রবিবার, ডিসেম্বর ১

বই পড়ে লাভ কী?

0

প্রারম্ভিক

বই পড়ার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে স্কুলে দুয়েকটা প্রবন্ধ পড়ানো হয়। সেখানে অনেক নীতিকথা বিদ্যমান এবং যে জাতি যত বেশি বই পড়ে সে জাতি তত বেশি উন্নত এরকম কথা থাকে। কিন্তু এই ধরনের কথায় এখানকার ৯০ ভাগের উপরে মানুষ বিশ্বাসই করেন না বলে মনে হয়, আর নয় ভাগ অবিশ্বাসী ভঙ্গিতে এই ধরনের চিন্তা পাশে সরিয়ে রাখেন। এবং ধরা যেতে পারে মাত্র এক ভাগ এই ধরনের কথায় সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন।

অর্থাৎ, বই পড়ানোর শিক্ষা নীতিশিক্ষামূলক অবস্থানেই রয়ে গেছে। কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগ হয় নাই। মানুষ এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন নাই। অতএব, সেই শিক্ষাটি ব্যর্থই হয়েছে।

একজন মাটি কাটলেন, রিকশা চালালেন বা এঞ্জিনিয়ারিং করলেন; তাতে নগদ লাভ আছে। বই পড়ায় তেমন লাভ নাই। যারা বিশ্বাস করেন বই পড়ায় লাভ আছে তারাও আসলে বুঝেন না লাভ যে আছে তা অন্যরে কীভাবে বোঝানো যায়। ফলে নীতির হাতে বই পড়ারে সঁপে দিয়া বলেন তাহা বড়োই পূণ্যের কাজ।

একজন মাটি কাটলেন, রিকশা চালালেন বা এঞ্জিনিয়ারিং করলেন; তাতে নগদ লাভ আছে। বই পড়ায় তেমন লাভ নাই। যারা বিশ্বাস করেন বই পড়ায় লাভ আছে তারাও আসলে বুঝেন না লাভ যে আছে তা অন্যরে কীভাবে বোঝানো যায়। ফলে নীতির হাতে বই পড়ারে সঁপে দিয়া বলেন তাহা বড়োই পূণ্যের কাজ। কিন্তু বাস্তবের জগৎ বড়োই কাঠখোট্টা, এইখানে পুণ্য লোকে খুব একটা খুঁজে-টুজে না।

আর বোঝানোর ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের উক্তি প্রণিধানযোগ্য, যে জিনিস আপনে আপনার বৃদ্ধ কাজের মহিলারে বোঝাতে পারলেন না সে জিনিস আপনি নিজেই বুঝেন নাই।

ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় চিন্তা করে এই লেখার শুরু এবং শেষ। এখানে বই পড়ার একটা সামগ্রিক আলোচনা করা হয়েছে। কেন, কীভাবে, কোনো বই এইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের আলোচনা, বই পড়া বিষয়ে একটি দিক নির্দেশনা দিতে পারবে বলে মনে হয়।


কেন বই পড়া?

বিনোদনের জন্য? থ্রিলের জন্য? নিজেকে ফ্যাশনেবল দেখানোর জন্য? না, তা নয়। এসবের জন্য আরও অনেক সহজ উপায় আছে। শুধুমাত্র তথ্যের জন্যও নয়, পত্রিকাতে তথ্যে ঠাঁসা থাকে। তা পড়ার পর কয়জন মনে রাখে কী পড়েছিল? ডেইলি স্টোয়িক বইয়ের [রায়ান হলিডে এবং স্টিফেন হ্যানসেলম্যান] একটি অংশ এখানে উল্লেখ করা যায়—

‘আপনি এই বই কেন পড়তে হাতে নিয়েছেন? কেন যেকোনো বই হাতে নেন পড়তে? নিজেকে স্মার্ট দেখাবে এজন্য নয়, বিমানে টাইম পাস করার জন্য নয়, আপনি যেসব কথা শুনতে চান সেসব কথা শোনার জন্য নয়— ঐসবের জন্য বই পড়ার চাইতে আরও অনেক সহজ উপায় আছে।

এই বই আপনি হাতে নিয়েছেন কারণ আপনি শিখছেন কীভাবে জীবন যাপন করা যায়। আপনি আরও মুক্ত হতে চান, কম ভয় পেতে চান, এবং প্রশান্তি অর্জন করতে চান। শিক্ষা হচ্ছে মহান জ্ঞানীদের জ্ঞানবানী পড়া এবং সেসব নিয়ে চিন্তা করা। এটা শুধু করার জন্য করা নয়। এর উদ্দেশ্য আছে।

দর্শন শিক্ষা বা বই পড়ার চাইতে টিভি দেখা বা হালকা খাওয়া দাওয়া ইত্যাদিকে কোনো কোনো দিন অধিকতর ভালো মনে হতে পারে আপনার কাছে, সেইসব দিনে এই উপদেশটি মনে রাখুন, জ্ঞান— বিশেষত নিজেকে জানাই হচ্ছে স্বাধীনতা।’


বই পড়ার উদ্দেশ্য

কোনো একটা কাজে উদ্দেশ্যটা দরকারি। প্রত্যেক কাজ নির্ভর করে তার উদ্দেশ্যের উপরে।
লুইস ক্যারলের ‘এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এ এলিস একদিন এমন জায়গায় উপস্থিত হলেন যেখান থেকে দুটি রাস্তা দু’দিকে চলে গেছে। গাছে বসে থাকা বিড়ালকে সে জিজ্ঞেস করলেন, এখান থেকে আমি কোন পথে যাব?
বিড়াল প্রশ্ন করল, তুমি কোথায় যেতে চাও?
এলিস জানালেন, তা আমি জানি না।
বিড়াল উত্তর দিল, তাহলে যে পথেই যাও না কেন, বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।

বই পড়ার ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্যটা ঠিক করে নেওয়া দরকারি। উদ্দেশ্য তখন পরিচালিত করবে কোনো পথে আপনি যাবেন এবং কোনো পথে যাবেন না। উদ্দেশ্য না থাকলে কোনো পথেই আপনি কোথাও পৌঁছাতে পারবেন না। ত্রিশঙ্কু দশায় আটকে থাকবেন। ত্রিশঙ্কু মহাভারতের একটি চরিত্র। তিনি স্বশরীরে স্বর্গে যেতে চেয়েছিলেন। দেবতারা আবার তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেন পৃথিবীতে। বিশ্বামিত্র তাকে আপন তেজবলে আটকে রাখেন, ফলে ত্রিশঙ্কু স্বর্গ ও মর্তের মাঝামাঝি আটকে ছিলেন।

‘গেইম অব থ্রনস’ সিরিজের একটি চরিত্র টিরিয়ন ল্যানিস্টার। তার মুখ নিঃসৃত একটি কথার মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় তিনি কেন বই পড়েন। তার মতে, ‘একটি তরবারিকে যেমন ধারালো রাখার জন্য শানপাথর দিয়ে শান দিতে হয় তেমনি মস্তিষ্ককেও শান দিতে হয় বই দিয়ে। এজন্যই আমি বই পড়ি।’

মস্তিষ্ককে শান দেওয়া বিভিন্ন জিনিস জানা, সেই অনুপাতে চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করা। ভালো বই কেবল তথ্য দেয় না, এবং প্রশ্নের উত্তর দেয় না। প্রশ্ন দেয়, চিন্তা করতে শেখায় বা উদ্বুদ্ধ করে। যদি কোনো বই তা করতে না পারে, তাহলে ধরে নেওয়া যায় তা বাজে বই।

আমেরিকান লেখক প্যাট্রিক রথফাস এর কথায়, ‘যেসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই না সেগুলিই আমাদের বেশি শেখায়। তারা আমাদের শেখায় কীভাবে চিন্তা করতে হয়। কোনো মানুষকে যদি উত্তর দিয়ে দেন তাহলে সে সামান্য একটু ফ্যাক্ট পায়। কিন্তু তাকে যদি একটি প্রশ্ন দেন তাহলে সে তার উত্তরগুলি নিজে নিজেই খুঁজে নেবে।’

বই সম্পর্কিত আরেকটি ভুল ধারণা অনেকের মধ্যে আছে, বইয়ে যা উল্লেখ থাকে তা সত্য। এটা কখনোই নয়। স্বাভাবিক ভাবে আমরা যা জানি তার অনেক কিছুই ভুল হতে পারে এবং হয়তো ভুলই।

লেখক রবার্ট জর্ডানের কথায়, ‘আপনি কখনোই সব জানতে পারবেন না এবং যা আপনি জানবেন তার এক অংশ সব সময়ই হবে ভুল। প্রজ্ঞার একটি অংশ হলো এই সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারা আর সাহসের এক অংশ হলো, তা স্বত্ত্বেও চালিয়ে যাওয়া।’


ফ্লবার্ট ও বই পড়ার উদ্দেশ্য

লেখক গুস্তাভ ফ্লবার্টের (*ফ্লবেয়ার) বলেছিলেন, ‘শিশুদের মতো শুধু আনন্দের জন্য বই পড়বেন না অথবা উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের মতো নির্দেশ পাবার জন্য পড়বেন না, পড়ুন জীবনকে জানার জন্য।’

গুস্তাভ ফ্লবার্ট, একজন বড়ো সাহিত্যিক। অনেকের কাছে মনে হতে পারে উদ্দেশ্যমূলক পড়াশোনা বিরোধী তার এই বক্তব্য। কিন্তু তার আগে আপনাকে বুঝতে হবে ফ্লবার্ট কী হতে চেয়েছিলেন তার জীবনে? সাহিত্যের একজন মহান শিল্পী। তিনি শিল্প ছাড়া অন্য কিছুকেই গুরুত্ব দিতেন না, কায়েমী স্বার্থান্বেষী (বুর্জোয়া) পরিবারগুলিকে ঘৃণা করতেন, বিবাহকে ঘৃণা করতেন, ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

ফ্লবার্ট তার মাকে চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি পৃথিবীর কিছুই গ্রাহ্য করি না, ভবিষ্যতকে গ্রাহ্য করি না, লোকে কী বলবে তা গ্রাহ্য করি না, কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার গ্রাহ্য করি না অথবা সাহিত্যিক খ্যাতিও গ্রাহ্য করি না, যার জন্য অতীতে একসময় আমি রাতের পর রাত জেগে স্বপ্ন দেখতাম। আমি এইরকমই, আমার চরিত্রও এইরকম। (১৫ ডিসেম্বর, ইস্তাম্বুল।)’ ফ্লবার্ট যা হতে চাইতেন জীবনে তার জন্য যা দরকার তাই কেবল বই থেকে চাইতেন। শিল্প বা শিল্প ভাবনা, জীবনবোধ। অন্য একজন সাধারণ ব্যক্তি যিনি ব্যবসায়ী হতে চান বা উদ্যোক্তা হতে চান, তিনি তার দরকারের বস্তুটি নেওয়ার জন্য ঐরকম বই পড়বেন। একজন লোক টেক স্টার্ট আপে আগ্রহী হলে তিনি ‘হার্ড থিংস এবাউট হার্ড থিংস’, ‘জিরো টু ওয়ান’, ‘লিন স্টার্ট আপ’ পড়বেন। একজন ইনভেস্টর পড়বেন ‘মার্জিন অব সেইফটি’, ‘ফলি অব ফুলস’, ইতিহাস, সাইকোলজি ইত্যাদির বই।

বিখ্যাত লেখক ভি এস নাইপলকে ইন্টার্ভিউতে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বই পড়া নিয়ে, তিনি উত্তর দেন, ‘আমি আপনাকে আগেই বলেছি, আমি পড়ি সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে আমার জ্ঞান বাড়াতে। আমি একটার পর একটা উপন্যাস পড়ে আমার সময় নষ্ট করব না কেবল বলার জন্য যে, আমি এইসব উপন্যাস পড়েছি।’


বই পড়া হলো অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা

জগতে ধরা যাক দুই ধরনের মানুষ আছে। এক ধরনের মানুষ অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে আগ্রহী। তারা মনে করেন একজন মানুষ তার অল্প সময়ের জীবনে শুধুমাত্র নিজ অভিজ্ঞতায় শেখার পন করে বসে থাকলে তা গর্দভের কাজ হবে। তারা বই পড়ে অন্য লোকেরা জীবনের সমস্যা, ব্যবসার সমস্যা বা সাহিত্য, রাজনৈতিক সমস্যা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে কীভাবে মোকাবেলা করছেন তা জানেন এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। নিজে যেসব সমস্যার সাথে যুদ্ধ করছেন সেইগুলাতে এইসব প্রয়োগের মাধ্যমে তার জীবনকে একটু ভালো করে তুলতে চান। সমাজের সমস্যা নিরসনকল্পে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা সময়ে জন্মানো ব্যক্তিদের অর্জিত জ্ঞানের আলোকে তার নিজের কাজ করতে পারেন।

আর অন্য দল মানুষ মনে করেন, অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার কিছু নাই। সব শিখতে হবে নিজের অভিজ্ঞতায়। তাই তারা নিজে নিজে শেখার জন্য বসে থাকেন। একটি বিদ্যুৎ প্রবাহীত হতে থাকা স্টিলের তারে প্রস্রাব করলে কী হবে, তা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তারা ঐখানে প্রস্রাব করে থাকেন।

বই পড়েন দুই দলের মধ্যে প্রথম দলের লোক।


প্রাণী হিসেবে মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতির কারণ অন্যের কাছ থেকে শেখা

প্রাণী হিসেবে মানুষের উন্নতির কারণ কী? আমরা শারীরিকভাবে দূর্বল, গাছে চড়ার জন্য খুব উপযুক্ত না; যেকোনো শিম্পাঞ্জিই আমাদের হারিয়ে দিতে পারে। মানুষের বাচ্চা খুবই প্রি-ম্যাচিয়ুরভাবে জন্ম নেয়, তাকে দেখাশোনা করে রাখতে হয় অনেক বছর। তাও কীভাবে মানুষ প্রাণীটি এত উন্নতি করে ফেলল?

সেন্ট্রাল আফ্রিকার কোনো ট্রপিক্যাল জঙ্গলে যদি বিশ জন মানুষ আর বিশ জন বানরকে ছেড়ে দেওয়া হয় বেঁচে থাকার প্রতিযোগীতায়, যেখানেই কেউই বাইরে থেকে কোনো সামগ্রী নিয়ে যেতে পারবে না, তবে মানুষেরা হারবে। তারা টিকে থাকতে পারবে না বনের সেই পরিবেশে। আফ্রিকার সেই পরিবেশ যেখান থেকেই উদ্ভব হয়েছিল এই মানুষের পূর্বপুরুষের। কিন্তু বানরেরা ঠিকই টিকে থাকবে।

মানুষের টিকে থাকতে হলে বনে বাস করা প্রাচীন আদিবাসী পিগমি কোনো গ্রুপকে খুঁজে বের করতে হবে। আদিবাসী এসব মানুষেরা কিন্তু বহাল তবিয়তেই এই বনে টিকে আছে দীর্ঘ দীর্ঘ দিন ধরে।

কথা হচ্ছে, এমন কেন হয়? মানুষ কেন তার মস্তিষ্কের ক্ষমতা, দৈহিক ক্ষমতা ইত্যাদি দিয়ে টিকে থাকতে পারবে না?

কারণ মানুষ একটি কালচারাল প্রাণী। কালচারাল বলতে, মানুষ জন্ম নেওয়া থেকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত অনেক কিছু শেখে, বিশেষত অন্য মানুষের কাছ থেকে। এগুলির মাধ্যমেই সে টিকে থাকে।

আধুনিক মানুষের যে কালচারাল জিনিস শেখা আছে তা বনে বাসের উপযুক্ত নয়। তাই তাদের ঐ জায়গায় টিকে থাকতে হলে প্রাচীন পিগমি দলের প্রয়োজন, যাদের কাছ থেকে তারা শিখে নিতে পারবে ঐ জায়গার কালচার।

অন্য প্রাণীর চাইতে এখানেই মানুষের পার্থক্য। অন্যের কাছ থেকে শেখাই মানুষকে স্মার্ট এবং অধিকতর সফল করে গড়ে তুলেছে। অনেক অনেক বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যন্ত্রপাতি তৈরি করতে, আগুন জ্বালাতে, শিকার করতে পরস্পরের সাথে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এবং গড়ে তুলেছিল এক সামগ্রিক কালচার। অন্যের কাছ থেকে শেখা, এক জেনারেশনের অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করে পরের জেনারেশনের এগিয়ে যাওয়া; এইভাবেই এগিয়েছে মানব জাতি। আমাদের আলাদা ব্যক্তি বুদ্ধিমত্তার জন্য নয়, আমাদের সামগ্রিক বুদ্ধিমত্তা এবং তা থেকে নেওয়ার ক্ষমতাই মানুষ হিসেবে আমাদের সফলতার মূলে।

মানুষের বহুযুগের অর্জিত জ্ঞান ও চিন্তার সার থাকে একেকটি ভালো বইয়ে। তা সেনেকায় আছে, মার্কাস ওউরেলিয়াসে আছে, আছে শেক্সপিয়রে, হেগেলে, ছফায় বা রবীন্দ্রনাথে।

আমাদের কালচারাল বিবর্তন বা উন্নতি হয়েছে সম্মানীত বা শ্রদ্ধেয় (প্রেস্টিজ অর্থে) লোকদের কাছ থেকে শেখার মাধ্যমেই।
ভালো বইয়ের মাধ্যমে, ভালো বই পড়ে আমরা বড়ো মানুষের চিন্তা থেকে নিতে পারি, নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারি। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আমাদের বুঝ আরও একটু বাড়াতে পারি।


মানুষের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুকোষ

মস্তিষ্কের প্রধান জিনিস স্নায়ুকোষ। তিন পাউন্ডের একটি মানব মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষ বা নিউরন থাকে কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন। আরও প্রায় দশ বিলিয়নের মতো থাকে সহকারী জিলাল কোষ। নিউরনগুলি অন্য নিউরনের সাথে যুক্ত থাকে এবং তাদের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়। নিউরনের কোষ দেহে শাখা থাকে যার নাম ডেন্ড্রাইট, এরা অন্য নিউরন থেকে তথ্য গ্রহণ করে। কোষ দেহ থেকে বের হওয়া লম্বা একটি অংশ থাকে যার নাম এক্সন, এই এক্সন অন্য নিউরনে তথ্য প্রদান করে।

কেন বই পড়ব?তো এই নিউরনে-নিউরনে কানেকশনই আমাদের মানসিক ক্যাপাসিটি নির্ধারণ করে। কোষের সংখ্যা নয়। তাই এই কানেকশন বা কানেকশনের সম্ভাব্যতা হলো গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো নিউরন নিউরিট্রান্সমিটার নামে এক রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে তার এক্সন দিয়ে বৈদ্যুতিক তাড়না পাঠায়। এই পদার্থ অন্য নিউরনের ডেন্ড্রাইটে পৌঁছে। তখন সেইখানেও বৈদ্যুতিক তাড়নার তৈরি হয়। এইভাবে একটি সিরিজ রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়।

কোনো ভালো খবরে, ধরেন আপনি ব্যবসায় বিরাট লাভ করেছেন বা আপনার সাহিত্যকর্ম প্যারিস রিভিউতে প্রকাশ হয়েছে; ইত্যাদিতে আমাদের ভালো লাগে। কারণ আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ তথা নিউরনে ডোপামিন নামে এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার তথা রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়।

সেরোটোনিন আরেকটি নিউরোট্রান্সমিটারের নাম। আবেগ, মুড ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যবসায় আপনি লস করলেন বা অন্য কোনো কারণে (তা হতে পারে বন্ধুর সাফল্যও!) আপনার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল, তখন মস্তিষ্কে সেরোটোনিন এর পরিমাণ কমে যাবে। এর ফলে আপনার উদ্বেগ বাড়বে, হতাশা বাড়বে।

তখন হতাশা কমানোর ওষুধ নেন অনেকে। এইসব ওষুধ মস্তিষ্কে সেরোটোনিন এর মাত্রা আবার বাড়ায়। তখনো কিন্তু আপনার দুঃখের কারণগুলা থাকে, ঐগুলা বদলায় না কিন্তু হতাশা কমে যায়; কারণ মস্তিষ্কে সেরোটোনিন তখন ভালো পরিমানে থাকে।

কেন বই পড়ব ২হরমোন বিষয়ক এটা সহজ ব্যাখ্যা, কিন্তু এগুলির কাজ, প্রভাব আরও ব্যাপক। এখানে এই ব্যাখ্যাই যথেষ্ট।


বই পড়ার সাথে ব্রেইনের সম্পর্ক কী?

অভিজ্ঞতার সম্পর্ক। এরকম জিনিস আপনি শুনে থাকবেন কেউ একজন বলছেন একটি বই তার জীবন বদলে দিয়েছে। এটা কেন হয়? এটা হয় কারণ ঐ বই পড়ার সময় তার নিউরনে নিউরনে নানা নতুন সংযোগ তৈরি হয়েছে। আরও আরও সংযোগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এবং এইগুলা এত বেশি পরিমাণে যে তিনি চিন্তার নতুন দুনিয়া দেখতে পেয়েছেন। তার জীবনদৃষ্টিই বদলে গেছে।

মানুষের অভিজ্ঞতার সাথে সাথে তার মস্তিষ্ক বদলে যায়। অভিজ্ঞতা নতুন স্নায়ুকোষ বা নিউরন তৈরি বা নতুন সংযোগ তৈরির মাধ্যমে মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করতে পারে। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এমনকী এক দিনের ব্যবধানে মস্তিষ্ক পরিবর্তিত হতে পারে।

আইডেন্টিক্যাল টুইন, যাদের আইডেন্টিক্যাল জিন আছে, এদের মস্তিষ্কও আলাদা হয়। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা আলাদা। দুইজন মানুষের বেড়ে উঠা, সমাজ, সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, শারীরিক গঠন, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি একইরকম হয় না। এগুলা তাদের আচার ব্যবহার, মতাদর্শ এবং চরিত্রের নানা ভিন্নতা তৈরি করে। সাধারণত মতাদর্শের ক্ষেত্রে লোকে মনে করে কোনো মতাদর্শ সে বেছে নিয়েছে কারণ ঐটা সেরা এজন্য। কিন্তু এই বেছে নেওয়ার পিছনে তার বেড়ে উঠা, সমাজ, শিক্ষা ইত্যাদির ভূমিকা প্রচুর তা সে খেয়াল রাখে না।

অভিজ্ঞতা তৈরি করে আমাদের। আমরা একেকজন আলাদা হয়ে উঠি আমাদের অভিজ্ঞতার ভিন্নতার জন্য। এই অভিজ্ঞতা অর্জন এবং মস্তিষ্ককে আরও বেশি চিন্তা উপযোগী করার এক সেরা মাধ্যম হলো বই পড়া।

অভিজ্ঞতা তৈরি করে আমাদের। আমরা একেকজন আলাদা হয়ে উঠি আমাদের অভিজ্ঞতার ভিন্নতার জন্য। এই অভিজ্ঞতা অর্জন এবং মস্তিষ্ককে আরও বেশি চিন্তা উপযোগী করার এক সেরা মাধ্যম হলো বই পড়া। ধরা যাক, আপনি আর আপনার আইডেন্টিক্যাল টুইন ভাই শেয়ার বাজারে ইনভেস্ট করেন। আপনার ভাই বই পড়ায় আগ্রহী নয়। সে কাজে বিশ্বাসী। মার্কেটের বাতাস বুঝে ইনভেস্ট করে সে অনেক লাভও করছে তাড়াতাড়ি। আর আপনি ধীর ভাবে অল্প লাভ করেছেন আর ইনভেস্টিং নিয়ে পড়াশোনা করলেন। পৃথিবীর সব বড়ো ইনভেস্টররা কীভাবে ইনভেস্ট করছেন তা আপনি তাদের আত্মজীবনী ও বই পড়ে জানলেন। আপনার মস্তিষ্কে নতুন নতুন কানেকশন তৈরি হলো। তৈরি হলো চিন্তার নতুন সব দুয়ার। আপনি এগুলি নিয়ে চিন্তা করলেন, প্রশ্ন করলেন অর্থাৎ মেটাকগনিশনের মাধ্যমে শিখলেন।

একদিন আপনি দেখলেন শেয়ার বাজারে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে, বাজারের সবাই ভয় পাচ্ছে এবং বিক্রি করে দিচ্ছে তাদের স্টক। আপনার ভাইও এই মিছিলে শরিক হলো। কারণ বাতাস এখন ভয়ের। সেও ভয় পেল এবং লসে বিক্রি করে দিল তার স্টক। কিন্তু আপনি পৃথিবীর বড়ো ইনভেস্টরদের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে নিজের মস্তিষ্কে এই ধরনের অবস্থায় কী করতে হয়, কীভাবে এখান থেকে সর্বোচ্চ প্রফিট বের করে আনতে হয় অথবা কীভাবে ভালোভাবে অবস্থা হ্যান্ডেল করতে হয়, তা জানবেন। ফলে আপনার মধ্যে ভয় কাজ করবে না।

একজন লোক যে ধরনের বই পড়েন তার মস্তিষ্কের কানেকশনগুলি সেইরকম হয়। সেই অনুপাতে তার বোঝার ক্ষমতা গড়ে উঠে। যারা পপুলার ফিকশন পড়ে কেবল, প্রায়ই দেখা যায় তারা অন্য ভালো বই পড়তে পারে না।


কী পড়া যায় অথবা কী পড়া যায় না

যা পৃথিবীতে লেখা হয়েছে, যত বই লেখা হয়েছে তার সবই ভালো বই না। মার্ক টোয়েন যখন বলেন, একজন লোক যে ভালো বই পড়ল না, তার সাথে পার্থক্য নেই পড়তে পারে না এমন লোকের। এখানে মার্ক টোয়েন বইয়ের কথা বলেননি, ভালো বইয়ের কথা বলেছেন। বই এবং ভালো বই এক জিনিস নয়। খারাপ বই বা স্বস্তা খবরের কাগজেও লেখা থাকে, কিন্তু ক্ষতিকর। বিশ্ব সাহিত্যের বড়ো লেখক; পৃথিবীর প্রায় সব বড়ো ঔপন্যাসিক যাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন, সেই তলস্তয় বলেন, ‘সাধারণ বিষ আর বুদ্ধিবৃত্তিক বিষের মধ্যে পার্থক্যটা হলো সাধারণ বিষ তার কটু স্বাদের জন্য চেনা সম্ভব। কিন্তু স্বস্তা পত্রিকা বা বইতে যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক বিষ থাকে সেগুলো দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মাঝে মাঝে হয় আকর্ষণীয়।’

কী পড়বেন অথবা কী পড়বেন না এটা ঠিক করতে হবে আপনার কী দরকার তার উপরে। ধরা যাক আপনার কোনো জিনিস বা যন্ত্র দরকার কিন্তু আপনি তা কিনছেন না, ভাবছেন, না কিনে অনেক টাকা বাঁচানো যাচ্ছে। কিন্তু অন্যদিক থেকে এই যন্ত্র না থাকা আপনার অনেক ক্ষতি করছে যাও এক ধরনের মূল্য, যা আপনাকে পরোক্ষভাবে দিতে হচ্ছে।

একটা টুথপেস্ট আপনার দরকার। আপনি তা না কিনে টাকা বাঁচালেন ভাবলেন। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে আপনার মুখে দুর্গন্ধ হচ্ছে, দাঁতের ক্ষতি হচ্ছে। অর্থাৎ, এইদিক দিয়ে আপনাকে মূল্য দিতেই হচ্ছে।

তদ্রুপ, যে জ্ঞান আপনার দরকার কিন্তু এখনো অর্জন করেননি এর জন্য আপনাকে মূল্য দিতে হচ্ছে। হয়তো বুঝতে পারছেন না।

ভালো বই পড়ার উপায় কী? খারাপ বই না পড়া। ১৯ শতকের জার্মান দার্শনিক আর্থার সোপেনহাওয়ার সরাসরিই বলেন, ‘ভালো কিছু পড়তে হলে একজনকে অবশ্যই এটা সূত্র হিসেবে নিতে হবে যে খারাপ কিছু পড়া যাবে না। কারণ জীবন ছোটো। আর সময় ও শক্তি সীমিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ একজন একই সাথে খুব বেশি ভালো বই এবং খুব বেশি খারাপ বই পড়ে ফেলতে পারবে না কখনোই। খারাপ বইয়েরা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষ যা চিন্তার ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়।’

ভালো বই চেনার উপায় কী? সমকালে বেশি বিক্রি হওয়া বই কি ভালো বই?

আর্থার সোপেনহাওয়ার এ বিষয়ে বলেন, ‘মনে রাখবেন যারা গর্দভদের জন্য লেখে তারা সব সময়ই বেশি পাঠক পায়। তাই কেবলমাত্র পড়ুন সেসব মহৎ চিন্তকদের লেখা যারা সব কালের ও দেশের লোকদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তারাই কেবল আমাদের শিক্ষিত করতে পারেন, পথ প্রদর্শন করতে পারেন।’

ভালো বই চেনার উপায় কী? সমকালে বেশি বিক্রি হওয়া বই কি ভালো বই?

আর্থার সোপেনহাওয়ার এ বিষয়ে বলেন, ‘মনে রাখবেন যারা গর্দভদের জন্য লেখে তারা সব সময়ই বেশি পাঠক পায়। তাই কেবলমাত্র পড়ুন সেসব মহৎ চিন্তকদের লেখা যারা সব কালের ও দেশের লোকদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তারাই কেবল আমাদের শিক্ষিত করতে পারেন, পথ প্রদর্শন করতে পারেন।’

এখন কেন একজন ব্যক্তি সোপেনহাওয়ার বা এরকম অন্য কোনো জ্ঞানী ব্যক্তির কথা শুনবেন? তার কি নিজের বিচার বিবেচনা বোধ নেই? আছে অবশ্যই। কিন্তু যদি তিনি পূর্বে উল্লেখ করা দুই প্রকার মানুষের মধ্যে প্রথম প্রকারের হন, যিনি ইতিহাসের মহৎ ও বড়ো মানুষদের অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান আহরণ করেন, সর্বক্ষেত্রে নিজের স্বশরীর অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেন না; তাহলে তিনি নির্ধিদ্ধায় জ্ঞানীদের কথা আমলে নিবেন।

নিকোলো ম্যাকায়াভেলি তার দ্য প্রিন্সে লিখেছেন, ‘মহৎ চিন্তকেরা যে পথ দিয়ে গেছেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তির উচিৎ সেই পথ অনুসরণ করা। যারা সবার সেরা হয়েছিলেন তাদের অনুকরণ করা। এর দ্বারা তার দক্ষতা ঐসব মহৎদের সমান হয়ে যায় না, কিন্তু তাদের সুভাষে সুভাষিত হয়।’

মহান রোমান স্টোয়িক দার্শনিক সেনেকা বলেন, ‘যারা আমাদের আগে এসব আবিষ্কার করেছেন তারা আমাদের প্রভু না, আমাদের পথপ্রদর্শক।’

পড়ার একটি মূল জিনিসই এই। অন্য মহৎ জ্ঞানীরা যা আগেই বের করে ফেলেছেন তা জানা এবং সেই অনুপাতে জীবন ও জগৎকে বোঝার চেষ্টা করা। একমাত্র আইনস্টাইনের মাপের মেধাবীরাই বলতে পারেন তিনি অন্যের চিন্তা বা আইডিয়া গ্রহণ না করে নিজেই নিজেই আইডিয়া বের করে ফেলবেন। যদিও আইনস্টাইন নিজে অনেক পড়াশোনা করেছেন কিন্তু তার মতো প্রতিভাবান কেউ এমন ধারণা পোষণ করে থাকলে তা হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যারা তার মতো প্রতিভার নন, তাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ এবং উৎকৃষ্ট পন্থা মহৎ জ্ঞানীদের চিন্তার আলোতে নিজের চিন্তাকে শানিত করা।

এই ধরনের বই পড়ার ক্ষেত্রে যে জিনিসটা আসে তা হলো নির্বাচন। কী আপনি পড়বেন তা গুরুত্বপূর্ণ। এবং এটা সম্পূর্নরূপে আপনার উপরই নির্ভর করে, আপনার নিয়ন্ত্রণে। এই ইন্টারনেটের সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লেখা তৈরি এবং প্রকাশ হচ্ছে। এর মধ্যে সব যদি পড়তে যান, তাহলে প্রচুর মূল্যবান সময় নষ্ট হবে অর্থহীন পড়ায়। পড়া পবিত্র কোনো বিষয় নয়। পড়া বিষয়ে পবিত্রতার নৈতিক গন্ধময়ী ধারণা দূরে রেখে দরকারকে সামনে আনা উচিৎ। দরকারে পড়বেন, পবিত্র কাজ করছেন এমন চিন্তাতে নয়।

একটি ভালো খাবার খাওয়ার পরে যদি ঝুলন্ত শৌচাগারযুক্ত ডোবার পানি কেউ পান করেন তাহলে তার ডায়রিয়া হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।

ভালো লেখার সাথে খারাপ লেখাগুলি পড়তে থাকলেও এমন হবে। লেখা হচ্ছে লেখকের চিন্তা, যখন কেউ পড়েন সেই চিন্তা ঐ পাঠকের সাথে কথা বলতে থাকে। খারাপ লেখা পাঠ ভালো লেখার অন্তঃসারকে দূষিত করে দিতে সক্ষম।

কেন বই পড়ব -০৩ভালো বই সহজভাবে চেনার একটা উপায় হলো, যেসব বই সময়ের ফিল্টারিং প্রসেসের ভিতর দিয়ে এসে টিকে আছে। নিঃসন্দেহে এগুলি ভালো, নাহলে এতদিন টিকে থাকার কথা না। সেনেকা, এপিকটেটাস, সক্রেটিস, শেক্সপিয়র, তলস্তয়; খারাপ হলে টিকত না এবং বর্তমান জ্ঞানের ও শিল্প সাহিত্যের জগতে তাদের গুরুত্ব থাকত না।


সহজভাবে এই সময়-ফিল্টার দেখে র্নিদ্বিধায় একটি ভালো বই নির্বাচন করা সম্ভব।

আর সমকালে ভালো বই বা লেখা কোনটি তা বোঝা হয়তো একটু কঠিনই। কিন্তু ধ্রুপদী সাহিত্য ও জ্ঞানের ছোঁয়া কারো চিন্তায় লেগে থাকলে তার জন্য বোঝা বেশি কঠিন হবার কথা নয়। হারুকি মুরাকামি জাপানি সাহিত্যিক, তিনি তার ‘নরওয়েজিয়ান উড’ বইতে একটি কথা বলেছেন, ‘যে বইগুলি অন্যেরা পড়ছে আপনিও যদি কেবল সেই বইগুলিই পড়েন তাহলে আপনিও অন্যদের মতই ভাববেন।’

আমাদের সমাজে চিন্তার দৈন্যতা উপস্থিত। তার প্রতিফলন আছে আমাদের বইগুলিতে। আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে যে সম্পদ বেশি পাওয়া যায় তা হচ্ছে আবেগ সম্পদ। চিন্তা সম্পদ নয়।’ এই চিন্তার দৈন্যতাই আমাদের সামগ্রিক দৈন্যতার কারণ এমন ধারণা করে নেওয়া হলে আশা করি খুব বড়ো ভুল হবে না। তাই, এখানে অন্যরা যা পড়ছে তা পড়তে থাকলে এই দৈন্যতার কোনো অবসান হবে না।

পোশাক বা কোনো ফ্যাশনের বস্তুর ক্ষেত্রে নতুন বের হওয়া পণ্যটার একটা গুরুত্ব থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বইয়ের ক্ষেত্রে এমন নয়। বহুযুগ ধরে টিকে থাকা কোনো পুরনো বই প্রচুর জ্ঞান ধরে রাখতে পারে

সাধারণ মানুষের একটা প্রবণতা থাকে নতুন বইয়ের প্রতি বা লেখার প্রতি। পোশাক বা কোনো ফ্যাশনের বস্তুর ক্ষেত্রে নতুন বের হওয়া পণ্যটার একটা গুরুত্ব থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বইয়ের ক্ষেত্রে এমন নয়। বহুযুগ ধরে টিকে থাকা কোনো পুরনো বই প্রচুর জ্ঞান ধরে রাখতে পারে যা বর্তমানের পৃথিবী বুঝতে, ভালো ভাবে জীবন যাপন করতে একজনকে সাহায্য করতে পারে; যেটা নতুন প্রকাশ হওয়া বইয়েরা নাও করতে পারে।

সোপেনহাওয়ার লিখেছেন, ‘কী একইরকম সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা! তারা যেন একই ছাঁচে গড়া! একই ধরনের পরিবেশে সবাই একই রকম চিন্তা করে! এইজন্যই তাদের মতামতগুলি ব্যক্তিগত ও নিম্নমানের। এবং একজন গর্দভ পাবলিক, এইসব লোকদের লেখা আবর্জনাগুলি পড়ে শুধুমাত্র এই কারণে যে এগুলা নতুন বের হয়েছে। আর বইয়ের তাকে রেখে দেয় মহৎ চিন্তকদের কাজগুলি।’


শুয়ে বই পড়বেন না

বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত গল্পকার, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘যা দেখেছি তা অভিজ্ঞতা, যা কানে শুনেছি তাও অভিজ্ঞতা, যা বইয়ে পড়েছি তাও অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের এই মানবজীবনে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যা-কিছু গ্রহণ করে নিজের মধ্যে রাখতে পারি, তা-ই। এর বাইরে ইচ্ছে করলেই কেউ লিখতে পারে না।’

কোনো একটি ঘটনা, কোনো জায়গায় ভ্রমণের সময় অনেক কিছু আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিতে পারে। এই স্বশরীরে অভিজ্ঞতার মতোই বই পড়ার অভিজ্ঞতার সময় কোনো ঘটনার বিবরণ, চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বা কথোপকথন আমাদের নাড়া দিতে পারে। কিন্তু সেগুলি যদি উপস্থিত সময়ে মনে রাখার জন্য লিখে রাখা না হয় তাহলে প্রচণ্ড ভালো স্মৃতিশক্তির অধিকারী না হলে তা ভুলে যেতে পারেন যে কেউ। প্রচণ্ড ভালো স্মৃতিশক্তি হলেও সব মনে থাকবে তা বলা যায় না। তাই, পড়ার সময় বই দাগানো এবং নোট রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শুয়ে বই পড়বেন না, এই উপদেশ দিয়েছেন মাস্টার জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া। বই পড়ার সময় নোট রাখার গুরুত্ব বিষয়ে তাঁর আত্মজীবনী ‘সামথিং লাইক এন অটোবায়োগ্রাফি’তে লিখেছেন, ‘আমি ভুলে গেছি এটা কে বলেছিলেন সৃষ্টি হচ্ছে স্মৃতি। আমার নিজের অভিজ্ঞতাগুলি এবং আমি যেসব বিভিন্ন জিনিস পড়ি তা আমার স্মৃতিতে রয়ে যায় এবং আমার নতুন সৃষ্টির ভিত্তিমূলে পরিণত হয়। আমি এটা একেবারে শূন্য থেকে করে ফেলতে পারি না। এই কারণে, যুবক বয়স থেকেই যখন আমি কোনো বই পড়ি তখন সব সময় হাতের কাছে খাতা সাথে রাখি। আমি আমার প্রতিক্রিয়া লিখে রাখি এবং যেসব জিনিস আমাকে নাড়া দেয় ঐসব লিখে রাখি। এরকম স্তুপের পর স্তুপ খাতা আমার আছে। যখন কোনো নতুন স্ক্রিপ্ট লিখতে যাই তখন আমি এই খাতাগুলিই পড়ি। তারা আমাকে সব সময় নতুন চিন্তার বিষয়বস্তু দিয়ে সাহায্য করে। এমনকী এক লাইনের ডায়লগে পর্যন্ত আমি এই খাতাগুলি থেকে সূত্র নিয়েছি। তাই আমি যা বলতে চাই তা হলো, শুয়ে শুয়ে বই পড়বেন না।’

এডগার এলান পো বলেছিলেন বই দাগানোর মাধ্যমেই একজন লেখককে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়। তুরস্কের লেখক ওরহান পামুকের বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক বই ‘ইস্তাম্বুল’। সেখানে তিনি লিখেছেন স্থাপত্যবিদ্যায় পড়ার সময়ে তিনি প্রচুর বই পড়তেন। ধনী লোকের যেসব ছেলেরা তার বন্ধু ছিল তারা, যারা ক্লাসের বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ত তাদের বলত মানসিক সমস্যায় ভোগা লোক অথবা ব্যাঙ্গার্থে বুদ্ধিজীবি। ওরহান পামুকের দুশ্চিন্তা হতো যখন তাকে বুদ্ধিজীবি বলা হতো, যার হয়তো টাকা পয়সার সমস্যা আছে; তাই সে বই পড়ে। তিনি নিজেকে পা-চাটা লোক নন এটা বিশ্বাস করানোর জন্য বলতেন, ‘আমি উলফ, ফ্রয়েড, সার্ত্রে, মান, ফকনার এদের বই কেবল মজা পাবার জন্য পড়ি।’ তখন তার বন্ধুরা বলত, ‘তাহলে তুমি কিছু কিছু লেখা দাগ দাও কেন?’

ওরহান পামুকের সেই গর্দভ বন্ধুরাও বুঝতে পেরেছিল, যে-ব্যক্তি দাগ দিয়ে বই পড়ছে তার বই পড়া কেবল মজা পাবার জন্য নয়।

অর্থাৎ, ওরহান পামুকের সেই গর্দভ বন্ধুরাও বুঝতে পেরেছিল, যে-ব্যক্তি দাগ দিয়ে বই পড়ছে তার বই পড়া কেবল মজা পাবার জন্য নয়।

‘যদ্যপি আমার গুরু’তে আছে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একবার আহমদ ছফাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি পড়ার সময় নোট রাখছেন কি না। ছফা এতে না বোধক উত্তর দিলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘তাইলে ত কোনো কাম অইব না। ক্ষেত চষবার সময় জমির আইল বাইন্ধ্যা রাখতে অয়।’ (কীভাবে বই পড়তে হয় এই লেখাটিও পড়া যেতে পারে।)

ক্ষেত চাষ করার সময় প্রথম কাজই হলো আইল বান্ধা। অর্থাৎ চার পাশের সীমানা একটু উঁচু করে দেওয়া। এই আইলই যদি না বাঁধা হয় তাহলে মূল এবং প্রথম কাজটিই হলো না। তখন সমস্ত ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াবে তলাবিহীন পাত্রের মতো, যাতে কিছু রাখা যায় না।


পুনঃপাঠ কেন?

কেউ যখন কোনো বই পড়া শুরু করেন তখন কত আগে শেষ করতে হবে এ নিয়ে তার কারো সাথে কোনো প্রতিযোগীতা নেই। বছরে কত বই পড়তে হবে এ নিয়েও কারো সাথে কোনো প্রতিযোগীতা নেই। প্রতিযোগীতা মানুষের এক ধরনের স্বভাব, সব ক্ষেত্রেই তাই তার প্রতিযোগীতামূলক ব্যবহার চলে আসে। কিন্তু বই পাঠের ক্ষেত্রে তা যেন কখনোই না আসে।

কত দ্রুত পড়লেন এই রেইসে না গিয়ে কী পড়লাম, বুঝলাম কি না, কীভাবে এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ন ইত্যাদি ভাবাটাই এখানে দরকারি। যেহেতু আপনার মূল উদ্দেশ্য ছিল জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানা, যাতে অনিশ্চিত পৃথিবীতে ভালোভাবে থাকার কার্যকর চেষ্টা করা যায়।

ভালো বই একবার পাঠেই শেষ হয়ে যায় না। বই পড়া মানে লেখকের চিন্তার সাথে কথা বলা। দ্বিতীয়বারে, তৃতীয়বারে, চতুর্থবারে তা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে। ভিন্ন দৃষ্টিকোন নিয়ে হাজির হতে পারে যা আগের পাঠে ধরা পড়েনি।

ফ্রেঞ্চ ঔপন্যাসিক ফ্রান্সিস মোরিয়াক বলেছিলেন, ‘কোনো লোকের হৃদয় কেমন তা বোঝাতে সে কী পড়ে তা না বলে আমাকে বলুন কী সে বার বার পড়ে।’

পুনঃপাঠ জরুরি এবং এর জন্য বইগুলি জমিয়ে রাখাও দরকার। এতে আরেক সুবিধা হলো যখন দরকার হয় তখনই তা খুলে দেখা যায়। দাগানো থাকলে সহজেই যে জায়গা দরকার তাতে চলে যাওয়া সম্ভব।


সব কি বুঝতেই হবে এবং এন্টি লাইব্রেরি

মানুষ তার কমফোর্ট জোন অর্থাৎ আরামদায়ক অবস্থায় থাকতে চায়। এজন্য যে হালকা পপুলার বই পড়ে সে অন্য ভালো বই পড়তে চায় না, কারণ এতে তার অস্বস্তি হয়। ভালো বইয়ে অনেক নতুন জিনিসের সাথে সে পরিচিত হয় এবং এর বেশিরভাগই সে বুঝতে পারে না। এই বুঝতে না পারা, তার ইগোকে আহত করে। একটি ভালো বই পড়া মানে আরও অনেক ভালো বই বা ধারণার আভাস পাওয়া যা একজন ব্যক্তি জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কত কম জানে তা বুঝিয়ে দিতে থাকে।

সাধারণ মানুষেরা এতে ভিতরে ভিতরে আহত বোধ করে। তাই সে তার আরামদায়ক অবস্থা তথা কমফোর্ট জোন ছাড়তে চায় না।

কিন্তু এতে আহত হলে চলবে না। এমনকি কোনো টার্ম বা ধারণা না বোঝা গেলেও সমস্যা নেই। না বোঝা মানে সামনে বোঝার সম্ভাবনা রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন একটি চমৎকার কথা,
‘ছেলেরা যে বই পড়িবে তাহার কিছু বুঝিবে এবং কিছু বুঝিবে না, এইরূপ বিধান থাকা চাই। আমরা ছেলেবেলায় একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম— যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দুই-ই আমাদের মনের উপর কাজ করিয়া যাইত। সংসারটাও ছেলেদের উপর ঠিক তেমনি করিয়া কাজ করে। ইহার যতটুকু তাহারা বোঝে ততটুকু তাহারা পায়, যাহা বোঝে না তাহাও তাহাদিগকে সামনের দিকে ঠেলে।’

অর্থাৎ, যা বোঝা যাবে না তা সামনের দিকে ঠেলবে। এগিয়ে নিয়ে যাবে।
একজন যত ভালো বই পড়বেন তত তার সংগ্রহে ভালো বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অথবা আরও অনেক বই পড়ার ইচ্ছা তার হয়। বোঝার জন্য। এন্টিলাইব্রেরি হচ্ছে লাইব্রেরির বিপরীত। দার্শনিক উম্বের্তো একো’র সংগ্রহে প্রচুর প্রচুর বই ছিল। এর সব তিনি পড়েননি, দার্শনিক নাসিম তালেব এই অপঠিত বইয়ের সংগ্রহের নাম দিয়েছেন এন্টিলাইব্রেরি। সংগ্রহের অপঠিত বইগুলি আমাদের বুঝিয়ে দেয় অনেক কিছু এখনো আমাদের জানা বাকি, এবং আমাদের জানার সমষ্টি অনেক অল্প। এই বোধ আমাদের বই পড়া জনিত ইগো বাড়তে দেয় না।

একটি বড়ো গ্রন্থাগারে হেঁটে গেলেও একই ধরনের অনুভূতি হয়।

বই পড়ার ফলে আত্মহংকার যেন না জন্মায়, এই বিষয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁর আত্মজীবনীতে (পৃথিবীর পাঠশালায়) লিখেছিলেন, ‘এমন পড়াশোনা নয় যার ফলে আপনি আর আপনার আশেপাশের মানুষদের মাঝখানে কেতাবটাই একটা ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায়।’

তবে এর মানে এই না যে যারা লজিক্যালি ভুল মত দেয়, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব তৈরি করতে চায় এদের চিন্তার ভুল ধরিয়ে দেওয়া যাবে না, এবং এদের তুচ্ছতাকে তুচ্ছ হিসাবে দেখানো যাবে না। লুটভিগ ভিটগেনস্টাইনের কথায়, দার্শনিকীকরণ হচ্ছে ভুল আর্গুমেন্টগুলিরে রিজেক্ট করা।

তবে এর মানে এই না যে যারা লজিক্যালি ভুল মত দেয়, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব তৈরি করতে চায় এদের চিন্তার ভুল ধরিয়ে দেওয়া যাবে না, এবং এদের তুচ্ছতাকে তুচ্ছ হিসাবে দেখানো যাবে না। লুটভিগ ভিটগেনস্টাইনের কথায়, দার্শনিকীকরণ হচ্ছে ভুল আর্গুমেন্টগুলিরে রিজেক্ট করা।


বই থেকে শেখা : মেটাকগনিশন

বই হচ্ছে একটি মাধ্যম যেখানে লেখক তার চিন্তা বা আইডিয়া লিখে রাখেন। এটি পড়েন পাঠক। পড়ার মাধ্যমে তিনি তার নিজের মস্তিষ্কে লিখিত চিন্তা বা আইডিয়াগুলি নেন। সাধারণভাবে এটা হলো বই থেকে কীভাবে জ্ঞান ছড়ায় বা আহরিত হয় তার মডেল।

আপনি হয়ত এটি লক্ষ করেছেন যে কোনো বই পড়ার পর এর খুব কম জিনিসই মনে থাকে। এর একটা কারণ স্মৃতিশক্তির সীমাবদ্বতা। কিন্তু স্মৃতিশক্তির উপর পুরো দোষ দেয়া যাবে না। কারণ আপনি যখন বইটি পড়েছিলেন তখন আপনার মনে হয়েছিল অনেক কিছুই বুঝতে পারছেন। কিন্তু পরে, ধরা যাক ছয়মাস পরে চিন্তা করতে গিয়ে আপনি কয়েকটি বাক্য ছাড়া দেখলেন বিষয়টা আর মনে নেই। বা মূল বিষয়টাই মনে নেই। এই অবস্থায় পুরো দোষ স্মৃতি শক্তির উপরে দেয়া যায় না।

লেখা নামক প্রযুক্তি, এবং বই থেকে জ্ঞান সঞ্চারণের মডেল নিম্নরূপ,

 

ব্রেইন (লেখক) → আইডিয়া → বই/ লেখা → ব্রেইন (রিসিভার)

 

সব রিসিভারের সক্ষমতা সমান থাকে না, অভিজ্ঞতা একরকম থাকে না। ফলে এই ট্রান্সমিশনিজম পদ্বতি কাজ করে না। বই থেকে শিখতে তাই এর বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে হয়। প্রশ্ন করতে হয়।

বই থেকে লার্নিং হয়, যখন পাঠক ওই জিনিসটি নিয়ে প্রশ্ন করেন। এই প্রসেসটা এত সূক্ষ্ম যে পাঠক নিজেই বুঝতে পারেন না। যেমন আমি একটা জিনিস পড়ছি তখন আমার মনে হলো আমার কোনো অভিজ্ঞতা, কোনো বইয়ে পড়া অন্য কিছুর সাথে বর্তমানে পড়তে থাকা জিনিসটি মিলে বা ব্যতিক্রম। তখন আমি এই মিল বা ব্যক্তিক্রমতা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। অথবা, কোনো জায়গায় এসে আমার মনে হলো, এই ব্যাপারটা কীভাবে হয় আমি বুঝতে পারছি না, তাই চিন্তা করতে শুরু করলাম। বা, আমি বইটি থেকে নোট নিলাম, সামারি করলাম, বা বইয়ের আইডিয়ার আলোকে নানা ব্যাখ্যা দিলাম বিভিন্ন বিষয়ের। এইসবের ক্ষেত্রে ব্যক্তি কিন্তু লেখকের আইডিয়াই লিখেন না, তিনি জিনিসটাকে প্রসেস করেন, সিন্থেসাইজ করেন, এনালাইজ করেন। এটি লার্নিং হিসেবে কাজ করে।

ব্রেইন এভাবেই শিখে। এটাকে বলে থিংকিং আবাউট থিংকিং। চিন্তা নিয়ে চিন্তা করা। মেটাকগনিশন।

একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই জিনিসটা সহজে আসে না। এমনকি তিনি যদি জানেন এভাবে এভাবে করতে হয়, মেটাকগনিশনের মাধ্যমেই বই থেকে শেখা যায়, তাও তিনি এটি সহজে করতে পারবেন না।

আপনি মনে করতে পারেন যদ্যপি আমার গুরু বইতে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক আহমদ ছফাকে বলেছিলেন, কোনো বই পড়ে তা নিজের ভাষায় লিখতে পারেন কি না, সেটা ভাবতে। যদি নিজের ভাষায় লেখতে পারেন, তাহলে আপনি বুঝেছেন। রাজ্জাক সাহেব এখানে মানুষের ব্রেইন কীভাবে শিখে, এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন নিজের অভিজ্ঞতায়। মেটাকগনিশন ট্রিগার করতেই তিনি আহমদ ছফাকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন।

খেয়াল রাখতে হবে আপনি যেন বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করতে পারেন। এমন বন্ধুবান্ধব থাকা জরুরি। বইয়ে লেখকের উপস্থাপিত ধারণা, তার পক্ষে আপনার অবস্থান বা সে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে যদি কারো সাথে আলাপ করতে পারেন তাহলে বইয়ের বিষয়বস্তু উপলব্ধি করতে পারবেন আরও ভালোভাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় এটি।

আইডিয়া ছড়িয়ে দেওয়া বই পড়া এবং জ্ঞান অর্জনের অংশ। জ্ঞান অর্জন ও ছড়িয়ে দেওয়াকে পুরুষজন্মের ঋষিঋণ হিসেবে দেখা হয়েছে মহাভারতে। এখানে স্বার্থপরতার বোধ কাজ করলে বুঝতে হবে পড়াটা হয় নাই। জ্ঞানও কিছু অর্জিত হয় নাই, জ্ঞানের ছায়া অর্জিত হয়েছে। যা নিজেকেই ধোঁকা দেবে।

আইডিয়া আলোচনা করে ছড়িয়ে দিয়েও আপনার লাভ আছে। যখন আপনি অনেকের সাথে ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলবেন তখন ঐ বিষয়, নিশ্চিত থাকুন আপনি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। এর মধ্যেকার কোনো সবল বা দূর্বল দিক আপনার কাছে এসে ধরা দেবে যা হয়তো পাঠের সময় বা আগে আপনি বুঝতে পারেননি।

আলোচনা কোনো আইডিয়া বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। তবে এই জন্য কেউ কেউ আপনাকে আঁতেল ভাবতে পারে। উপরে দেখেছেন ওরহান পামুককেও তার বন্ধুরা আঁতেল বলত। এইভাবে তাদের সংজ্ঞানুযায়ী, চার্লি মাঙ্গার, ওয়ারেন বাফেট সহ পৃথিবীর সব জ্ঞানীরা, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা আঁতেল হবেন। একজন জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান হওয়া চেষ্টার বিষয়। সেনেকার কথায় পৃথিবীর ইতিহাসে দূর্ঘটনাক্রমে কখনো কেউ জ্ঞানী/প্রজ্ঞাবান হন নি। লোকের ঐসব কথায় বিন্দুমাত্র লক্ষ দেওয়ারও দরকার নেই। দার্শনিক মিশেল ডি মন্টেইনের উক্তি এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে সম্মানের সিংহাসনেও নিজের পশ্চাতদেশ রেখেই বসতে হয়।’


পুরা বই কি পড়তে হবে?

বই সম্পর্কিত সবচাইতে বড়ো এক কুসংস্কার হলো, বই পুরা পড়তে হবে। পাঠ্যপুস্তক দ্বারা শিক্ষা দেওয়া হয়, এই কারণেই হয়তো জনমনে এই ধারণা।

তাই উম্বের্তো একোর লাইব্রেরি দেখে যেমন মানুষ বলত অবাক হয়ে, আপনি এই সব বই পড়ছেন? বা দেরিদারে যেমন তার পড়ার ঘরে গিয়ে প্রশ্নকর্ত্রি জিজ্ঞেস করেন, সব পড়ছেন? এইরকম প্রায় অনেকে এই প্রশ্নের মুখামুখি হন, পুরা পড়েন?

উক্ত দুই ব্যক্তিই জানিয়েছিলেন তারা পড়েন নাই। একোর পয়েন্ট ছিল মানুষ বুঝে না লাইব্রেরি এক রিসার্চ টুল। দেরিদার পয়েন্ট ছিল, যেটা আমরা তার প্রসেস থেকে অনুমান করে নিতে পারি, বেশি পড়া না, সতর্ক পড়া।

আসলে বই পড়তে ব্যক্তির যতটুকু লাগবে ততটুকুই তিনি নিবেন। এখন এক বই আমি নিলাম, যেখানে হয়তো বিটকয়েন তৈরির ইতিহাস আছে প্রথমে, এর পরে পেট্র ডলারের-গ্লোবাল মনেটারি সিস্টেমের ইতিহাস ও এতে বিটিসির প্রভাব কী হবে, এর পরে ইথেরাম ও ডিএপ বিষয়ে। ধরা যাক, শেষের বিষয়টা ছাড়া বাকিগুলা আমি জানি, তাইলে কোনো বাধ্য বাধকতায় পুরা বই পড়তে হবে? হবে না। ইভেন স্কিম স্ক্যান করে জিনিশটা বুঝতে পারলে পড়ার দরকার নাই। সব কিছু সমান মনোযোগ দেবার মত গুরুত্ব বহন করে না।


ভালো পাঠকদের সাথে মিশুন

আপনি যদি কোনো কক্ষে সবচেয়ে স্মার্টেস্ট লোক হন, তাহলে সেই কক্ষ ত্যাগ করুন, এটা স্মার্ট হবার উপদেশ। অন্য কক্ষে যান যেখানে আপনার চাইতে বেশি স্মার্ট লোক আছেন। স্মার্ট হবার জন্য এটা প্রথম নিয়ম। পৃথিবীর প্রায় স্মার্ট লোকেরা এই কাজ করেছেন। গণিতবিদ রিচার্ড হ্যামিং যখন বেল ল্যাবরেটরীতে কাজ করতেন তখন তিনি দুপুরের খাবার খেতেন পদার্থবিজ্ঞানের টেবিলে। কারণ তার মনে হয়েছিল গণিতের টেবিলের লোকেরা যা জানেন, তা তিনিও জানেন। ফলে তার চাইতে স্মার্ট লোকদের খুঁজে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের টেবিলে গিয়ে খেতে থাকেন।

আপনি যদি কোনো কক্ষে সবচেয়ে স্মার্টেস্ট লোক হন, তাহলে সেই কক্ষ ত্যাগ করুন, এটা স্মার্ট হবার উপদেশ। অন্য কক্ষে যান যেখানে আপনার চাইতে বেশি স্মার্ট লোক আছেন। স্মার্ট হবার জন্য এটা প্রথম নিয়ম। পৃথিবীর প্রায় স্মার্ট লোকেরা এই কাজ করেছেন।

এইভাবে ভালো পাঠক হতে হলে ভালো বইয়ের পাঠকদের সাথে মিশুন। ভালো পাঠকদের কাছ থেকে আপনি ভালো বইয়ের খোঁজ পাবেন, গুরুত্বপূর্ন চিন্তার সাথে পরিচিত হবেন।

উপসংহার অথবা ঋণ স্বীকার

প্রবন্ধের শেষ কথা হচ্ছে ট্রেন্ডি হবার জন্য বই পড়বেন না। পড়ুয়া মেয়ের সাথে প্রেম করুন টাইপের লুতুপুতু পাঠক হওয়ার দরকার কী! এরকম আহাম্মকী কল্পনাও করা যায় না আসলে, প্রেম করার জন্য বই কোনো দারুণ মাধ্যম নয়। বই পড়া সময় সাপেক্ষ ও কষ্টের কাজ। এর চেয়ে বহু কার্যকরী ও সহজ মাধ্যম রয়েছে প্রেম করার জন্য। বিনোদনের জন্যও একই কথা। বর্তমান আধুনিক সমাজে বিনোদনের নানা মাধ্যম। টিভি মিডিয়া, বানিজ্যিক ফিল্ম এবং ইন্টারনেটে নানা বিনোদনমূলক ওয়েবসাইট ও এপ বিদ্যমান। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ওগুলো তুলনামূলক সহজ। বই পড়ুন জ্ঞানের জন্য, প্রজ্ঞাবান হবার জন্য, জীবন ও জগৎকে ভালোভাবে বোঝার জন্য, প্রানী হিসেবে মানুষ যেসব বোকামিতে পড়ে সর্বদা সেগুলি বোঝার জন্য এবং সেগুলিতে কম পড়ার জন্য। অপেক্ষাকৃত কম বোকা আপনি হতে পারবেন ভালো বই পড়ে। ভালো বই পড়ুন, তাতে কোনো প্রতিযোগীতা নেই। ফলে বার বার একই বই পড়তে অসুবিধা নেই। বছরে পাঁচটা ভালো বই পড়া, পাঁচশোটা বাজে বই পড়ার চেয়ে ভালো।

লিংক : ২০১৬ সালে আমার পড়া কয়েকটি বই

এই লেখায় আমি অনেক ভালো চিন্তকদের উক্তি শেয়ার করেছি। তাদের নাম উল্লেখ আছে। এছাড়া মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার অংশটা জানতে পারি জোসেফ হেনরিকের দ্য সিক্রেট অব সাকসেস বই থেকে। নিউরনের ক্রিয়াকলাপের বিষয়টি আছে পিটার বেভেলিনের সিকিং উইজডমে। সৌরিন নাগের অনুবাদে ওরহান পামুকের বই ইস্তাম্বুল, আকিরা কুরোসাওয়ার সামথিং লাইক এন অটোবায়োগ্রাফি, আর্থার সোপেনহাওয়ারের অন রিডিং, অন রাইটিং প্রবন্ধ, তলস্তয়ের উক্তি ক্যালেন্ডার অব উইজডমে আছে। রায়ান হলিডে আর স্টিফেন হ্যানসেলম্যানের ডেইলি স্টোয়িক, আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরু…ইত্যাদির উল্লেখ আছে প্রবন্ধে। নিউটনের সেই মহান উক্তি ‘আমি যদি অন্যের চাইতে বেশি কিছু দেখে থাকি, তাহলে তা হচ্ছে মহানদের কাঁধে দাঁড়ানোর জন্য।’ এই প্রবন্ধের সব লেখার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই জ্ঞানীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, কৃতজ্ঞতা ভালো বইয়ের প্রতি।

কেউ আনন্দ বা বিনোদনের জন্য বা এমনিতে বই পড়লে আমার আপত্তি থাকার কথা না, যেহেতু তার সময় নিয়ে তিনি কী করবেন এটা তার ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়, যেমন একজন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লে একে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু সমাজে সামগ্রিকভাবে ধরলে ওই ধরণের কাজের সমালোচনা করা যায়। বই পড়াটাকে একটা চিন্তামূলক কাজ ধরে নিয়ে, ইফেক্টিভ রিডিং কীভাবে করা যায়, সেইদিকে ভাবনা চিন্তারে নিতে এই লেখা। কারো উপকার করতে পারলেই এর সার্থকতা।

.

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

একজন গল্পকার। তার প্রকাশিত গল্পের বই মার্চ করে চলে যাওয়া একদল কাঠবিড়ালী এখানে জাদু শেখানো হয়, এবং কতো শতো মুখ

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।