শনিবার, এপ্রিল ২০

ঘটনা এইরূপে ঘটে

0

ঘটনা এইরূপে ঘটে— সাবিকুন্নাহার পলির বিয়ে হয়ে যাওয়ার সাড়ে পাঁচ বছর পর অবিবাহিত রুহুল আমিন জানতে পারে সাবিকুন্নাহার পলি তার বিবাহিত স্ত্রী। এই কথা জানার পর তার অস্থিরতা অনুভব হয়। এবং সাড়ে পাঁচ বছর আগের হৃদয়ের ক্ষত পুনরায় জেগে ওঠে। জীবনানন্দ জানতেন কি না কে জানে— হৃদয় খুঁড়ে কেউ বেদনা জাগাতে না চাইলেও বেদনা কীভাবে কীভাবে যেন ঠিকই জেগে উঠে হৃদয় আঁকড়ে ধরে দমবন্ধকর অবস্থার সৃষ্টি করে।

যাই হোক, ঘটনায় আসি। রুহুল আমিনের প্রকৃত বয়স ঊনত্রিশ বছর কয়েক মাস হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রানুযায়ী বয়স ৩১ বছর ছাড়িয়ে গেছে। ঘটনা তেমন কিছু না। সেবার যখন ভোটার তালিকা ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হচ্ছিলো তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। কিন্তু এলাকার মেম্বারসাব কহিলেন, ‘পাঁচ বছর পরে ফের ভোটার তালিকা হইবো— এর মাঝে তো তুই আর ভোটার হইতে পারবি না। এর চেয়ে, বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দিয়ে এখনই হয়ে যা। ব্যাটা! ডিজিটাল ভোটার কার্ড পাবি! এই সুযোগ মিস করা ঠিক হবে?’ রুহুল আমিনের বাবা গিয়াসুদ্দিন ও রুহুল আমিন দুইজনই ভাবল এই সুযোগ কোনোমতেই মিস করা ঠিক হবে না। ফলত রুহুল আমিন বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দিয়ে ভোটার হয়ে যায়। এবং সে বছরই প্রথমবার ভোটার কার্ড ব্যবহার করে ভোট দিতে পারে। এরপর ১০ বছর কেটে গেলেও কোনোবারই আর সে এই ভোটারকার্ড ব্যবহার করে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। লাভের লাভ তার কিছুই হয়নি। বরং ব্যাপারটা মন্দ হয়েছে ভীষণ। গতবছর তার গ্রামের ইশকুলের দফতরির চাকরি পাওয়ার একটা সুযোগ এসেছিল, বয়স ত্রিশ না হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়ার কারণে সেই সুযোগটাও কাজে লাগানো গেল না। অথচ তার গ্রামে ওই পোস্টে তার চেয়ে যোগ্য কেউ ছিল না। আর শেষে চাকরিটা পেল এনামুল মুন্সির ছেলে তৌহিদুল, যে কিনা বয়সে প্রকৃত অর্থে তার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়ো, কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র ও সার্টিফিকেট হিসেবে বয়স বছর পাঁচের ছোটো।

রুহুল আমিনের প্রকৃত বয়স ঊনত্রিশ বছর কয়েক মাস হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রানুযায়ী বয়স ৩১ বছর ছাড়িয়ে গেছে। ঘটনা তেমন কিছু না। সেবার যখন ভোটার তালিকা ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হচ্ছিলো তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। কিন্তু এলাকার মেম্বারসাব কহিলেন, ‘পাঁচ বছর পরে ফের ভোটার তালিকা হইবো— এর মাঝে তো তুই আর ভোটার হইতে পারবি না। এর চেয়ে, বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দিয়ে এখনই হয়ে যা। ব্যাটা! ডিজিটাল ভোটার কার্ড পাবি!

এইসব মেনে নিয়েই রুহুল আমিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকছিল, যেহেতু বেঁচে থাকা ছাড়া তার আর তেমন কিছু করার নেই। টেনেটুনে এসএসসি পাশের পর পড়াশোনা হয়নি। সে সময় এলো মাছ চাষের জোয়ার। অন্য জেলা থেকে আসা ফরিদ নামের এক লোক গ্রামের মানুষের জমি লিজ নিয়ে পুকুর কেটে ‘আল ফরিদুন মৎস্য খামার’ নামে খামার দিয়েছিল। রুহুল আমিন সেই খামারে হিসেব রাখার একটি চাকরি পেয়ে যায়। এই করেই তার জীবন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু যা হয়! সময় এক তালে কাটে না। মৎস্যখামারে ক্রমেই মাছের উৎপাদন কমে গেল। মাছের উচ্ছিষ্ট খাবার ও রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারে দূষিত হয়ে গেল মাটি ও পানি। সেইসব পুকুরে আর মাছ টিকে না। ওদিকে লিজের মেয়াদও শেষ। আল ফরিদুন খামার গুটাতুন ভাগাতুন। মানে ফরিদ সাহেব খামার বন্ধ করে চলে যায়। পুকুরগুলো নিয়ে গ্রামবাসীর এখন হাহাকার অবস্থা। সেখানে না করা যায় মাছের চাষ, না হয় পুকুরের পাড়ে সবজি-ফসল।

মাছ বা ফল-ফসল না হওয়া রুহুল আমিনের সমস্যা না। রুহুল আমিনের সমস্যা হচ্ছে তার চাকরি না থাকা। বেকার হয়ে যাওয়ার পর রুহুল আমিন কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। গত বছর পাশের গ্রামের লিয়াকত বললো, ‘দেশে থেকে কিছুই হবে না, চল কাতার যাই। কাতারে কাতারে লোক কাতার যাচ্ছে। কাড়ি কাড়ি টাকা কামাচ্ছে। দেশে শালার কিছুই হবে না!’ বৈদেশ যেতে হলে প্রথমে যা হাতে থাকতে হয়, তা হলো পাসপোর্ট। রুহুল আমিন আর লিয়াকত সোলায়মান মণ্ডলের মাধ্যমে দশ হাজার টাকা কন্ট্রাকে পাসপোর্ট করতে দেয়। তিন-চারদিন জেলা শহরে ঘুরে অফিসের লাইনে-টাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ছবি-টবি তুলে গ্রামে ফিরে আসে তারা। তারও মাস খানিক পর একদিন গঞ্জে হাবুলব্যাপারির দোকানে উপস্থিত থাকার কথা বলে সোলায়মান মণ্ডল। বলে যে, পুলিশ ভ্যারিফিকেশন হবে। নিজের ও বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র আর হাজার দুয়েক টাকা নিয়ে যেন বিকেলে ৩টার মাঝে উপস্থিত থাকে। তো রুহুল আমিন গিয়ে দেখে সোলায়মান মণ্ডলও এসেছে। দুই তিন গ্রামের আরও কয়েকজন আছে হাবুল ব্যাপারির দোকানোর সামনের বেঞ্চিতে বসে। তাদেরও পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়ে ভ্যারিফিকেশন হবে। বিকাল চারটার দিকে একজন পুলিশ আসলেন মোটর সাইকেলে করে। পুলিশ সাহেব এক জায়গায় বসে তাদের এক এক করে ডাকলেন, দুই হাজার করে টাকা নিলেন। যে দশ-বারোজন ছিল প্রায় সবারই ভ্যারিফিকেশন ওকে হয়ে গেল, কিন্তু সমস্যা হলো নন্দীগ্রামের ভজন শীল আর রুহুল আমিনের। ভজন শীলের জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবার নাম লেখা রাজেন্দ্রকুমার শীল। আর ভজনশীলের বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রে লেখা রাজেন্দ্র শীল। এই ‘কুমার’ না থাকার জটিলতার প্যাঁচে পড়ে যায় ভজন শীল। রুহুল আমিনের প্যাঁচটা অন্য রকম। প্রকৃত অর্থে সে অবিবাহিত, তাই পাসপোর্টের তথ্যে সে অবিবাহিতই দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ সাহেব বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র মতে রুহুল আমিন বিবাহিত। এবং তার স্ত্রীর নাম সাবিকুন্নাহার পলি। ভজন শীল ও রুহুল আমিন উভয়ের সমস্যা পুলিশের কাছে কোনো সমস্যাই না, যদি তাহাকে অতিরিক্ত পাঁচটি হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু এই সমস্যা জটিল সমস্যা হয়ে ওঠে রুহুল আমিনের জন্য। কারণ গঞ্জ থেকে গ্রামে ফিরতে ফিরতেই রাষ্ট্র হয়ে যায় যে সাবিকুন্নাহার পলির সাথে রুহুল আমিনের বিয়ে হয়েছিল। যার প্রমাণ রুহুল আমিনের জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করছে।

 


বছর দশ-এগারো আগে যখন রুহুল আমিনের এই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়, তখন এর তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বাতেন স্যার। বাতেন স্যারের ছেলে ইমরানুল হক আর রুহুল আমিন পরস্পর বাল্যবন্ধু। সে সময় এসএসসি দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায় বসেছিল তারা। আর সাবিকুন্নাহার পলি পড়ত ক্লাস সেভেনে। রুহুল আমিন মনে মনে সাবিকুন্নাহার পলিকে পছন্দ করত। আর সেই কারণে সে প্রতিদিন সাবিকুন্নাহার পলির স্কুলে যাওয়া আসার পথে অপেক্ষা করত। বন্ধু হিসেবে ইমরানুল হক সব সময় রুহুল আমিনের পাশে থাকত। দুইজনই কালোদীঘির পাড়ে শিমুল তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাবিকুন্নাহার পলির স্কুলে যাওয়া আসা দেখা ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তিই প্রকাশ করত না।

সাবিকুন্নাহার পলি বুঝতে পারত এই দুইজনের একজন তাকে পছন্দ করে। এবং মূলত তার জন্যই তারা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কোনজন যে তাকে পছন্দ করে সে তা অনুমান করতে পারছিল না। বান্ধবীদের সাথে স্কুলে যেতে যেতে ভাবত, ‘লালডা না কালাডা?’ বলে ফেলা ভালো, ইমরানুল হকের গায়ের রঙ একটু অস্বাভাবিক কালো। আর রুহুল আমিন বেশ ফর্সা।

সাবিকুন্নাহার পলি বুঝতে পারত এই দুইজনের একজন তাকে পছন্দ করে। এবং মূলত তার জন্যই তারা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কোনজন যে তাকে পছন্দ করে সে তা অনুমান করতে পারছিল না। বান্ধবীদের সাথে স্কুলে যেতে যেতে ভাবত, ‘লালডা না কালাডা?’ বলে ফেলা ভালো, ইমরানুল হকের গায়ের রঙ একটু অস্বাভাবিক কালো। আর রুহুল আমিন বেশ ফর্সা। এবং চুলের রঙ প্রাকৃতিকভাবেই লালচে। সাবিকুন্নাহার পলি দীর্ঘদিন ‘লাল’ ও ‘কালো’ বিষয়ে দ্বন্দ্বের ভেতর ছিল। ইমরানুল হক কালো হলেও তার বাবা বাতেন স্যার, শিক্ষিত পরিবার। এবং ইমরানুল হক ছাত্র ভালো। এসএসসিতে ‘জিপিএ ফাইভ’ যে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে রুহুল আমিনের বাবা গিয়াসুদ্দিন; কৃষক। পারিবারিক অবস্থা খারাপ না হলেও, ‘সেই ভালো’ বলা যায় না। রুহুল আমিন ছাত্র হিসেবেও টানাটুনির, জিপিএ তিন পেলেও পেতে পারে। কিন্তু দেখতে সাকিব খানের মতো। ফলত সাবিকুন্নাহার পলি সে সময়টাতে বেশ কিছুদিন খুব চিন্তার ভেতর ছিল, কে আসলে তাকে পছন্দ করে, আর কে তাকে পছন্দ করলে তার ভালো লাগবে— ছিল এই দ্বন্দেও। সে ভেবেছিল তাকে পছন্দ করার সাহস রুহুল আমিনের নাও থাকতে পারে। কারণ সে তফিজ উদ্দিন মৃধার মেয়ে। তার দাদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কেরানি। তাদের সম্পত্তি ও স্ট্যাটাসের সাথে রুহুল আমিন ঠিক যায় না। ইমরানুল হক ভালো ছাত্র হিসেবে এলাকায় বেশ পরিচিত। ক্লাস ফাইভে এবং এইটে বৃত্তি পাওয়া ছেলে। স্কুলের সবাই তাকে সমীহ করে। বড়োরা স্নেহ করে। কিন্তু গায়ের রঙ কালো। তার মতো সুন্দরীর পাশে তাকে ঠিক মানাবে কি না— এ প্রশ্ন থেকে যায়। ফলে সাবিকুন্নাহার পলির ‘রাস্তায় কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে’— এটার জন্য যেমন ভালো লাগে, ‘কে অপেক্ষা করে?’— সে প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যও উতলা বোধ করে সে। ক্লাস সেভেনের ছাত্রী, বয়স তের চৌদ্দ, কোনো মতেই বৈষয়িক চিন্তা-ভাবনার বয়স সেটা না। মনভর্তি আবেগই থাকার কথা ছিল। কিন্তু তফিজ উদ্দিন মৃধার মেয়ে হিসেবে এইসব হিসাব বংশগতি থেকে পেয়ে থাকাটা অসম্ভব কিছু না। এ কথা তো ঠিক— মানুষ আধেক তার বংশগতির আর আধেক পরিবেশের। ফলে বৈষয়িক চিন্তাও সে মনে মনে কষে ফেলে। তারপরও কালো সে যতোই ভালো হোক, গায়ের কালোকে আমরা নেগেটিভ ভাবেই দেখে আসছি শতাব্দীর পর শতাব্দী। কলোনিয়াল মনোভাব আমাদের। তবে সম্পদশালী হলে সেই কালোকে গলার মালা করতেও দ্বিধা নেই। কিন্তু মনে মনে ফর্সাকেই তো আমরা সুন্দর মানি।

খুব বেশি দিন সাবিকুন্নাহার পলিকে ‘কালোডা না লালডা’ দ্বন্দ্বে থাকতে হয়নি। এসএসসির রেজাল্ট হওয়ার পর জিপিএ ফাইভ পেয়ে ইমরানুল হক শহরের কলেজে ভর্তি হয়ে চলে যায়। আর জিপিএ টু পয়েন্ট ফাইভ পেয়ে রুহুল আমিন কোথাও ভর্তি না হয়ে কালোদীঘির পাড়ে শিমুল তলায় দাঁড়িয়ে থাকে। সাবিকুন্নাহার পলি যখন বুঝতে পারে কালোটা নয় লালটাই তার জন্য প্রেম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার প্রথম খুব আনন্দ হয়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের অবস্থান নিয়ে কিছুটা হতাশা অনুভব করে— তবে কি ইমরানুল হকের মতো ভালো ছাত্র তাকে পছন্দ করতে পারে না! সে কি ততোটা সুন্দরী নয়! কেন ইমরানুল হক ও রুহুল আমিন দু’জনই তাকে ভালোবাসে না! এই হতাশা বুকে তুলে লাল ফিতার ফুল তোলা দীর্ঘ চুলের বেনি দুটি ঝুলিয়ে নিয়ে সাবিকুন্নাহার পলি প্রতিদিন ইশকুলে যেতে আসতে থাকে। আর রুহুল আমিন শিমুলতলার পাশে নতুন গড়ে ওঠা ‘আল ফরিদুন মৎস্য খামার’-এ হিসাব রক্ষক হিসাবে চাকরি করতে করতে সাবিকুন্নাহার পলির স্কুলের যাওয়া আসা দেখতে থাকে।

ইন্দ্রিয় দিয়েই সবকিছু অনুভূত হয়। আর অনুভবেই তৈরি হয় স্মৃতি। অনুভূতি জমে জমে অভ্যাস। যাকে কখনও দেখা হয়নি, ছোঁয়া যায়নি, যার কখনও ঘ্রাণ পাওয়া যায়নি— তাকে কি কখনও ভালোবাসা যায়? ভালোবাসতে হলে ন্যূনতম যেকোনো একটি ইন্দ্রিয় দিয়ে সে মানুষটিকে অনুভবে আনতে হয়; সে হোক দর্শনে, শ্রবণে, স্পর্শে কিংবা ঘ্রাণে।

ইন্দ্রিয় দিয়েই সবকিছু অনুভূত হয়। আর অনুভবেই তৈরি হয় স্মৃতি। অনুভূতি জমে জমে অভ্যাস। যাকে কখনও দেখা হয়নি, ছোঁয়া যায়নি, যার কখনও ঘ্রাণ পাওয়া যায়নি— তাকে কি কখনও ভালোবাসা যায়? ভালোবাসতে হলে ন্যূনতম যেকোনো একটি ইন্দ্রিয় দিয়ে সে মানুষটিকে অনুভবে আনতে হয়; সে হোক দর্শনে, শ্রবণে, স্পর্শে কিংবা ঘ্রাণে। ইমরানুল হক দৃশ্য থেকে সরে যাওয়ায়, ক্রমেই সে সাবিকুন্নাহার পলির কাছে গৌণ হয়ে ওঠে, আর রুহুল আমিন দৃশ্যের ভেতর থেকে হয়ে ওঠে মুখ্য। এবং ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাবিকুন্নাহার পলির ইশকুলে যাওয়া আসার পথে এমন কোনো দিন নেই যে রুহুল আমিন শিমুল গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে থাকেনি। ঝড়, বৃষ্টি কিংবা প্রখর রৌদ্রের দিনেও রুহুল আমিন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকেছে। কেবল চোখাচোখি ব্যতীত সেই তিনটি বছর তাদের সরাসরি কথাও হয়নি কখনও। স্কুলের শেষ দিন র‌্যাগ ডে থেকে ফেরার পথে সাবিকুন্নাহার পলি বংশগতি থেকে পাওয়া সকল হিসেব নিকেশ মুছে দিয়ে পৃথিবীর এক নতুন হিসেব শুরু করে। শিমুলতলায় অসহায়ের মতো বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা রুহুল আমিনকে সে অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরে এবং কান্না কম্পিত ঠোঁট নিয়ে চুমু খায়।

 


পুলিশ ভ্যারিফিকেশন শেষে গঞ্জ থেকে ফিরে রুহুল আমিন এক বিরাট মুসিবতে পড়ে যায়। রুহুল আমিন ও সাবিকুন্নাহার পলির বিষয়টি গ্রামবাসীর কারও অজানা নয়। কিন্তু এই সাড়ে পাঁচ বছরে সে অধ্যায় গ্রামের মানুষজন ভুলতে বসেছিল। ঠিক ভুলে না গেলেও, তরঙ্গ মুছে স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল গ্রামের মানুষের এই বিষয়ে চিন্তার গোলপুকুর। কিন্তু সেই পুকুরে জাতীয় পরিচয়পত্রে স্ত্রী হিসেবে সাবিকুন্নাহার পলির নামের বিষয়টি আরও বড়ো এক ঢিল হয়ে যেন পড়ে। ফলত আবারও ঢেউ ওঠে। মানুষজন বাঁকা চোখে তাকায়। ফিসফিস ওঠে—তাইলে কি সত্যি সত্যি রুহুল আমিন আর সাবিকুন্নাহার পলি নিজেরা নিজেরা বিয়ে করে ফেলেছিল! মানুষ সাধারণত এই রকম হয়, অপরের ব্যাপারে খুব বেশি দূর তাকাতে পারে না। তারা ভুলে যায় জাতীয় পরিচয়পত্র যখন তৈরি হয়েছিল, তখন সাবিকুন্নাহার পলি মাত্র সেভেনে পড়ে, আর রুহুল আমিন আদতে ষোলতে। ওই বয়সে তাদের পক্ষে নিজেরা নিজেরা বিয়ে করে ফেলে জাতীয় পরিচয়পত্রে স্ত্রীর নাম তুলে দেওয়াটা ছিল অসম্ভব। মানুষ সেইসব ভাবে না। বরং কল্পনার রং লাগিয়ে বিষয়টিকে আরও রঙিন করে তুলতে চায়। অথচ, সাবিকুন্নাহার পলির বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রাম আলতাপুরে। তার একটা বাচ্চাও আছে। এখন আবার সেই পুরনো আগুনের কেন ধুঁয়া ওঠানো! বাতাস কি সেই ধুঁয়া সবিকুন্নাহার পলির শ্বশুড়বাড়ির গ্রামে নিয়ে যাবে না? নিশ্চয়ই স্বামীর সংসারে সাবিকুন্নাহার পলি একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে— এই চিন্তা ও ভয়ে রুহুল আমিন কুঁকড়ে যায়। তার কিছুই ভালো লাগে না।

জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য নেওয়া বাতেন স্যার ইহলোক ত্যাগ করেছেন বছর তিনেক হবে। ইমরানুল হক আছে মালয়েশিয়ায়। বছর ছয় আগে চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ায় যায় সে। সেখানেই বিয়েশাদি করে ঘর-সংসার করেছে। ইমরানুল হকের সাথে এখন আর যোগাযোগ নাই রুহুল আমিনের। ফলত জাতীয় পরিচয়পত্রে কীভাবে রুহুল আমিনের স্ত্রীর নামের জায়গায় সাবিকুন্নাহার পলির নাম যুক্ত হয়ে গিয়েছে সেটা ঠিক জানা যাচ্ছে না। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে নানারকম ভুল তো নতুন কিছু নয়। যেমন মইনুদ্দিনের বাবার নাম এসেছে ভুল। শহীদুলের রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ, এসেছে ও পজেটিভ। ওপাড়ার রেহানা আক্তারের নামের আক্তার ফেলে কোথা থেকে ‘বিশ্বাস’ জুড়ে দিয়ে বানিয়েছে রেহানা বিশ্বাস। মো. মমিনুল শেখের জীবিত বাবার নামের আগে বসেছে ‘মৃত’। জাতীয় পরিচয়পত্রের এইরূপ ভুল নিয়েই হাজার হাজার মানুষ জীবন কাটিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে। হয়তো রুহুল আমিনের পরিচয়পত্রের এই ভুলটিও কোনো বড়ো বিষয় হতো না, যদি স্ত্রীর নামটি ‘সাবিকুন্নাহার পলি’ না হতো। এই নামটি একই সাথে ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়েছে’, ঘেঁটে দিয়েছে পুরনো কাসুন্দি।

 


পরদিন সাবিকুন্নাহার পলির বাবা তফিজ উদ্দিন মৃধা খবর দিয়ে রুহুল আমিনকে ডেকে নিয়ে কানাঘুষার বিস্তারিত জানতে চায়, সাড়ে পাঁচ বছর পর আবার কেন রুহুল আমিনের সাথে তার মেয়ের নাম জড়িয়ে কথা ওঠে? সমস্যাটা কী?

রুহুল আমিন বিস্তারিত বলে। বলে যে, এইটা একটা মিসটেক। এবং কোনোভাবে কোনোভাবে হয়তো এই মিসটেকটা হয়ে থাকতে পারে। অতিশীঘ্রই এই মিসটেক সংশোধন করে সে তার পাসপোর্ট ওকে করে ফেলবে। তারপর ফু করে চলে যাবে কাতার। পৃথিবীতে সাবিকুন্নাহার পলির জন্য সে আর ঝামেলা হয়ে দাঁড়াবে না।

রুহুল আমিন বিস্তারিত বলে। বলে যে, এইটা একটা মিসটেক। এবং কোনোভাবে কোনোভাবে হয়তো এই মিসটেকটা হয়ে থাকতে পারে। অতিশীঘ্রই এই মিসটেক সংশোধন করে সে তার পাসপোর্ট ওকে করে ফেলবে। তারপর ফু করে চলে যাবে কাতার। পৃথিবীতে সাবিকুন্নাহার পলির জন্য সে আর ঝামেলা হয়ে দাঁড়াবে না। এই সব শুনে তফিজ উদ্দিন মৃধা বলে যে, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সমস্যা সমাধান করে রহুল আমিন যেন তার মেয়ের জীবন থেকে চিরবিদায় নেয়। তার মেয়ের এখন সুখের সংসার। এইসব পঁচা জলের ছিটা যেন কোনোভাবেই সেই সংসারে না লাগে।

কে জানে কেন, এই প্রথম রুহুল আমিন নিজেকে খুব অপমানিত মনে করে। আর সে খুব সাহসী হয়ে ওঠে। তফিজ উদ্দিন মৃধার চোখে চোখ রেখে সে বলে, ‘কোনো টেনশন কইরেন না, চাচাজি। আমি দেখতাছি বিষয়টা।’ জবাবে তফিজ উদ্দিন মৃধা তাচ্ছিল্যের ‘হুহ!’ বলে বটে, কিন্তু সে জানে রুহুল আমিন কোনোভাবেই সাবিকুন্নাহার পলির কোনো রকম ক্ষতির কারণ হবে না। তবে কথা থাকে, রটনা বড়ো বাজে জিনিস। ঘটনা না ঘটলেও রটনার কারণে ঘটনার একটা আকার সমাজে দাঁড়িয়ে যায়। মানুষদের অনেকেই রটনা বিশ্বাস না করলেও রটনার আশেপাশে একটা ঘটনা ঠিকই ভেবে নেয়। তারা বলে যে, যাহা রটে তাহা কিছু হলেও ঘটে। তবে এই রটনার ঘটনার সময় কিছু ঘটে নাই। অনেক পরে কিছু একটা তো ঘটেছিলই। কিন্তু যতোটা রটেছিল ততোটা কোনোদিন ঘটেনি।

রুহুল আমিন ভীষণ দুঃচিন্তার ভেতরও এই ভেবে সুখী হয়েছিল যে, কপালে লিখা না থাকলেও, ভুল করে হলেও সাবিকুন্নাহার পলির নামটি তার স্ত্রী হিসেবে কোথাও লেখা হয়েছে।

যা হোক, রুহুল আমিন ভীষণ দুঃচিন্তার ভেতরও এই ভেবে সুখী হয়েছিল যে, কপালে লিখা না থাকলেও, ভুল করে হলেও সাবিকুন্নাহার পলির নামটি তার স্ত্রী হিসেবে কোথাও লেখা হয়েছে। সে বিশ্বাস করতে চায়, হয়তো ইমরানুল হকই দুষ্টুমি করে তার বাবা বাতেন স্যারের কাগজপত্র থেকে রুহুল আমিনের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ফরমে সাবিকুন্নাহার পলির নামটি যুক্ত করে দিয়ে থাকতে পারে। পরে জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি তোলার দিন প্রচণ্ড গরম এবং জেনারেটরের সমস্যার কারণে ভজঘট লেগে যাওয়ায় কেউই বিষয়টি আর খেয়াল করেনি। আজ দশ-এগারো বছর পর সে বিষয়টি এমন জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ের ভেতর কতকিছু পাল্টে গেছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ এমনকি সম্পর্কও বদলে গেছে। কোথাকার মানুষ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! কত মানুষ কাছে এসেছে, কত মানুষ চলে গিয়েছে দূরে! হাওয়া পাল্টেছে, গ্রাম পাল্টেছে, পাল্টেছে বাজার ও ঘর। শুধু পাল্টায়নি রুহুল আমিন। এক সরল রৈখিক জীবন সে বয়ে নিয়ে এসেছে বিগত দশ-এগারোটি বছর। তার জীবনে যোগ-বিয়োগ যেন সমান সমান। ফলে এই ভুলটুকুকে হঠাৎ তার প্রাপ্তি হিসেবে দেখতে ভালো লাগতে থাকে। সে ভেবেছিল, থাক না নামটা জাতীয় পরিচয়পত্রে স্ত্রী হিসেবে। আরও পাঁচ হাজার টাকা পুলিশ সাহেবকে দিয়ে দিলে পাসপোর্ট তো হয়েই যাবে। কিন্তু তফিজ উদ্দিন মৃধার সাথে কথা বলার পর সে ভাবে জীবন থেকে তো আগেই মুছে দিয়েছে, যেভাবেই হউক এখন তার জাতীয় পরিচয়পত্র থেকেও সাবিকুন্নাহার পলির নাম মুছে ফেলতে হবে।

 


পৃথিবী এতো সহজ নয়। বিশেষ করে আপনি যদি সাধারণ মানুষ হয়ে এই দেশে জন্মগ্রহণ করেন তবে পৃথিবী আপনার জন্য জটিলতম এক গ্রহ— জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে গিয়ে এই সত্য রুহুল আমিন অনুভব করতে পারল কি না জানা যায়নি। তবে প্রথমবারের মতো সে বুঝতে পারে, সে আসলে কেউ না। সরকারি অফিসের কেউই তাকে পাত্তাই দেয়নি। অফিসে মানুষের ভিড় লেগে আছে। পাসপোর্টের জন্য লম্বা লাইন অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। সে সময়টাতে সোলায়মান মণ্ডল সব কাগজপত্র ঠিক-ঠাক করে দিয়েছিল, কী করতে হবে না-হবে সব বলে দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র ঠিক করতে এসে সে এক জটিল ধাঁধার ভেতর যেন ঢুকে যায়। অফিসের সবাই নিজেদের নিয়ে এতো ব্যস্ত যে কাউকেই সে তার সমস্যার কথা বলার সুযোগ পায় না। অফিসের পিয়ন হবে হয়তো একজন তাকে ঠেলে বাইরে বের করে দিয়ে দাঁড়াতে বলে। সে বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। ভেতরে ঢুকে সমস্যাটার কথা কাউকে বলতে পারল না। যেহেতু বিষয়টা গোপন, এবং গ্রামের লোকজন বিষয়টা নিয়ে কানাঘুষারত, সে চায়নি কাউকে বিষয়টা জানাতে। ভেবেছিল চুপচাপ জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করে সে ফিরে যাবে। মানুষের তো ভুল হতেই পারে। নিশ্চয়ই সব ভুল সংশোধনের উপায়ও আছে। কিন্তু কয়েকজনের সাথে কথা বলে অচিরেই রুহুল আমিন বুঝতে পারে এখানে ইচ্ছে করে ভুল করা হয়। কারণ যত ভুল, তত বিশৃঙ্খলা। যত বিশৃঙ্খলা আর ততই মজা। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে যখন গাছ হয়ে যাচ্ছিল রুহুল আমিন, তখন ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া পিয়ন ফিরে আসে। এসে জানতে চায়, কী চায় সে? রুহুল আমিন বিস্তারিত বলে। কিন্তু মোবাইল ফোন টেপাটেপিতে ব্যস্ত পিয়ন সাহেব বিষয়টা শোনে কি না বোঝা যায় না। কথার মাঝেই কাউকে ফোন দিয়ে ঝাড়ি দেয়। ফোনে ঝাড়ি দেওয়া শেষ করে, রুহুল আমিনের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়। বলে, বুঝছি, তথ্য সংশোধন। যান মোড়ের ‘আল্পনা কম্পিটার্রস’-এ গিয়ে মফিজুলকে আমার কথা বলবেন, বলবেন— মতিন সাহেব আমাকে পাঠিয়েছে। সে-ই সব ব্যবস্থা করে দেবে।

আল্পনা কম্পিউটার্সে মফিজুলকে বিস্তারিত খুলে বলে রুহুল আমিন। মফিজুল খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনেছে বলে মনে হলো। সব শুনে মফিজুল বলে,‌‘এটা কোনো সমস্যাই না। পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। আর আপনি খালি ডিভোর্স পেপারটা নিয়ে আইসেন।’

আল্পনা কম্পিউটার্সে মফিজুলকে বিস্তারিত খুলে বলে রুহুল আমিন। মফিজুল খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনেছে বলে মনে হলো। সব শুনে মফিজুল বলে,‌‘এটা কোনো সমস্যাই না। পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। আর আপনি খালি ডিভোর্স পেপারটা নিয়ে আইসেন।’

রুহুল আমিন অবাক হয়— ডিভোর্স পেপার পাব কোথায়?

মফিজুল বলে, ও! মারা গেছে! তাইলে ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে।

রুহুল আমিন পুনরায় মফিজুলকে তার সমস্যার কথা বিস্তারিত বলে। এবার মফিজুল বলে সাত হাজার টাকা লাগবে। আর আপনার ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের একটি লিখিত কাগজ লাগবে যে আপনি অবিবাহিত।

রুহুল আমিন ফিরে আসে গ্রামে। কিন্তু চেয়ারম্যান গ্রামে থাকে না। চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ কাজে শহরে থাকে। কবে আসবে তার ঠিক-ঠিকানা নাই। তারপরও রুহুল আমিন চেয়ারম্যানের ফিরে আসার জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করে। এছাড়া আর তার কীইবা করার থাকে!

 


রুহুল আমিন চুপচাপ থাকলেও গ্রামের মানুষ চুপ থাকে না। ফিসফাস চলতেই থাকে। তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে— তবে কি সত্যি সত্যি সাবিকুন্নাহার পলি ও রুহুল আমিন নিজেরা নিজেরা বিয়ে করে ফেলছিল! কিন্তু যে দ্বিধাটা তাদের ভেতর উঁকি দেয়, সেটা হচ্ছে— বিয়ে যদি হয়েই থাকে, তবে রুহুল আমিনকে তালাক না দিয়ে সাবিকুন্নাহার পলির পুনরায় কীভাবে আলতাপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেন মজনুর সাথে বিয়ে হয়? নাকি তালাক হয়েছিল? মানুষ যেরকম হয়— অপরের ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে দুনির্বার আগ্রহ নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। তবে এইসব প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য সাবিকুন্নাহার পলির দায় অস্বীকার করা যায় না।

সেই যে সে বছর— এসএসসি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হয় সাবিকুন্নাহার পলি। এবং কৈশোর পেরুনোর পর ষোল-সতের বছর বয়সে অতি লাবণ্যময়ী হয়ে ওঠে সে। সেই সাথে তার উচ্ছ্বল চোখ, দূরন্ত মতি, চলনে অশান্ত ঢেউ সবার মনেই ঝড় তোলে। আর এই বয়সটাই এতো সুন্দর যে— পৃথিবীর সুন্দরতম ফুল মনে হয় তাকে। গ্রামের ইশকুলে পড়ার সময় তার সৌন্দর্যে মোহিত দুয়েকজন থাকলেও সকলেই তার পরিচিত, এবং তারা যেহেতু জানে সে তফিজ উদ্দিন মৃধার মেয়ে, কারো প্রেম নিবেদন করার সাহস হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সাবিকুন্নাহার পলি ক্ষুদ্র গণ্ডি ছেড়ে আরও বড়ো পরিসরে এসে উপস্থিত হয়, তখন পৃথিবীর অনেক ভ্রমর গুঞ্জন তোলে। ক্লাস সেভেনে থাকতে নিজেকে নিয়ে যে সংশয়, যে হিসেব ছিল— সেই হিসেবের সাবিকুন্নাহার পলি থাকলে নিজেকে নিয়ে দারুণ ধন্দে পড়তে হতো। এতো এতো অপশন থেকে বেছে নেওয়ার ভীষণ দ্বন্দ্বে নিজের সাথে নিজেকেই জড়াতে হতো হয়তো। কিন্তু ইশকুলের শেষ দিন র‌্যাগ ডে শেষে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরার পথে রুহুল আমিনকে জড়িয়ে চুমু খাওয়ার ভেতর দিয়ে নিজের চিত্তকে সে স্থির করে নিয়েছিল। ফলত পৃথিবীর প্রেমময় নাবিকেরা আর তরী ভেড়াতে পারেনি সাবিকুন্নাহার পলির প্রেম দরিয়ার ঘাটে। যেহেতু ইশকুলের পাঠ চুকিয়ে সে কলেজে উঠে যায়। রুহুল আমিনও কালোদীঘি পাড়ের শিমুলতলা ছেড়ে এসে দাঁড়ায় আব্বাসীয়া মাদ্রাসার কদম তলায়। সাবিকুন্নাহার পলি রিকশাযোগে কলেজ যাওয়ার পথে রুহুল আমিনের সাথে চোখাচোখি হতো। আর তখন মুচকি হাসত সাবিকুন্নাহার পলি। তার হাসি ছড়িয়ে যেত রুহুল আমিনের মনে, হাসির প্রত্যুত্তরে হাসি। আর সারাদিন সেই হাসির ঘোরের ভেতর বেঁচে থাকতে থাকত তারা। এইভাবে চলে যাচ্ছিল সময়, দিন, রাত, মাস। কলেজে ভর্তি হয়ে একটা মোবাইল ফোন কেনার পারমিশন পায় সাবিকুন্নাহার পলি। তখন মোবাইল ফোন হয়ে ওঠে তাদের প্রেমের দূত— বনমালী। না রাত জেগে জেগে প্রেমমালাগাঁথা নয়; কখনও-সখনও সাবিকুন্নাহার পলি হয়তো গোপনে চুপিসারে ফোন দিয়ে বলল, ‘হ্যালো! কী করতেছেন?’ রুহুল আমিন তখন হয়তো বলে, ‘এই তো ঘুমাতে যাব।’ সাবিকুন্নাহার পলি এই শুনে হয়তো বলে, ‘আচ্ছা! ঘুমান।’ এইটুকুই। এতেই দুজনের হৃদয় ভরে উঠতো সুখে। কেউ কেউ অল্পতেই তৃপ্ত। প্রকৃত প্রেম তো এমনই— প্রেমের মানুষকে একটি বার দেখতে পেলে কিংবা কণ্ঠস্বরটা একটু শুনতে পেলেই হাজার বছর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।

ইশকুল-কলেজের ছাত্রী হিসেবে সাবিকুন্নাহার পলি ছিল অমনোযোগী। কলেজের প্রথম বছরের পরীক্ষায় তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হলে তার বাবাকে একবার কলেজে যেতে হয়। খুব অপমানিত বোধ করে তফিজ উদ্দিন মৃধা। বাড়ি ফিরে সিদ্ধান্ত নেয় গাধা মেয়েকে পড়িয়ে আর লাভ নেই। বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়।

ইশকুল-কলেজের ছাত্রী হিসেবে সাবিকুন্নাহার পলি ছিল অমনোযোগী। কলেজের প্রথম বছরের পরীক্ষায় তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হলে তার বাবাকে একবার কলেজে যেতে হয়। খুব অপমানিত বোধ করে তফিজ উদ্দিন মৃধা। বাড়ি ফিরে সিদ্ধান্ত নেয় গাধা মেয়েকে পড়িয়ে আর লাভ নেই। বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়। আর ঠিক সে সময়ই কে জানে কেন বারো বছর দুবাই থেকে ফিরে আসতে হয় আলতাপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেন মজনুকে। দুবাই ফেরত মনোয়ার হোসেন মজনু শাদা ধবধবে জামা কাপড় পরে একটা বড়োসর মোটর সাইকেলে রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে গঞ্জে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে থাকে। হাতে ও গলায় স্বর্ণের অলংকার। স্বর্ণখচিত দামি মোবাইল ফোন। বাড়িতে দুতলা দালান। গঞ্জে বিশাল দোকান নিয়েছে। বারো বছর বেশ ভালো অর্থকড়ি কামিয়েছে। এখন বিয়েশাদি করে গ্রামেই থেকে যাবে। এমনটি শোনা যায়। এবং একদিন পথে সাবিকুন্নাহার পলিকে দেখে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় মোনায়ার হোসেন মজনু তফিজ উদ্দিন মৃধার কাছে বিয়ের ঘটক পাঠিয়ে দেয়। তফিজ উদ্দিন মৃধা হিসেব নিকাশ করে দেখে বিষয়টা মন্দ না। একমাত্র মেয়ে পাশের গ্রামেই থাকবে— চাইলেই দেখতে যাওয়া যাবে। তার চেয় বড়ো ব্যাপার মনোয়ার হোসেন মজনুর জমিজিরাত অনেক। আছে টাকা পয়সাও। স্ট্যাটাসে তমিজ উদ্দিন মৃধার সাথে যায়। এবং সাবিকুন্নাহার পলিকে ডেকে বলে দেয় যে, আগামী মাসের তেরো তারিখ তার বিয়ে। পাত্র আলতাপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেন মজনু। সাবিকুন্নাহার পলি হচ্ছে সাবিকুন্নাহার পলি। সেও তার বাবার মুখের সামনেই বলে দেয়— এটা অসম্ভব। কোনো মজনু টজনুকে সে বিয়ে করবে না। বিয়ে যদি হয় তবে রুহুল আমিনের সাথেই হবে।

পৃথিবীতে এ এক আশ্চর্য বিষয়, মানুষ সাধারণত অসম্ভবের প্রেমেই পড়ে, এবং প্রেম দিয়েই সে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন সে নিজের সেই প্রেমের কথা ভুলে যায়। নিজের ছেলে মেয়েদের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এবং বলে যে, অসম্ভব! ওই ছোটোলোকের সাথে তোকে বিয়ে দেওয়ার চেয়ে কেটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেব। যদিও হয়তো সমুদ্র বহুদূর, গ্রামের পাশে কোনো নদীও নেই। কিন্তু বাংলা সিনেমাতে এইরূপ দেখা যায়। জীবনেও এইসব থাকে। তফিজ উদ্দিন মৃধাও এইরূপ বলে। এবং রুহুল আমিনকে ডেকে পাঠায়।

বিব্রত রুহুল আমিন এসে দাঁড়ায়। সে মূলত ভীতু। ভীতু প্রেমিকের চেয়ে পৃথিবীতে নিকৃষ্টতম কিছু নেই। তফিজ উদ্দিন মৃধা প্রশ্ন করে, ‘মনোয়ার হোসেন মজনু যে লেভেলের তুমি কি সেই লেভেলে পড় মিয়া? তোমার সাহস দেখে অবাক হইলাম!’ আরও নানাবিধ বিষয় তুলে সে কথা বলে। এইসব শুনে নিজেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত বিব্রত রুহুল আমিন ভাবে, যেহেতু সে সাবিকুন্নাহার পলিকে ভালোবাসে, তার সুখই নিজের সুখ। এবং মনোয়ার হোসেন মজনু উচ্চ লেভেলের হেতু সাবিকুন্নাহার পলি উচ্চ লেভেলেই থাকুক।

রুহুল আমিন তফিজ উদ্দিন মৃধার নিদারুণ দাম্ভিক মূর্তির সামনে ম্লানতর হয়ে যায়। সে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। মাথা নীচু করেই কথা দেয় সাবিকুন্নাহার পলির জীবনে সে কোনোদিন ছায়া হয়েও থাকবে না।

রুহুল আমিনের এই সাহসহীনতার কথা শুনে সাবিকুন্নাহার পলি আহত হয়। তারপরও সে তাকে মেসেজে এই লিখে বোঝাতে চায় যে প্রেমই নির্ধারণ করে মানুষের লেভেল। যেহেতু রুহুল আমিনকে সে ভালোবাসে, তাহার লেভেলের ধারে কাছে কেউ নেই। এবং সে এ-ও বিশ্বাস করে ভালোবাসার মানুষের সাথে একদিনও যদি বেঁচে থাকা যায়— সেটাই জীবনের সার্থকতা। কিন্তু রুহুল আমিন অবধি সেই মেসেজ আর পৌঁছায় না। কেননা রুহুল আমিন সেদিন তফিজ উদ্দিন মৃধার বাড়ি থেকে বের হয়ে উধাও হয়ে যায়। তাকে ফোনেও আর পাওয়া যায় না।

 


চেয়ারম্যানের অপেক্ষায় থেকে থেকে রুহুল আমিনের জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করার বিষয়টি পিছিয়ে যেতে থাকে। যেহেতু সাত হাজার টাকা দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করা হচ্ছে, সেহেতু পুলিশ সাহেবকে কেন আর অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া— এই ভেবে আর পুলিশ সাহেবকে কোনো টাকা পয়সা দেওয়া হয়নি। ওদিকে লিয়াকত তার পাসপোর্ট হাতে পেয়ে গেছে। আটকে আছে রুহুল আমিনেরটা। রুহুল আমিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারে চেয়ারম্যান গিয়েছেন ভারতের চেন্নাইতে, কী এক অসুখের চিকিৎসা করাতে। ফিরতে ফিরতে তিন-চার মাস লেগে যেতে পারে। রুহুল আমিন আল্পনা কম্পিউটার্সের মফিজুলকে ফোন দিয়ে বলে, চেয়ারম্যান নাই। ফলে তার অবিবাহিতের সার্টিফিকেট পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তখন মফিজুল বলে যে, ‘তাইলে এক কাজ করেন, আপনি দেখেন একটা ডিভোর্স পেপার নিয়া আসতে পারেন কিনা।’ রুহুল আমিন বলে যে, যাকে সে বিয়েই করেনি। তাকে সে ডিভোর্স দেবে কী করে? মফিজুল জানায়, এইটা কোনো ব্যাপারই না। ডিভোর্স দেওয়া ওয়ান-টুর মামলা। যেকোনো কাজী অফিসে গিয়ে বললেই হবে।

সব শুনে কাজী সাহেব বলেন, ‘জটিল বিষয়। এইটা তো অসম্ভব ব্যাপার। যাকে বিয়ে করেন নাই, তাকে ডিভোর্স দেবেন কীভাবে?’ রুহুল আমিন বলে, সমস্যাটা তো নামটাতেই।

অগত্যা রুহুল আমিন কাজী অফিসে গিয়ে কাজীকে বলে যে, তার আসলে একজনকে ডিভোর্স দেওয়া দরকার। কাজী সাহেব বললেন, চাইলেই যাকে ইচ্ছে তাকে ডিভোর্স দেওয়া যায় না। রাষ্ট্রে আইন আছে, কানুন আছে, আছে নিয়মের বেড়াজাল। সবকিছুর একটা সিস্টেম আছে। কেবল রেজিষ্ট্রিকৃত স্ত্রীকেই ডিভোর্স দিয়ে রুহুল আমিন ডিভোর্স পেপার প্রত্যাশা করতে পারে। রুহুল আমিন কাজী সাহেবকে তার সমস্ত বিষয়াদি খুলে বলে। সব শুনে কাজী সাহেব বলেন, ‘জটিল বিষয়। এইটা তো অসম্ভব ব্যাপার। যাকে বিয়ে করেন নাই, তাকে ডিভোর্স দেবেন কীভাবে?’ রুহুল আমিন বলে, সমস্যাটা তো নামটাতেই। কোনোভাবে সাবিকুন্নাহার পলির নামে একটা ডিভোর্স পেপার তৈরি করে দিয়ে দেওয়া যায় কি না? কাজী সাহেব অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বললেন, সম্ভব। তবে বিষয়টা অনৈতিক। এবং খরচ লাগবে। আর লাগবে সাবিকুন্নাহার পলির জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।

এই প্রক্রিয়া রুহুল আমিনের আরও জটিল বলে মনে হয়। সাবিকুন্নাহার পলির জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া কঠিন বিষয়। আর তার জাতীয় পরিচয়পত্রে নিশ্চয়ই স্বামীর নাম উল্লেখ রয়েছে। সবমিলিয়ে রুহুল আমিনের দমবন্ধ লাগে। ওই দিকে পাসপোর্ট হাতে না পাওয়ায় কাতারের ভিসা পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে যেতে থাকে।

রুহুল আমিন ভাবে যেভাবেই হউক কাতার তাকে যেতেই হবে। সেখানে গিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে অনেক টাকা বানিয়ে ফেলবে সে। তারপর মনোয়ার হোসেন মজনুর লেভেলে পৌঁছে যাবে। সাড়ে পাঁচটি বছর ধরে সে এই অপেক্ষাতেই ছিল। সারাটি জীবন সে সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি। প্রথমে হারিয়েছে সাবিকুন্নাহার পলিকে। তারপর ইশকুলের দফতরির সরকারি চাকরি। এখন শেষ সুযোগ কাতার যাওয়া— এটাও হারাতে বসেছে। সে পুলিশ সাহেবের কাছে যায়, পাঁচ হাজার টাকা দিতে সে প্রস্তুত। কিন্তু পুলিশ সাহেব বলেন, দেরি হয়ে গেছে। জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করে পুনরায় পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার পরামর্শ দেন তিনি।

রুহুল আমিন খুব অসহায় বোধ করে। সাড়ে পাঁচ বছর আগের ঘটনার বিপর্যস্ততা সে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। উপরন্তু এইসব ঝামেলার চাপে সে বিপন্ন বোধ করে। তার কেবল ভেঙে পড়তে ইচ্ছে করে। কেবল নাই হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

যদিও সাড়ে পাঁচ বছর আগে উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিতে তার তেমন দোষ ছিল না। রুহুল আমিনের ছিল চিন্তার ঘাটতি, সাহস ও বুদ্ধির অভাব। প্রেমের ক্ষেত্রে ভালোবাসতে পারা ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা লাগে না। তফিজ উদ্দিন মৃধা যখন তাকে অপমান করছিল, নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করছিল, তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিল, তখন সে কোনো জবাব দিতে পারেনি। অথচ তার মনে হয় পৃথিবীতে তার চেয়ে বেশি ভালো কেউ সাবিকুন্নাহার পলিকে বাসতে পারবে না। এই ভালোবাসতে পারার যোগ্যতাই তাকে উপরের লেভেলে নিয়ে আসতে যথেষ্ট। এই কথা সে সেদিন বলতে পারেনি। এই সাড়ে পাঁচ বছর ধরে বহুবার মনে মনে সে তফিজ উদ্দিন মৃধার প্রশ্ন উত্তর দিয়ে গেছে।

সেই দিন উধাও হওয়ার আগে সে সন্ধ্যায় রুহুল আমিন বিধ্বস্ত হয়ে বের হয়েছিল সাবিকুন্নাহার পলিদের বাড়ি থেকে। তার কানে যেন লাউড স্পিকারে বাজছিল তফিজ উদ্দিন মৃধার কথাগুলো। আর ঘোরের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় উপজেলা শহরে। গ্রাম থেকে সাত-আট কিলোমিটারে পথ। উপজেলা শহরে এক বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে তার মামাতো ভাই নাদের। সেইখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। নাদের বিস্কুট ফ্যাক্টরির কাজ শেষ করে রুহুল আমিনকে নিয়ে তার মেসে চলে যায়। সেই মেস থেকে কোনো এক ফাঁকে রুহুল আমিনের মোবাইল ফোনটি চুরি হয়ে গিয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। সাবিকুন্নাহার পলির মেসেজটা সে পায় না। সাতটা দিন নাদেরের মেসে দেবদাস হয়ে শুয়ে বসে থেকে ফিরে যখন বাড়ি ফিরেছিল, প্রথমেই তার বাবা গিয়াসুদ্দিন একটা কঞ্চি নিয়ে দৌড়ানি দেয়, ‘শুয়োর, আছিলি কই তুই এতোদিন! বাড়িতে একটা ফোন দিয়েও জানাস নাই! দেবদাস হইছোস!!’ তার মা ছুটে আসেন, বাবার হাত থেকে কঞ্চি কেড়ে নিয়ে রুহুল আমিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। সাতদিন অজ্ঞাত থাকার পর পরিবারের সাথে প্রাথমিক মিলন পর্ব শেষ না হতেই কারও কাছে সে জানতে পারে সাবিকুন্নাহার পলি নাকি তফিজ উদ্দিন মৃধাকে বলেছে রুহুল আমিনকে সে গোপনে বিয়ে করে ফেলেছে। এই শুনে তফিজ উদ্দিন মৃধা সাবিকুন্নাহার পলিকে প্রচণ্ড মার মেরে ঘরে বন্দি করে রেখেছে।

গোপনে বিয়ে করে ফেলার মিথ্যা বিষয়টা সত্যি সত্যি সাবিকুন্নাহার পলি নিজেই রটিয়ে দিয়েছিল। সে যখন কোনোভাবেই রুহুল আমিনের সন্ধান পাচ্ছিল না। তার ভয় হচ্ছিল জোর করেই বুঝি তার বাবা মনোয়ার হোসেন মজনুর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন বুদ্ধি করে এই রটনা রটায়। এতে কাজও হয়ে যাচ্ছিল। তফিজ উদ্দিন মৃধা মনে মনে ভেবেছিল বিয়ে যখন ওরা করেই ফেলেছে, কী আর করা! রুহুল আমিন ফিরে আসুক। ছেলেটা তো খারাপ না। বিনয়ী ও সৎ। কিন্তু পুনরায় সমস্যাটা বাঁধায় রুহুল আমিন নিজে। সাবিকুন্নাহার পলিকে মেরে বন্দি করে রেখেছে শুনে সে ছুটে যায় তফিজ উদ্দিন মৃধার কাছে। গিয়ে বলে যে, ‘মিথ্যা কথা, আপনি যা শুনছেন সব ভুল। আমরা বিয়ে করি নাই। আপনি সাবিকুন্নাহার পলিকে মারবেন না প্লিজ… আমি আর কোনোদিন তার মুখোমুখি হবো না। আমি চলে যাচ্ছি।’

সাবিকুন্নাহার পলিকে মেরে বন্দি করে রেখেছে শুনে সে ছুটে যায় তফিজ উদ্দিন মৃধার কাছে। গিয়ে বলে যে, ‘মিথ্যা কথা, আপনি যা শুনছেন সব ভুল। আমরা বিয়ে করি নাই। আপনি সাবিকুন্নাহার পলিকে মারবেন না প্লিজ… আমি আর কোনোদিন তার মুখোমুখি হবো না। আমি চলে যাচ্ছি।’

তফিজ উদ্দিন মৃধার হাসি পায়। সে হেসে দেয়। তারপর চোখমুখ শক্ত করে বলে, ‘যা এনতে ফকিন্নির পুত! নিজের লেভেল বুঝোস না!’

তার পরের শুক্রবারে আলতাপুর নিবাসী মনোয়ার হোসেন মজনুর সাথে সাবিকুন্নাহার পলির বিয়ে হয়ে যায়। সেই বিয়েতে সানাই বেজেছিল কি না রুহুল আমিন জানতে পারে না।

 


লিয়াকতের ভিসা লেগে গেছে। যার মাধ্যমে তারা কাতার যাচ্ছে, সে রুহল আমিনকে একমাস সময় দিয়েছে। এর মাঝে পাসপোর্ট না দিতে পারলে ভিসা আর হবে না। রুহুল আমিন ইতোমধ্যে গত দশ বছরে সঞ্চিত সব তুলে দিয়েছে কাতার যাওয়ার ভিসা পেতে। এখন যদি সে কাতারে যেতে না পারে তবে তার লেভেল আরও নিচে নেমে যাবে। সাবিকুন্নাহার পলির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর প্রায় দুই বছর সে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছিল। তারপর সে একদিন উচ্চ লেভেলে পৌঁছানোর কথা ভেবে ঘর থেকে বের হয়ে ‘আল ফরিদুন মৎস্য’ খামারে গিয়ে চাকরিটা ফেরত চায়। যেহেতু সে সততার সাথে চাকরিটা করেছিল ফরিদ সাহেব তাকে চাকরিটা ফেরত দিয়ে দেয়। কিন্তু খামারের তখন পড়ন্ত সময়। তারপরও কাজের ভেতর নিজেকে সঁপে দিয়ে নিজেকে জীবিত রাখতে চেয়েছিল রুহুল আমিন। গুঁড়িয়ে যাওয়া নিজেকে একটু একটু করে সে দাঁড় করিয়েছে। এখন তীরে এসে লেভেলে ওঠার তরী বুঝি ডুবে যায়!

কী ভেবে কে জানে রুহুল আমিন গিয়ে হাজির হয় আলতাপুরে সাবিকুন্নাহার পলির শ্বশুর বাড়িতে। মনোয়ার হোসেন মজনু তাকে বসতে দেয়। জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো রুহুল আমিন? রুহুল আমিন মাথা নাড়ায় যে সে ভালো আছে। মনোয়ার হোসেন মজনু মুচকি হাসে। তারপর কাউকে ডেকে বলে চা-নাস্তা দিতে। কেউ এসে একবাটি আঙুর আর এক প্লেটে গোল গোল বিস্কুট দিয়ে যায়। রাজ্যের ক্ষুধা যেন ভর করে রুহুল আমিনের পেটে। সে এক এক করে সবগুলো আঙুর আর বিস্কুট খেয়ে নেয়। মনোয়ার হোসেন মজনু রুহুল আমিনের কাছে এসে বসে। জানতে চায়, ‘কোনোদিন তো আমার বাড়িতে আসো নাই, রুহুল আমিন। আজ কী মনে করে?’ রুহুল আমিন বলে, সাবিকুন্নাহার পলির সাথে তার একটু কথা বলা দরকার। মনোয়ার হোসেন মজনু বলে, ‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে। বসো।’ তারপর উঠে যায়। সময় কতক্ষণ অতিবাহিত রুহুল আমিন বুঝতে পারে না। তার কাছে মনে হয় অনন্তকাল সে এখানে বসে আছে। কিংবা সে আদতে সৃষ্টির পর থেকে এখানেই আছে। এক সময় একপেড়ে খয়েরি রঙের একটা শাড়ি পরে এসে দাঁড়ায় সাবিকুন্নাহার পলি। সাড়ে পাঁচ বছর পর রুহুল আমিন তাকে দেখে। সে দেখে যে সাবিকুন্নাহার পলি। দাঁড়িয়ে থাকে। অভিব্যক্তিহীন। চোখে প্রেম নেই, ঘৃণা নেই, কিছু নেই।

 


সাবিকুন্নাহার পলির জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও অন্যান্য কাগজপত্র কাজী সাহেবকে দিয়ে সে ইউনিয়ন পরিষদের বিশাল রেইনট্রির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ ডিভোর্স হয়ে যাবে সাবিকুন্নাহার পলির সাথে রুহুল আমিনের। তারপর পাসপোর্ট, ভিসা এবং ফু করে কাতার। তারপর অনেক কাজ করতে হবে। লেভেলে উঠতে হবে। কাজী সাহেব ফিরে আসে। সাবিকুন্নাহার পলির জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিটি রুহুল আমিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই মহিলার আইডি তো মৃতদের তালিকায় চলে গেছে। মহিলা কি জীবিত নাই?

 

১০
রুহুল আমিন কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে কালোদীঘির পাড়ে শিমুলতলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষণ বৃষ্টিতে ভিজে যেতে থাকে পৃথিবী।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম বাংলাদেশে। প্রকাশিত গল্পের বই 'আনোহাবৃক্ষের জ্যামিতি'।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।