শুক্রবার, অক্টোবর ৪

ফ্লাওয়ার মানে ফুল ও অন্যান্য কবিতা : মাজহার সরকার

0

পারমাণবিক জীবন


হেঁটেই যাওয়া যায় মানুষের কাছে
কিন্তু পথে একটা কুকুরের বিস্কুট খাওয়া দেখতে গিয়ে দেরি হলো,
বিজয়ী ধ্রুবতারার রক্তিম গণ্ড চুমে ধুলো ভালোবেসে পথ হাঁটা কত কঠিন!
প্রকৃত পশুর জীবন ছেড়ে সামাজিক সম্পর্ক চাষে কেটে গেল ময়ূর বিভা
সৌধের খরগোশ তার স্মৃতিপুকুর ছুঁয়ে দেখে চাপা পড়ে আছে বর্ণালি শরীর।
মধ্যদিনের নির্মাতা! প্রতীক্ষার নামে এ কেমন অত্যুজ্জ্বল কমলা পেলাম
মুখে রাঙামাছের দুধ, রোববার হ্রদে নীল গাভীর পালক পেল পদ্মের অঙ্কুর,
হেঁটেই যাওয়া যায় শিউলি সন্ধ্যাঝরা মসলার হোটেলে, কিন্তু
দেরি হয়ে গেল মরতে বসা ডালে একটা ফুলের হলুদ মাংস দেখে
ঠোঁটের পরাগ উড়ে যায় মোমের কৃষি ও কুয়াশায়
পথের চাবুক পথের প্রত্যাঘাত, কারখানায় তৈরি হচ্ছে বোবা পরমায়ু
তবু ঘাস সাঁতরিয়ে রোদপিঠে ছুটছে রানিহাঁস ভ্রমরজলের দিকে
ইশারার ধাত্রীপাখি এই তৃষ্ণাব্যথিত বনে শ্রুতির ছায়া ফেলে কাতরে ওঠে,
হেঁটেই যাওয়া যায় অর্থলীন মানুষের নীল অ্যাপার্টমেন্টে
কিন্তু নর্দমায় পড়ে যাওয়া একটা বেড়ালের মুখ দেখতে গিয়ে দেরি হলো
সময়ের বাদামিখড় শস্যে মানুষের নাম দেখেছি, একাকী বসে সৌন্দর্য সয়।


স্ক্রোল করে হঠাৎ খুঁজে পাই


পিক্সেলে আছে, আছে ইনবক্সেও
অবসর হলো না দেখার
বিহ্বল একটি নাম সাইবারস্পেসের পাতায়
পড়ে আছে যেন গীতল বনজাম।

একটা নাম কীভাবে হলো আইডি, ক্ষণের বিশ্বস্ত চুম্বনে ঘন,
যেমন করে বারান্দায় চড়ুইদের জন্য প্রতিদিন
এক বাটি পানি রাখি।
ওদের মধ্যে কোনো কোনোটা ওই নামের মতো
স্ক্রোল করে হারিয়ে ফেলি, ওপর নিচ করে খুঁজি
তবুও নাগালের বাইরে চলে যায়
স্নেহ নেয়, কিচিরমিচির করে, কিন্তু নিকটে গেলে
বিশ্বাস করে না আর।
আমার স্থপতি, উড়ে যায় সময়ের অ্যালগরিদমে।

জীবনে এত বই পড়েছি, কোনোটাই কাজে লাগল না
নানা জীবন ঘেঁটে, অন্যের গল্পে ইতিহাসে
নামটা পাইনি আর। মোবাইলের ব্যাটারি ফুরিয়ে ফেলে
মনে হয় দূরে আছি, নামটা যে এখন কেবল আইডি
বিগত যুগের চিহ্ন ধরে
তখনও মেসেঞ্জারে সবুজবাতি জ্বেলে অপেক্ষা করে।


ডুমুরমাতা


একই শহরে থেকেও দুটি ডুমুরের কখনও দেখা হয় না
রাস্তায় বেরুলে মনে হয় এই বুঝি অপেক্ষার দৃশ্যবীজ
মৃত্তিকার সন্ধানে ঘমায়মান কুহকে, আলাপে ছড়াবে স্বরপ্রতিমা,
দুই ঋতু গিয়ে তাদের আরেক বোন এলো, উপবনে নির্জনে
একটা ডুমুরের পতনের শব্দ
চাষীদের কানে তবু পৌঁছলো না, দৌড়ুতে থাকল,
হাড় চিরে বৈঠা বানাল, করোটি থেকে নৌকা
একজন ফল বিক্রেতা তার সবুজ ডুমুরগুলো গামছায় মুছছিল
একজন চাকুরে নারী মুগ্ধ ব্যাগ হাতে তাকিয়েছিল তাদের দিকে
একটা টিয়া ডুমুর ঠোঁটে নিয়েই লজ্জিত হয়ে পড়েছিল,
ডুমুরশিশুরাই তাদের মাকে জন্ম দিতে শেখায়
যেমন থাকে ওরা সবসময়, সোনালি, পাতায় আর ডালে,
প্রত্যন্ত কুটিরের শিশু ক্ষণে কেঁদে ওঠে, একই শহরে পথের পাশে
চিরুনি পাথরের আচ্ছন্ন রূপছবি অচেনা কুকুরের মতো চেঁচায়
তখন গভীর রাত জানো তো! প্রাণের প্রস্তুতি ছুঁয়ে স্মৃতির পেয়ালা
ভাঙা সন্ধ্যার চামচে বাজে ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে।
বাষট্টি বছর পর কখনও হৃত শহরে
দুই আয়ু চলে গিয়ে আরেকটি ঋতু এলো, বলল,
দুটি ডুমুরকে হেঁটে যেতে দেখেছি, আর্ত শস্যের গুচ্ছে
এমন যুবতীমুখ আগে কোনোদিন দেখা যায়নি।


ফ্লাওয়ার মানে ফুল


আকাশ থেকে অবশেষে বৃষ্টি নামলেও
দোতলা থেকে বৃষ্টি নামের মেয়েটি নেমে এলো না।
প্রেমিকের প্যান্টের পকেটে দুধছানাটি চেঁচাচ্ছে
গালে তিতিরের ঘাস, বুকের খরগোশ তাকিয়ে আছে
বাসনার সশস্ত্র জবায় ঢুকে যাচ্ছে খেলনা বন্দুক।
শহর বড়ো হচ্ছে, ছোটো হচ্ছে মাছের মন
বৃষ্টি জিজ্ঞেস করেছে, তুমি কেন বড়ো হও না?
প্রেমিক দাঁড়িয়ে থাকে পেঁয়াজের মতো, বাতাসের খোসা ছিলে
একটি লাল ঘোড়া দৌড়ে এসে থামল সেতুর ওপর
একজন কৃষক তার দুটি কুমড়া ধরে আদর করছিল
পাথর কুড়িয়ে নিলে বুকে যেমন শব্দ হয়
গত জানালায় ঝরা পাতা যেমন গিটার হয়ে বাজে
বৃষ্টি জিজ্ঞেস করেছে, গাঁদার বীজ কখন লাগাবে?
উপমায় মাটির ইঞ্জিন সারারাত চলে জ্বালানি চুম্বনে।


সামান্যই প্রকাশ করা যায়


সমুদ্রের সব রং উঠে এলে কলমের ঠোঁটে
কি-বোর্ডে যদিও দৌড়ায় বারশ ঘোড়া
প্রভাত কাকলি থেকে জন্ম নেওয়া রূপের কালি
……………….. সামান্যই প্রকাশ করতে পারে।
আর কোনো দিশারী পালক বিকশিত হবে সুগন্ধী ডানায়,
প্রাচীন গ্রহে পড়বে তোমার শরীর-সাজানো ছায়া
মুগ্ধতায় ভিজিয়ে অধর, বীজ থেকে শিষ মেলে দেখো কেবলই
মালা গেঁথে আলোর প্রাণেরা প্রতীক্ষাতেই থেকে যেতে চায়।
কেউ পৌঁছতে চায় না, দ্বিধা নিয়ে দয়িতার সময় নিয়ে
………………………কেবলি পথে মুখ ফুরিয়ে ফেলে।
মালঞ্চের ঋদ্ধ তীরে খর তৃষ্ণার দাগ নিয়ে হেঁটে
……………………একটি আলিঙ্গনও পূর্ণ করতে পারে না,
একটি সবুজে অজেয় চুম্বন পেতে কোন পত্র এত দীর্ঘ নয়
কোন ধ্বনি উৎসনির্মাণে সঞ্জীবনী জাগিয়ে উত্তর পায় না মন্থনের জল।
ভেড়ায় ফুল খাবে, আঁকা পাখির হারমোনিয়াম বাসনা ছোঁবে,
তবু সৌন্দর্য সমতা পায় না
শোধনে রক্তসেতার লবণের বন রেখে প্রতিশূন্য স্বগত সিঁড়িতে
কিংবা উন্মুখ জানালায় কেউ বাঁধে চুল, দর্পণে দেখো সামান্যই।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৮ ডিসেম্বর, ১৯৮৬, কুমিল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। লেখালেখি শুরু শৈশব থেকে। কবিতার বই ‘সোনেলা রোদের সাঁকো’, ‘শরতের বাস টার্মিনাল’, ‘শূন্য সত্য একমাত্র’, ‘প্রিয়তমো, সুন্দর সময় চলিয়া যায়’, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী নিঃসঙ্গতা’, ‘প্রেরিত পুরুষ’, ‘চিৎকার রণিত হৃৎপিণ্ডে’ ইত্যাদি।  উপন্যাস ‘রাজনীতি’ ও ‘নেমক হারাম’। গল্পের বই ‘আগ্নেয় আশ্বিনের তামুক’। পেয়েছেন ‘সিটি ব্যাংক-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার’ (২০১২) ও ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’ (২০১৬)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।