বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮

আওলিয়া : এনামুল রেজা

0

আওলিয়া বলে ডাকত তাকে সবাই। আওলাদ আল মিয়াকে সম্ভবত একসঙ্গে মিলিয়ে ডাকা। ফকিরাপুলের একটা পুরনো ধরণের চারতলা দালানে থাকত। তে’তলায়। সরু দালানের সরু এপার্টমেন্ট। বেশ বড়ো এক বেড, মাঝারি ডাইনিং, কিচেন আর টয়লেট। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে সেই এপার্টমেন্টে উঠতে হতো।

একটা গ্লাস হাউজের ম্যানেজার ছিল আওলিয়া। মুনশাইন গ্লাস চেম্বার। যদিও লোকজন ওটাকে আওলিয়ার কাচের দোকান নামে চিনত।

আওলিয়া বলে ডাকত তাকে সবাই। আওলাদ আল মিয়াকে সম্ভবত একসঙ্গে মিলিয়ে ডাকা। ফকিরাপুলের একটা পুরনো ধরণের চারতলা দালানে থাকত।

গ্লাস হাউজটার কাজে সে স্কুল শেষ করে যোগ দিয়েছিল। তার বাপ মনসুর আল মিয়ার বন্ধুর দোকান। আর ফকিরাপুলের এপার্টমেন্টেও সে বাবা-মা আর বোনদের নিয়ে বসবাস করত জন্মের আগে থেকেই। সময় সামনে দিকে গড়ানোর সাথে সাথে তার বোনেদের বিয়ে হয়েছে একে একে, তারা যার যার স্বামীর সংসার করছে এখন পৃথিবীর বিবিধ প্রান্তে। বাবা-মা কয়েক বছরের ব্যবধানে মরে গেলেন। এক সময়ের হৈ-হুল্লোড়ে ভরা এপার্টমেন্ট এখন ফাঁকা ভুতুড়ে। সারাদিন তো সে প্রায় থাকেই না।

আওলিয়ার বয়স বেশি নয়। টেনে টুনে আটাশ হতে পারে। কিন্তু মাথার চুল পড়ে যাওয়ার কারণে তাকে খুব বয়স্ক দেখায়। এ ছাড়া স্বাস্থ্যও ভালো না। উচ্চতায় মাঝারি। ইদানিং নামাজ ধরেছে। সে কারণে দাড়ি কাটছে না। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ। নামাজের পরিবেশ তাদের ঘরে তেমন ছিল না। ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে জুমার নামাজে যাওয়াটা ছিল অভ্যেসের মতো। এরপর সে ছেড়েই দিয়েছিল সব।

ঘটনাক্রমে এক সাম্প্রতিক গ্রীষ্মকালে জুম্মার খুতবা শুনে সে নবীর প্রেমে পড়ে গেল। ইয়াসরিবে নবীর উপরে তার শত্রুরা পাথর ছুড়ে মারছে, নবী রক্তাক্ত হয়েও কাউকে অভিশাপ দিচ্ছেন না, এই ঘটনাটা শুনে সে ভরা মজলিশেই শব্দ করে কেঁদে ফেলেছিল।

মসজিদের ইমাম তাকে গোঁফ চেঁছে ফেলতে বলেছেন, কিন্তু গোঁফ আওলিয়ার খুব পছন্দের জিনিস। কিছুটা আধুনিকমনা তরুণ মসজিদের ইমাম একদিন এ নিয়ে তাকে ঘুরিয়ে বলেছেন, ‘এমন গোঁফদাড়ি ইসলামে তো নিষেধ আছে ভাই।

‘হুজুর, কোনো সমস্যা তো হইতাছে না।’

‘না হউক, এমন গোঁফদাড়ি রাখা কিন্তু ইহুদি কালচার। একটা টিভি সিরিজ আছে দেখবেন, পিকি ব্লাইন্ডার্স, সেইখানে আলফি সলোমন নামে এক ইহুদি মদের কারবারি আছে। তারে দেখলেই বুঝবেন।’

আওলিয়া হুঁ হাঁ করে চলে এসেছে। তবে পিকি ব্লাইন্ডার্সের প্রথম সিজন প্রায় শেষ হয়ে এলেও ইহুদি আলফি সলোমনের দেখা সে পায় নাই। একবার তার মনে হলো, হুজুর নিশ্চয় মজা করেছেন।

নামাজ শুরু করার পর নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছিল আওলিয়া। চারদিকে এত এত অনাচার আর অনিয়ম তার চোখে পড়ছিল যা আগে কখনও সে খেয়াল করে নাই। এত পাপকর্ম মানুষ কিভাবে করে এটাও তার মাথায় আছিল না। মুসলমানের ঘরের ছেলেমেয়ে। কিন্তু অবিশ্বস্ত, সুদ-ঘুষ করে, মিছা কথা বলে, সুযোগ পেলেই অন্যের হক মেরে খায়।

যেমন এক শুক্রবারের কথা বলা যাক। মুনশাইন গ্লাস হাউজের মালিক গোলাম রব্বানী যেহেতু আওলিয়ার বাবা মনসুর আল মিয়ার বন্ধুজন, তিনিও আজ মরেন কাল মরেন অবস্থায় আছেন। দোকানের মালিকানা এখন বলতে গেলে আওলিয়ার চেয়ে কয়েক বছরের ছোটো দিলশাদ রব্বানীর।

যেহেতু শুক্রবার, জুম্মার নামাজ পড়ার বিষয় ছিল। দিলশাদ সেদিন দোকানে এলো একটা টিশার্ট আর জিনস পরে। নামাজের আগে আগে তাকে দেখে আওলিয়ার মাথা গরম হয়ে গেল।

‘একি মিয়া, এমন ল্যাটকায়া পেন পরছো কেন? গাঁটের উপর উঠাইয়া পরতে তো পারো।’

দিলশাদ রব্বানী কিছুটা অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি এই কথা বলতেছ? এই পেন তো তুমি আমি দুইজন এক লগে গিয়া কিনলাম নুরজাহান মার্কেট থিকা?’

‘হ। তো কী হইছে? এই দেখ, কাইটা কেমন খাটো কইরা ফেলছি?’

‘দুই মাস আগে তুমিও তো এই পেন এমন লটাকায়াই পরতা। অখনে কী হয়া গেল দুই মাসে?’

‘পেন এমন লটাকায়া পরা ইছলামে নিষেধ আছে।’

দিলশাদ রব্বানী হেসে ফেলল এই কথায়, ‘কইতাছো কী? এই যে এমুন ঝোপের লাহান গোঁফও রাখছো দাড়ির লগে, এইটাও তো ইছলামে নিষেধ আছে।’

‘কাইটা ফালামু। গোঁফ কাটতে আর কী লাগে? আইজই কাইটা ফালামু। তুমিও পেন গুটাইয়া পরো।’

‘গুটাইলাম না। আমি কী করুম না করুম এইটা ঠিক করবা নিকি তুমি।’

তর্কটা ঐ পর্যন্তই ছিল। কিন্তু নামাজের সময় হলে জুম্মাতেও গেল না দিলশাদ। সেদিনের পর থেকে আগ বাড়িয়ে বা একান্ত দরকার ছাড়া বাল্যবন্ধু দিলশাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল আওলিয়া। সুযোগ থাকলে হয়তো মুনশাইন গ্লাস হাউজের চাকরিও সে ছেড়ে দিত।

তর্কটা ঐ পর্যন্তই ছিল। কিন্তু নামাজের সময় হলে জুম্মাতেও গেল না দিলশাদ। সেদিনের পর থেকে আগ বাড়িয়ে বা একান্ত দরকার ছাড়া বাল্যবন্ধু দিলশাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল আওলিয়া। সুযোগ থাকলে হয়তো মুনশাইন গ্লাস হাউজের চাকরিও সে ছেড়ে দিত।

অফিস মসজিদ চায়ের দোকান বাসা, ক্যান্টিন অফিস বাজার বাসা। এই তার ঘোরাফেরার রুটিন। এভাবেই জীবন কেটে যাচ্ছিল। সোশাল মিডিয়ায় ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লেখালেখিও ছিল তার আরও এক নিত্যকাজ। যেহেতু, কারও সঙ্গে পথে দেখা হলেই নামাজ আর চুল-দাড়ি-পোশাক নিয়ে কথা বলত আওলিয়া, বন্ধুবান্ধব দূর থেকে তাকে দেখলেই কেটে পড়ত, একে অন্যকে বলত, ‘ঐ দেখ, আওলিয়া আইতাছে, তরে পুলছেরাত এইবার পার করায়াই ছাড়ব।’

এদিকে আবার নিজের গোঁফের স্বাস্থ্যও পুষ্ট হচ্ছিল। গোঁফে নিয়মিত শ্যাম্পু করা, সরিষার তেল মাখানো, এ ধরণের যত্ন নিত সে। চুলের তো আর যত্ন নেবার উপায় ছিল না কেননা তার চুলই ছিল না প্রায়। মসজিদে গেলে অনেকেই তার দিকে বাঁকা চোখে চাইত।

ইমাম সাহেব একদিন বলে ফেললেন, ‘গোঁফ তো দেখি পুরা ইহুদি-নাছারাদের মতো বানাইয়াই ফেললেন। পিকি ব্লাইন্ডার্স দেখেন নাই?’

‘দেখছি তো। কিন্তু কই, আলফি সলোমনরে তো দেখলাম না।’

‘কোন পর্যন্ত দেখছেন ভাই?’

‘পরথম সিজন।’

‘সেকেন্ড সিজনে তারে পাবেন। প্রথম সিজনে তো নাই। আচ্ছা, থাক, ওতে কাজ হইবো না। আপনেরে মেসেঞ্জারে এখ্যান সিনেমার নাম পাঠাইয়া দিমুনে। ওতে দেখবেন যে মূল নায়ক ডাক্তার ইয়ং, সে কেমন বেদ্বীন খবিশ ইবলিশ।’

‘হুজুর এইটা কী বলেন, খবিশের সিনেমা আমি দেইখা কী করব?’

‘দেখবেন। দেখে বুঝবেন যে দ্বীনের নিয়ম কানুন মানা কত জরুরি।’

সেই রাতে মেসেঞ্জারে ইমাম সাহেবের বার্তা এলো। গুগলে সার্চ দিয়ে আওলিয়া কিছুক্ষণেই বুঝে গেল এইটা এক নাকমরা আমেরিকান ব্লু ফিল্ম। এক কালে বিশেষজ্ঞরা এই ছবির বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক ব্যাখ্যা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তথ্যগুলো সহজে হজম না হওয়ায় প্রথমে নিজের মনে কিছুক্ষণ সে ছিঃ ছিঃ করল। ইমাম সাহেব এরকম বদ লোক সে আগে ভাবে নাই। তাকে এমন একটা বাজে ছবি কেন দেখতে বললেন?

তবে একটু পরেই মনে হলো, ইমাম সাহেব বিবেচক মানুষই তো, নিশ্চয় বিবেচনা করেই বলে থাকবেন। সুতরাং সিনেমাটা খুঁজে বের করতে সে অনেকটা সময় খরচ করল। এক মেয়ের কাহিনি, যার জীবনে যৌনতার ছড়াছড়ি কিন্তু তৃপ্তি নাই। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার ইয়ং এর দেখা সহজেই সে পেয়ে গেল। এবং বুঝল কেন ইমাম সাহেব তাকে ছবিটা দেখতে বলেছেন। মোটা ঝাড়ুর মতো গোঁফ ইয়ং লোকটার। উনি মেয়েদের গোপনাঙ্গের চিকিৎসক। খুব দুষ্ট লোক।

সেই রাতে আয়নায় মেলাক্ষণ নিজের বড়ো হতে থাকা গোঁফের দিকে চেয়ে রইল আওলিয়া। ইমাম সাহেব তাকে এমন খারাপ লোকের সঙ্গে তুলনা দিয়েছে ভেবে বেদম মন খারাপ হলো। মন খারাপের কারণেই হয়তো ফজরের ওয়াক্তে মসজিদে গেল না সে।

সেই রাতে আয়নায় মেলাক্ষণ নিজের বড়ো হতে থাকা গোঁফের দিকে চেয়ে রইল আওলিয়া। ইমাম সাহেব তাকে এমন খারাপ লোকের সঙ্গে তুলনা দিয়েছে ভেবে বেদম মন খারাপ হলো। মন খারাপের কারণেই হয়তো ফজরের ওয়াক্তে মসজিদে গেল না সে। অতঃপর সারা দিন পার হয়ে গেল। এমনকি দোকানের যে কর্মচারী তার অনুসরণে নামাজ শুরু করেছিল, সে এসেও জোহর আর আছরের ওয়াক্তে বলল নামাজের কথা। নিজের অফিস কামরা থেকে বের হলো না আওলিয়া।

কিছুদিনের মধ্যেই তার কেশহীন মাথা আর দাড়ি-গোঁফে ভরতি চেহারাটা উন্মাদ ধরণের হয়ে গেল। ইমাম সাহেবের মুখোমুখি হতে হবে এই দুশ্চিন্তায়ই হয়তো মসজিদের যাওয়া সে বাদ দিল। কিন্তু কেন যে গোঁফ কাটছে না, এটা সে নিজেও বুঝতে পারল না। এ কি এক ধরণের জেদ? নিজের সঙ্গে না অন্য মানুষের সঙ্গে? বুঝে এলো না তার।

ইমাম সাহেব কয়েকবার এর তার মাধ্যমে তাকে ডেকে পাঠানোর পরেও আওলিয়ার দেখা পান নাই। সুতরাং একদিন আছরের নামাজ শেষে মুনশাইন গ্লাস হাউজে চলে এলেন। আওলিয়া প্রথমে তার সঙ্গে দেখা করতে না চাইলেও অবশেষে রাজি হলো। ইমাম সাহেব সম্মানী লোক। দেখা না করলে তার অপমান।

আওলিয়াকে দেখে চমকে উঠলেন ইমাম, ‘ভাই আমার, এ কী অবস্থা হয়েছে?’

সে জবাব দিল না। ইমাম আবার বললেন, ‘আপনি আমার উপর রাগ হয়েছেন?’

‘জ্বি না।’

‘তা বললে কি মানবো ভাই? আমার উপরে রাগ করতে পারেন, আল্লাহ পাকের উপরে তো আর রাগ করা ঠিক না। আসেন ভাই, আপনি এই এশার ওয়াক্তে আসেন, গোঁফ আপনাকে কাটতে হবে না। আমি অনুতপ্ত। আপনাকে ঐ ছবির কথা বলা ঠিক হয় নাই।’

আওলিয়া বলল, ‘রাগ যে কার উপরে হইছি জানি না হুজুর। গোঁফটা যে কেন কাটতেছি না, এইটাও বুঝি না।’

‘সবই শয়তানের অসোওয়াসা তথা কুমন্ত্রণা। নামাজে আসেন। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’

সে আবার হুঁ হাঁ করল। ইমাম সাহেব চলে গেলেন। নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ হয়তো কাজ করছিল লোকটির। হয়তো সেই অপরাধবোধ থেকে নিজেকে হালকাও করতে পারলেন। কিন্তু আওলিয়া যথারীতি মসজিদে গেল না।

মসজিদে না গেলেও, নামাজ পড়া বন্ধ করলেও, ফেসবুকে হাদিস কুরআনের আয়াত এগুলো নিয়মিত শেয়ার দিতে ভুল হতো না তার। আগেকার এই অভ্যেসটা রয়ে গিয়েছিল। একদিন এক বিখ্যাত নায়িকার পেজে গিয়ে তার খোলামেলা কোন ছবির নিচে আওলিয়া বেশ গুছিয়ে দীর্ঘ মন্তব্য লিখল, যার সারাংশ এইরকম: নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে নায়িকা হিসেবে নিজের সম্মান বজায় রাখা উচিত, ইজ্জতের পরোয়া করা উচিত…নইলে ইমানদার মানুষেরা চুপচাপ মেনে নেবে না। সঙ্গে পর্দা বিষয়ক একটা আয়াত।”

সেই কমেন্টে একুশ হাজার রিঅ্যাকশন পড়ল। আরও হাজার হাজার লোক মন্তব্য করেছিল। তার কথাটাই কেন এত মনোযোগ পেল, বুঝতে পারলো না আওলিয়া। কিন্তু এই কমেন্টের সূত্র ধরে তার নিজের ফেসবুক শেয়ার আর পোস্টগুলোতেও মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেল।

এরপর অল্প কিছু দিনের মধ্যে একজন ফেসবুক সেলেব্রেটি হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করল আওলিয়া। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে লেখালেখি করে। প্যালেস্টাইনে মুসলিমদের উপর ইহুদিদের অত্যাচারে সে উচ্চকণ্ঠ। মাদ্রাসা শিক্ষা-ব্যবস্থার রিফর্মেশন কেন জরুরি এসব নিয়েও নিজের যুক্তি দেয়। ইদানিং নারী-পুরুষের উন্মুক্ত সম্পর্কের বিরুদ্ধেও সে জনগণকে সচেতন করে। তিন থেকে দশ হাজার রিঅ্যাকশন পায়। বিশেষ করে মেয়েদের পর্দা বিষয়ক লেখায় বেশি লাইক কমেন্ট লাভ অ্যাংগ্রি রিঅ্যাকশন জমা হয়। নিজের মতামতের একটা বিশাল গ্রহণযোগ্যতা তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

কিন্তু এইসব আসলেই কি তার জীবনে ঘটে? মাঝেমধ্যেই আওলিয়ার সন্দেহ হতো। ফকিরাপুলের পৈত্রিক সরু এপার্টমেন্টের বিছানায় শুয়ে নিজের হার্টবিট শুনতে চেষ্টা করত সে। সোশাল মিডিয়ায় কেন সে নিজের এমন একটা পরিচিত দাঁড় করাল? কী লাভ এতে? সে যা নিজেকে মনে করে, আর বাস্তবে যা কিছু করে, একটা তো আরেকটার একদম বিপরীত।

কিন্তু এইসব আসলেই কি তার জীবনে ঘটে? মাঝেমধ্যেই আওলিয়ার সন্দেহ হতো। ফকিরাপুলের পৈত্রিক সরু এপার্টমেন্টের বিছানায় শুয়ে নিজের হার্টবিট শুনতে চেষ্টা করত সে। সোশাল মিডিয়ায় কেন সে নিজের এমন একটা পরিচিত দাঁড় করাল? কী লাভ এতে? সে যা নিজেকে মনে করে, আর বাস্তবে যা কিছু করে, একটা তো আরেকটার একদম বিপরীত। প্রায়ই তার মনে হতো যে ফেসবুক একাউন্টটা বন্ধ করে দেবে। বিষণ্ণও লাগত। কয়েকবার এমনকি আত্মহত্যার কথাও সে ভেবেছিল। আর সে সময়গুলোতেই দেখা যেত বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হোটেল থেকে ইলিশ-খিচুড়ি পাঠিয়েছে বাবুর্চি চুন্নু।

এভাবে বেশিদিন অবশ্য চলতে পারল না। এক রমজান মাসে তারাবীহর আগে আগে ইমাম সাহেব মুনশাইন গ্লাস হাউজে দলবেঁধে এলেন। তার সঙ্গে মহল্লার গোটা দশেক ক্ষমতাবান মুসল্লি। গোঁফ-দাড়িতে ঢাকা আওলিয়ার মুখ দেখে সকলেই সমস্বরে নাউযুবিল্লাহ বলে উঠল।

ইমাম বললেন, ‘ভাই কেমন আছেন? আপনি তো এখন বিখ্যাত লোক।’

সে বিব্রত হলেও চুপ করে রইল। ইমাম সাহেব আবার বললেন, ‘কিন্তু একজন বেনামাজী হয়ে এইভাবে আপনি ধর্মব্যবসা করবেন, কখনও ভাবিনাই।’

পাড়ার ক্ষমতাবান একজন মুসল্লি যোগ করলেন, ‘হাজার হাজার লোক আপনার কথা মান্য করে। আপনি তাদের ধর্মীয় জ্ঞান দেন। কিন্তু নিজে এমন খবিশি অবস্থায় থাকেন। নামাজে আসেন না। এসব তো পাপ কাজ হইতেছে।’

‘তাহলে আমাকে কী করতে বলেন আপনারা?’

‘ভণ্ডামি বন্ধ করবার কই। নামাজে আসতে হইবো আপনারে। না হইলে ধর্ম নিয়া এইসব লিখালেখি বন্ধ করতে হইব।’

‘কিন্তু আমি কি মিথ্যা কথা লিখি? যেইডাই কই, হাদিস কুরান ঘাইটাই তো বলি হুজুর।’

বয়স্ক একজন মুসল্লি তখন প্রশ্ন করেন, ‘কিন্তু কেন বলেন? আপনের উদ্দেশ্য কী? এর জবাব দিবার পারবেন বাবা?’

আওলিয়া কিছুটা রেগে গেল এই পর্যায়ে। কেননা, সে আসলেই কী বলবে ভেবে পেল না। সবাইকে উদ্দেশ্য করে সে জানাল, ‘দ্বীনের কাজ কে কিভাবে করবে কেন করবে এর জবাবদিহি আমি মানুষের কাছে করব না।’

তখন ইমাম সাহেব সিদ্ধান্ত ঘোষণার কণ্ঠে জানালেন, ‘তাহলে আমাদের আর কিছুই করার নেই ভাই। আপনাকে আমরা আল্লাহর নামে সঠিক পথে নিয়ে আসতে চাই। আমাদের ক্ষমা করবেন।’

নাটকীয় কায়দায় ইমাম তিনবার হাতে তালি দিলেন। আর রুমে এসে ঢুকল মহল্লার নাপিত সাইনাত হোসেন। আওলিয়া তাকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেও কোনো প্রতিবাদ করল না। সাইনাত হোসেন তার দাড়ি ছেঁটে দিল একমুঠি পরিমাণ বড়ো রেখে। এরপর লালচে হয়ে ওঠা মোটা গোঁফ খুরের কয়েক পোঁচে নামিয়ে ফেলল। কেশহীন মাথায় যা কিছু কেশ অবশিষ্ট ছিল ফেলে দিল সেসবও। পকেট থেকে সাদার উপর সবুজ সুতোয় নকশা করা সুন্দর একটা টুপি আওলিয়ার কেশবিহীন মস্তকে পরিয়ে দিলেন ইমাম সাহেব। নরম কণ্ঠে আওলিয়াকে বললেন, ‘জ্ঞানী লোক আপনি। দ্বীনের সেবায় আপনারে আমরা চাই। এইভাবে তো শয়তানের রাস্তায় একলা ছাইড়া দিবার পারি না।’

বয়সের এই পর্যায়ে এসে আওলিয়ার বেঁচে থাকা একটু শ্লথ হয়ে পড়ল। যেন বা এর দরকার ছিল। মুণ্ডিত মাথা আর দাড়ি নিয়ে সে কিছুই করল না প্রায়। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিজেবল না করলেও ব্যবহার বন্ধ করে দিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বোনেরা ফোন করলে জানাল যে, দেশে সে ভালো আছে, কোনোরকম ভিসারই প্রয়োজন নেই। এসব দিনেও তার মরে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তখন শীতকাল থাকত আর অনেক শীত নামলেই বাবুর্চি চুন্নু সন্ধ্যাবেলায় রসে ডোবা চিতুই আর ধোঁয়া ওঠা খেজুরের গুড়ের চা পাঠিয়ে দিত।

তবে কিছুদিন পর তারচেয়ে বয়সে অনেকটা বড়ো এক মহিলাকে বিয়ে করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল আওলিয়া। দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সূত্র ধরে বিধবা রুকসানা পারভিন এসেছিল তার কাছে অর্থ সাহায্যের জন্য। মহিলার সঙ্গে তার তেরো বছর বয়সী এক পুত্র কাউসার।

এভাবে আওলিয়ার জীবন এক নতুন মোড়ে বাঁক নিলে তার প্রতি অনেকের আগ্রহই কমে গিয়েছিল। ফকিরাপুলের সেই সরু এপার্টমেন্টের বেডরুমে রুকসানা পারভিন আর কাউসার ঘুমাতো রাত নামলে। আওলিয়া ঘুমাতো ড্রয়িংরুমে বিছানা পেতে। রুকসানা পারভিন একদিন তাকে নিজের সঙ্গে শুতে ডাকবে এই স্বপ্ন দেখে দেখে তার জীবন কাটতে শুরু করেছিল।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

এনামুল রেজা একজন ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক। প্রথম উপন্যাস 'কোলাহলে' প্রকাশ পেয়েছে ২০১৬ সালে। অনিয়মিতভাবে নিজের ওয়েবসাইট এবং পত্র-পত্রিকায় লিখে থাকেন। জন্ম ১৯৯১। ঢাকায়, মিরপুরে মায়ের বাসায়। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পৈত্রিক নিবাস খুলনায়। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস। লেখক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের অন্যতম ওয়ার্ডপ্রেস সফটঅয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান উইডেভস-এ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।