অনুবাদ : তন্ময় হাসান
পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা যে কয়জন ক্ষ্যাপা চিত্রশিল্পীর কথা শুনতে পাই তাদের মধ্যে সুইস বাংশদ্ভুত শিল্পী পল ক্লী একজন। তিনি ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে সুইজারল্যান্ডের সুচেনবুচিসে জন্মগ্রহণ করেন। জার্মান সংগীত শিক্ষক হ্যান্স উইহেল ক্লে ও মা সুইস গায়ক ইডা মেরি ক্লে, নেক্সিকের দ্বিতীয় সন্তান তিনি।
ছোটোবেলা থেকেই পল ছিল অতি উৎসাহী ও প্রতিভাবান এক বালক। পিতা মাতার সংগীতপ্রীতি তাকেও সুনাম এনে দিয়েছিল কিন্তু ধরে রাখতে পারেননি। ১৮৯৪ সালে পল তাঁর পিতা-মাতার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিউনিখের ফাইন আর্টস একাডেমিতে হেনরিচ, নাইর এবং ফ্রাঞ্জ ভন স্টকের সাথে শিল্পচর্চা শুরু করেন।
পল ক্লী কে প্রথম চিনি তার এ্যবস্ট্রাক্ট আর্টের মাধ্যমে। তার সম্পর্কে আরও জানতে গিয়ে তাকে চিনি ইতিহাসবিদ, সাররিয়ালিজমের জনক আর বাউহাস আর্ট এর গুরুলোক হিসেবে। এই সুইস-জার্মান আর্টিস্ট বিংশ-শতাব্দীর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আর্ট মুভমেন্ট এর সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
পল ক্লী’র কাজগুলা সবসময়ই বহুমাত্রিক দেখা যায়। আমরা নানা ফর্ম, অক্ষর, জীবজন্তু ও বৈষয়িক জিনিস দেখতে পাই তার কম্পোজিশনে। জোয়ান মিরো, সালভাদার দালি থেকে মার্ক রথকো ও রবার্ট মাদারওয়েল সবাই ক্লী’কে মর্ডান আর্টের পথিকৃত হিসেবে মেনে নিয়েছে। ক্লী’র হাত ধরে মর্ডান আর্ট এবং আর্টিস্ট একটা নতুন পথ পায়।
সংগীতের দিকে বিশেষ দূর্বলতা ছিল তার। তিনি খুব ভালো ভায়োলিনও বাজাতেন। সংগীত থেকে বরাবরই আঁকার অনুপ্রেরণা পেতেন। বাচ্চাদের আঁকা ছবিতে বিশেষ আগ্রহ ছিল তার। ১৯১৪ তে আফ্রিকা গিয়ে প্রচণ্ড প্রভাবিত হন আফ্রিকান হায়রোগ্লিফিক আর আর্ট দ্বারা, যা পরে তার করা কাজেও দৃশ্যমান।
পল ক্লী আঁকাআকির পাশাপাশি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। লেখক হিসেবেও তিনি বেশ খ্যাত। তার লেখা ডায়রি-ই সে প্রমান।
ডায়রি থেকে তার টিনএজ বয়সের কয়েকটি এন্ট্রি প্রথম পর্বে অনুবাদ করা হলো।
১.
বাচ্চাকালের স্মৃতি দিয়ে শুরু করলে, আমার জন্ম হয় মুনচেনবুখসের একটা স্কুলঘরে, বার্ণ শহরের কাছেই, ১৮ ডিসেম্বর ১৮৭৯ সালে। আমার জন্মের কয়েকমাস পর আমার বাবা যিনি হফওয়েল টির্চাস ট্রেনিং কলেজে সংগীতের শিক্ষক ছিলেন, বার্ণে পাকাপোক্তভাবে বসবাসের অনুমতি পান। প্রথমে আমরা আরবারগারগেস নামের ছোট্ট গলিতে গরীবি একটা বাসাতে উঠি। খুব তাড়াতাড়িই হলারস্ট্রাসে ৩২ এ চলে যাই যা অনেক বড়ো আর অভিজাত এলাকা। এই দুই বাসার কোনো স্মৃতি আমার মধ্যে নাই কিন্তু এরপর হলারস্ট্রাসে ২৬ এর কথা আমার ভালো ভাবে মনে আছে। এখানে আমি ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণির পড়ালেখা শেষ করি। এরপর আমরা চলে যাই ক্রিচেনফেল্ড, যেখানে আমি আমার শৈশবের কম অপাপবিদ্ধ সময় পার করি। হাইস্কুলের শেষ বছরে, আমরা ওবস্টবার্গের পারিবারিক বাঙলোতে কাটিয়েছি।
২.
যখন বড়োরা কথা বলত, এই ধরেন আমার মা আর তার বান্ধবী, তাদের দ্রুত কথা বলার মধ্যে থেকে আমি শব্দ আলাদা করতে পারতাম না। এই অর্থ ছাড়া অসীম বাক্যগুলাকে আমার বরাবরই ভীনদেশী ভাষা মনে হতো। (২ বছর)
৩.
একবার আমার মা বাসায় ফিরে দেখলেন তার সুন্দর টেবিলল্যাম্পটা ভেঙে গেছে। তার একটানা কান্না একটা গভীর প্রভাব সৃষ্টি করছিল আমার মধ্যে। (৩ বছর)
আমার দাদীআম্মা, ফ্রিক, ক্রেয়ন দিয়া আমাকে আঁকা শিখিয়েছেন। সে একধরনের নরম টয়লেট পেপার মতো কাগজ ব্যবহার করতেন।
৪.
আমার দাদীআম্মা, ফ্রিক, ক্রেয়ন দিয়া আমাকে আঁকা শিখিয়েছেন। সে একধরনের নরম টয়লেট পেপার মতো কাগজ ব্যবহার করতেন। সিল্ক পেপার বলতেন তিনি এটাকে। দাদী আপেল কামড় দিয়ে খেত না, টুকরা করেও না। সে একটা চাকু দিয়ে পুরাটা ছিলে নিয়ে খেত। টক টক ঢেকুর তার প্রতিদিনের কাহিনি। (৩-৪ বছর)
![পল ক্লি](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2021/09/71905_1561787628.jpg)
পল ক্লির পেইন্টিং
৫.
মেয়েদের সৌন্দর্য সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা ইঁচড়েপাকা হলেও ছিল যথেষ্ট গাঢ়। জরি ফিতা বাঁধা প্যান্ট পরতে না পারার কারণে মেয়ে না হওয়ার দুঃখও ছিল আমার।
৬.
শৈশবের অনেক সময় ধরে বাবাকে আমি পরোক্ষভাবে বিশ্বাস করতাম এবং তার কথাগুলোকে (বাবা সব পারে) ধ্রুব সত্য হিসেবে মানতাম। কিন্তু একটা জিনিসই সহ্য করতে পারতাম না সেটা হলো এই বুড়ো লোকের খেপানো। একবার একা আছি, খেলার ছলে নিজে নিজে অভিনয় করছিলাম। হঠাৎ একটা আনন্দিত ‘ওফ’ শব্দ আমাকে খুব আঘাত করে। পরের সময়ে এই ‘ওফ’ শব্দ অনেক রেগুলার ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
যেদিন রাতে মা-বাবা বাইরে যেত, ঘরের দায়িত্ব থাকত কাজের লোকের কাছে। ঘর বাড়ি পরিষ্কারে আমরাও অংশগ্রহণ করতাম অনেক আগ্রহ নিয়ে। যখন ঘর মোছার সময় হতো, ওই ব্রাশে বসে আমরা সামনে পেছনে ঘুরে বেড়াতাম।
৭.
যেদিন রাতে মা-বাবা বাইরে যেত, ঘরের দায়িত্ব থাকত কাজের লোকের কাছে। ঘর বাড়ি পরিষ্কারে আমরাও অংশগ্রহণ করতাম অনেক আগ্রহ নিয়ে। যখন ঘর মোছার সময় হতো, ওই ব্রাশে বসে আমরা সামনে পেছনে ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু এই স্পেশাল সুবিধা সবসময়ই পেত আমার বোন। দুঃখজনক মুহূর্ত, যা পরে পুরো সন্ধ্যার মর্মকেই প্রশ্নবিদ্ধ করত।
৮.
ভূত-প্রেত যা আমি আঁকতাম (৩ বছর বয়সে) তা হঠাৎই বাস্তব হওয়া শুরু করল। আমি ভয়ে দৌড়ে মায়ের কাছে যাই আর অভিযোগের সুরে জানাই যে তারা জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।
৯.
দাদীর মৃত্যু আমার উপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের আশেপাশে যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। আর আমার ফুফু, মাথিলডার চোখের জল ছোটো একটা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছিল। ওইদিনের পরও হাসপাতালে লাশ রাখা ঘরের ওদিকে যেতে কেঁপে উঠতাম। মৃতরা আমাদের আতঙ্কিত করতে পারে, এটা আমি নিজে নিজেই শিখেছিলাম কিন্তু কান্নাকাটি এমন একটা প্রথা মনে হলো যা শুধু বড়োদের জন্য বরাদ্ধ। (৭ বছর)
১০.
ভবঘুরে লোকেরা মাঝে মাঝেই আমাকে স্বপ্নের মধ্যে তাড়া করত। আমি তাদেরকে বলতাম যে, আমি তোমাদেরই একজন, আমাকে কিছু করো না। আর এইভাবে নিজেকে বাঁচাতাম। এই ছলচাতুরি পরে স্কুলেও বেশ কাজে লেগেছিল। (প্রায় ৭ বছর)
![পল ক্লি ২](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2021/09/Paul-Klee-Courtesy-of-National-Gallery-of-Canada-1024x576.jpg)
পল ক্লির পেইন্টিং ২
১১.
যখন স্কুলে নতুন বই বিতরনের দায়িত্ব পেলাম, একটা মেয়ে তার পছন্দের রং দেখাল আর বলল এই রং এর বই সে চায়। আমার হাতে তার ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা ছিল এবং আমি তাকে তার পছন্দের বইটাই দিলাম। এটা একটা গুজব ছড়িয়ে দিল যে আমি ওকে পছন্দ করি এবং এইটা আমারে একরকম কষ্টই দিল কারণ মেয়েটা অতো সুন্দর না আর থাকত ফেলসেনাও’তে।
বাগানের বেড়ার ভাঙা অংশ দিয়ে আমি একটা ডালিয়ার একটা ডাল চুরি করে আমার ছোটো বাগানে লাগিয়েছিলাম। আমি ভাবছিলাম কিছু সুন্দর পাতা হবে আর হয়তো এক দুইটা ফুল হবে। কিন্তু গাছটা বড়ো হতে থাকল আর অসংখ্য গাঢ় লাল ফুলে ভরে উঠতে থাকল।
১২.
বাগানের বেড়ার ভাঙা অংশ দিয়ে আমি একটা ডালিয়ার একটা ডাল চুরি করে আমার ছোটো বাগানে লাগিয়েছিলাম। আমি ভাবছিলাম কিছু সুন্দর পাতা হবে আর হয়তো এক দুইটা ফুল হবে। কিন্তু গাছটা বড়ো হতে থাকল আর অসংখ্য গাঢ় লাল ফুলে ভরে উঠতে থাকল। এইটা আমার মধ্যে একটা ভয়ের জন্ম দিল আর আমার ইচ্ছা করতে থাকল গাছটা ফেরত দিয়ে দিতে। (৮ বছর)
১৩.
বার্ণে, আমি একটা কনর্সাটে গিয়েছিলাম। সেখানে ‘ব্রামস পিয়ানো কনর্সাটো বাজিয়েছিল ফার্নে, ডি মাইনর টিউনে। এটা শুনে আমি একবারে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাই। যার ফলে, সেদিন রাতে আমার ঘুম হয় না আর পরদিন স্কুলে পৌঁছাই প্রায় ১ ঘন্টা দেরিতে। কিন্তু চলে যাওয়া সময়ের জন্য কিছু করা সম্ভব হয়নি।
ব্যাসেল থেকে আসা একটা মনমরা চিঠি আমাকে একবারে হতাশ করে দেয়। অন্ধকার, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া এ অনুভূতির জন্য আদর্শ মনে হয়। আমার মনে হলো এখন সবচে উচিত কাজ হবে শুয়ে দীর্ঘ একটা ঘুম দিয়ে পরের বসন্তে ওঠা। (১৭ বছর)
![পল ক্লি ৩](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2021/09/images.jpg)
পল ক্লির পেইন্টিং ৩
১৪.
কয়েকটা ছোটোগল্প লিখেছিলাম, কিন্তু সব নষ্ট করে দিয়েছি। যাই হোক, নিজেকে নিজেই সুরক্ষিত রাখছি। (১৮ বছর)
১৫.
যখন আমি একদম বাচ্চা ছিলাম, আমি সুন্দর রচনা লিখতাম আর বোধও করতে পারতাম (১০-১১ বছর পর্যন্ত)। তারপর আমার মেয়েদের প্রতি আগ্রহ বাড়ল। তারপরের সময়ে আমি টুপি পড়তাম একদিক বাঁকিয়ে আর কোর্টের শুধু শেষ বোতামটাই লাগাতাম। (১৫ বছর)। এরপর নিজেকে পেইন্টার আর একজন অভিশপ্ত মানুষ ভাবা শুরু করলাম। শেষ বছরের আগেই স্কুল ছেড়ে দিতাম কিন্তু বাপ-মা এর প্রবল ইচ্ছায় সেটা করিনি। আমার এখন নিজেকে শহিদ মনে হয়। শুধু যা কিছু নিষিদ্ধ তাই আমাকে আনন্দ দিত। ড্রয়িং আর লেখালেখি। দ্বাদশ শ্রেণি কোনোমতে পাশ করে আমি মিউনিখ চলে আসি আঁকতে।
![Tanmoy Pro Pic](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2021/05/Pro-Pic.jpg)
কবি ও অনুবাদক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। কবিতা ও অনুবাদ ভালো লাগে।