‘আমার মনে হয় না আপনি রুশ ভাষা জানেন।’
‘রুশ ভাষা? আমি! না।’ সিটি হাসপাতালের একজন ইন্টার্ন হিসেবে আমার জানা ছিল এরা নানারকম অপ্রচলিত কাজে জড়িত। কিন্তু রাশান ভাষার সাথে যোগসাজশটা খুবই অবান্তর মনে হলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘রুশ ভাষা কেন?’
ইমাজেন্সি থেকে ইন্টার্ন জানাল, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন সম্ভাব্য হার্ট ফেইলিউরের রোগী ভর্তি হবে— ফুসফুসে কিছু পানি আছে একটু শ্বাসকষ্ট আর পায়ে পানি জমেছে। মনে হচ্ছে মহিলা রুশ ভাষায় কথা বলছে। রোগীর সাথে কেউ নেই!’
‘বলেন কি! ভয়ানক কথা! আচ্ছা রোগীকে যদি ওয়ার্ডে রাখার মতো মনে হয় তাহলে পাঠিয়ে দিন’ —বলে ভাবলাম আজ লম্বা রাতের এডমিশন ডিউটিটা শেষে না অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়!’
ভদ্রমহিলার ফাইলে একটা নোট আর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট ছিল। ভদ্রমহিলা তার এক প্রতিবেশীকে জানিয়েছিল যে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, আর সেই প্রতিবেশী অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়েছিল। প্রতিবেশী জানিয়েছে এই মহিলা সম্প্রতি রাশিয়া থেকে এসেছে, আর যে আত্মীয়ের বাসায় সে থাকে, সে প্রায়ই শহরের বাইরে কাজের জন্যে যায়।
ভদ্রমহিলার ফাইলে একটা নোট আর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট ছিল। ভদ্রমহিলা তার এক প্রতিবেশীকে জানিয়েছিল যে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, আর সেই প্রতিবেশী অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়েছিল। প্রতিবেশী জানিয়েছে এই মহিলা সম্প্রতি রাশিয়া থেকে এসেছে, আর যে আত্মীয়ের বাসায় সে থাকে, সে প্রায়ই শহরের বাইরে কাজের জন্যে যায়।
নার্সিং স্টেশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেউ কি রুশ ভাষা জানেন?’ আমি আশা করিনি কেউ রুশ ভাষা জানেন, কিন্তু আমার দিক থেকে পরিষ্কার থাকা দরকার বলেই সবাইকে জানালাম। বলাবাহুল্য, অনেককেই দু দিকে মাথা নাড়তে দেখলাম। দিনের বেলায় বেশ কিছু ভাষার অনুবাদক পাওয়া যায়, কিন্তু রাতের বেলায় রোগীর আত্মীয়স্বজনের উপরেই নির্ভর করতে হয়।
সন্ধ্যার ব্যস্ত সময়ে নতুন রোগীটাকে নিয়ে আলাদা একটা চাপ অনুভব করছিলাম; আমি হাঁটতে হাঁটতে ওয়ার্ডে গেলাম। ঢলঢলে হসপিটাল গাউন পরা শাদা চুলের নিস্প্রভ মহিলাটিকে কিছুটা ভয়ার্তও মনে হলো। এক হাতে শিরায় স্যালাইন যাচ্ছিল, আর তার অন্য হাতে সে শক্তভাবে একটি কালো রঙের ধেপসে যাওয়া পার্স ধরে রেখেছিল।
‘হ্যালো, কেমন আছেন?’ তার দিকে তাকিয়ে সম্ভাষণ করে আমি তাকে একটু সহজ করে নিতে চাইলাম। সে কিছুই বলল না, শুধু কষ্ট করে শ্বাস নিতে লাগল। আমরা একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, এ ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো উপায় দেখছিলাম না। আমি আমার নিজের বুকের দিকে আংগুল তুলে বললাম, ‘ডক্টর’। তার দুশ্চিন্তাময় চেহারায় পরিবর্তন এলো না কিন্তু সে মাথা নাড়ল। আমি ইশারায় স্টেথোস্কোপ দেখিয়ে তার বুক পরীক্ষা করতে চাই বলতেই সে আবারও মাথা নাড়ল।
তার সম্পর্কে আর কিছু না জানলেও এই লক্ষ্মণ আর এক্স-রের ভিত্তিতে তার চিকিৎসা শুরু করা যায়। নার্সিং স্টেশনে দাঁড়িয়ে আমি রোগীর চিকিৎসা নির্দেশনা লিখলাম, আর রোগীর ইতিহাস ইত্যাদির পাতাটি একটি অসম্পূর্ণ ব্যর্থতার চিহ্ন হয়েই রইল।
পরীক্ষায় দেখতে পেলাম তার মৃদু হার্ট ফেইলিউরের লক্ষ্মণ আছে, বুকের এক্স-রে-তেও তাই পাওয়া গেল। তার সম্পর্কে আর কিছু না জানলেও এই লক্ষ্মণ আর এক্স-রের ভিত্তিতে তার চিকিৎসা শুরু করা যায়। নার্সিং স্টেশনে দাঁড়িয়ে আমি রোগীর চিকিৎসা নির্দেশনা লিখলাম, আর রোগীর ইতিহাস ইত্যাদির পাতাটি একটি অসম্পূর্ণ ব্যর্থতার চিহ্ন হয়েই রইল।
‘এক্সকিউজ মি। কিছুক্ষণ আগেই আপনার কথা শুনেছি। আপনার কি রুশ ভাষা জানা মানুষ দরকার?’ আমি যে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে লিখছিলাম, সেখানে এসে লোকটি বলল: ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছি, সে এসেছে তার মাকে দেখতে, সে আপনার সমস্যার কথা শুনে আমাকে বলল।’
‘আপনি জানেন রুশ ভাষা?’
সে রাশান জানে না, কিন্তু সে ইড্ডিস ভাষা জানে; আর তার শ্বশুর যিনি হাসপাতালে আছেন, তিনি রুশ আর ইড্ডিস জানেন, ইংরেজিও জানেন সামান্য। তারা দুজন মিলে সাহায্য করতে পারবে বলে আশাবাদী। রোগীটি দেখছিল যে আমি তার বিছানার পাশে অতিরিক্ত দুটো চেয়ার আনিয়ে দুজন আগন্তুককে আসতে ইশারা করলাম। বুড়ো মানুষটি প্রথমে কথা বলতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর রোগীও কথার উত্তর দিতে শুরু করল। ওরা রোগীর নাম সঠিক উচ্চারণে শোনাল; আমিও এবারে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম।
রোগীর অসুখের ইতিহাসটা নিতে শুরু করলাম। আমার প্রশ্ন জামাই ইড্ডিস ভাষায় বলে, আর শ্বশুর সেটা রোগীর জন্য রুশ ভাষায় অনুবাদ করে দেন। আর উত্তরগুলোও বিপরীত পথে আসতে থাকে, রোগীর শ্বাসকষ্টের সমানুপাতিকভাবে কিছুটা ধীরলয়ে। রোগীকে বেশি ভারাক্রান্ত করব না ভেবে, আমি কেবলমাত্র তার মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে প্রশ্ন করছিলাম। কথামালা ঘুরে আসছিলো— ইংলিশ থেকে ইড্ডিস, ইড্ডিস থেকে রাশান, রাশান থেকে ইড্ডিস, সেখান থেকে আবার ইংলিশ। আমি ভাবছিলাম ভাষার বদল হতে হতে মূল তথ্যগুলো না বিকৃত হয়ে যায়।
‘আগেও কি কখনো এমন হয়েছিল?’ জিজ্ঞেস করলাম। এই মহিলা আগে একবার কিয়েভের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। কখনো কখনো রাতের বেলায় তার শ্বাসকষ্ট হয়, বিশেষ করে যখন পায়ে পানি আসে।
আমি নির্ণয় করার চেষ্টা করলাম— এবারে অসুখটা বাড়ল কিভাবে। প্রেসক্রিপশনের ওষুধগুলো খেয়ে সে ভালো থাকত, কিন্তু এ সপ্তাহে তার ওষুধ ফুরিয়ে গিয়েছিল। ‘ডাক্তার বলেছিল লবণ কম খেতে’, অনূদিত হয়ে এলো, ‘কিন্তু টিনের খাবারে কতটা লবণ দেয় তা বোঝার তো কোনো উপায় নেই!’
মহিলাটি তার ব্যাগের ভিতর থেকে পাতলা একটা ওয়ালেট বের করল। সে সাবধানে একটা ছবি আর একটা বিজনেস কার্ড বের করল। আমি মধ্যবয়স্ক লোকটার ছবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনি কে?’
মহিলাটি তার ব্যাগের ভিতর থেকে পাতলা একটা ওয়ালেট বের করল। সে সাবধানে একটা ছবি আর একটা বিজনেস কার্ড বের করল। আমি মধ্যবয়স্ক লোকটার ছবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনি কে?’
‘আমার কাজিন, আমার চাচির পাশে দাঁড়ান।’ সে আমেরিকাতে ভালো রোজগার করছিল; তাই যখন রাশিয়াতে সংকট দেখা দিল, তখন মহিলাটিকে এদেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করল। এ সপ্তাহে সে হুট করে শহরের বাইরে চলে না গেলে তার তাজা শাকসবজি আর ওষুধের ঘাটতি পড়ত না।
কার্ডে একটা টেলিফোন নাম্বার ছিল। আমি ভাষাসহযোগিদের বললাম, ‘আমরা আগামীকাল অফিসটাইমে এই নাম্বারে ফোন করব।’
আমি ভাষাসহযোগিদের অনুরোধ করলাম যাতে তারা আরও দুই একটা জিনিস রোগীকে বুঝিয়ে বলেন। যেমন, তাকে শিরায় যে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে সেখান দিয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে পারব; সবুজ নল দিয়ে আমরা অক্সিজেন দিচ্ছি যাতে সে ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারে। আমি খুব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বললেও আমি নিশ্চিত এই কথাগুলো খুব ভালোভাবে অনুবাদ করা সম্ভব হয়নি কিন্তু কথাগুলো শুনেই মহিলার চোখে নতুন আলোর ঝিলিক দেখা গেল। তার মানে সে আমার কথা বুঝতে পেরেছে। এবারে আমি ভাষাসহযোগি দুজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে রোগীর ফাইলে নতুন কিছু তথ্য যোগ করে অন্য রোগীদের দেখতে গেলাম।
চলে এলেও আমি যেন রোগীটির কথা শুনতে পাচ্ছিলাম— উচ্চারণ ভঙিমা, স্বরের ওঠানামা— এসবে আমার দাদীমার কথা মনে পড়ে গেল। তিনিও একটা ভিন্নভাষী দেশ থেকে এসেছিলেন, আর কখনোই ইংরেজিটা রপ্ত করতে পারেননি। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, এই দুই মহিলা কোন সাহসে নিজের দেশ ছেড়ে ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন!
চলে এলেও আমি যেন রোগীটির কথা শুনতে পাচ্ছিলাম— উচ্চারণ ভঙিমা, স্বরের ওঠানামা— এসবে আমার দাদীমার কথা মনে পড়ে গেল। তিনিও একটা ভিন্নভাষী দেশ থেকে এসেছিলেন, আর কখনোই ইংরেজিটা রপ্ত করতে পারেননি। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, এই দুই মহিলা কোন সাহসে নিজের দেশ ছেড়ে ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন!
সেই রাতে ওয়ার্ডগুলো কিছুটা নীরব হয়ে গেলে আমি অন্ধকার করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওষুধে রোগীটির উন্নতি হচ্ছে কি না দেখার জন্য থামলাম। রোগীটি জেগে ছিল, আগের চাইতে ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারছিল। স্টেথোস্কোপ দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে তার ফুসফুসদুটো পরিষ্কার হচ্ছে। ওয়ার্ডের ডিম লাইটের আলোয় সে আমার দিকে তাকাল। সে আমার দিকে তাকিয়ে প্রথমবারের মতো হাসতেই তার চোখের নিচের ভাঁজগুলো আরও কুঁচকে এলো। আমি তার স্যালাইন দেওয়া হাতটি ধরে তার আংগুলগুলোতে মৃদু চাপ দিচ্ছিলাম— এ যেন দোভাষীর সাহায্য ছাড়াই তৃতীয় কোনো ভাষায় তার সাথে কথা বলছি।
লেখক পরিচিতি : মারসিয়া গোল্ডওফ্ট (Marcia Goldoft, MD) পেশায় একজন রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে থাকেন। তাঁর ‘Another Language’ গল্পটি The Journal of the American Medical Association ( JAMA) তে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে JAMA তে প্রকাশিত চিকিৎসকদের লেখা এরকম বাস্তবসম্মত ১০০ গল্পের Roxanbe K Young সম্পাদিত গল্প সংকলন ‘A Piece of My Mind’ এ প্রকাশিত হয়।
জন্ম ৪ জানুয়ারি ১৯৬৮। মূলত কবি। আটটি কবিতার বই ছাড়াও লিখেছেন ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিপাঠের বই। পেশাগত জীবনে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন। প্রকাশিত কবিতার বই : সড়ক নম্বর দুঃখ বাড়ি নম্বর কষ্ট, আমার আনন্দ বাক্যে, পঁচিশ বছর বয়স, মেঘপুরাণ, ভেবেছিলাম চড়ুইভাতি, বুকপকেটে পাথরকুচি, ডুবোজাহাজের ডানা, অন্ধ ঝরোকায় সখার শিথানে । গল্পের বই : স্বপ্ন মায়া কিংবা মতিভ্রমের গল্প।প্রবন্ধ : তিন ভুবনের যাত্রী । স্মৃতিপাঠ : অক্ষরবন্দি জীবন। স্বনির্বাচিত কবিতা (প্রকাশিতব্য) : পদ্যাবধি । স্মৃতিকথা (প্রকাশিতব্য): গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প : পাবলিক হেলথের প্রথম পাঠ । ডকুফিকশন (প্রকাশিতব্য) : ঝিনুক নীরবে সহো।