মহাঢেউ
তোমার প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার গল্পটি শুনেছি
প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতটি শুনিনি।
আকাশে যে চাঁদ, তা অনেকটা মাথার উপর উঠে এসেছে।
আমি মাইক্রোবাসের পেছনের সিটে শুয়ে পাহারা দিচ্ছি তাকে।
পাতলাবান সীমান্ত থেকে তাকে ধরে এনেছি
আরেকটু দেরি হলেই সে লুকিয়ে পড়তো মেঘালয়ের পাহাড়ে।
আমি যে ধুলো ভালোবাসি, তা তো তুমি জানোই।
ধুলো যে আমাকে ভালোবাসে, সঙ্গে থাকলে
তুমি বুঝতে পারতে। পৃথিবী আজ ভালোবাসায় ভালোবাসায়
ভরে গিয়েছে।
একজন প্রাং, উদ্ভাবন করেছে আচিক লিপি।
তার স্বপ্ন— একদিন মুদ্রিত নোটে ছাপা হবে গারোদের এই ভাষা।
একজন অনন্যা— তার কাছে লিপি শিখতে এসে,
ভালোবেসে ফেলেছে তাকে। এখন তারা কারখানা থেকে ফিরে
নতুন হরফে নতুন কবিতা লিখে চলেছে
রাতের পর রাত।
বিরান প্রান্তরে গারো শিশু-কিশোর আর যুবতীরা এসেছিলো
তাদের চুলে ধুলো— যেন পুষ্পরেণু।
তাদের পা খালি, কিন্ত চোখগুলো চকচক করছিলো ভালোবাসার
আবেগে।
অপুষ্ট শরীর— চারপাশে তবু মৌ মৌ করছিলো হৃদয়ের সৌরভ।
তারা নাচলো, তারা গাইলো, তোমরা আসবে, আমরা বিশ্বাস করিনি
কিন্তু আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, তোমরা আসবে।
তারা ছড়িয়ে দিলো বুনো ফুল আমাদের মাথার ওপর।
তারপর পরিয়ে দিলো পাখির পালক-গাঁথা মুকুট।
আমরা জানি, এসবের উপযুক্ত নই আমরা কেউ।
কিন্তু যারা ভালোবাসে তারা কোনো যুক্তি মানে না।
আমরা শিখলাম, কীভাবে ভালোবাসতে হয়।
আর বললাম, সেই ভালোবাসারই কথা।
যদিও জানি, এই ভালোবাসা দুই বেলা নুন-ভাতের কোনো
নিশ্চয়তা দেবে না তাদের, ছেঁড়া জামার বদলে গায়ে উঠবে না
নতুন পিরান, খালি পায়ে জুতো—পরিশ্রম ছাড়া পাবে না অন্য পরিত্রাণ।
আমরা নষ্ট মানুষদেরই প্রতিনিধি— যারা সব অসঙ্গতি রচনা করে।
তবু আমাদের বুক হুহু করে, চোখের পাপড়িতে বাষ্প জমা হয়।
আমরা ওদের বুকে জড়িয়ে ধরি, বলি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
বালুর সমুদ্রের যেখানে শেষ, সেখান থেকে পাহাড়ের সূচনা।
ওটা মেঘালয়— আমার দেশ না।
আমি মেঘের সঙ্গে মিশে থাকা দূরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি
ওখানে থাকে প্রাঙের বাবা, কিছু দূরে কয়লাখনিতে।
জীবিত না মৃত, সে জানে না। কেউ জানে না।
এ এমন এক উপত্যকা— যেখানে জীবন ও মৃত্যু
স্বতন্ত্র কোনো অর্থ বহন করে না।
সন্ধ্যা নামে। সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে— অস্ত যাওয়ার আগেই
পুবের আকাশে উঠে আসে চাঁদ। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা
ঝরনা— আমাদের নদী— মহাঢেউ। নামটা যেন নির্মম পরিহাস।
অস্পষ্ট আলোয় আমরা নদীর জলে হাত রাখি— বুক রাখি, মুখ রাখি।
তখনই বুঝতে পারি, অনেক জল আর উঁচু প্রবাহ হলেই নদী মহৎ
হয়ে ওঠে না— ভালোবাসতেও জানতে হয়।
আমরা ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে উঠে আসি তার পাড়ে—
ধুধু মরুভূম—এক শস্যহীন প্রান্তর।
চাঁদের আবছা আলোয় আমরা তৃষ্ণা নিবারণ করলাম।
এই সেই চাঁদ— হয়তো তুমি এখন এর দিকেই তাকিয়ে আছ।
আর গুনগুন করে গাইছ শৈশবে শেখা প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত।
ভালোবাসার টানে আমরা এসেছিলাম, ভালোবাসার টানে
আমরা ফিরে যাচ্ছি। দৃশ্যগুলো খুব মসৃণভাবে
পিছলে যাচ্ছে পেছনের দিকে— পিছলে যাচ্ছে
পাহাড়ি সব মুখ, অন্তরঙ্গ চু আর ওদের চোখভরা স্বপ্ন।
এমন এক পূর্ণিমার রাতে, মনে পড়ে, লুম্বিনি গ্রাম।
আমরা তবু ঘরে ফিরে যাচ্ছি।
এমন এক পূর্ণিমার রাত— কোনো এক পূর্ণিমার রাতে
সব জড়তা ভেঙে তুমি হয়তো আমাকে শুনিয়ে দেবে
তোমার শেখা প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর আমার মনে পড়বে
পূর্বজন্মের স্মৃতি—
ঘাম-মাখা কিছু মুখ, ধুলোর মতো মিহি স্বপ্নচূর্ণ
জোছনার মতো দিগন্ত-প্লাবিত ভালোবাসা
আর
পাহাড়ের পদতলে মহাঢেউ নদী
বয়ে যাচ্ছে
বয়ে যাচ্ছে
বয়ে যাচ্ছে
অনন্ত কালের সীমানায়।
আত্মা যতটা দূরে থাকে
বলি, একটু সাবধানে থাকো
দূরে রাখো নিজেকে
জানো তো, লোকজন কী বলে?
আমি খুব বেখেয়ালি, উদাসীন
অলস ও স্বপ্নচারী।
রাতের যে প্রহরে নিশাচর পাখিও
ঘুমিয়ে পড়ে— আমি জেগে থাকি
গন্তব্যের আগেই আমি নেমে যাই,
থেমে থাকি
আর অনেকে তো ভাবে,
আমার কোনো গন্তব্যই নেই
আমি তাকিয়ে দেখি না কিছু
শুনে কিছু বুঝতে পারি না
আমি কথা বলি খুব নিচু স্বরে
বিষমাখা তির কলজে এফোঁড়-ওফোঁড় করলে
আমি চিৎকারও করতে পারি না
তবু নাকি আমি ভয়ঙ্কর
তবু নাকি আমাকে ভালোবেসে ফেলবার আশঙ্কা
তাই বলি, একটু সাবধানে থাকো
একটু সতর্ক থাকো
দূরে রাখো নিজেকে
আত্মা যতটা দূরে থাকে
লাশ থেকে
অন্তত ততটা।
এখন গৃহদাহ, এখন জতুগৃহ
এখন গৃহদাহ, এখন জতুগৃহ
এখন আসমান কাঁপছে কুণ্ঠায়
ঘিঞ্চি গলি আর সদর রাস্তায়
না, কোনো কিছু নেই মানব-আস্থায়।
এখন নদীতীরে বালুরা ঝলকায়
একটি রালুকণা অগ্নিফল খল খায়
নদীতে জলও নাই, ও নদী, জ্বলো তাই?
পূর্বাভাসে তুমি এ-কথা বলো নাই!
দখিনা বায়ু বয়, বাতাস এ তো নয়
বায়ুতে ভাসবে কি ফুলের রেণু আর?
এমন অসমান দেখিনি প্রান্তর
যে দিকে চোখ যায় সব অবান্তর।
স্তম্ভ নড়ে যায় মানুষ মরে যায়
চাওয়া ও পাওয়াতে যে তফাৎ বিস্তর
রক্তে ঘামে আর কিংবা সাধনায়
একটি অঞ্জলি দে জল তিস্তায়।
এদিকে দ্বিপ্রহরে গ্রাম কি এ শহরে
বানের মতো নামে তীব্র চিৎকার
জঙ্গি ভঙ্গিতে সঙ্গী সংগীতে
হিসেব নিতে চায় কতোটা জিত কার।
জলের প্রাণ নেই সে অপরাহ্ণেই
পাখিতে গান নেই দীর্ঘকাল
অনেক চাওয়া নেই একটি চাওয়া—এই
শান্ত স্নিগ্ধ ধীর সকাল।
মৃত্যুর পর কিন্তু সমাহিত হওয়ার আগে
আমার মৃত্যুর পর কিন্তু সমাহিত হওয়ার আগে
আমার শরীরটা কীভাবে পড়ে থাকে,
তাকে নিয়ে কী কী কাণ্ড হয়,
তা খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
কারা আসে, কারা কাঁদে, কারা হাসে,
কারা নির্বিকার— দেখতে চাই আমি। নিজেকে আমার
দেখা হয়নি কখনো— দর্পণে নয়,
জলে নয়,
কারো চোখের তারায় নয়।
পাখি উড়ে গেলে খাঁচাটাকে কতটুকু নিঃসঙ্গ দেখায়,
কতটুকু মিহি ধুলো উড়ে উড়ে আসে, কোন ঝরা পাতা?
আমি যাদের ভালোবেসেছি, কিন্তু যারা আমাকে ভালোবাসেনি—
যারা আমাকে ভালোবেসেছে, কিন্তু যাদের আমি ভালোবাসতে পারিনি,
যাদের আমি ঘৃণা করেছি, কিন্তু যারা আমাকে ঘৃণা করেনি,
যারা আমাকে ঘৃণা করেছে, কিন্তু যাদের আমি ঘৃণা করিনি—
তাদের চোয়ালের ভাঁজ কেমন বদলে যায,
তা আমি প্রত্যক্ষ করতে চাই
আমার মৃত্যুর পর কিন্তু সমাহিত হওয়ার আগে।
হীনযান থেকে যারা আমাকে তুলে নিয়েছিল
মহাযানে— প্রান্তিক অবস্থান থেকে নন্দনকানন—
তারা এই নিস্পন্দ দেহের দিকে কীভাবে তাকায়—
দেখে যেতে চাই।
কার মুখচ্ছবি পৃথিবীর অন্তিম দৃশ্য— জেনে নিতে চাই।
গভীর অরণ্যে জ্যোৎস্না
তোমাকে ভালোবাসি বলে দীর্ঘদিন তোমার কাছ থেকে
অনেক দূরে থাকলাম—
পাতাল যেমন আকাশ থেকে অনেক দূরে থাকে
কিংবা চোখের তৃষ্ণা থেকে মায়াবী মুখ
কিংবা নদীর উৎস থেকে সমুদ্রের মোহনা।
অভিমান এত তীব্র, কিন্তু আমি আর সইতে পারছি না।
আমাকে তুমি ডাকনি, তবু আমি ফিরে আসছি—
জল যেমন ফিরে আসে জলের বুকে,
স্মৃতি যেমন ফিরে আসে গভীর লতাগুল্ম ছিঁড়ে,
আলোকরশ্মি যেমন ফিরে আসে অন্ধকারের জরায়ু ভেদ করে—
তেমনভাবে আমি ফিরে আসছি।
কোনো সংবর্ধনা আমি আশা করি না তোমার কাছে—
চৈত্রের জমি যেমন আশা করে না আকাশের কাছে একফোঁটা জল,
শীতের আকাশ যেমন সমুদ্রের কাছে আশা করে না এক চিলতে মেঘ,
শরতের মেঘ যেমন তার বুকে আশা করে না বজ্র-বিদ্যুৎ;
তবু আমি ফিরে আসছি তোমার কাছে, তোমার কাছেই।
কিংবা আমি দূরেই যাইনি তোমাকে ভালোবাসি বলে,
হয়তো আমি তোমার বুকের মধ্যেই ছিলাম—
জলের মধ্যে যেমন লুকিয়ে থাকে তৃষ্ণা,
নক্ষত্রের বুকে যেমন মিশে থাকে স্বপ্ন,
স্বপ্নের ভেতর যেমন লুকিয়ে থাকা মগ্নচৈতন্যের বিষ।
দীর্ঘদিন পরে আমি তোমাকে অনুভব করলাম—
বৈশাখের গরম ধুলো যেমন অনুভব করে প্রথম বৃষ্টির জল
নারী যেমন আস্বাদন করে মাতৃত্বের অহংকার
মাতৃত্ব যেমন অনুভব করে অস্তিত্বের বিস্তার
কিংবা এই প্রথম তুমি আমাকে অনুভব করলে গভীর অরণ্যে জ্যোৎস্নার মতো
কিংবা সমুদ্রের তলদেশের বর্ণময় স্নায়ুশিরার মতো
কিংবা ঔদাস্য-ভারাক্রান্ত একজন অন্তর্নিহিত কবির মতো।
জল্লাদ আমাকে টেনে নিয়ে যাবে গিলোটিনে
মহাসড়ক ছেড়ে গলিতে ঢুকেও দেখেছি বড়ো বড়ো গাড়িগুলো সেখানে ঢুকে পড়ে। যেন জীবাত্মা মিলিত হওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে তার পরমাত্মার সঙ্গে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়, আমার ইচ্ছে নয়, তবু তাদের আমি অধিকার করি। তারা আমার সঙ্গে মিশে যায়। আর হাইওয়ে থেকে অপহৃত মাল-সামানসহ ট্রাক বা কাভারড ভ্যান উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ। একবার আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম জলার ধারে, দূর থেকে একটা আন্তঃনগর ট্রেন ধেয়ে এসে ঢুকে গেল আমার বুকের ভেতর। অনেক যাত্রী ছিল তাতে, আমার শুধু মনে হলো, ‘থাক, এদের খাদ্য-বস্ত্রের অভাব অন্তত হবে না।’
আসলে আমি চাই একটা নিরিবিলি জীবন। মাথার ওপরে একটা আকাশ, যৎ-সামান্য মেঘের সঞ্চার, চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো প্রকৃতি। রঙবেরঙের কয়েকটা পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং আর গুবরেপোকা। জলাশয়ে হিল্লোল। আমি চাই ফসলের জমি থেকে ফিরে আসা উদাসীন কয়েকটা মানুষ। দিগন্তের দিকে ছুটে যাওয়া কিছু ছেলেমেয়ে।
এক জোছনারাতে আমি হাঁটছিলাম ফাঁকা একটা মাঠে। সমুদ্র থেকে উঠে আসা বাতাসে কীসের একটা লোনা গন্ধ— আমি ভাবছিলাম। এই অপরাধে পুলিশ আমাকে হুইসিল বাজিয়ে হাতকড়া পরিয়ে হাজতে ভরলো, চালান করে দিলো কোর্টে, মহামান্য আদালত আমাকে জামিনও দিলেন না। জেব্রার মতো জামা চড়িয়ে পুরে দিলেন জেলখানার ভেতর। আসলে সেটা ছিল এক অরণ্য। কচি ঘাসপাতার গন্ধে আমার চোখ বুজে এলো। বাঘ-ভালুক আর বুনোফুলের গন্ধ আমাকে নেশাগ্রস্ত করে ফেললো। হয়তো আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, নয়তো জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। আর এই দীক্ষা আমি লাভ করলাম যে, বন্দি কখনোই সর্বার্থে রুদ্ধ নয়। আমার চঞ্চল চিত্ত ঘুরে বেড়াতে থাকলো কাল থেকে কালে, পাতা থেকে ডালে, ডালপালা থেকে পুষ্পের সৌরভে। ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আমিও তেমন স্বপ্নে গেলে অপরাধ করে ফেলি, মাননীয় আদালত।
মর্মান্তিক আদালত, ওই তো কালো পোশাক-পরা জল্লাদ আসছে। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যাবে গিলোটিনে।
ফোঁটা ফোঁটা রক্তে লিখিত হতে থাকলো সেই কবিতাটি—
লাগাতার বৃষ্টির মতো নাজিল হচ্ছে কবিতা-বিষয়ক ফতোয়া।
কাগজে একটি বর্ণ বসালে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি গোয়েন্দাদের মধ্যে।
একটি চিত্রকল্পে থরথর করে কেঁপে ওঠে সিংহাসন।
আমাকে রিমান্ডে নিয়ে গিয়ে মাথার ওপর তীব্র আলো জ্বেলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন।
সবই অবান্তর। যেন ছেলেখেলা। আর ওদের চোখে-মুখে
অসম্মান করতে পারার উল্লাস।
আর এরই পুনারাবৃত্তি। পুনরাবৃত্তির পুনরাবৃত্তি।
এই আমাদের বাস্তবতা। এই বাস্তবতাই আমরা নির্মাণ করেছি।
বংশ-পরম্পরা। এই আমাদের প্রাপ্তি— যুগ থেকে যুগ।
আমি তাই ঘোষণা করলাম, আমি আর লিখবো না। কিচ্ছুই লিখবো না।
ভুলে যাবো বর্ণমালা। আমি আর ভাববোও না। ভুলে যাবো ধ্বনি।
শপাং করে চাবুক এসে পড়ে আমার পিঠে। আমাকে ভাবতেই হবে,
আমাকে লিখতেই হবে। নইলে তার সাম্রাজ্যের অসম্মান।
আমি লিখলাম ‘তুমি’।
চারপাশ থেকে তীব্রগতি তীর এসে বিদ্ধ করে আমাকে। কে এই তুমি?
আবার আমাকে চোখ-ঝলসানো আলোর মধ্যে বসিয়ে রাখে দিনের পর দিন।
রাতের পর রাত। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। পুনাবৃত্তির পর পুনারবৃত্তি।
এই আমার জীবন। এই জীবনের বাস্তবতা।
‘কীভাবে তুমি অভিজ্ঞতা অর্জন কর?’
‘দেখে।’
আমার চোখ উপড়ে নেয়া হলো।
‘শুনে।’
আমার কর্ণকুহরে ঢেলে দেয়া হলো সিসা।
কেটে নেয়া হলো জিভ। বুজিয়ে দেয়া হলো নাসারন্ধ্র। চেছে নেয়া হলো ত্বক।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করা হলো, ‘কীভাবে তুমি আস্বাদন করো প্রশান্তি?’
‘লিখে।’
উপড়ে নেয়া হলো আমার আঙুলের নোখ। তাতেও স্বস্তি নেই।
কেটে ফেরা হলো আমার আঙুল। আর
ফোঁটা ফোঁটা রক্তে লিখিত হতে থাকলো সেই কবিতাটি—
যা আমি লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জল্লাদের ভয়ে লিখতে পারিনি।
দৃশ্য নয়, যেন দীর্ঘশ্বাস
মনে কর, আমার প্রত্যাবর্তনের পথে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া আর জারুল।
মনে কর, পথের আশেপাশে জলাশয়— তাতে বাতাসের খুনসুটি।
মনে কর, আমি মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি ঘরে—
ঘর— আকাশ যার ছাদ, আর দেয়াল— দিগন্ত।
মনে কর, ঝরাপাতার মতো পেছনে গড়াগাড়ি খাচ্ছে কান্নার স্বর,
যেন আবহসঙ্গীত।
মনে কর, লেবুফুলের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
মনে কর, অন্যের জমি চাষ করে নিজের ভাঁড়ারের দিকে তাকিয়ে আছে
…………….. ভূমিহীন কৃষক। দৃশ্য নয়, যেন দীর্ঘশ্বাস।
মনে কর, বুকের ভেতরে ঢুকে গেছে একটি গণিত— যোগ-বিয়োগ
…………………… গুণ বা ভাগ— ফল একই।
মনে কর, পাখি ডাকছে প্রবল বৃষ্টিপাতের ভেতর।
মনে কর, জোছনা দখল করে নিচ্ছে দিনের সমস্ত সম্বল
মনে কর, গর্ভদেশে স্পন্দমান নতুন প্রাণ—
মনে কর, ষড়েন্দ্রিয়ের কিছু ভোজ সম্পন্ন করে আমি ফিরে যাচ্ছি।
পথ ঢুকে যায় বুকে
চৌমাথা বা পাঁচমাথার মোড়ে এলে মনে হয়
সবকটি পথে পা বাড়িয়ে দিই।
দেখি, কোন পথ কোথায় নিয়ে যায়।
আমি অস্থিরতা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকি—
আর পথগুলো ঢুকে যায় আমার বুকের মধ্যে।
আর মনের মধ্যে জেগে ওঠে দ্বিধা,
এ কথা কি সত্য— সব পথ একই গন্তব্যে পৌঁছায়?
পথ নদীর মতো— না বেঁকে সে এগুতে পারে না।
পথের সরলতাকে বোকার মতো দেখায়।
দুপাশের দৃশ্য বদলে যেতে থাকে আর ওপরে
স্বকীয় আকাশ।
এক পথে যদি তুমুল বৃষ্টিপাত, অন্যপথে খরা।
এক পথে যদি গর্ত খোঁড়া হয়, অন্যপথে ঝরে পড়ে ফুল।
এক পথে অন্ধকার ঘাঁপটি মেরে থাকলে
অন্যপথ ভেসে যায় আলোর বন্যায়।
এক পথে লেবুফুলের গন্ধ তো অন্যপথে
রঙিন ডানার চঞ্চলতা।
একটি জীবন নিয়ে আমার আর কোথাও যাওয়া হয় না,
আমি বুকে অস্থিরতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আর
পৃথিবীর সমস্ত পথ এসে ঢুকে যায় আমার বুকের মধ্যে।
বাতাসকে বন্দি করা যায়— আকাশকে নয়
তোমার ভালোবাসার আলিঙ্গন এত তীব্র— আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
আমি ভয়ে ভয়ে থাকি। আমি ছড়িয়ে পড়তে চাই দশ দিগন্তে কিন্তু তুমি
আমাকে বন্দি করে রাখতে চাও তোমার হিরন্ময় ক্ষুদ্র কুঠুরিতে।
জীবন একটাই। তাই আমি ডানা মেলে উড়তে চাই মহাসমুদ্রের গভীরে,
সাঁতার কাটতে চাই মহাশূন্যে। কাচের দেয়াল ভেঙে আমি বাতাসের মতো
ছড়িয়ে পড়তে চাই বিশ্ব-চরাচরে। তুমি চাও পাথরের স্থবিরতা ও আনুগত্য।
আমি চাই গায়ে জল-কাদা লেগে থাক— চুলে ধুলো, চোখে সমুদ্র-শিশির।
কিন্তু তুমি তা সহ্য করতে পার না। প্রেমিক আর ক্রীতদাসের পার্থক্য তুমি
বুঝতে চাও না। তাই তুমি ভয় দেখিয়ে ভালোবাসা আদায় করতে চাও।
আমি বাইরে যাই— আমার পায়ের নিচে পৃথিবী, মাথার ওপরে আকাশ।
তোমার বুক ঢিপঢিপ করে। অরণ্যের অন্ধকারে জোনাকির এক চিলতে
আলো নিয়ে আমি ঘরে ফিরি। তুমি তখন আমাকে নিরীক্ষণ কর। তোমার
মনে হয় যে-সৌম্যমূর্তি নিয়ে আমি বাইরে গিয়েছিলাম, তা ছিনতাই হয়ে
গেছে। তোমার দীর্ঘশ্বাসের উত্তাপে ঘর ভরে যায়। তুমি কোনোদিন ভাবতেও
পারবে না, জোছনাময় রাতে আমি যদি বাইরে না-যেতে পারি, চাঁদ এসে
আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকে। সরোবরের জল হাঁটু মুড়ে আমার
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে; চুলে হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
আকাশ নেমে আসে হাতের নাগালে— আমি ঘুমাই মাটির শয্যায়। সোঁদা গন্ধ
আর ঝিঁঝির ডাক আর পাখির গান আর বাতাসের সুর আমাকে ঘিরে থাকে।
আমি মিশে যাই তাদের সত্তায়। একদিন নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারবে— বাতাসকে
বন্দি করা যায়— আকাশকে নয়।
খালেদ হোসাইন। জন্ম ১৯৬৪ সালে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। মা সুফিয়া খাতুন। বাবা গোলজার হোসাইন। মা কবিতা লিখতেন, আর স্বপ্ন দেখতেন। একটা স্বপ্ন ছিল, এই ছেলে কবি হবে। খালেদ হোসাইনের কবিতার জগতটি ক্রমাগত রহস্যময় হয়ে উঠেছে। কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য ও ৭টি অনুবাদসহ— প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৫। খালেদ হোসাইনের নেশা ভ্রমণ, স্বভাবে ঘরকুনে। পেশায় তিনি বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।