রবিবার, ডিসেম্বর ১

শার্লি জ্যাকসনের গল্প : ভয়

0

অফিসে একটা ভালো দিন কাটিয়ে ক্লান্ত জনাব হ্যালোরান বেরেসফোর্ড আটঘণ্টা পর এখনো খোশমেজাজে। তাঁর পরিষ্কার কামানো গাল এখনো প্রায় একই রকম আছে। পরনের প্যান্টটার ইস্ত্রি অটুট। বিশেষ দিনটা মনে থাকার জন্য নিজের ওপর সন্তুষ্ট মনে ক্যান্ডিশপ থেকে বড়ো একটা বাক্স হাতে নিয়ে বের হয়ে দ্রুত হেঁটে মোড়ের দিকে রওনা হন তিনি। নিউইয়র্কের প্রতিটি ব্লকে বেরেসফোর্ডের মতো ছোটো আকারের ধুসর স্যুট পরা অন্তত বিশ জন মানুষ পাওয়া যাবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসের মধ্যে চ্যাপ্টা হওয়া ক্লিন শেভ করা মানুষও পাওয়া যাবে গোটা পঞ্চাশেক। এক শ জন ছোটোখাটো মানুষ পাওয়া যাবে, যারা বোধ হয় নিজেদের স্ত্রীর জন্মদিন মনে রাখতে পেরে বেজায় খুশি। আজ স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে ডিনারে যাবেন তিনি, তারপর দেখবেন কোনো সিনেমার শেষ মুহূর্তের টিকিট পাওয়া যায় কি না। সব মিলিয়ে দিনটা ছিল চমৎকার, আপনমনে গুনগুন করতে করতে বেরেসফোর্ড দ্রুত হাঁটেন।

মোড়ে দাঁড়িয়ে তিনি ভাবছিলেন বাসে উঠে সময় বাঁচাবেন, না কি এই ভিড়ের মধ্যে একটা ট্যাক্সি পাকড়াও করার চেষ্টা করবেন। অফিসপাড়া থেকে তাঁর বাড়ির রাস্তাটা দীর্ঘ পথ। বেরেসফোর্ড সাধারণত ফিফথ অ্যাভিনিউ থেকে একটা দোতলা বাসের ওপরতলায় বসে পত্রিকা পড়ে নিরুপদ্রব আধাঘণ্টা সময় উপভোগ করেন। সাবওয়ে ওঁর চরম অপছন্দ, ট্যাক্সি ডাকার জন্য যে কসরত করতে হয়, তাঁর আসে না সেটা। যা-ই হোক, আজ স্ত্রীর পছন্দের চকোলেট কিনতে গিয়ে ক্যান্ডির দোকানে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে; টেবিলে ডিনার দেওয়ার আগে বাড়ি ফিরতে চাইলে আরেকটু জলদি করতে হবে। বেরেসফোর্ড রাস্তার ওপর কয়েক পা এগিয়ে একটা ট্যাক্সির দিকে হাত নেড়ে ডাক দেন, ‘ট্যাক্সি!’ তাঁর গলার আওয়াজটা অদ্ভুত চড়া সুর তুলে অসহায়ভাবে হারিয়ে যায় কেবল। অপ্রস্তুত অবস্থায় চোরের মতো ফুটপাতে সটকে আসেন তিনি, আর ট্যাক্সিটা ভ্রুক্ষেপহীন চলে যায়। এসময় হালকা হ্যাট মাথায় একটা লোক বেরেসফোর্ডের পাশে এসে দাঁড়ায়, তারপর লোকজনের ভিড়ের মধ্যে মিনিটখানেক তাঁর দিকে চেয়ে থাকে। লোকজন যেভাবে বিশেষ কিছু না ভেবেই কোনো কিছুর দিকে তাকায়, বেরেসফোর্ডও লোকটার দিকে তেমনিভাবে তাকিয়ে থাকেন। তিনি দেখেন লোকটার হালকা হ্যাটের নিচে সরু একটা মুখ, অল্প গোঁফ, কোটের কলারটা ওপরদিকে ওঠানো। নিজের কামানো গাল আর ঠোঁটটায় হাত বুলিয়ে বেরেসফোর্ড ভাবেন, লোকটা দেখতে অদ্ভুত। হয়তো ভাবছে, বেরেসফোর্ডের প্রায় অসচেতন অঙ্গভঙ্গিটা আপত্তিকর; তারপর ঘুরে দাঁড়ানোর আগে ভুরু কুঁচকে বেরেসফোর্ডের দিকে আপাদমস্তক তাকায় লোকটা। বেরেসফোর্ড ভাবেন, বাজে একটা লোক।

 

 

Faruq Moinuddin_Motifফিফথ অ্যাভিনিউর যে বাসটাতে বেরেসফোর্ড সচরাচর যান, সেটি মোড়ের দিকে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে আসছিল। ট্যাক্সি ধরতে হবে না বলে খুশিমনে বাসস্টপের দিকে এগিয়ে যান তিনি। বাসের ভেতর দিকের হ্যান্ডেলটা ধরার জন্য হাত বাড়াতেই হালকা হ্যাট পরা বাজে লোকটা অভদ্রভাবে কনুইর গুঁতো মেরে সামনে এগিয়ে যায়। বেরেসফোর্ড গজগজ করে তার পেছন পেছন যেতে চাইলে ভেতরের ঠাঁসা যাত্রী নিয়ে বাসের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি দেখেন, চলে যাওয়ার সময় বাসের বন্ধ দরজার ভেতর থেকে হালকা হ্যাট পরা লোকটি তাঁর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

বেরেসফোর্ড আপনমনে বলেন, ‘এটা নোংরা এক কৌশল’; তারপর ঝাঁঝের সাথে কাঁধ ঝাঁকিয়ে কোটটা ঠিক করে নেন। বিরক্তি তখনো যায়নি তাঁর। নিজের গলার ওপর ভরসা না করে রাস্তার ওপর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার একটা ট্যাক্সি দেখে হাত নাড়ান তিনি। এসময় একটা ডেলিভারি ভ্যান তাঁকে প্রায় চাপা দিতে যাচ্ছিল। প্রায় পিছলে ফুটপাতে উঠে এলে ট্রাক ড্রাইভারটি জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে অবোধ্য কিছু একটা বলে চিৎকার করে ওঠে। আশপাশের মানুষগুলো তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে দেখে হেঁটে রওনা হন তিনি । দুই ব্লক পরে আরেকটা বাসস্টপ আছে। ট্যাক্সি পাওয়ার জন্যও ভালো একটা জায়গা। সাবওয়ে স্টেশনও আছে। সাবওয়ে যতই অপছন্দ হোক না কেন, যেকোনোভাবে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য তাঁকে সেটাও নিতে হতে পারে আজ। মোড়ের ধাক্কাধাক্কির পরও তাঁর ধুসর স্যুটটা তখনো পরিপাটি আছে, বগলে ক্যান্ডির বাক্সটা নিয়ে তিনি অফিসপাড়ার রাস্তা ধরে হেঁটে যান। বিরক্তিটা হজম করে নেবেন ঠিক করেছেন; আজ তাঁর স্ত্রীর জন্মদিন, হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করেন তিনি।

shirley_Paranoia_Cover_1পথচলতি লোকজনকে লক্ষ করে বিরক্তিটা ভুলে যেতে পেরে তাঁর পর্যবেক্ষণ আরও ধারালো হয়। তাঁর দিকে এগিয়ে আসা ভুরু কোঁচকানো উঁচু হিল পরা মেয়েটি কোনো তুচ্ছ বিষয় মন থেকে তাড়াতে পারছে না বোধ হয়। কিংবা হয়তো জুতোর কারণে এরকম হতে পারে। দোকানের শো উইন্ডো দেখতে দেখতে এক বুড়ো-বুড়ি ঝগড়া করছে। হালকা হ্যাট পরা অদ্ভুতদর্শন লোকটা ভিড়ের মধ্য দিয়ে দ্রুত হেঁটে আসছিল, দেখে মনে হচ্ছিল কারো ওপর ঘেন্না আছে ওর… লোকটা সত্যিই অদ্ভুত; বেরেসফোর্ড হেঁটে যাওয়া লোকজনের সারি থেকে সরাসরি ঘুরে তাকিয়ে দেখেন লোকটা চট করে ঘুরে তাঁর প্রায় দশ ফুট পেছনে হাঁটতে শুরু করেছে। মনে মনে অবাক হয়ে তিনি ভাবেন, এটাকে কী বলা যায়, তারপর আরেকটু জোরে পা চালাতে শুরু করেন। লোকটা বোধহয় বাস থেকে নেমে পড়েছে, ভুল বাসে উঠেছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু তাহলে যেখানে নেমেছে সেখান থেকে আরেকটা বাস না ধরে উল্টোদিকে হেঁটে আসছে কেন? কথা বলতে বলতে হেঁটে যাওয়া দুটো মেয়েকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে অতিক্রম করে যান বেরেসফোর্ড ।

যে মোড়ে পৌঁছাতে চাইছিলেন, তার অর্ধেক পথ বাকি থাকতে একধরনের অসুস্থ বিস্ময়ে তিনি লক্ষ করেন, হালকা হ্যাট পরা লোকটি তাঁর কনুইর কাছ ঘেঁষে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। অন্য দিকে তাকিয়ে হাঁটার গতি কমিয়ে দিলেন তিনি। লোকটিও তাঁর দিকে না তাকিয়ে নিজের গতি কমিয়ে দেয়।

বেরেসফোর্ড ভাবেন, ‘আজব ব্যাপার!’ তার চেয়ে বেশি কিছু ভাবার ঝামেলায় গেলেন না। ক্যান্ডির বাক্সটা শক্তভাবে ধরে মানুষের সারি থেকে দ্রুত বেরিয়ে একটা দোকানে ঢুকে পড়েন তিনি। দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বুঝতে পারেন, একটা স্যুভেনির ও ব্র্যান্ড স্টোর ওটা। ভেতরে দুই কি তিনজন মানুষ, একজন মহিলা ও একটা ছোটো মেয়ে এবং একজন নাবিক। বেরেসফোর্ড কাউন্টারের শেষ মাথায় একটা সিগারেট কেস নিয়ে অনর্থক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন, ওটার ওপরে লেখা ‘স্যুভেনির অভ নিউ ইয়র্ক সিটি,’ নিচে ট্রাইলন ও পেরিস্ফিয়ারের পরিচিত ছবি আঁকা।

টয়লেটের মতো করে বানানো একটা ম্যাচ হোল্ডার নিয়ে একচোট হেসে মহিলা মেয়েটিকে বলে, ‘জিনিসটা খুব কিউট না?’ ওটা এমনভাবে বানানো যে ম্যাচের কাঠিগুলো কমোডের ভেতরে চলে যাবে। বেরেসফোর্ড দেখলেন ওটার ঢাকনার ওপরও সেই ট্রাইলন ও পেরিস্ফিয়ারের ছবি আঁকা। তার ওপর লেখা ‘স্যুভেনির অভ নিউ ইয়র্ক সিটি’।

হালকা হ্যাটপরা লোকটা দোকানে ঢোকে, বেরেসফোর্ড পিছু ফিরে কাউন্টারের ওপর থেকে একটার পর একটা জিনিস তুলে নিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একদিকে ভাবছিলেন ‘নিউ ইয়র্ক সিটির স্যুভেনির’ কথাটা লেখা নেই এমন কোনো কিছু আছে কি না; অন্যদিকে ভাবছিলেন হালকা হ্যাট পরা লোকটার কথা। ‘কী চায় সে’ প্রশ্নটা ‘কাকে চায়’ প্রশ্নের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে।

হালকা হ্যাটপরা লোকটা দোকানে ঢোকে, বেরেসফোর্ড পিছু ফিরে কাউন্টারের ওপর থেকে একটার পর একটা জিনিস তুলে নিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একদিকে ভাবছিলেন ‘নিউ ইয়র্ক সিটির স্যুভেনির’ কথাটা লেখা নেই এমন কোনো কিছু আছে কি না; অন্যদিকে ভাবছিলেন হালকা হ্যাট পরা লোকটার কথা। ‘কী চায় সে’ প্রশ্নটা ‘কাকে চায়’ প্রশ্নের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। ওর অভিসন্ধি যদি বেরেসফোর্ডের বিরুদ্ধেই হয়, তাহলে বুঝতে হবে ওরা দুষ্টচক্র। তা না হলে আগেই সে কথা জানান দেয়নি কেন ওরা? লোকটিকে চ্যালেঞ্জ করে ওর উদ্দেশ্য জানতে চাওয়ার ভাবনাটা বেরেসফোর্ডের মনের মধ্যে অল্পসময়ের জন্য একবার খেলে যায়। এরকম সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে সহজাত সতর্কতার কারণে পরক্ষণে নিজের ছোটোখাটো আকৃতির কথা মনে পড়ে ওঁর। সবচেয়ে ভালো হয় লোকটিকে এড়িয়ে গেলে। একথা ভাবতে ভাবতে দোকানের দরজার দিকে এগিয়ে যান বেরেসফোর্ড, উদ্দেশ্য, হালকা হ্যাট পরা লোকটিকে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে বাড়ি ফেরার বাসে ওঠা।

লোকটাকে পেরোবার আগেই দোকানের সেলস ক্লার্কটি কাউন্টারের শেষ মাথা ঘুরে এগিয়ে এসে একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বেরেসফোর্ডের মুখোমুখি হয়, তারপর বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে, ‘আপনার যা পছন্দ দেখতে পারেন, মিস্টার।’

‘আজ আর নয়, ধন্যবাদ’ বলে বেরেসফোর্ড ক্লার্ককে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বাঁ দিকে সরে যান। কিন্তু লোকটা একইভাবে সরে গিয়ে বলে, ‘আপনি দেখেননি এমন খুব ভালো কিছু জিনিস আছে।’

বেরেসফোর্ড তাঁর চড়া স্বরটা কঠিন করে বলেন, ‘নো, থ্যাংকস।’

ক্লার্ক সাধাসাধি করে, ‘একবার দেখুন এগুলো।’ একজন ক্লার্কের তুলনায় লোকটা অস্বাভাবিকরকম নাছোড়বান্দা। বেরেসফোর্ড চোখ তুলে দেখেন হালকা হ্যাট মাথায় লোকটা ডান পাশ দিয়ে দ্রুত তাঁর কাছে চলে এসেছে। লোকদুটোর ঘাড়ের ওপর দিয়ে তাকালে দেখা যায় দোকানটা এখন ফাঁকা। রাস্তাটাকে এখান থেকে বহু দূরে বলে মনে হচ্ছে। দুদিক থেকে আসা যাওয়া করা মানুষগুলোকে ছোটো থেকে আরও ছোটো মনে হচ্ছিল; বেরেসফোর্ড বুঝতে পারেন, লোক দুটো এমনভাবে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে যাতে তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন।

হালকা হ্যাট পরা লোকটি ক্লার্ককে বলে, ‘সাবধান! আস্তে যাও।’ ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে। সংকটে পড়া বিফল সাধারণ মানুষের মতো বেরেসফোর্ড বলেন, ‘এই যে এখন!’ তখনো তাঁর বগলে নিচে ধরা ক্যান্ডির বাক্সটি। ‘এই যে,’ পেছনে নিরেট দেয়ালের ওজন টের পান তিনি।

হালকা হ্যাট পরা লোকটা বলে ওঠে, ‘রেডি।’ লোকদুটো যখন টানটান, বেরেসফোর্ড একটা বন্য চিৎকারে দুজনের মাঝখান দিয়ে দরজার দিকে ছুট লাগান। পেছনে একটা শব্দ শোনা যায়, সেটাকে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন এবং তাঁর দিকে ছুটে আসার শব্দ বলেই মনে হলো। দরজা দিয়ে বের হয়ে চলমান মানুষের সারির মধ্যে মিশে যেতে যেতে বেরেসফোর্ড ভাবেন, রাস্তায় আমি নিরাপদ, যতক্ষণ পর্যন্ত অনেক লোকজন থাকবে, আমাকে কিছু করতে পারবে না ওরা। অনেকগুলো প্যাকেট হাতে এক মোটাসোটা মহিলা ও পরস্পরের কাঁধে ভর দেওয়া একজোড়া ছেলেমেয়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকান তিনি। দেখতে পান ক্লার্কটি দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। হালকা হ্যাট পরা লোকটাকে কোথাও দেখা যায় না। বেরেসফোর্ড ক্যান্ডির বাক্সটাকে অন্যহাতের নিচে চালান করে দেন, যাতে ডান হাতটা খালি থাকে। তিনি ভাবেন, একেবারে অর্থহীন। এখনো দিনের আলো রয়ে গেছে। ওরা কীভাবে ভাবল যে কিছু একটা করে পালিয়ে যেতে পারবে?

হালকা হ্যাট পরা লোকটা সামনের মোড়ে অপেক্ষা করছিল। বেরেসফোর্ড একটু ইতস্তত করেন, তারপর ভাবেন এতগুলো মানুষের চোখের সামনে এটা একেবারেই অসম্ভব। তিনি নির্ভয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে যান। হালকা হ্যাট পরা লোকটা তাঁর দিকে তাকায় না, একটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল সে। মোড়ে পৌঁছে যান বেরেসফোর্ড, তারপর তীরবেগে রাস্তায় ছুটে গিয়ে বিকট গলায় ডাক দেন, ‘ট্যাক্সি,’ গলার এরকম আওয়াজ যে তাঁর আছে সেটা আগে কখনোই বুঝতে পারেননি। একটা ট্যাক্সি থামে, যেন এই বিশাল ডাককে অগ্রাহ্য করতে সাহস পায়নি ড্রাইভার। বেরেসফোর্ড কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে ওটার দিকে এগিয়ে যান। তাঁর হাত দরজার হ্যান্ডেলের ওপর রাখতেই আরেকটা হাত তাঁর হাতের ওপর এসে পড়ে, বেরেসফোর্ড বুঝতে পারেন, হালকা হ্যাটের কানাটা তাঁর গালে ঘষা খাচ্ছে।

ট্যাক্সি ড্রাইভারটি বলে, ‘যেতে চাইলে আসুন,’ দরজাটা খোলাই ছিল। যে শরীরটা ট্যাক্সির মধ্যে ঠেলে ঢুকে পড়ে, তার ধাক্কা সামলে আরেকটা হাতের নিচ থেকে নিজের হাতটা বের করে নিয়ে ফুটপাতে ফিরে যান বেরেসফোর্ড। মোড়ে একটা আন্তঃশহর বাস থামে, বেরেসফোর্ড কিছু না ভেবে দ্রুত উঠে পড়েন, তারপর কয়েন রেজিস্টারে একটা আধুলি ফেলে দিয়ে বাসের পেছনদিকে গিয়ে বসেন। দেখলেন হালকা হ্যাট পরা লোকটা একটু সামনে, তাঁর এবং দরজার মাঝামাঝি বসা। ক্যান্ডির বাক্সটা কোলের ওপর নিয়ে বসে ভাবার চেষ্টা করেন বেরেসফোর্ড। নিশ্চয়ই হালকা হ্যাট পরা লোকটি গোঁফ নিয়ে তাঁর অসচেতন দেহভঙ্গি সম্পর্কে কোনো বিদ্বেষ পুষে রাখেনি, যদি না সে অদ্ভুতরকম স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। যেভাবেই হোক, স্যুভেনির শপের ক্লার্কটাও তো ছিল, তারপর তিনি হঠাৎ করে বুঝতে পারেন যে দোকানের ক্লার্কটার আচরনও বেশ উদ্ভট ছিল বটে। তিনি ক্লার্কের প্রসঙ্গ মাথা থেকে সরিয়ে রেখে হালকা হ্যাট পরা লোকটার কথা ভাবতে চাইলেন। এটা যদি লোকটার গোঁফের প্রতি তাঁর অপমানজনক ভঙ্গির কারণে না হয়, তাহলে কী হতে পারে? আরেকটা ভাবনা বেরেসফোর্ডকে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে: তাহলে হালকা হ্যাট পরা লোকটা কতদিন ধরে অনুসরণ করছে তাঁকে? আজ সারাদিনের কথা ভাবলেন তিনি: একদল লোকের সাথে অফিস থেকে বের হয়েছেন, সবাই খোশমেজাজে কথা বলছিল, ওরা মনে করিয়ে দেয় যে আজ তাঁর স্ত্রীর জন্মদিন, একসাথে ক্যান্ডিশপ পর্যন্ত যায় ওরা, তারপর সেখান থেকে চলে যায় সবাই। অফিসের তিনজন সহকর্মীকে সাথে নিয়ে লাঞ্চের সময়টুকু ছাড়া সারাদিন অফিসেই ছিলেন তিনি। বেরেসফোর্ডের মনটা আচমকা লাঞ্চের সময় থেকে লাফ দিয়ে বাসস্টপে হালকা হ্যাট পরা লোকটাকে প্রথম দেখার ঘটনায় চলে আসে। মনে হচ্ছিল লোকটা বেরেসফোর্ডকে সামনে ঠেলে দেওয়ার বদলে ভিড়ের মধ্যে বাসের ওপর ঠেলে দিতে চাইছিল। সেক্ষেত্রে, তিনি যখন বাসে উঠে পড়তেন… বেরেসফোর্ড চারপাশে তাকান। বাসে এখন আর মাত্র পাঁচজন যাত্রী বাকি আছে। তাদের মধ্যে ড্রাইভার, বেরেসফোর্ড নিজে, আরেকজন তাঁর কিছুটা সামনে বসা হালকা হ্যাট মাথায় লোকটি। বাকি দুজনের একজন শপিংব্যাগসহ এক বুড়ি, আরেকজনকে দেখে মনে হয় লোকটা বিদেশি। লোকটার দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবেন, বিদেশি, বিদেশি ষড়যন্ত্র, গুপ্তচর। কোনো বিদেশির ওপর ভরসা না করাই ভালো।

বাসটা উচু অন্ধকার বাড়িগুলোর ভেতর দিয়ে দ্রুত ছুটছিল। জানালার বাইরে তাকিয়ে বেরেসফোর্ড বুঝতে পারেন একটা শিল্প এলাকার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বাস। মনে পড়ে, পূর্বদিকে যাচ্ছিলেন তাঁরা, ঠিক করেন, নেমে পড়ার জন্য কোনো একটা আলোকিত ব্যস্ত জায়গার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

বাসটা উচু অন্ধকার বাড়িগুলোর ভেতর দিয়ে দ্রুত ছুটছিল। জানালার বাইরে তাকিয়ে বেরেসফোর্ড বুঝতে পারেন একটা শিল্প এলাকার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বাস। মনে পড়ে, পূর্বদিকে যাচ্ছিলেন তাঁরা, ঠিক করেন, নেমে পড়ার জন্য কোনো একটা আলোকিত ব্যস্ত জায়গার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বেড়ে ওঠা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে বেরেসফোর্ড একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করেন। রাস্তার কোণে বাস স্টপ লেখা সাইনবোর্ডের পাশে কেউ একজন দাঁড়ানো। আবছা দেখা যাওয়া মনুষ্যমূর্তিটি হাত তুললেও বাস থামে না। অবাক হয়ে বেরেসফোর্ড স্ট্রিট সাইন দেখতে থাকেন, লক্ষ করেন এক জায়গায় লেখা ‘ইস্ট ৩১ স্ট্রিট,’ একই সাথে নামার সংকেত দেওয়ার জন্য ঘণ্টা বাজানোর দড়িটার দিকে এগিয়ে যান তিনি। মাঝের আইল ধরে এগিয়ে যেতেই, বিদেশির মতো দেখতে লোকটিও উঠে ড্রাইভারের পাশের দরজার কাছে যায়। বলে ‘নামব,’ বাসের গতি কমে আসে। বেরেসফোর্ডও সামনের দিকে এগিয়ে যান, বুড়ির শপিং ব্যাগটা কীভাবে যেন তাঁর সামনে পড়ে গিয়ে ভেতরের জিনিসপত্র বের হয়ে আসে। ছোটো ছোটো নানান জিনিস সবদিকে ছড়িয়ে যায়-এক সেট ব্লক, পেপার ক্লিপের একটা প্যাকেট ইত্যাদি।

বাসের দরজা খুলে গেলে বেরেসফোর্ড মরিয়াভাবে বলেন, ‘দুঃখিত’। তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে বুড়ি তাঁর হাত ধরে বলেন, ‘তাড়া থাকলে এটা নিয়ে ভেবো না। আমি ওসব তুলে নিতে পারব বাছা।’ বেরেসফোর্ড তাঁর হাত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বুড়ি বলেন, ‘এটা যদি তোমার স্টপ হয় চিন্তা কোরো না। সব বিলকুল ঠিক আছে।’

বেরেসফোর্ডের জুতোতে গোলাপি ফিতার একটা কয়েল জড়িয়ে গিয়েছিল, মহিলা বলেন, ‘ব্যাগটা আইলের ওপর রেখে দেওয়াটা আমারই ভুল।’

মহিলার কাছ থেকে তিনি যখন ছুটতে পারেন ততক্ষণে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা মেনে নিয়ে বেরেসফোর্ড দুলতে থাকা বাসের ভেতর এক হাঁটু গেড়ে বসে সারা মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা পেপার ক্লিপ, ব্লক, চিঠি লেখার কাগজের বাক্স থেকে কাগজ আর খামসহ জিনিসগুলো তুলতে থাকেন। বুড়ি মিষ্টি হেসে বলেন, ‘আমি খুব দুঃখিত, সবই আমার আমার দোষ।’

ঘাড় ঘুরিয়ে বেরেসফোর্ড একবার দেখেন হালকা হ্যাট মাথায় লোকটি আরাম করে বসে আছে। লোকটা সিগারেট খাচ্ছিল, তার মাথা পেছনে হেলানো, চোখদুটো বন্ধ। বেরেসফোর্ড বুড়ির জিনিসপত্রগুলো যতদূর সম্ভব কুড়িয়ে দেন, তারপর ড্রাইভারের পাশে দাঁড়াবার জন্য সামনে এগিয়ে যান। তিনি বলেন ‘নামব।’

ড্রাইভারটি মাথা না ঘুরিয়েই বলে, ‘ব্লকের মাঝপথে থামাতে পারব না।’

‘তাহলে পরের স্টপে।’

বাস দ্রুত চলতে থাকে। ঝুঁকে পড়ে সামনের জানালা দিয়ে রাস্তার নম্বর দেখতে গিয়ে ‘বাস স্টপ’ লেখা একটা সাইন দেখতে পান বেরেসফোর্ড।

তিনি বলেন, ‘এখানে।’

ওটা পেরিয়ে যেতে যেতে ড্রাইভার বলে, ‘কী?’

‘শোনেন, আমি নামতে চাই।’

‘ঠিক আছে, পরের স্টপে।’

‘এইমাত্র একটা পেরিয়ে এলেন আপনি।

‘ওখানে তো বাসের অপেক্ষায় কাউকে দেখলাম না। যা-ই হোক, আপনি সময়মতো বলেননি আমাকে।’

বেরেসফোর্ড অপেক্ষা করেন। মিনিটখানেক পর আরেকটা বাস স্টপ দেখতে পেয়ে বলেন, ‘এখানে।’

কিন্তু বাস থামে না, গতি না কমিয়ে সাইনপোস্ট পেরিয়ে যায়।

ড্রাইভার বলে, ‘আমার নামে অভিযোগ করতে পারেন।’

বেরেসফোর্ড বলেন, ‘শুনুন তাহলে।’

ড্রাইভারটি এক চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়, লোকটা মজা পাচ্ছে বলে মনে হলো। তারপর বলে, ‘আমার নামে অভিযোগ করতে পারেন, এই কার্ডে আমার নম্বর আছে।’

‘পরের স্টপে যদি না থামেন, আমি দরজার কাচ ভেঙে চিৎকার করব।’

‘কী দিয়ে? ক্যান্ডির বাক্স দিয়ে।’

‘আপনি কীভাবে জানেন যে এটা—’ এটুকু বলার পর বেরেসফোর্ড বুঝতে পারলেন যে লোকটার সাথে কথায় জড়িয়ে পড়লে পরের বাসস্টপটা পার হয়ে যাবে। তাঁর মাথায় এটা আসেনি যে বাসস্টপ ছাড়া অন্য যেকোনো জায়গায় তিনি নামতে পারেন। সামনে বাতি দেখতে পেলেন তিনি, বাসটাও এসময় ধীরগতি হয়ে আসে। বেরেসফোর্ড চকিতে একবার পিছু ফিরে দেখতে পান হালকা হ্যাট পরা লোকটা শরীর টানটান করে উঠে দাঁড়িয়েছে।

একটা সাইনপোস্টের সামনের স্টপে দাঁড়ায় বাসটা, কিছু দোকানপাট ছিল সেখানে।

ড্রাইভার বলে, ‘ঠিক আছে, নামার জন্য আপনি এতই যখন উদ্বিগ্ন।’ হালকা হ্যাট মাথায় লোকটা পেছনের দরজা দিয়ে নেমে পড়ে। বেরেসফোর্ড সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে বলেন, ‘আমি বোধ হয় আরও কিছুক্ষণ থাকব।’

ড্রাইভারটি বলে, ‘এটা শেষ স্টপ। সবাই নামুন।’ তারপর বেরেসফোর্ডের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে বলে, ‘আপনি চাইলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন। এই কার্ডে আমার নম্বর আছে।’

বেরেসফোর্ড নেমে ফুটপাতে দাঁড়ানো হালকা হ্যাট পরা লোকটার দিকে সোজা এগিয়ে যান । তারপর বেশ জোরালো কণ্ঠে বলেন, ‘এটা একেবারেই হাস্যকর। ব্যাপারটার কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনাকে জানিয়ে রাখতে চাই যে প্রথম যে পুলিশটিকে দেখতে পাব আমি…,’ হালকা হ্যাট পরা লোকটি তাঁর দিকে তাকিয়ে নেই দেখে থামেন তিনি। দেখেন লোকটার বিরক্ত একঘেঁয়ে দৃষ্টি তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে ছড়ানো। বেরেসফোর্ড ঘুরে তাকিয়ে মোড়ে দাঁড়ানো এক পুলিশকে দেখতে পান।

হালকা হ্যাট পরা লোকটাকে ‘দাঁড়ান এখানে’ বলে পুলিশটির দিকে রওনা হন তিনি। মাঝামাঝি গিয়ে ভাবেন: পুলিশের কাছে কী অভিযোগ করবেন? একটা বাস তাঁর অনুরোধেও দাঁড়ায়নি, স্যুভেনির শপের ক্লার্ক খদ্দেরদের সাথে ঝামেলা করে, হালকা হ্যাট পরা এক রহস্যময় মানুষ-কিন্তু কেন? তিনি বুঝতে পারেন যে পুলিশটির কাছে তাঁর বলার মতো কিছু নেই: তিনি ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন, হালকা হ্যাট পরা লোকটি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনই সাবওয়ের গেটের দিকে ছুট লাগান তিনি। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে পকেট থেকে একটা কয়েন তুলে নেন, রিভলভিং ডোরের ভেতর দিয়ে পার হয়ে গেলে হাতের বাঁয়ে ডাউনটাউনের ট্রেন, সেদিকে ছোটেন।

দৌড়াতে দৌড়াতে তিনি ভাবছিলেন: লোকটা ভাববে আমি যদি খুব গাধা হই তাহলে ডাউনটাউনের দিকে যাব, যদি তার চেয়ে কিছুটা চালাক হই তাহলে যাব আপটাউনের দিকে, আর সত্যিকারের বুদ্ধিমান হলে আমি ডাউনটাউনেই যাব। সে কি আমাকে মোটামুটি চালাক ভাবে, না কি খুব চালাক?

হালকা হ্যাট পরা লোকটা বেরেসফোর্ডের কয়েক মুহূর্ত পরেই ডাউনটাউনের প্লাটফরমে নেমে আসে, তারপর দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে থাকে। হতোদ্যম হয়ে একটা বেঞ্চে বসে পড়েন বেরেসফোর্ড। বসে বসে ভাবেন, ঠিক হলো না, একেবারেই ঠিক হলো না; লোকটা এখন বুঝে ফেলেছে কেমন চালাক আমি।

ঝড় তুলে ট্রেনটা স্টেশনে ঢোকে, বেরেসফোর্ড খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েন, দেখেন হালকা হ্যাট পরা লোকটা পরের কামরার দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল। ঠিক যখন দরজা বন্ধ হতে যাবে, বেরেসফোর্ড লাফ দিলেন, দরজা ধরেও ফেললেন, বেরিয়ে যেতেও পারতেন যদি না একটা মেয়ে তাঁর হাত ধরে চিৎকার করে উঠত, ‘হ্যারি, ঈশ্বরের দোহাই, কোথায় চললে?’

দরজাটা বেরেসফোর্ডের শরীরের কারণে আধখোলা, হাতটা ভেতরে মেয়েটার হাতে ধরা, সর্বশক্তি দিয়ে হাতটাকে ধরে রেখেছে সে। কামরার ভেতরের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলে, ‘সে তার পুরোনো বন্ধুদের দেখতে চায় না, এটা কি ভালো?’

কয়েকজন হেসে ওঠে, বেশিরভাগ লোকই তাকিয়ে দেখছিল ওকে।

কে যেন বলে ওঠে, ‘সিস্টার, শক্ত করে ধরে রাখেন।’

মেয়েটি হাসে, তারপর বেরেসফোর্ডের হাত ধরে টানতে থাকে। কামরার লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে মেয়েটি বলে, ‘পালাতে চাইছে ও।’ এসময় বড়োসড়ো এক লোক এগিয়ে এসে দাঁত বের করে হেসে মেয়েটিকে বলে,‘আপনি যদি ওকে এমন মরিয়াভাবে পেতে চান, আপনার জন্য ওকে ভেতরে নিয়ে আসতে পারি আমরা।’shirley_Paranoia_Cover_2

বেরেসফোর্ড টের পান তাঁর হাত ধরা মুঠোটা হঠাৎ এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিনত হয়েছে, সেটা দরজার ফাঁক থেকে একটানে ভেতরে এনে ফেলে তাঁকে, বন্ধ হয়ে যায় দরজা। কামরার সবাই মজা করে ওঁকে দেখে হাসছিল, বড়োসড়ো লোকটা বলে, ‘কোনো ভদ্রমহিলার সাথে এরকম করতে হয় না, বন্ধু।’

বেরেসফোর্ড মেয়েটার উদ্দেশে চারদিকে তাকান, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কোথায় যেন মিশে গিয়েছে সে। ট্রেন চলা শুরু করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে কামরার লোকজন ওর দিকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে, তিনি কোটটা ঝেড়ে ঠিকঠাক করে নিলেন। দেখেন ক্যান্ডির বাক্সটা তখনো অক্ষত।

 

 

Faruq Moinuddin_Motifসাবওয়ে ট্রেনটা ডাউনটাউনের দিকে যাচ্ছিল। বেরেসফোর্ড গোয়েন্দা কৌশল, রহস্যোপন্যাসের চাতুরি ইত্যাদি নিয়ে মাথা খাটিয়ে একটা উপায় ভেবে বের করেন, যা অব্যর্থ হতে পারে। খুব নিরীহভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। ট্রেন ডাউনটাউনে পৌঁছালে টুয়েন্টি থার্ড স্ট্রিটে গিয়ে বসার একটা সীটও পেয়ে যান। তারপর ফোর্টিন্থ স্ট্রিটে ট্রেন থামলে নেমে পড়েন। হালকা হ্যাটও তাঁর পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় উঠে আসে। যেমনটি আশা করছিলেন, সামনের ডিপার্টমেন্ট স্টোরের নিওন আলোতে লেখা, ‘আজ রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা’। লোকজনের ক্রমাগত আসা যাওয়ার কারণে ওটার দরজা পুরো খুলে গিয়ে সামনে পেছনে দোল খাচ্ছিল। বেরেসফোর্ড ভেতরে ঢোকেন। দোকানটা তাঁর মাথা গুলিয়ে দেয়। কাউন্টারগুলো সবদিকে ছড়ানো, অন্য যে কোনো জায়গার চেয়ে এখানকার বাতিগুলো অনেক উজ্জ্বল। মানুষের শোরগোল শোনা যাচ্ছিল। বেরেসফোর্ড ধীরে ধীরে একটা কাউন্টারের পাশে যান, প্রথমে পাতলা ও রোদে পোড়া তামাটে, কালো, পাতলা ও স্বচ্ছ স্টকিংসগুলো, তারপর গাদা করে রাখা মূল্যহ্রাসের হাতব্যাগ, ভালোগুলো বাক্সের মধ্যে রাখা, তারপর মেডিক্যাল সরঞ্জাম, প্রমাণসাইজের মূর্তিগুলো অশ্লীল বন্ধনী পরা অবস্থায় কাউন্টারে দাঁড় করানো, লোকজন বিব্রত মুখে সেসব কিনতে আসছিল। বেরেসফোর্ড সেখান থেকে ঘুরে টুকিটাকি জিনিসে ভর্তি একটা কাউন্টারের সামনে আসেন। স্কার্ফ কাউন্টারে বেজায় শস্তা কিছু স্কার্ফ, পোস্টকার্ড, কালো চশমা ইত্যাদি। একজায়গায় লেখা ‘যেকোনো জিনিস ২৫ সেন্ট’। অস্বস্তির সাথে একজোড়া কালো চশমা কিনে নেন তিনি।

তারপর, যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন, সেটা থেকে বেশ দূরের আরেকটা দরজা দিয়ে বের হয়ে আসেন। আট কি নয়টা দরজার যেকোনো একটা ব্যবহার করা যেত, কিন্তু এটাকে যথেষ্ট জটিল মনে হলো। হালকা হ্যাটের কোনো নিশানা নেই। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যাওয়ার পরও কেউ বাধা দিল না। দ্বিতীয় না কি তৃতীয় গাড়িটি যাবে, সেটা নিয়ে তর্ক হলেও শেষপর্যন্ত যেটা তাঁকে দেওয়া হলো সেটাই নিলেন তিনি, গাড়িতে উঠে বাড়ির ঠিকানা বাতলে দেন ড্রাইভারকে।

তাঁর স্ত্রী উদ্বেগে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোনো সমস্যা হয়েছে?’ তারপর স্বামীর টাইটা আলগা করে চুলগুলো ঠিক করে দেন। বলেন, ‘তুমি কি অসুস্থ? কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? কী হয়েছে?’

কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে পৌঁছে যান বেরেসফোর্ড। তারপর সাবধানে নিঃশব্দে ট্যাক্সি থেকে বের হয়ে লবিতে ঢুকে পড়েন। হালকা হ্যাট ছিল না কোথাও, কোনো উটকো লোক নজর রাখছিল না। এলিভেটরেও তিনি একা, কোন ফ্লোরের বোতাম টিপলেন দেখার কেউ নেই। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে তিনি ভাবেন বাড়ি ফেরার দীর্ঘ যাত্রাটা স্বপ্নে দেখছিলেন কি না। দরজার বেল টিপে অপেক্ষা করেন তিনি, তাঁর স্ত্রী দরজা খুললে সম্পূর্ণ অবসন্ন বেরেসফোর্ড ঘরে ঢোকেন।

মায়াভরা গলায় ওঁর স্ত্রী বলেন, ‘তুমি সাংঘাতিক দেরি করে এলে, ব্যাপারটা কী?’

তিনি ওঁর দিকে তাকান, নীল পোশাক পরেছে, তার মানে আজ যে ওঁর জন্মদিন সেটা মনে রেখেছেন, আশা করে বসে আছেন, বেরেসফোর্ড বাইরে খেতে নিয়ে যাবেন ওঁকে। নিস্তেজভাবে ক্যান্ডির বাক্সটা স্ত্রীর হাতে তুলে দেন তিনি, তবে তাঁর উদ্বেগটা লক্ষ করেন না। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কী এমন ঘটেছিল ডার্লিং? এখানে এসে বসো। খুব কাহিল দেখাচ্ছে তোমাকে।’

স্ত্রীর পিছু পিছু লিভিং রুমের দিকে যান তিনি, নিজের চেয়ারটাতে বসেন, বেশ আরাম লাগে, তারপর ওটাতেই শুয়ে পড়েন।

তাঁর স্ত্রী উদ্বেগে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোনো সমস্যা হয়েছে?’ তারপর স্বামীর টাইটা আলগা করে চুলগুলো ঠিক করে দেন। বলেন, ‘তুমি কি অসুস্থ? কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? কী হয়েছে?’

বুঝতে পারেন তিনি যতখানি নন, তার চেয়ে বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাঁকে, স্ত্রীর এই মনোযোগের জন্য গর্ববোধ হয় তাঁর। গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলেন, ‘কিছুই না, কোনো সমস্যা নেই। তোমাকে একটু পরে বলছি সব।’

তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘বসো, তোমার জন্য একটা ড্রিংক নিয়ে আসি।’

স্ত্রী বেরিয়ে যেতেই নরম চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দেন বেরেসফোর্ড। তাঁর জানা ছিল না যে এই দরজার একটা চাবি আছে। খুব হালকাভাবে ওটা ঘোরানোর শব্দ কানে আসে তাঁর। উঠে দাঁড়িয়ে দরজায় কান পাতলে হল রুম থেকে তাঁর স্ত্রীকে টেলিফোন করতে শোনা যায়।

ডায়াল করে অপেক্ষা করছেন তিনি। তারপর বলেন, ‘শোনেন, শোনেন, শেষপর্যন্ত এসেছেন উনি। তাঁকে পাওয়া গেছে।’

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ভ্রমণ লেখক, অর্থনীতি বিশ্লেষক ও অনুবাদক। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রথম গল্পের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ক লেখালেখির মাধ্যমে কর্পোরেট জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ২০০০ সালের প্রথম থেকে মুম্বাই প্রবাসকালে দৈনিক প্রথম আলোতে তাঁর লেখা ‘মুম্বাইর চিঠি’ শিরোনামের নিয়মিত কলামটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মূলত এই কলামটির মাধ্যমেই তাঁর ভ্রমণবিষয়ক লেখালেখির সূত্রপাত ঘটে। এযাবত প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে গল্পগ্রন্থ চারটি, অনুবাদ পাঁচটি, ভ্রমণ সাতটি, অর্থনীতি-ব্যাংকিং বিষয়ক গ্রন্থ চারটি এবং প্রবন্ধগ্রন্থ একটি। মার্কিন গবেষক ক্লিণ্টন বি সিলির লেখা জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ গ্রন্থের সফল অনুবাদ ‘অনন্য জীবনানন্দ’ বইটির জন্য তিনি ‘আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ২০১১’ এবং ভ্রমণসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।