শনিবার, এপ্রিল ২৭

কমিটমেন্ট

0

ফারিয়া বইপত্রের তলা থেকে ফোন বের করে। মা রান্নাঘরে কিছু একটা ভাজছেন, এক্ষুণি এই দিকে আসার সম্ভাবনা কম বুঝে ফোন অন করে সে। আজকে বিকেলেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফোনটা আর চালু করবে না। অন্তত অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হবার আগে তো নয়-ই। কিন্তু যদি আসিফ কোনো সন্ধি বার্তা পাঠায়? পাঁচ ঘন্টা না যেতেই আবার চালু করে ফেলল, তার আশা আসিফ ভুল বুঝতে পারবে, ক্ষমা চাইবে।

ফারিয়া একটু উঁকি দিয়ে দেখে নেয় লিভিং রুমে বাবা কী করছেন। সপ্তাহখানেক ধরেই সে ভাবছিল বাবাকে পুরো ব্যাপারটা বলা যায় কি না। একবার বাবা জিজ্ঞেসও করেছিল, ঠাট্টার ছলে, ‘আসিফ কি তোর বয়ফ্রেন্ড?’ সে তখন খুব হালকা চালে, ‘আরে ধুর, আমাদের ক্লাসের ছেলেরা কেউ অত ম্যাচিওরই না’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করেছে। মাকে ছাড়া কখনো কোথাও গেলে তাদের মধ্যে এমন হালকা চালে কথা হয়, মায়ের সামনে বাবাও যেন একটু সিরিয়াস প্যারেন্ট হয়ে যান। আচ্ছা, বাবা কি মাকে ভয় পান?

কলিংবেলের শব্দে চমক ভাঙে ফারিয়ার। এই সময়ে কে আর আসবে, দারোয়ান কিংবা পাশের বাসার বুয়া জাতীয় কেউ হবে হয়তো। ভালোই হলো, মায়ের এই রুমে এসে তার পড়ালেখার খোঁজ নেওয়ার সম্ভাবনা আরও কমলো।

কলিংবেলের শব্দে চমক ভাঙে ফারিয়ার। এই সময়ে কে আর আসবে, দারোয়ান কিংবা পাশের বাসার বুয়া জাতীয় কেউ হবে হয়তো। ভালোই হলো, মায়ের এই রুমে এসে তার পড়ালেখার খোঁজ নেওয়ার সম্ভাবনা আরও কমলো। কিছুক্ষণ সময় পাওয়া গেল। আসিফের টেক্সট মেসেজগুলো সে ডিলিট করছে না এখন আর। আগে সব ডিলিট করে দিত, গতবারের ঝগড়ার পর বেশি মন খারাপ হয়ে লাবণীকে বলেছিল, আসিফ এমন বাজে বাজে কথা লেখে ঝগড়া হলেই। লাবণী জিজ্ঞেস করেছে বাজে কথাগুলো কী। সে মুখে আনতে পারে না কথাগুলো, লাবণী তখন একটু বিরক্ত হয়েই বলেছে, ‘বলতে না পারলে দ্যাখা’, যখন সে বলল সেসব ডিলিট করে দিয়েছে তখন লাবণী মুখ বেঁকিয়ে বলেছে, ‘তো প্রমাণ কী যে আসিফ আসলেই গালি দিয়েছে তোকে?’

প্রথমে ফারিয়ার যে অনুভূতি হয়েছে তা হলো অপমান, লাবণী কী করে বলতে পারল একথা? আসিফ তার প্রেমিক, ক্লাসের সবাইকে জানিয়ে ভ্যালেন্টাইন’স ডে তে প্রপোজ করে তাদের সম্পর্ক শুরু, সে কি আসিফের নামে বানিয়ে বলবে? পরে একটু মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখল, আসলেই ওই নোংরা এসএমএস গুলো জমিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই কাউকে এটা বোঝানোর। মা দেখে ফেলবে ভয়ে সে ডিলিট করেছে সব, নাকি নিজের গা ঘিন ঘিন করছিল বলে– এখন আর মনে নেই।

ফোনে আরেকটা মেসেজ এসেছে, ‘তুই শুধু না, তোর বাপমাও চরিত্রহীন। তা না হইলে ইনসেস্ট করত না’। আসিফ ছাড়া আর কাউকে ফারিয়া বলেনি তার বাবামায়ের বিয়ের কারণে দাদাবাড়ি নানাবাড়ি কারো সঙ্গেই তাদের যোগাযোগ নেই। কিন্তু এই টেক্সটের জন্য প্রস্তুত ছিল না সে, তার গা কাঁপতে থাকে। এটা ডিলিট করতেই হবে, লাবণীও জানে না বাবা আর মায়ের বিয়ের গল্প। লিভিংরুমে কী যেন একটা ভাঙ্গে খান খান শব্দে, চমকে ওঠে ফারিয়া, ফোনটা প্রায় হাত থেকে পড়ে যায়, মেঝেতে পড়ার আগেই হাঁটু দিয়ে ধরে ফেলে সে। আবার সুইচ অফ করে রেখে দরজায় দাঁড়ায়।

তার ঘর আর বাবা মায়ের ঘরের মাঝখানে ডাইনিং আর লিভিং রুম। তার ঘরের দরজায় দাঁড়ালে ওদের ঘরের দরজাটা দেখা যায় সরাসরি। আর বাঁয়ে তাকালে লিভিং রুম দেখা যায়। দরজা একটু ফাঁক করতেই সে লিভিং রুম দেখতে পায়। বাবার সামনে একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, অস্বাভাবিক রকমের কাছে। বাবা মা দুইজনের পেছন দিক দেখা যাচ্ছে, মা ডাইনিং আর লিভিং রুমের মাঝে যে কাঠের পার্টিশনটা গত পরশু সরিয়ে রাখা হয়েছে সেই জায়গাটায়। মহিলাটা কে হতে পারে ভাবতে গিয়ে ফারিয়া চমকে ওঠে। আজ বিকেলের শেষ মেসেজে আসিফ লিখছিল, ‘হোয়াট ইউ হ্যাভ লার্নড ফ্রম ইয়োর প্যারেন্টস ইজ ফাকিং এনি স্ট্রেঞ্জার ইউ রান ইনটু’

 

ভদ্রমহিলার পরণে জিন্স আর গায়ে একটা কুর্তা। চুলের রঙ ঠিক তেমন যেটা করার অনুমতি মা কখনো দেবে না বলে চুলে রং করার ইচ্ছাই তার হয়নি আর। উজ্জ্বল বারগ্যান্ডি আর ম্যারুনের মধ্যে ওমবার। নাকে একটা রিং আর মোটা করে দেওয়া কাজলে উনাকে দেখতে লাগছে টিভি থেকে আসা কোনো চরিত্রের মতন।

ভদ্রমহিলার পরণে জিন্স আর গায়ে একটা কুর্তা। চুলের রঙ ঠিক তেমন যেটা করার অনুমতি মা কখনো দেবে না বলে চুলে রং করার ইচ্ছাই তার হয়নি আর। উজ্জ্বল বারগ্যান্ডি আর ম্যারুনের মধ্যে ওমবার। নাকে একটা রিং আর মোটা করে দেওয়া কাজলে উনাকে দেখতে লাগছে টিভি থেকে আসা কোনো চরিত্রের মতন। মা বা তার বন্ধুদের মায়েরা কখনো এমন বোল্ড গেট আপ নিতে পারে না, আর তাদের জেনারেশনের মেয়েরা নিতে চাইলেও অনুমতি দেয় না। অথচ এই মহিলার বয়স মায়ের চেয়ে কম হলেও একদম কম না, অন্তত তেত্রিশের উপরে তো হবেই। ফারিয়া বড়োদের বয়স কখনো ঠিকঠাক অনুমান করতে পারে না।

মহিলা তাকে দেখে ফেলতে পারেন ভেবে দরজার পাল্লার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়ায় সে। কিছু একটা নাটক চলছে, বুঝতে পারে। ‘এই ভাসটা গতমাসে চীন থেকে এনেছিলেন, না?’ অপরিচিত কণ্ঠটা নিশ্চয়ই সেই ভদ্রমহিলার। ‘খুব শখ করে কিনেছিলেন তো?’ তার কণ্ঠের এই সুরটাকে নিশ্চয়ই ভালো বাংলায় শ্লেষ বলে। ফারিয়া বুঝতে পারে না প্রশ্নটা কাকে করা হচ্ছে। তাদের গতমাসে চীনে বেড়াতে যাবার খবর ইনি জানেন কেমন করে? অনেকক্ষণ পরে মায়ের গলা শোনা যায় ‘হ্যাঁ’ একটু থেমে আবার ‘আপনি এটা ভাঙলেন কেন?’ এবার যে হাসিটা শোনা গেল সেটাকে অট্টহাসি বলে, নিজের বাংলা ভোকাবুলারি নিয়ে নিজেই সন্তুষ্ট হয়ে যায় ফারিয়া।

‘কেন? কেন?’ হাসি সামলাতে পারছেন না যেন মহিলা ‘আমি তো আপনার সংসারটাই ভেঙে দিতে পারতাম বহু আগে। সামান্য একটা ফ্লাওয়ার ভাসের মায়া করছেন আপনি মিসেস ইমতিয়াজ?’

এবারে আর কৌতুহল সামলাতে পারে না ফারিয়া। দরজা ফাঁক করে ডাইনিঙে দাঁড়ায়। বাবা উঠে দাঁড়িয়েছে। পেছন থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই বাবা নার্ভাস কি না। ‘তুমি বসো, আমরা বসে কথা বলি’। মহিলা সোফায় পা তুলে বসলেন। ‘কী রান্না করছিলেন আপনি? কাঁঠালের তরকারি নাকি চিকেন স্টু? আপনি তো এঁচোড় খুব ভালো রাঁধেন, তাই না? আর চিংড়ি দিয়ে পুঁই শাক?’

বাবার সব পছন্দের খাবার জানেন ইনি। মা এখন কী করবেন? এঁকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলবেন? কিন্তু ইনি ঢুকলেন কী করে? রাত নয়টার পরে কেউ এলে ইন্টারকমে ফোন করা হয়, সরাসরি ওঠে না কেউ। ফারিয়ার প্রশ্ন যেন টের পেয়ে গেছেন ‘আপনি যেবার আপনার বড়োমামা, মানে ইমতিয়াজের ফুফাতো ভাইকে দেখতে গেলেন, সেবারে আমি সাতদিন থেকেছি আপনার বাসায়। ফ্রিজে এসবই রান্না করা ছিল। গরম করে খেয়েছি আমরা। দারোয়ান চেনে আমাকে, সেইজন্যেই আটকায়নি’ বাবা মায়ের আনঅর্থোডক্স বিয়ের তথ্য ইনিও জানেন দেখা যাচ্ছে।

‘এখন আপনি কী চান?’ মা এমনভাবে কথা বলছেন যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

‘আমি কী চাই? এমনভাবে কথা বলছেন মিসেস ইমতিয়াজ অ্যাজ ইফ আপনার বাসায় ভিক্ষা করতে এসেছি?’

মা কখনো রেগে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন না, অন্তত ফারিয়া তার সাড়ে ষোল বছরের জীবনে শোনেনি। একদিন খুব রেগে গিয়ে হাত তুলেছিলেন চড় মারার জন্য, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। ফারিয়া অল্প কিছু সৌভাগ্যবান ছেলেমেয়েদের মধ্যে একজন যে গর্ব করে বলতে পারে বাবামায়ের হাতে কোনোদিন মার খায়নি কিংবা বকাঝকা শোনেনি। বাবা মা দুইজনেই শাসন করতে হলে অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় হাসি ছাড়া কথা বলেন, এতেই যা বোঝার বুঝে নেয় সে।

এখন কি মা এই মহিলাকে চড় মারবেন? নিশ্চয়ই না। মা বরং দেয়ালে মাথা ঠুকতে পারেন, নিজের সংসারের দুটো থালা বাসন গ্লাস যে মহিলা কোনোদিন ছুঁড়ে ভাঙেন না রাগ প্রকাশ করার জন্য, একজন অপরিচিত মহিলাকে মারা তাঁর জন্য অসম্ভব। ফারিয়াকে অবাক করে দিয়ে মা সোফায় গিয়ে বসেন, ফারিয়া দরজার আড়ালে লুকিয়ে যায়, মাকে সে জানতে দিতে চায় না যে সে জেগে আছে, এতসব উদ্ভট ঘটনা সে দেখেছে। কিন্তু দরজায় কান পেতেই রাখে।

‘আমি ভিক্ষা চাওয়ার কথা বলিনি। কী উদ্দেশ্যে এসেছেন সেটাই জানতে চাইলাম’ মায়ের কথায় কোনো ঝাঁঝ নেই, কোনো শ্লেষ বা বিদ্বেষ পর্যন্ত নেই। মা কেন এতো কুল? কীভাবে?

আবার কিছু একটা ছুঁড়ে মারার আওয়াজ হলো।

‘স্টপ ইট স্মিতা। ওঘরে আমার মেয়ে ঘুমাচ্ছে, স্টপ মেকিং নয়েজ’ বাবার গলা, কড়া কিন্তু অত উঁচু নয়।

‘মেয়ে উঠুক, দেখুক তার বাপের আসল চেহারা’ স্মিতা নামের ভদ্রমহিলা এবার বেশ চিৎকার করেই বলে। এর নাম স্মিতা কে রেখেছিল? আয়রনিক!

‘আপনি তাহলে আমাদের মেয়েকে তার বাবার চরিত্র সম্পর্কে জানাতে এসেছেন?’ মায়ের গলা এখনো নিরুত্তাপ, যেন প্রশ্নটার উত্তর জানাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, বাকি কোনোকিছুই তেমন জরুরি নয়।

‘আপনি তাহলে আমাদের মেয়েকে তার বাবার চরিত্র সম্পর্কে জানাতে এসেছেন?’ মায়ের গলা এখনো নিরুত্তাপ, যেন প্রশ্নটার উত্তর জানাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, বাকি কোনোকিছুই তেমন জরুরি নয়।

‘তার জানা দরকার না? তার এপেয়ারেন্টলি হ্যাপি প্যারেন্টদের কনজুগাল লাইফ আসলে কেমন সেই রিয়্যালিটি জানার বয়স তো তার হয়েছেই!’

ফারিয়ার ইচ্ছা করে মহিলার গলা টিপে ধরতে। একবার, অনেক আগে সে এক লোকের দিকে ইট ছুঁড়ে মেরেছিল, লোকটা ইচ্ছা করে ধাক্কা মেরেছিল মায়ের গায়ে, মা পড়ে গেছিল ফুটপাথে। সে তখন কোন ক্লাসে? কেজি বা ওয়ান হবে। স্কুলের সামনে থেকে রিকশা না পেয়ে তারা খানিকটা হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল। ইট লেগে লোক হুলুস্থুল শুরু করেছিল। মা কোনোমতে মাফটাফ চেয়ে নিয়ে সমাধান করলেন। অথচ দোষটা সেই লোকের, মা কেন মাফ চাইবেন? ফারিয়ার আরও বেশি রাগ উঠে গেছিল তখন। কিন্তু সারা রাস্তা মা কোনো কথাই বললেন না, শুধু চোখ মুছলেন একটু পর পর। মায়ের কান্না দেখে সেও কাঁদতে শুরু করেছিল। তার পরের মাসে বাবা গাড়ি কেনেন। এরপর থেকে সে আর গাড়ি ছাড়া স্কুলে যায়নি।

‘তাহলে আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের মেয়েকে জানানো যে তার বাবা একজন বদ চরিত্রের লোক? বিবাহবহির্ভূত একটি সম্পর্ক তাঁর আছে তাই তাঁকে বাবা হিসেবে শ্রদ্ধা করা যাবে না?’

‘না না, ছি ছি, তা কেন? ইমতিয়াজ সাহেব একজন সম্মানী লোক, ভালো বাবা, ভালো স্বামী, তাঁকে শ্রদ্ধা কে না করবে? তাঁর মেয়েকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানি দেওয়া তো শিবের অসাধ্য!’ ভদ্রমহিলা কেন এতো হেসে হেসে কথা বলছেন তা ফারিয়া বুঝতে পারে না।

‘তাহলে আপনার উদ্দেশ্যটা আসলে কী? এই অসময়ে কারো বাড়িতে আসার?’
‘রুবি, তুমি কি একটু ওই ঘরে যাবে, আমি দেখছি কী করা যায়।’ বাবা মাকে কিছু বললে মা সাধারণত সেটা মেনে নেন, এখনও কি মানবেন, উঠে ওই ঘরে চলে যাবেন? ফারিয়া আবার উঁকি দেয়।

মা উঠে দাঁড়িয়েছেন। স্মিতা নামের ব্যক্তিটি সোফায় পা তুলে আধশোয়া হয়ে আছে, মায়ের দিকে তার পা। বেয়াদবি দেখানোই মনে হয় এই পজিশনে বসার একমাত্র কারণ।

‘বাহ, কি সুন্দর, আপনি কি সবসময় এভাবে উনার কথায় ওঠেন বসেন মিসেস ইমতিয়াজ?’

মা কোনো জবাব না দিয়ে স্থির তাকিয়ে থাকেন।

‘এটা কি আপনাদের বিবাহের কমিটমেন্টের অংশ, যে কোনোদিন উনার কথার অবাধ্য হবেন না?’

‘আপনি আসলে কী বলতে চান?’

‘আমি আপনাদের কমিটমেন্টের ধরণটা জানতে চাচ্ছিলাম। আপনার হাজবেন্ড আমাকে কমিটমেন্ট শব্দটা শেখাচ্ছিলেন, বলছিলেন যে সকল সম্পর্কে নাকি কমিটমেন্ট থাকতে হয়, আমি অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে গেলেও সেই কমিটমেন্ট নাকি ভঙ্গ হয় আর সেজন্য উনি আমাকে বেধড়ক পেটাতে পারেন’

‘স্মিতা প্লিজ মিথ্যা কথা বলো না, উই হ্যাড এ হীটেড আর্গুমেন্ট, তুমি নিজেই আগে চড় চাপড় কিল ঘুষি দিচ্ছিলে, আমি যা করেছি সেলফ ডিফেন্সের জন্য’ বাবা কেন এই মহিলাকে এতো অনুনয় বিনয় করছে? মহিলা যদি সত্যিও বলে থাকে তাতে কী এমন এসে যায়। এর সঙ্গে বাবার একটা অনৈতিক সম্পর্ক যে আছে সেটা তো পরিষ্কার।

আবারো অট্টহাসি দেন মহিলা, হাসতে হাসতে যেন পেটে খিল ধরে যাচ্ছে তার। আচ্ছা, এই মহিলা কি একজন অভিনেত্রী? যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো রকম এক্সপ্রেশন দিতে পারেন সেজন্য?

‘মিসেস ইমতিয়াজ, আপনার হাজবেন্ড কখনো আপনার গায়ে হাত তুলেছেন?’

মা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, বেডরুমের দিকে এগোচ্ছেন তিনি। এটাই ভালো, ফারিয়া ভাবে। মায়ের প্রেশার বেড়ে গেছে নিশ্চয়ই, এসি চালিয়ে কিছুক্ষণ লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা দরকার। এসিতে বাবার সাফোকেটিং লাগে বলে মা এসি অফ করে রাখেন, বাবা বাসায় থাকলে।

ফারিয়ার স্বস্তি নষ্ট করে মা আবার ঘোরেন, ‘আমাদের কনজুগাল লাইফের কোনো ইন্টিমেট ডিটেইল একজন স্ট্রেঞ্জারকে কখনোই বলব না আমি’ মায়ের কন্ঠ শীতল, তবে ফারিয়া জানে এই শীতল কণ্ঠ বেরোয় প্রচন্ড রাগে প্রেশার বেড়ে গিয়ে যখন মায়ের ঘাড়ে ব্যথা শুরু হয় শুধুমাত্র তখনই।

‘আমি স্ট্রেঞ্জার নই মিসেস ইমতিয়াজ, আপনাদের এই বাসায় আমিও বসবাস করেছি, আপনি সতের বছর করেছেন আর আমি সাতদিন, কিন্তু তাতে কী? সময় তো একটা আপেক্ষিক ব্যাপার, তাই না?’ একদমে কথাগুলো বলে মহিলা, তারপর একটু হেসে বলে, ‘আইনস্টাইন সেটা প্রমাণ করে গেছেন’

‘কেউ তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে তাজমহল তার বাবার সম্পত্তি হয়ে যায় না’।

এবারে স্মিতা অট্টহাসি হাসেন না, হয়তো সারাক্ষণ অপ্রত্যাশিত অভিব্যক্তি দেখানোই তাঁর বৈশিষ্ট্য।

‘আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার স্বামী তাজমহলের মতন মহান কোনো ব্যাপার? একটা জলজ্যান্ত শিল্পকর্ম নাকি আপনাদের এই বাসাটা একটা টুরিস্ট স্পট? নাকি যে কেউ ইমতিয়াজের সঙ্গে শুতে বসতে পারে আপনার কোনো আপত্তি নেই তাতে? আপনাদের বিয়ের কমিটমেন্ট কি এমন ছিল? অ্যান ওপেন ম্যারেজ?’

‘আমি ঘুমাতে যাচ্ছি, আপনার যা খুশি ভাবতে পারেন’

‘কিন্তু আমি তো চলে যাচ্ছি না মিসেস ইমতিয়াজ, আমার কথা শেষ হয়নি’

‘আমাদের বাসায় কোনো গেস্ট রুম নেই, আপনি চাইলে এই সোফায় ঘুমাতে পারেন। কিংবা স্টাডি রুমেও ডিভান আছে’

মায়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? একে রাতে থেকে যেতে বলছে কোন আক্কেলে? ফারিয়া বুঝতে পারে না কিছুই, এখন কী হবে?

স্মিতা উঠে দাঁড়িয়েছে— ‘রণে ভঙ্গ দিলেন মিসেস ইমতিয়াজ? এত সহজে স্বামীর উপর অধিকার ছেড়ে দিলেন? জানেন তো, আমি আশেপাশে থাকলে যে উনি কোনো ভাবেই আপনাদের শোবার ঘরে আপনার পছন্দের ডিজাইনের খাটে আপনার সঙ্গে শুতে যাবেন না?’

‘উনি কার সঙ্গে ঘুমাতে যাবেন সেটা উনার নিজের সিদ্ধান্ত, আমার কিছু বলার নেই। আমি কার সঙ্গে থাকতে চাই সেটা আমার সিদ্ধান্ত। কমিটমেন্টের অর্থ জিজ্ঞেস করছিলেন না, আমার কাছে এটাই কমিটমেন্ট। আর… আমার নাম মিসেস ইমতিয়াজ নয়, তাজরিন আহমেদ রুবি’
মা শোবার ঘরের দিকে চলে যান। বাবা পুরোটা সময় দুই হাতে মাথা খামচে ধরে হাঁটুর উপর কনুই রেখে বসে ছিলেন। এখন বাবা কী করবেন? এভাবেই বসে থাকবেন?
সে ফোন অন করে আসিফের মেসেজগুলো ডিলিট করে ফেলে আবার। তারপর নম্বর ব্লক করে দেয়। একটু পরে একটা মোটর বাইকের আওয়াজ শোনা যায় রাস্তায়। পর্দা সরিয়ে ফারিয়া দেখতে পায় মোটর সাইকেলের পেছনে বসা স্মিতার পিঠ।

লিভিং রুমে উঁকি দিয়ে সে দেখে বাবা ফুলঝাড়ু আর বেলচা নিয়ে ভাঙা পোরসেলিনের টুকরোগুলো জড়ো করছে।

বাবার জন্য ফারিয়ার খুব মায়া হয়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।