শনিবার, জুলাই ২৭

ভোকাট্টা : আল ইমরান সিদ্দিকী

0

Motif-01১.
ব্যাচেলর ও ব্যাংকার হিসেবে আমার জীবনটা একদম পানসে। প্রতিদিন একই কাজ, একই ক্লায়েন্ট এবং প্রায়শ একই রকম ভুলের বৃত্তে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত লাগে। মাঝে মাঝে নিজের জীবনের গুরুতর সব সিদ্ধান্তকেই ভুল বলে মনে হয়। কিন্তু আজ আমার অনুভূতি একটু অন্য রকম। দু’দিন হলো নতুন ইন্টার্ন এসেছে ব্যাংকে। বুঝতেই পারছেন সে নারী। কিন্তু, তাই বলে এটা ভাববেন না যে, আমার মধ্যে অবদমিত বাসনা শিহরন তৈরি করছে। আসলে অনুভূতিটা আমি বোঝাতে পারব না, কারণ আমার অভিজ্ঞতার বাইরে এটা। প্রথম দিন তার সবুজ সিল্কের সালোয়ার-কামিজ, হাঁটাচলা, বাঁক-বিভঙ্গ, পরের দিন অর্থাৎ আজ তার সুতি আকাশি-সাদা জামায় চুলের পানি আমাকে কী কী বলল, আমি ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। ঠিক সুন্দরী যুবতি দেখলে তার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো নিঃসঙ্গ যুবকের যা হয়, আমার ঠিক তা হয়নি। নিজের চাওয়া-পাওয়া, আবেগ-অনুভূতি, সিদ্ধান্ত আমার কাছে চিরকালই একটা অনিশ্চিত ও অমীমাংসিত বিষয়। তবে আজকের মতো এতটা নিশ্চয় না। এবং এইসব অমীমাংসা আমাকে আরও নিঃসঙ্গ, উদাসীন করে তোলে। ফলে উত্তরার যে বাসাটায় আমি একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকি, সেখানে ফিরতে দেরি হয় আমার। অনেকক্ষণ একা একা ঘুরি, হয়তো পার্কে সন্ধ্যায় মানুষ হাঁটাহাটি করছে, এক কোণে একটা বেঞ্চে বসি। পার্কের কোনায় চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট খাই, সিগারেট ফুঁকি। এই উত্তরাতেই আমার প্রায় এক যুগ কেটে গেল। বন্ধু-বান্ধবদেরও বিয়ে হয়ে গেল। কত স্মৃতি; মাঝে মাঝে স্মৃতির পাশে দাঁড়াই সশরীর।

সে জেদ ছেড়ে কখনো ফোন করেনি আর। নওরীনের সাথে সম্পর্কটা নষ্ট না হলে হয়তো এখন আমার সংসার থাকত। বিয়ে, সংসার এই বিষয়গুলি এখন আমার কাছে খুব বিব্রতকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ বিয়ের কথা বললে আমি পাত্রী চেয়ে বসি।

যেমন সেদিন হাঁটতে হাঁটতে তিন নাম্বার সেক্টরের একটা গেস্টহাউসের সামনে গিয়েছিলাম। কেউ থাকে না মনে হলো। নওরীনের সাথে আমার চমৎকার স্মৃতি আছে ওই গেস্টহাউসে। নওরীন আমার জীবনে একমাত্র প্রেম। প্রেমে একাধিকবার পড়লেও, প্রেম নিবেদনের সাহস আমার কখনো হয়নি। শুধু একবার প্রেম নিবেদনসহ আমার কাছে এসেছিল। তাতেই জীবনের একমাত্র নারীসঙ্গ ঘটেছে আমার। নওরীনের জন্য খারাপ লাগে এখন, মায়া হয়। মেয়েটার সাথে অন্যায়ই করেছি আমি। বাবার একমাত্র মেয়ে, ফলত জেদি। বেকারত্বের দিনগুলিতে মনমেজাজ খারাপ থাকত, এবং খারাপ থাকার কারণে এক দিন রাগের মাথায় বলেছিলাম, এতবার ফোন করো কেন! আর করব না বলে ফোন রেখে দিয়েছিল। যত দিন সম্পর্কটা ছিল, আমিই ফোন করতাম, আমিই দেখা করার সময়-স্থান নির্ধারণ করতাম। সে জেদ ছেড়ে কখনো ফোন করেনি আর। নওরীনের সাথে সম্পর্কটা নষ্ট না হলে হয়তো এখন আমার সংসার থাকত। বিয়ে, সংসার এই বিষয়গুলি এখন আমার কাছে খুব বিব্রতকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ বিয়ের কথা বললে আমি পাত্রী চেয়ে বসি। যেমন মণি আপাকে বলেছিলাম, ‘তুমি আমাকে একটা পাত্রী ম্যানেজ করে দাও।’ মণি আপা বিস্ময় নিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ রে বাবু, তোর যে একটা মেয়ের সাথে প্রেম ছিল, সে কোথায়?… তুই কি একটা প্রেম করতে পারিস না?… এই যুগে সবাই প্রেম করে… নিজের পাত্রী নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়…’। অবশ্য ঠিকই বলে। এখন তো সবাই সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে, বাবা-মা’রাও সন্তানের প্রেমকে ঊর্ধ্বে রাখে, পাত্রের বাজারদরকে তেমন মূল্য দেয় না। ওদিকে একটা প্রেম যখন এক দিক দিয়ে ভাঙতে থাকে, তখন আরেক দিক দিয়ে আরেকটা নতুন সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। হায়! কোনো মেয়ের কঠিন সময়ে সান্ত্বনাদানকারী বন্ধুও হতে পারলাম না, তাহলে হয়তো অপর দিকে ভাঙতে থাকত আর আমার দিকে এসে জোড়া লাগত। সেলফোন, স্যোশাল মিডিয়ার প্রভাবে বদলে যাওয়া সময়ের সাথে পুরোপুরি মানিয়ে নেওয়া গেল না।

নওরীন এক দিন ফোন করে বলেছিল, ‘শোনো বাবু, তোমার পরিচিত কোনো গেস্টহাউস বা ভালো হোটেল আছে?’ কারণ জানতে চাইলে বলল ‘চট্টগ্রাম থেকে আমার এক বান্ধবী ও তার বর আসবে, তারা থাকবে দুই রাত।’ আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘না, আমার তো জানা নাই!’ সে বেশ হতাশ হয়ে জানতে চাইল আমি এত হাবলা কেন; এত বছর ঢাকায় থাকি, অথচ কিছুই জানি না। আমি বললাম, ‘জানি না বলে যে জানব না, তা তো না; খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি তোমাকে।’ নওরীনের কণ্ঠটা সাথে সাথে আহ্লাদে ভরে উঠল। বলল ‘বাবু, শোনো না, আমরাও কি পারি না!’ আমার তখন মনো হলো বান্ধবীর কথা বলাটা হয়তো একটা ভণিতামাত্র, হয়তো সে বান্ধবী ও তার বরের বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নাই।

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম; কিছু দিন পর নওরীনকে নিয়ে যখন আমি সকালবেলা রিকশায় চেপে গেস্টহাউসে গেলাম, তখন ঈদের ছুটি শেষ হয়নি। মানুষজন নেই, গাড়ি-ঘোড়া নেই। গেস্টহাউসের উলটো পাশে বাড়ির সামনের গাছে পানি দিচ্ছিল এক প্রৌঢ় লোক। কেয়ারটেকার গোছের। নওরীনকে নিয়ে গেস্টহাউসে ঢোকার সময় তার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য লক্ষ করলাম, যেন তার সমস্ত শরীরে শিহরন খেলে গেল এবং এই পরিস্থিতিকে ঘিরে তার অক্ষমতাও অস্থিরতারূপে খেলে গেল তার সর্বাঙ্গে। যেন মুখের সামনে দিয়ে সাংঘাতিক সুন্দর অনাচার ঘটতে যাচ্ছে তাকে বঞ্চনা ও বন্দিত্বে ঠেলে দিয়ে।

সন্ধ্যায় যখন দাঁড়ালাম গেস্টহাউসের সামনে, দেখি গেস্টহাউসের উলটো দিকে একটা টং দোকান বসেছে। নওরীনকে নিয়ে যখন এসেছিলাম, তখন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। চা দিতে বললাম, সিগারেট ধরালাম, কাপ হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসলাম। সত্যিই মনে হচ্ছিল বাড়িটায় কেউ থাকে না। অন্ধকার। আশ্চর্য লাগছিল ভেবে, ওই জানালাটা, অন্ধকার জানালাটা, তার ওপাশে আমি নগ্ন হয়ে শুয়ে ছিলাম নওরীনের সাথে। কী বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা! সময় ততোধিক বিস্ময়কর। আজ কয়েক বছরের ব্যবধানে সব কল্পনা বলে ভ্রম হচ্ছে। যেন কিছুই ঘটেনি। অঞ্জন দত্তের গানের লাইন মনে পড়ল ‘ফিরে তো যাওয়া যায় না যে আর সেখানে!’ আমি ছিলাম, নওরীন ছিল, রিকশায় করে পুরো উত্তরা ঘুরে বেড়ানো আমাদের! তার কথা মনে পড়লে অনুশোচনা হয় আমার। মায়া হয়। সিগারেটটা নিভিয়ে উঠে যাব, এমন সময় মনে পড়ল, আমি অন্ধকার জানালার ওপাশে, ওই রুমে, তখন দুপুর হয়েছে, লোকজন নেই কোথাও, হালকা বাতাসে অন্য দিকের জানালার পর্দায় আমগাছের ডালপালার ছায়া কাঁপছে। সময় যেন স্থির হয়ে আছে। একটা-দুটা পাখি কি ডাকছিল তখন? মনে নেই। আমার হঠাৎ সিগারেটের তৃষ্ণা পেল। কোমরের নিচে গামছা পেঁচিয়ে, গেস্টহাউসের কেয়ারটেকারকে ডাকলাম লাইটারের জন্য। নওরীন বিরক্ত হয়েছিল, তুমি এইভাবে গামছা পরে দরজা খুলবা! এখন মনে হয়, তার সব নিষেধ, তার সব আবদার কেন রাখিনি। হায়, ‘ফিরে তো যাওয়া যায় না যে আর সেখানে’। কত দিন গিটার বাজাই না। নওরীন বলেছিল, ‘আমি জবটা পালটাতে পারলে তোমাকে একটা ভালো গিটার কিনে দিব।’ কিন্তু তার জব পালটানো হলো না। বরং চলে যেতে হলো চট্টগ্রামে, পৈতৃক আশ্রয়ে। গিটার তখন আমি বাজাতাম অনিয়মিত। এখন ধুলো জমে গেছে। বন্ধুদের সাথে ব্যান্ড করার ইচ্ছা ছিল। রাহেল গানও লিখেছিল কয়েকটা। কিন্তু কেউ জবে ঢুকে গেল, কেউ মান-অভিমান করল, আর ব্যান্ড করা হলো না। হলো না জ্যামিং। ও হ্যাঁ, এসবেরও বহু আগেই বন্ধুদের দুই-তিনজন একাধিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েছিল; তখন গ্রামীণ ফোনের একচেটিয়া ও চড়ামূল্যের নেটওয়ার্ক সার্ভিসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাংলালিংক চলে এসেছে বাজারে। ২৫০০ টাকায় ফোনসহ সিমকার্ড দিচ্ছিল তারা। অচিরেই সবার হাতে হাতে বাংলালিংক চলে গেল। দোকানে দোকানে ফ্লেক্সিলোডের পোস্টার লাগল। আমরা নিয়মিত ভার্সিটিতে যেতাম, ক্লাস করতাম অনিয়মিত। ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে সুন্দরীদের ফোন নাম্বার নানা জনের ফোনে জায়গা পেল। তখন দিন এমনই ছিল। বন্ধুদের কাছে চাইলে অপরিচিত সুন্দরীদের নাম্বার পাওয়া যেত। আমিও কয়েকজনের নাম্বার জোগাড় করেছিলাম। তখন মনে হলো ২০/২১ বছরের একটা যুবকের সঙ্গিনী না থাকাটা বেইজ্জতির ব্যাপার। অবশ্য আমার মূল বন্ধুসার্কেলে থাকলে এমন মনে হতো না। কারণ, সেখানে দুই-তিনজনকে বাদ দিলে সেটা মোটামুটি একটা ‘চিরকুমার সভা’ই ছিল; সংগীতসাধনার মাধ্যমে দেশকে উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর ছিলাম আমরা। এক দিন পরিকল্পনা করে, কপালের হালকা ঘাম মুছে একটা নাম্বারে কল করেছিলাম। কিন্তু, অপর দিক থেকে ফোন পিক করার সাথে সাথে কেটে দিয়েছিলাম। আবার এ-ও ভাবতাম, প্রেম করলে রেস্টুরেন্টের বিল, রাতভর কথা বলার বিল ভরব কীভাবে! বাড়ি থেকে যে টাকা আসত, তা দিয়ে টানাটানি করে চলতে হতো। একটা টিউশনি ম্যানেজ করেছিলাম হাতখরচ বাড়ানোর আশায়। কিন্তু সপ্তাহে চার দিন নিয়ম করে সন্ধ্যাবেলায় যেত ইচ্ছা করত না। বেশ ফাঁকি দেওয়া হয়ে যাচ্ছিল নানা অজুহাতে। ছাত্রের প্রতি অন্যায় করা হয়ে যাচ্ছে ভেবে টিউশনিটা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে আমি আরও একটা টিউশনি নিয়েছিলাম। আমার ছাত্রীর নাম ছিল টুম্পা। আজ সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে আমি টুম্পাদের বাসার আশেপাশে এসে দাঁড়িয়েছি।

 

২.
হয়তো টুম্পারা এখনো এই বাসায় থাকে, অথবা থাকে না। তাদের অ্যাপর্টমেন্ট-বিল্ডিংয়ের ভারী কালো লোহার গেটটা প্রায়ই আমার স্বপ্নে আসত বাগানবিলাস গাছসহ। এখন আর সে গাছটা নেই। এমনকি বাসার উলটো দিকে, একটু বামে, ঘেরাও দেওয়া ফাঁকা প্লটের কোনায় যে দুটো কলাগাছ ছিল, তাও নেই। যদিও প্লটটা ফাঁকাই আছে এখনো। টুম্পা বা তার পরিবারের কারো জন্য আমার মন খাঁখাঁ না করলেও, সেই ফেলে আসা সময়ের জন্য আমার মন খাঁখাঁ করছে। যদিও সেই সময়গুলি এখনকার চেয়ে ভালো ছিল, সেটা হলফ করে বলতে পারি না। তবু মন খাঁখাঁ করে ও করছে ওইসব দিনের জন্য, কেমন এক অতীতচারিতা আমাকে পেয়ে বসছে দিনকে দিন। টুম্পাকে আমি অঙ্ক ও ইংরেজি বাদে আর সব পড়াতাম। ভাবা যায়! বন্ধুদের কেউ অবাক হয়ে বলত ‘এডি কই পাস্ মামা! আমারে এইরাম একটা দে ম্যানেজ কইরা!’ আমার নয়, কিন্তু বন্ধুর বন্ধুরা বলত ‘ভাই, আপনার কপাল!’ হ্যাঁ কপালই। আমি ক্লাস নাইনের টুম্পাকে প্রথমে গল্প পড়তে বলতাম, তারপর জরুরি প্রশ্নগুলির উত্তর মুখস্থ করাতাম বসে বসে। ফলে ‘মুখস্থ করো’ এই কথা বলার পর সেদিনের মতো আমার আর কোনো কাজ থাকত না। আড়চোখে টুম্পার মায়ের চলাফেরা দেখতাম। সেই সুন্দরী মহিলা আমাকে এক দিন দুধ ও আম খেতে দিয়েছিল। এমনকি হাত ধোয়ার জন্য পানিও ঢেলে দিয়েছিল; টুম্পা তখন বইয়ের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক। বাসায় কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও টুম্পার মা আমাকে নাশতা দিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে তিনি শারীরিক সৌন্দর্য সংবরণের ছলে শারীরিক সৌন্দর্য প্রদর্শন করতেন। তবে সেটা ইচ্ছাকৃত কি না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না; ওই বয়সে মন ফ্যান্টাসি ভালোবাসে, ফলে, জোর করে হলেও বিষয়টাকে আমি যুক্তি দিয়ে আমার দিকে টানতাম। কখনো হয়তো নাশতা দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন ‘আপনার ছাত্রী কি ঠিক মতো পড়ে?’ বলতে বলতে অজান্তে হয়তো বুক থেকে কাপড় খসে পড়ল, সাথে সাথে শশব্যস্ত হয়ে হয়তো সংবরণ করলেন, এই রকম আর কী। প্রতিদিনই টুম্পার মা আমাকে নাশতা দিয়ে যেতেন, প্রতিদিনই আমি টুম্পার মার কাছ থেকে রাতের খোরাক নিয়ে বাসায় যেতাম।

আমারে এইরাম একটা দে ম্যানেজ কইরা!’ আমার নয়, কিন্তু বন্ধুর বন্ধুরা বলত ‘ভাই, আপনার কপাল!’ হ্যাঁ কপালই। আমি ক্লাস নাইনের টুম্পাকে প্রথমে গল্প পড়তে বলতাম, তারপর জরুরি প্রশ্নগুলির উত্তর মুখস্থ করাতাম বসে বসে। ফলে ‘মুখস্থ করো’ এই কথা বলার পর সেদিনের মতো আমার আর কোনো কাজ থাকত না। আড়চোখে টুম্পার মায়ের চলাফেরা দেখতাম।

টুম্পা ছাত্রী হিসেবে বিশেষ সুবিধার ছিল না। পড়ায় মন ছিল না, মাথাও খুব একটা কাজ করত না। তবে সাজগোজে তার মনোযোগ বেশি। বিকালটা সাজগোজ করে কাটাতেই সে ভালোবাসে। নওরীনকে আমি দু’একবার বলেছিলাম টুম্পার গল্প, টুম্পা ঠিক তোমার মতো দেখতে, তুমি ছোটোবেলায় নিশ্চিত ওর মতো ছিল। নওরীন টুম্পাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু অনেক দিন আগে যেখানে মাত্র কয়েক মাস পড়িয়েছি, সেখানে হুট করে প্রেমিকা নিয়ে যাই-বা কীভাবে!

প্রতিমাসে শুরুর সপ্তাহে, টুম্পার মা আমাকে খামে করে বেতন দিয়ে যেতেন। তার বাবাকে আমি একবার কি দুবার দেখেছি মাত্র। অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। যেদিন বেতন পেতাম, তার পরের দিকে পড়াতে যেতাম না। ওই দিন পকেটে টাকা নিয়ে একটু রিল্যাক্স করতাম। কিন্তু এই আরামের টিউশনির প্রতিও আমি নিষ্ঠাবান হতে পারলাম না। একবার পরীক্ষার আগের দিন খুব ক্লান্ত ও অসুস্থ বোধ হওয়ায় আমি যেতে পারলাম না। এমনিতেও রোজ রোজ আমার যেতে ভালো লাগত না। মনের সাথে জোরাজুরি করেই যেতাম। টুম্পার মা আমাকে কিছু বলেনি পরীক্ষার আগের দিন না যাওয়ায়। তবে তিনি যে বিরক্ত হয়েছেন, সেটা বুঝতে পেরেছি পরের দিন, তিনি আমাকে নাশতা দিতে আসেননি। কাজের মেয়েটা নাশতা দিয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষায় টুম্পা খারাপ করেনি। তবে পরীক্ষার পর আমি আর সে টিউশনি করিনি। ছেড়ে দিয়েছি হুট করে। টুম্পা আমাকে খুব সমীহ করত, পছন্দ করত। কিন্তু টিউশনি ছেড়ে দেবার পর সে একবারও আমাকে ফোন করেনি। তার মা বারবার আমাকে ফোন করে যেতে বলেছিল, আমি যাইনি। এমনকি বাইরে হলেও একবার দেখা করতে খুব অনুরোধ করেছিল। রাখিনি সে অনুরোধ। সেই টুম্পা এত দিন বাদে আমার ব্যাংকে ইন্টার্ন হয়ে এসেছে। এখন সে দেখতে অনেকটাই নওরীনের মতো। সেই একই রকম মুখ, গায়ের রং, উচ্চতা ও স্বাস্থ্য।

টুম্পাদের বাসায় আমার শেষ দিনটার কথা আমার মনে পড়ে প্রায়ই। শনিবার ছিল সেদিন, নাকি বৃহস্পতিবার! পড়াতে পড়াতে নাশতা খাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম টুম্পা বারবার চোখ মুছছে। ভাবলাম হয়তো মায়ের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে। নাকি আমি বকা দিয়েছি? কখন-বা বকা দিলাম! একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলাম ‘কী হয়েছে, কাঁদতেছ কেন?’ ‘কিছু না’ বলে টুম্পা বইয়ের দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়েছিল। তারপর আবার চোখ মুছতে শুরু করল। আমি আবার জানতে চাইলাম ’কাঁদতেছ কেন টুম্পা? কী হইছে আমাকে বলো?’ কিন্তু সে বলে না। শেষে বলেই বসল ‘স্যার, আমি আপনারে খুব পছন্দ করি’। আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। কারণ অভিব্যক্তিতে ‘পছন্দ’ শব্দটার মানে আমি ধরতে পেরেছি। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। সতর্ক ও ভীত চোখে দরজার বাইরে বারবার তাকাচ্ছিলাম, ভয় পাচ্ছিলাম টুম্পার মা বা কাজের মেয়েটা হয়তো শুনে ফেলতে পারে। আমি নিচু গলায় টুম্পাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম তার সাথে আমার সম্পর্কটা ছাত্র-শিক্ষকের। সহমর্মিতার সাথে উপদেশ দিলাম। বললাম ‘এটা কিন্তু ঠিক না’। শেষে এও বলালাম ‘আমি তোমাকে পছন্দ করি, অনেক স্নেহ করি, তোমার উচিত আমাকে শ্রদ্ধা করা’। টু্ম্পা চোখ মুছতে মুছতে বলল, ’আমি আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি’। আমি বলেছিলাম ‘ঠিক আছে, এইবার কান্না থামাও, খামাখা কেন কাঁদতেছ?’ আমি যতটা ব্রিবত হয়েছিলাম, ঠিক ততটা বিরক্তও। ‘কেন কাঁদতেছ’ এই প্রশ্ন শেষবারের মতো ছুড়ে দেওয়ার সাথে সাথে টুম্পা বলেছিল, ‘কাঁদতেছি, কারণ আমার আম্মুও আপনারে পছন্দ করে’।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম: অক্টোবর, ১৯৮৩ ইং, নীলফামারি। বর্তমান নিবাস: নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে ব্যাংকার হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত কবিতার বই: কাঠঠোকরার ঘরদোর (২০১৫), ধুপছায়াকাল (২০১৮), গোধূলির প্যানোরামা (২০২০)। সম্পাদনা : ওয়েবম্যাগ নকটার্ন  (যৌথ)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।