শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

আবুল হাসানের ঈর্ষা : মোশতাক আহমদ

0

কলেজ পড়ুয়া তরুণ লেখক, বুদ্ধদেব বসুর ‘আমরা তিনজন’ গল্পের নায়িকা মোনালিসা ওরফে অন্তরা ওরফে তরুর পরিণতিতে বিমর্ষ হয়ে পড়ল। সেই যে বিখ্যাত গল্প, যার শুরুটা এরকম— ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি, অসিত আর হিতাংশু; ঢাকায় পুরানা পল্টনে, উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা, সেই পুরানা পল্টন, সেই মেঘে-ঢাকা সকাল!’

এর প্রায় চল্লিশ বছর পর বুদ্ধদেব বসু আবার লিখলেন, বেতার জগত পত্রিকায়, ‘ভাব বিনিময়’ নামের রচনায়—

পত্রখানা ও গল্পটির লেখক একই ব্যক্তি, যুবক, কলেজের ছাত্র— যেমন আমি ছিলাম ঢাকায়, পুরানা পল্টনে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। চিঠিতে লেখা আছে: ‘কোনো কোনো লেখা কোনো পাঠকের মনে এতদূর পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে যে স্বয়ং লেখক তা ধারণা বা উপলব্ধি করতে পারেন না।… ‘আপনার “আমরা তিনজন” পড়ে অন্তত আমার তা-ই ধারণা হয়েছে।

‘মাসখানেক আগে ঢাকা থেকে একটি চিঠি পেলাম, সাথে একটি সাময়িক-পত্রে ছাপা-হওয়া রচনা, রচনাটির নাম ‘আমরা তিনজন’। পত্রখানা ও গল্পটির লেখক একই ব্যক্তি, যুবক, কলেজের ছাত্র— যেমন আমি ছিলাম ঢাকায়, পুরানা পল্টনে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। চিঠিতে লেখা আছে: ‘কোনো কোনো লেখা কোনো পাঠকের মনে এতদূর পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে যে স্বয়ং লেখক তা ধারণা বা উপলব্ধি করতে পারেন না।… ‘আপনার “আমরা তিনজন” পড়ে অন্তত আমার তা-ই ধারণা হয়েছে। গল্পটি পড়ে আমি গল্প লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। এবং তা আমার তরুণ জীবনের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে।’ পত্রলেখক তাঁর স্বরচিত যে গল্পটি পাঠিয়েছেন তাতে লেখা আছে : ‘বুদ্ধদেব বসুর “আমরা তিনজন” পড়ে… হিতাংশুদের বাড়ি পুরানা পল্টনের তারাকুটির অনেক খুঁজেছি; কিন্তু পাইনি। শেলির চোখে [শেলি এক নায়িকার নাম] বুদ্ধদেব বসুর ‘মোনালিসা’র ছায়া খুঁজেছি— কিন্তু পাইনি। সেই পুরানা পল্টন, সেই মোনালিসা, সেই অসিত, হিতাংশু, বিকাশ— কিছুই পাইনি আমরা।’

লেখকের নাম সিরাজ, সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা শহরের উদীয়মান গল্পকার। বুদ্ধদেব বসুর ‘আমরা তিনজন’ পড়ে ওলট-পালট হওয়া এক কলেজ ছাত্র। বুদ্ধদেব বসু, সিরাজকে পাঠালেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত ত্রিশটি নির্বাচিত গল্পের সংকলন ‘ভাসো, আমার ভেলা’। এমন দেখনহাসি প্রচ্ছদ যে সে প্রচ্ছদের ছবি দেখেই সপ্তডিঙ্গা নিয়ে সাতসাগর পার হবার পাথেয় পাওয়া গেল বলে মনে হলো সিরাজের। বইটা সে বারবার উলটে পালটে দেখে, ঘ্রাণ নেয়; পড়ার মতো স্থিরতা পাচ্ছে না। নিজের লেখা নিয়ে সে নানা পত্রিকা অফিসে যায়— সাথে ওই বুদ্ধদেব বসুর ‘ভাব বিনিময়’ নামের প্রবন্ধ। কথাটা ঢাকা শহরের ছোটো সাহিত্যিক মহলে চাউর হয়ে যেতে সময় লাগল না।

সিরাজ সেদিন দৈনিক পাকিস্তানে আহসান হাবীবের কাছে নতুন গল্প জমা দিবেন। কবির ব্যস্ততা দেখে সিরাজ গিয়ে ভুঁইয়া ইকবালের টেবিলে বসে আছেন। ভুঁইয়া ইকবালের কাছ থেকেই তিনি বুদ্ধদেব বসুর ঠিকানা জোগাড় করেছিলেন। ইকবাল সে সময়ে তাঁর ‘পূর্বলেখ’ পত্রিকার দুই বাংলার একটা সংকলনের জন্য পশ্চিম বাংলার কবিদের ঠিকানা জোগাড় করছিলেন। ইকবালের কাছে আবুল হাসান আর নির্মলেন্দু গুণ এলেন হই হই করতে করতে। ঝোলা থেকে বগলা সিগারেট বের করে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আসর সরগরম করে ফেললেন। সিরাজ কবিতার লোক নন, মুখচোরা মানুষ। নীরবে সরে গেলেন।

পরদিন বিকেলে আউটার স্টেডিয়ামে হাসানকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখতে পেলেন। হাসানই এগিয়ে এলেন।

—আপনার নাম সিরাজ, তাই না?

—আমাকে আপনি চিনেন?

—হ্যাঁ, চিনিতো, দেখা হয়েছে আগে। আপনার গল্পও পড়েছি।

হঠাৎ করেই খুব পরিচিতের মতো জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কাছে একটা টাকা হবে? আমার কাছে এক টাকা আছে; আর এক টাকা হলে দুজনে মিলে আইসক্রিম পার্লারে বসা যেত।

সিরাজের কৌতূহল হলো। বলল, পকেটে বাসায় যাবার রিকশা ভাড়া আছে। ঠিক আছে, চলুন আপনার সাথে বসি।

—বাসা কোথায় আপনার?

—জি, দক্ষিণ মৈশুন্ডি।

—আরে, কাছেই তো! হাঁইটা যাইবেন!

দুজনে মিলে গুলিস্তানের একটা আইসক্রিম পারলারে বসে অনেক সাহিত্য আলোচনা হলো। এক সময় আবুল হাসান বুদ্ধদেব বসুর লেখা চিঠি আর উপহার হিসেবে পাঠানো বইটা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সিরাজ মহা উৎসাহে মূল ‘আমরা তিনজন’ পড়ে তার প্রতিক্রিয়া, একই নামে গল্প লিখে সিনেমা পত্রিকা চিত্রাকাশে ছাপানো, কবিকে সেই পত্রিকাসহ চিঠি পাঠানো— সবই শোনালেন।

—আপনি কি বুদ্ধদেব বসুর গল্পের সেই তারাকুটির খুঁজে পেয়েছিলেন?

একটা বাড়িকে তারাকুটির ভেবে আমার গল্পটা সাজিয়েছিলাম। পুরানা পল্টনে আমাদের স্কুল সহপাঠী খোকনদের বাড়ি। মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি যেতাম। ওদের বাড়িটি ছিল দুই বিঘা জুড়ে গাছগাছালি ঘেরা একতলা বাড়ি। প্রখর রোদেও ওদের বাড়ি ছিল সুনিবিড় ছায়াশীতল মায়াময় শান্তির নীড়। ওদের বাড়ির লোকেশন দেখে সেটাকেই তারাকুটির ভেবেছিলাম।

—একটা বাড়িকে তারাকুটির ভেবে আমার গল্পটা সাজিয়েছিলাম। পুরানা পল্টনে আমাদের স্কুল সহপাঠী খোকনদের বাড়ি। মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি যেতাম। ওদের বাড়িটি ছিল দুই বিঘা জুড়ে গাছগাছালি ঘেরা একতলা বাড়ি। প্রখর রোদেও ওদের বাড়ি ছিল সুনিবিড় ছায়াশীতল মায়াময় শান্তির নীড়। ওদের বাড়ির লোকেশন দেখে সেটাকেই তারাকুটির ভেবেছিলাম। আসলে বুদ্ধদেব বসু ওই লোকেশন ব্যবহার করলেও মোনালিসাদের বাড়ি সেটা ছিল না। আসলে পটভূমি ছিল পরম ভবন, বসুর বন্ধু পরিমলদের বাড়ি। তাই আমরা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম।

—তারপর?

—গল্পে মোনালিসার মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি। খুব কষ্ট হয়েছিল। দিনরাত আমি মোনালিসাকে ভাবি। মোনালিসাকে কী ভাবে বাঁচিয়ে রাখব ভেবে পাই না। রাতে ঘুমাতে পারি না। মোনালিসা আমাকে জাগিয়ে রাখে। ঘুমিয়ে পড়লে ডেকে তুলে, তুমি নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছো! আমার কী ব্যবস্থা করলে? তাই আমার গল্পের কেশবতীকে সৃষ্টি করে বুদ্ধদেব বসুর নায়িকাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছি। গল্পের ভেতর আমরা সারাক্ষণ তাঁকে মুগ্ধ নয়নে ঘিরে রাখি। চরিত্রটি আমাদের তিনজনের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে, আনন্দে গান গায়।

—খুবই ইন্টারেস্টিং! তারপর গল্প পড়ে বুদ্ধদেব বসু কি বললেন?

—জানেন হাসান ভাই, বসু লিখেছেন, আমার চিঠি পড়ে ঢাকার একটা চঞ্চল ও সজীব সাহিত্যিক আবহাওয়ার আভাস পেয়ে উনি খুব খুশি হয়েছেন বলে লিখেছেন। আমার মাঝেও অনেক সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন বলে লিখেছেন! এটা যে কত বড়ো প্রেরণা …

—হ্যাঁ, এখানেই তো তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় কেটেছে অজিত দত্তের সাথে, এক সাথে প্রগতি পত্রিকা করেছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রকে জগন্নাথ কলেজে দেখেছিলেন কিন্তু তেমন আলাপ হয়নি এখানে থাকতে। পরে কোলকাতায় গিয়ে নতুন করে সম্পর্ক হলো।

—উনি লিখেছেন, ‘তোমার “আমরা তিনজন” গল্পটি এইমাত্র পড়ে উঠলাম। পড়তে পড়তে নিজের ছেলেবেলার কথা বারবার মনে পড়ছিল আমার— ১৯২৫-২৬-এর পুরানা পল্টনে, যখন আমিও বন্ধুদের নিয়ে তোমাদেরই মতো পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। তোমার লেখা থেকে অনুমান করা গেল ঢাকা কত বদলে গেছে, কত নতুন রাস্তা, পার্ক, সিনেমা হয়েছে, কিন্তু আমার চোখে এখনো ভাসে সেই বিশাল প্রান্তর, আমার জানালা থেকে সোজা রেললাইন পর্যন্ত ছড়ানো। আমি বুঝতে পারছি তোমার লেখার হাত আছে, কিন্তু বড্ড বানান ভুল করো এখনো, আশা করি কালক্রমে সেগুলো শুধরে যাবে।

—হা হা হা!

—উনি ঢাকার সমসাময়িক লেখকদের লেখা পড়তে চাইলেন। আমি আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ— এই চার লেখকের চারটি বই, সেই সঙ্গে চিঠির উত্তর দিলাম। কবি বুদ্ধদেব বসু বই-প্রাপ্তি সংবাদ ও চিঠির উত্তর দিলেন। চিঠির সঙ্গে তাঁর ‘ভাসো, আমার ভেলা’ গল্পগ্রন্থ উপহার পাঠালেন। লিখলেন, ‘সিরাজউদ্দিন আহমেদ / কল্যাণীয়েষু / বুদ্ধদেব বসু / ২৫ মে, ১৯৬৭/ কলকাতা।’

—বইটা আমাকে পড়তে দিয়েন তো! আচ্ছা, এরপরেও চিঠি দিয়েছেন?

—হ্যাঁ। চিঠিটা সাথে আছে। এই যে— লিখেছেন, ‘তোমার চিঠি আর তোমার পাঠানো বই ও পত্রিকাগুলো একই সঙ্গে এসে পৌঁছালো। অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। ঢাকার কবিদের মধ্যে অনেকের লেখার সঙ্গেই আমি ‘কবিতা’র সময় থেকেই পরিচিত, কথাসাহিত্য বিষয়ে বিশেষ কিছু জানতুম না, তোমার সৌজন্যে সে-বিষয়েও কিছু ধারণা পাওয়া গেল। সবগুলো এখনো পড়ে উঠতে পারিনি, তবে মনে হলো কারো-কারো রচনায় বেশ বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু অনেকেই এমন বিশৃঙ্খল বানান লেখেন যে অনেক চেনা শব্দকেও অচেনা মনে হয়। অবশ্য বানান নিয়ে পশ্চিম বাংলার তরুণ লেখকরাও যে অবহিত তা নয়, কিন্তু অনেকেই ভুল করেন ব’লে ভুলটাই সমর্থনযোগ্য হয় না। এবং ভাগ্যক্রমে তার সংশোধনও দুঃসাধ্য নয়। তোমার এ-চিঠিটাতে বানানভুল প্রায় নেই।’

—এবারে তো বানানের সার্টিফিকেটও পেয়ে গেলেন!

—হা হা হা! হ্যাঁ, আগের চিঠিতে আমার গল্পে বানান ভুলের কথা লিখেছিলেন। আরও লিখেছেন, ঢাকার স্মৃতি তাঁর অনেক লেখাতেই আছে। লিখেছেন, ঢাকায় প্রথম যখন বেতার-কেন্দ্র খোলা হয় তখন তিনি কোলকাতা থেকে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন— আর এসেছিলেন নজরুল ইসলাম। ঢাকার রেডিওতে পড়ার জন্যই ‘আবছায়া’ লিখেছিলেন। বলেছেন, তিনি বহু গল্প-উপন্যাসেই ঢাকার পটভূমিকা ব্যবহার করেছেন; সম্প্রতি ঢাকার পটভূমিতে ‘গোলাপ কেন কালো’ নামে একটি উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে বেরোচ্ছে।

এমন কাব্যময় গল্প অনেকদিন পড়েননি। হাসানের নিজের গল্পগুলোও খুবই কাব্যিক, অনেক ক্ষেত্রে গল্পগুলোতে গল্পই নাই। কিন্তু বসুর গল্পগুলোতে গল্প তো আছেই, কবিতাও আছে। বুদ্ধদেব বসুর গল্প পড়লে মনে হয় ইংরেজি বাকরীতি অনুসরণ করে নতুন একটা বাকরীতির নমুনা সৃষ্টি করেছেন।

আবুল হাসান বইটা নিয়ে চলে গেলেন। পড়েন আর মুগ্ধ হন। এমন কাব্যময় গল্প অনেকদিন পড়েননি। হাসানের নিজের গল্পগুলোও খুবই কাব্যিক, অনেক ক্ষেত্রে গল্পগুলোতে গল্পই নাই। কিন্তু বসুর গল্পগুলোতে গল্প তো আছেই, কবিতাও আছে। বুদ্ধদেব বসুর গল্প পড়লে মনে হয় ইংরেজি বাকরীতি অনুসরণ করে নতুন একটা বাকরীতির নমুনা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু পরিণত বয়সের গল্পগুলো পড়তে গিয়ে হাই তুলতে তুলতে রেখে দিলেন হাসান। যাই হোক, এই বইটা সংগ্রহে রাখা চাই! বইটা তিনি সিরাজকে ফেরত দেবেন না— বুদ্ধদেব বসুর স্বাক্ষর করা বই বলে কথা! আর যা সুন্দর প্রচ্ছদ আর ছাপা! —এই কারণেও তো বইটা সংগ্রহে রাখতে ইচ্ছা করে!

সিরাজ তো বই পাওয়ার আনন্দে, উত্তেজনায় বইটা ভালো করে পড়েও দেখেননি! তিন মাস পরেও যখন বইটা ফেরত পেলেন না, একদিন বিউটি বোর্ডিংয়ের বাগানে হাসানকে পাকড়াও করলেন—

—হাসান ভাই, আমার বইটা—

—ওই বই তো তুমি পাবে না।

—মানে?

—তুমি তো বইটা আমাকে দিয়ে দিয়েছ।

—কী বলেন? বুদ্ধদেব বসু নিজে অটোগ্রাফসহ বইটা আমাকে পাঠিয়েছেন! আমি আপনাকে ধার দিয়েছি। দিয়ে তো দিইনি! দিব কেন?

— শোনো, পাঁচ টাকা লাগবে। তাহলে বইটা ফেরত পাবে। —হাসান কঠিন স্বরে বললেন।

—এ কেমন কথা! আমার বই কালকের মধ্যে ফেরত দিবেন! নইলে আমি দেখে নিব। —সিরাজের তরুণ রক্ত, তায় পুরান ঢাকার স্থানীয় ছেলে সে। এ কথা শুনে হাসান মেজাজ হারালেন।

—কী দেখে নেবে তুমি? বলেই হাসান রেগেমেগে সিরাজের জামার কলার ধরে বসলেন!

এমন সময়ে একজন সাহিত্য অনুরাগী, ধোপ-দুরস্ত পোশাকের শ্রমিক নেতা শাহজাহান চৌধুরী বিউটি বোর্ডিংয়ে ঢুকছিলেন। তিনি হাসানকে নিরস্ত করলেন। হাসানকে তিনি ভালোভাবেই চিনতেন। পুরো ঘটনা শুনে নিয়ে ব্যপারটাতে মধ্যস্থতা করলেন। শাহজাহান ভাই বললেন, সিরাজকে বইটা ফেরত দিয়া দাও। পাঁচ টাকা দিয়া কি করবা আমাকে বলো, দরকার হলে আমি তোমাকে টাকা দিব!

 

পরের সপ্তাহে আবুল হাসান বইটি নিয়ে এলেন বিউটি বোর্ডিংয়ে।

—তুমি কি আমার সেই কবিতাটা পড়েছ? রুমানা নামের একটা মেয়ে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস পড়ে পড়ে উপন্যাসের নায়িকাদের মতোই জ্বরে ভুগত?

—না, হাসান ভাই, পড়া হয়নি আমার।

—বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পাঠ্যবইতে চলে যাবে, পাঠকের কাছে যাবে না। তাঁর কবিতা যত না সংক্রামক, তাঁর গল্পের বর্ণনাগুলো তাঁর চাইতেও বেশি সংক্রামক মনে হয়েছে। তাইতো বইটার মালিকানা দখল করতে চেয়েছিলাম। আসলে, আমার কাছ থেকে কেউ কখনো বই ফেরত চায় না। তুমি চেয়েছিলে, তাই রাগ হয়েছিল। তোমার প্রতি এক ধরণের ঈর্ষাও হয়েছিল!

—কবিতা তেমন একটা পড়া হয় না। আপনার ছোটোগল্প পড়েছি কয়েকটা।

—ওই হইল। ওইগুলাও তো কবিতাই। গল্পের পত্রিকা তাই গদ্যের মতো করে লিখে দিই!

এ কথা শুনে সিরাজের চোয়াল ঝুলে গেল! ভাবল, হবেও হয়তোবা।

হাসান রেস্তোরাঁর নিচু জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালেন, যেখানে লাল মোরামের রাস্তা ধরে এক পাশে লতাপাতা-ঘেরা ফুলের বাগান, মাঝখানে সবজেটে ঘাসের উঠোন— কিছুক্ষণ চুপচাপ নিস্পলক তাকিয়ে রইলেন। তারপর পকেট থেকে শাদা কাগজ আর কলম বের করে লিখলেন,

পৃথিবীতে আজ বড়ো অবিশ্বাস!
কখনো কান্নার কাছে মুখ নিয়ে মানুষ দেখিনি!
সৌর মাইল দূরে কান পেতে কম্পমান আত্মার ভিতরে আজ
অলৌকিক
দেখছি তোমাকে, তুমি ভালো আছো?

নিচে স্বাক্ষর করে কাগজের টুকরোটা সিরাজকে দিলেন, ‘এই নাও, তোমার ক্ষতিপূরণ দিলাম।’

সিরাজ কবিতাটা বইয়ের ভেতর রেখে দিল। আজ রাতে সে ‘ভাসো, আমার ভেলা’ নিয়ে বসবে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ৪ জানুয়ারি ১৯৬৮। মূলত কবি। আটটি কবিতার বই ছাড়াও লিখেছেন ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিপাঠের বই। পেশাগত জীবনে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন। প্রকাশিত কবিতার বই : সড়ক নম্বর দুঃখ বাড়ি নম্বর কষ্ট, আমার আনন্দ বাক্যে, পঁচিশ বছর বয়স, মেঘপুরাণ, ভেবেছিলাম চড়ুইভাতি, বুকপকেটে পাথরকুচি, ডুবোজাহাজের ডানা, অন্ধ ঝরোকায় সখার শিথানে । গল্পের বই : স্বপ্ন মায়া কিংবা মতিভ্রমের গল্প।প্রবন্ধ : তিন ভুবনের যাত্রী । স্মৃতিপাঠ : অক্ষরবন্দি জীবন। স্বনির্বাচিত কবিতা (প্রকাশিতব্য) : পদ্যাবধি । স্মৃতিকথা (প্রকাশিতব্য): গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প : পাবলিক হেলথের প্রথম পাঠ । ডকুফিকশন (প্রকাশিতব্য) : ঝিনুক নীরবে সহো

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।