রবিবার, ডিসেম্বর ১

লাতিন আমেরিকার চার নারীর চার কবিতা ।। অনুবাদ ও ভূমিকা : আলম খোরশেদ

0

লাতিন আমেরিকার কবিতার ইতিহাসে নারীদের খুব সম্মানজনক ও মর্যাদাবান অবস্থান রয়েছে। মেহিকোর সাহসী আশ্রমকন্যা সর হুয়ানা ইনেস দে লা ক্রুস (১৬৪৮-১৬৯৫) এর শ্রদ্ধাসিক্ত নামোল্লেখ ছাড়া সাধারণত লাতিন আমেরিকার কবিতার কোনো সামগ্রিক আলোচনার সূত্রপাতই হতে পারে না। প্রকরণের দিক থেকে বারোক রীতির অনুসারী সর হুয়ানার কবিতা ও অন্যান্য রচনায় সামাজিক, ধর্মীয়, লৈঙ্গিক বৈষম্য ও অসংগতি এমন প্রবলভাবে বিবৃত হয় যে, সমালোচকেরা পরবর্তীকালে তাঁকে হিস্পানিক সাহিত্যের একজন সাহসী প্রটোফেমিনিস্ট আখ্যা দিতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর অনতিক্রম্য প্রভাব পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে এসে আরও প্রবলভাবে অনুভূত হতে থাকে, মুখ্যত তাঁর নারী অনুসারীদের মধ্যে। আমরা জানি, ১৯৪৫ সালে প্রথম নোবেলবিজয়ী লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিক একজন কবি ও নারী; তিনি এই সর হুয়ানারই আরেক দূরবর্তী মানসকন্যা, চিলের গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল (১৮৮৯-১৯৫৭)। অবশ্য তাঁরও আগে উরুগুয়াইয়ের জাতিকা দেলমিরা আগুস্তিনি (১৮৮৬-১৯১৪) লাতিন আমেরিকার কবিতায় আধুনিকতার সূচনাকারীদের মধ্যে অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিলেন। এরপর থেকে অদ্যাবধি গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়েই নারীরা দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করেছেন কবিতার রাজ্যপাট। এঁদের মধ্যে অন্তত দশজন বিশ্বখ্যাত কবির নাম করা যায়, যাদের উল্লেখ ছাড়া লাতিন আমেরিকার আধুনিক কবিতার কোনো আলোচনাই সম্ভব নয়। এঁরা হলেন উরুগুয়াইয়েরই আরও দুজন হুয়ানা দে ইবারবুরু (১৮৯৫-১৯৭৯) ও সারা দে ইবানেস (১৯১০-১৯৭১); আর্হেন্তিনার আল্ফোন্সিনা স্তর্নি (১৮৯২-১৯৩৮) ও ওলগা অরস্কো (১৯২০-১৯৯৪); এল সালবাদোরের ক্লাউদিয়া লার্স (১৮৯৯-১৯৭৪) ও ক্লারিবেল আলেগ্রিয়া (১৯২৪-২০১৮); ব্রাজিলের সিসিলিয়া মেইরেলেস (১৯০১-১৯৬৪) ও এনরিকেতা লিসবোয়া (১৯০৩-১৯৮৪); নিকারাগুয়ার মারিয়া তেরেসা সাঞ্চেস (১৯১৮-১৯৯৪), মেহিকোর রোসারিয়ো কাস্তেয়ানোস (১৯২৫-১৯৭৪) প্রমুখ। তো, এঁদেরই সুযোগ্য উত্তরসূরি চার নারীর চারটি প্রতিনিধিত্বশীল কবিতার অনুবাদ এখানে উপস্থাপিত হলো, যাদের মধ্যে তিনজনই এখনও জীবিত ও সৃজনে সক্রিয়; যথাক্রমে ব্রাজিলের আদেলিয়া প্রাদো (জন্ম ১৯৩৫), কুবার নান্সি মোরেহন (জন্ম ১৯৪৪) ও চিলের মার্হরি আগোসিন (জন্ম ১৯৫৫)। চতুর্থজন, আর্হেন্তিনার সুবিখ্যাত পরাবাস্তববাদী কবি আলেহান্দ্রা পিসারনিক (১৯৩৬-১৯৭২) অল্পবয়সেই আত্মঘাতী হন।


আদেলিয়া প্রাদো
অতীন্দ্রিয় গোলাপ


আমি যেদিন প্রথম
আকার বিষয়ে সচেতন হই,
সেদিন মাকে বলি:
‘রান্নাঘরে দনিয়া আরমান্দার একটা ঝুড়ি আছে
সেখানে সে পেঁয়াজ আর টমাটো রাখে’
আর তারপর উদ্বেগ জানাতেই থাকি যে,
এমনকি সুন্দরতম বস্তুটাও কোনো একসময় নষ্ট হয়ে যায়,
যতদিন না আমি এই কথাগুলো লিখে উঠতে পারি:
‘এই ঘরে আমার বাবার মৃত্যু হয়,
এইখানেই ঘড়িতে চাবি দিয়ে তিনি
জানালার ভিত ভেবে যেখানে কনুই ভর দেন
সেটি আসলে ছিল মৃত্যুর চৌকাঠ।’
আমি বুঝতে পারি, শব্দেরা এইরূপে গুচ্ছাকারে লিখিত হলে
তারা যা বর্ণনা করে, সেসব ছাড়াও বেঁচে থাকা সম্ভব হয়,
বুঝতে পারি যে, আমার বাবা, যাকে ধ্বংস করা যায় না,
ফিরে আসছেন।
এটা অনেকটা এরকম যে, কেউ একজন
দনিয়া আরমান্দার ঝুড়িটা এঁকে বললেন,
‘তুমি এখন এই ফলটা খেতে পারো।’
অর্থাৎ পৃথিবীতে শৃঙ্খলা বলে কিছু আছে।
এবং কোত্থেকেই বা আসে তা?
আর কেনইবা এই শৃঙ্খলা,
যা নিজেই এক অপার উৎস আনন্দের
এবং যা সূর্যালোক ছাড়া ভিন্ন কোনো আলোয় স্নাত,
আত্মাকে এমন বিষণ্ন করে তোলে?
সময়ের ক্ষয় থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে আমাদের,
প্রয়োজনে সময়কে ফাঁকি দিয়ে হলেও।
আর তাই আমি লিখে যেতে থাকি:
‘আমার বাবা এই ঘরে মারা গিয়েছিলেন …
রাত, তুমি নেমে আসতে পারো,
তোমার কালো রঙ এই স্মৃতিকে ঢেকে দিতে পারে না’

এটাই ছিল আমার প্রথম কবিতা।


আলেহান্দ্রা পিসারনিক
বাবার জন্য কবিতা


আর ঠিক তখনই
মুখের ভেতর মৃত ও শীতল এক জিহ্বা নিয়ে
তিনি সেই গানখানি গেয়ে ওঠেন
যে-গান তারা তাঁকে গাইতে দেয়নি
এই অশ্লীল বাগান আর ছায়াদের পৃথিবী
যা তাঁকে খুব ভুল একটা সময়ে
তাঁর শৈশবের সেই গান মনে করিয়ে দিয়েছিল
তারা তাঁকে গাইতে দেয়নি বলে
সে-গান তিনি খুব চেয়েও গাইতে পারেননি
শুধু তাঁর অনুপস্থিত নীল চোখ
অনুপস্থিত মুখগহ্বর
অনুপস্থিত কণ্ঠের প্রক্ষেপণটুকু ছাড়া।
তারপর তাঁর সেই অনুপস্থিতির সুউচ্চ মিনার থেকে
তাঁর গান ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হলো অদৃশ্যের অস্পষ্টতায়
নিঃশব্দ বিস্তারে
আমার এইসব শব্দের মতোই চিরবিচরণশীল শূন্যতায়।


নান্সি মোরেহন
মোহমুক্তি, রুবেন দারিওর জন্য


একটি ময়ূর যদি কখনো এই পথ দিয়ে যায়
আমি ভান করব যেন তার পেখম দেখছি,
তার পা-জোড়া, তার থাবার ঠমক,
তার অহংকারী দেহভঙ্গি,
তার দীর্ঘ গ্রীবা;
সত্য হচ্ছে, এখানে আরও একটি ময়ূর রয়েছে,
যাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না
আধুনিকতার ময়ূর,
সমুদ্রের নুনে ক্ষয়িত পোশাক যার;
আমাদের সেই খাড়া-চুল কবিকে একদা যা চমকে দিয়েছিল,
সত্য হচ্ছে, এখানে আরও একটি ময়ূর রয়েছে
না, না, আপনারটি নয়,
আমি যাকে আমার কল্পিত বাড়ির উঠোনে
ছিঁড়ে ফালাফালা করি
আমি যার ঘাড় মটকে দিই, প্রায় শোকেরই ভঙ্গিতে
আমার তখন তাকে নীল, খুব নীল,
একেবারে আকাশের নীল বলে মনে হয়।


মার্‌হরি আগোসিন
সে একটা দ্বীপ হতে চেয়েছিল


সে একটা দ্বীপ হতে চেয়েছিল,

সে তাদের, দ্বীপেদের,
অফুরন্ত উন্মাদনাকে ভালোবাসত।

সে এমন একখানা দ্বীপে পৌঁছুতে চাইত
যেটি সম্ভবত কোনো দ্বীপই নয়।

পাথুরে ও ধ্বংসপ্রবণ প্রেম থেকে নিজেকে আলগা করে নিতে

সে একটা দ্বীপ হতে চেয়েছিল
সমুদ্রের কটিরেখা জুড়ে বসবাসের আনন্দ পেতে
দ্বীপ ছেড়ে কোথাও যেতে কিংবা ফিরে আসতে নয়
কেবল একটা দ্বীপ হতে
নিশাদ্বীপ
উষাদ্বীপ
দ্বীপ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ-এর জন্ম ১৯৬০ সালে কুমিল্লায়। পেশায় প্রকৌশলী আলম খোরশেদ প্রবাসে উচ্চশিক্ষা ও দীর্ঘ পেশাজীবনের শেষে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন ২০০৪ সালে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চা ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। শিল্পসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমান উৎসাহী তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় অবশ্য সমকালীন বিশ্বসাহিত্য। তাঁর সম্পাদিত লাতিন আমেরিকান ছোটগল্প সংকলন ‘যাদুবাস্তবতার গাথা’ আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের একটি পথপ্রদর্শক কাজ। সম্পাদনা, অনুবাদ ও মৌলিক রচনা মিলিয়ে তিনি এ-পর্যন্ত প্রায় কুড়িটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বর্তমানে তিনি লেখালেখির পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরে তাঁর নিজের গড়া বিস্তার,চট্টগ্রাম আর্টস কমপ্লেক্স পরিচালনার কাজে সার্বক্ষণিকভাবে ব্যাপৃত রয়েছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।