো
যদি, দাগ থেকে যায়?
কারো কারো রক্তকে ভয় ছিলো
যখন তখন রক্তপাত ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা!
কেউ কেউ কাচকে খুব ভয় পেতো
অ্যাস্ট্রের মতো পড়ে গিয়ে যদি ঝনঝন বেজে উঠে?
তবু এতোসব ভয় নিয়ে তারা মৃত্যুকে ভয় পায়নি।
প্রতিবার বলতো
‘মেরে ফেলো। এইবার আমাকে মেরে ফেলো, প্লিজ।’


বাচ্চাদের স্কুল


চাকরি চলে যাওয়ার পর
বউ একটা নতুন চাকরি ধরায়া দিছে
নোয়ামনিকে তার ইস্কুলে আনা নেওয়ার চাকরি।
এই চাকরিটা আমি অবশ্য আনন্দের সাথে করি।
বাচ্চাদের ইস্কুল আমার ভালো লাগে।
হরেক রকম বাচ্চা। একসাথে এত্তগুলা বাচ্চা। দৌড়াচ্ছে, কিচিরমিচির করছে
লুটোপুটি, হুটোপুটি। কী অদ্ভূত সুন্দর! বাচ্চাদের ইস্কুল ছাড়া
এই দৃশ্য আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
একেকটা বাচ্চা ক্লাস শেষে বেরিয়ে এসে তার মায়েদের বুকে আছড়ে পড়ছে।
আমার দেখতে কী যে ভালো লাগছে!
আহা! বাচ্চাদের মায়েরা।
ফর্সা, গোলগাল। নাদুস নুদুস একেকটা বাচ্চার মা।
তারা আমাকে দেখে
আগুন্তুক ভাবে বোধহয়।
দেখে আর কী যেন ভাবে?
ভাবে কি! মনে হয় তারা আমাকে চোখ দিয়া খায়।
খাচ্ছে তো রোজ। অনেকজন।
আমারও ভালো লাগে। ভালো লাগলে আমিও খাই।
বাচ্চাদের ইস্কুল। এইভাবে অনেকজনের খাওয়া খাওয়ি হয়ে বেঁচে আছে দীর্ঘকাল।


জল খলবল


জলের নিচে কী আছে?
কী থাকে জলের নিচে?
অতল?
তবু আলী আলী বলে ঝাপায়ে পড়ে মানুষ।
জলের নিচে কী আছে জানা নেই
হাঙ্গর, কুমির তো থাকতেই পারে।
আছে বিচিত্র রঙের অক্টোপাশ।
ঝাপ দেয়ার পর তারা আমাকে অষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে পারে।
এনাকোন্ডার মতো নিরিহদর্শন সাপ জলের নিচে আমাকে পেচিয়ে ফেলতে চাইবে
আমি গাঙশুশুকের মতো ভুস করে উঠতে চাইবো
একটু, এক পলকের শ্বাস নেয়ার জন্য।
তারা আমাকে টেনে ধরবে
আরো, আরো নিচে
অতল
খাদের পেটের ভেতর নিয়ে যেতে চাইবে।
জলের গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসবে মানিক রাজার ডেকছি
তারা আমাকে সোনা, রুপা আর মোহরের গল্প শুনাবে
দেখাবে মৎসকন্যার লাস্যময়ি শরীর
লোভের লালচে ফেলে নিয়ে যাবে পাতাল পুরি।
তারপর ভেড়া করে রেখে দেবে যাবজ্জীবন।
এইসব গা ছমছম ভয়ের গল্প।
প্রতিবার জলে ঝাপ দেয়ার আগে সে আমাকে শোনায়।
জলের নিচে কী আছে জানা নাই
তবু আলী আলী বদর বদর বলে জলে আমি ঝাপায়া পড়িবো।


ক্রসফায়ার


একটা আপনি আড়ালে গেলে আরেকটা আপনি সামনে এসে দাঁড়ায়
খাড়া হয়।
একটা তুমি উঁকিঝুকি পাড়ে।
কথা কয়। গান গায়। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।
আরেকটা আপনি সবুজ বাতি জ্বেলে বসে থাকে চুপচাপ।
যেন কথা বললেই হেরে যাবে। ডুব পলান্তি খেলা।
আরেকটা তুমি আসে বন্দুক নিয়ে । গুলি করে।
ক্রসফায়ার!
তারপর কান্না করে।
এইভাবে অনেকগুলো আপনি অনেকগুলো তুমি মিলে
সারারাত একটা আমির সঙ্গে খেলা করে। গান গায়। কান্না করে।
অনেকগুলো আপনি, তুমির সঙ্গে একটা আমি সারারাত খেলা করে
ভোরবেলা চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকে। ক্রসফায়ারের লাশের সাথে।


রঙিন মাছের শহর


রঙিন মাছের শহরে বসে আছি বহুদিন।
এই সমুদ্র, বিস্তীর্ণ জলরাশির নিচে তারা খেলা করে
স্বচ্চ নহরের ভেতর তারা ঘুরে বেড়ায়।
আমাদের আনন্দিত করে।
যেন চাইলেই লিখে ফেলা যায় কবিতা
এমন আহ্লাদ এই রঙিন মাছের শহরের।
বহুদিন
আরো বহুদিন, এই রঙিন মাছের শহরে আছি
মৃত এক কল্পপুরী, কফিনের ভেতর ঘুরছি
নির্বিকার!
আমাদের সম্মিলিত ক্রোধের ভেতর রঙিন,
লাল নীল মাছেরা কফিনের ভেতর
আশ্চর্য এ্যাকুরিয়ামে যুথবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খেলা করছে
নির্বিবাদ।


কনফেশান


কোত্থেকে শুরু করা যায়, বলুন?
ঠিক কখন কোন আবর্তের ভেতর দিয়ে শুরু করেছিলাম–
শৈশব কৈশোর ধর্তব্যের মধ্যে নয়– অবাধ স্বাধীনতার দিন…
যখন ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকি একটা নীল দেয়াল আর গোলাপী আকাশের ভেতর।
হ্যাঁ, দেয়ালটা ছিলো নীল আর আকাশটা গোলাপী
যিশুর কসম! তোমাকে আমি তুলে দিয়েছিলাম হিব্রু পণ্ডিতদের হাতে,
আর উহুদের প্রান্তরে আমিই মুহম্মদের দাঁত উপড়ে ফেলেছিলাম।
পাখিদের মতো ভূ-গোল না জানা মিথ্যেবাদী
এই আমিই সুচতুর হানা দিয়েছি পড়শীর নিরাপদ আশ্রয়।
খুব হিসাব করে বলতে হচ্ছে, সত্য আমি কদাচিত বলি–
যে খেয়ে গেছে কুমারজীবন তার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই,
যে সেবিকা কোমল হাতে সারিয়েছে হৃদপিণ্ডের ফোঁড়া
তারও প্রতি ছিলো না কোনো প্রত্যাশা;
কে জানে নিজেরই খেয়ালে কখন রাতদুপুরে আমার বাঁশি বাজাতে ইচ্ছে করছিল?
মুখপোড়া হনুমানের মতো লেজে আগুন জেনেও
দ্বিতীয়বার…
দ্বিতীয়বার আমি গ্রামে গিয়েছিলাম
দ্বিতীয়বার আমি জন্মেছিলাম অসম্ভব রূপবতী একটি দেশে
দ্বিতীয়বার আমি পাঠশালায় গিয়েছিলাম, মিথ্যের জবরজঙ জগৎ
দ্বিতীয়বার আমি কবি হয়ে জন্মেছিলাম, ভুল ব্যকরণ আর ভুল অনুকরণ
দ্বিতীয়বারও আমি অস্বীকার করেছি জন্মলগ্নের কথা
পিতা ও ভাই, মা আর বোনের সাথে পরিচিত হইনি দ্বিতীয়বারও
দ্বিতীয়বারও আমি বোদলেয়ার!
বন্ধু আর প্রণয়িনীর গলায় নিষ্ঠুর চেপে ধরেছি হাত,
তাই না?
হ্যাঁ, দ্বিতীয়বারও আমি আঙিনা থেকে দূর দূর তাড়িয়ে দিয়েছি শাদা প্রজাপতি,
ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসা কবুতর রাঙিয়ে দিয়েছি রক্তে।
দ্বিতীয়বারও একটা অচল আধুলির পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছি চকচকে পাথর
দ্বিতীয়বারও জমিয়েছি জহর, ফোঁটা আর ফোঁটায়।
দ্বিতীয়বারও আমি সেই গ্রামে গিয়েছিলাম যে গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি ছিলো না।
দ্বিতীয়বারও মিথ্যা আর মিথ্যেয় ভরেছি জীবন।
লেজে আগুন জেনেও দ্বিতীয়বার ছুঁয়ে দিয়েছি সেবিকার মুখ।
দ্বিতীয়বারও গোয়ার্তুমি… দ্বিতীয়বার বায়ান্ন… দ্বিতীয়বার একাত্তুর… দ্বিতীয়বার চিৎকার… দ্বিতীয়বার ভুল… দ্বিতীয়বার ভালোবাসি… দ্বিতীয়বার আধুলি… দ্বিতীয়বার পাথর… দ্বিতীয়বার যিশু এবং মুহম্মদ কাউকে না পেয়ে ফালি ফালি করে কেটেছি নিজেরি কলিজা… দ্বিতীয়বার… দ্বিতীয়বার…
এবং তৃতীয়বারও আমি এমনটিই করবো।
নাও, এই যে তুলাদণ্ড, আর হত্যা করো আমাকে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, যশোদলপুর, কিশোরগঞ্জ। প্রকাশিত গ্রন্থ: শাদা প্রজাপিত (কবিতা), ২০০৯; কন্সপিরেন্সি অফ সাইলেন্স (গদ্যগ্রন্থ), ২০১১; টীকাভাষ্য (কবিতা), ২০১৬। সম্পাদনা: কবিতার কাগজ ‘শূন্য’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।