শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

চেতনাকে আরও বিস্তৃত করার জন্য আমার কল্পনাকে ব্যবহার করি : ওলগা তোকারচুক

0

নোবেল কমিটির সঙ্গে ওলগা তোকারচুকের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার এটি। সাহিত্যে ২০১৮ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষ্যে নোবেল কমিটির সঙ্গে ওলগা তোকারচুকের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারটি প্রথমে সরাসরি ধারণ করা হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে সুইডেনের স্টকহোমে। পরবর্তীতে ধারণকৃত সাক্ষাৎকারটি নোবেল কমিটি তাদের ওয়েবসাইটে ট্রান্সক্রিপ্ট হিসেবে প্রকাশ করে।

এ সাক্ষাৎকারে ওলগা তোকারচুক সাহিত্য ও লেখক হিসেবে তার চিন্তাভাবনার বিভিন্ন বিষয়, যেমন লেখালেখির পেছনে বাবা-মা ও অন্যদের প্রভাব, শৈশবে ভবিষ্যত পরিকল্পনা, মনোবিজ্ঞানী হিসেবে গল্প বলার পদ্ধতি ও অভিজ্ঞতার প্রভাব, লেখার সময় উপভোগের বিষয়, ভালো লেখক হওয়ার গুণাবলী, লেখালেখির মূল বিষয় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখকদের পরামর্শ, নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেছেন। সাক্ষাৎকারটি শ্রী-র পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন ফজল হাসান


olga tokarczuk

ওলগার তোকারচুকের নোবেল বক্তৃতার সময় | ছবি : সংগৃহিত


প্রশ্ন: আপনার বাবা-মা দু’জনেই শিক্ষক ছিলেন। তাদের পেশা আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?

ওলগা: সত্যিই খুব ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। আমাদের বাড়িভর্তি অনেক বই ছিল। আমি শুরু থেকেই দেখেছি যে, আমার বাবা-মা কীভাবে বই নিয়ে আলোচনা করেছেন, বই পড়েছেন এবং বই কিনেছেন। এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে, বাবার সঙ্গে আমি লাইব্রেরিতে প্রচুর সময় ব্যয় করেছি। তবে আমার খুব ভালো করে মনে আছে যে, আমাদের একটি বইয়ের শেলফ ছিল এবং আমার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বইগুলো সবসময় নিচের তাকে রাখা হতো। সুতরাং আমি সেই তাকগুলোতে খুব নিবিড়ভাবে চোখ বুলাতাম এবং আমার এখন মনে হয়, সত্যিই সেসময় আমি বিকল্প বিশ্ব হিসেবে বই আবিষ্কার করেছিলাম। শুরুর দিকে আমাদের অনেকগুলো রূপকথার গল্পের বই ছিল এবং আমি এখনো রূপকথার গল্প পড়তে খুবই পছন্দ করি। সম্প্রতি আমি ‘ব্রাদার্স গ্রিম’স্ ফেয়্যারই টেইলস’-এর একগুচ্ছ বই কিনেছি, যা আমি একধরনের কাব্যগ্রন্থ হিসেবে পড়ছি। কিন্তু পরবর্তীতে আমার মনে হয়েছে যে, জ্যুলে ভার্ন আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই পরবর্তীতে আমি এভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছি— যেমন সীমান্ত অতিক্রম করা, অন্যান্য দেশ ও বিভিন্ন সংস্কৃতির কথা চিন্তা করা এবং ভ্রমণ করা। সুতরাং আমার মধ্যে ভীষণ শক্তিশালী ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল।

 

প্রশ্ন: আপনি কি স্কুল উপভোগ করেছেন?

ওলগা: আমি আমার স্কুল পছন্দ করতাম। তবে আমার বন্ধুদের কারণে এবং একসঙ্গে সময় কাটানো কিংবা সামাজিক কারণে নয়। আমি শৈশবে এমন একধরনের ছিলাম, যে স্ব-শিক্ষাকে পছন্দ করত। তাই আমার অনেক শখ ছিল এবং অনেক আকর্ষণীয় বিষয়ের ওপর দূর্বলতা ছিল। উদাহরণ হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা বলা যায়। সুতরাং সত্যিই আমি নিজেকে আনন্দ দেওয়ার জন্য পড়াশোনা করতাম এবং অনেক সময় ব্যয় করেছি। আমার মাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষকের কথা খুব ভালো করে মনে আছে। তিনি জীববিজ্ঞানের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। তিনি আমাদের জীববিজ্ঞান পড়িয়েছেন। তিনি প্রতিটি জীবের শারীরিক অস্তিত্বের সুন্দর দিক বর্ণনা করে আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।

 

প্রশ্ন: আপনি যখন ছোটো ছিলেন, তখন কী হতে চেয়েছিলেন?

ওলগা: অবশ্যই খুব অল্প বয়সে আমি প্রতিটি মেয়ের মতো একজন অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে আমি সেই ইচ্ছে বাদ দিয়েছি। তার কারণ ছিল যে, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করলে দ্রুত উন্নতি করতে পারব। আমার আশা ছিল আমি একজন চিকিৎসক হবো, বিশেষ করে কসমিক চিকিৎসক। তাই আমি আমার ভবিষ্যৎ পেশা সম্পর্কে চিন্তা করেছিলাম। ওহ ঈশ্বর! আমি কীভাবে বলব যে, তা ছিল সত্যিকারের এক অভিযাত্রা এবং আমি নিজেকে কসমিক অভিযানের অংশ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সময় কীভাবে মানব দেহ কসমিক মহাকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা আমি পরীক্ষা করে দেখেছি এবং সে-টা ছিল খুবই চমকপ্রদ ধারণা। অবশ্যই আমি বিজ্ঞানের বিকাশের সময়কে অতিরঞ্জিত করেছি। এখন আমি বুঝতে পারি, আমার গ্রন্থগুলোর বিষয় একই। এ প্রশ্নের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

 

প্রশ্ন: একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আপনার প্রশিক্ষণ কীভাবে আপনার গল্প বলার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করেছে?

ওলগা: আমি মনে করি, মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা আমার জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। অবশ্যই আমি আমার মায়ের প্ররোচনার জন্য সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করতে প্রলুব্ধ হয়েছিলাম। উল্লেখ্য, তিনি শুরু থেকেই জানতেন যে, আমি লেখালেখি করতে চেয়েছি। কিন্তু মনোবিজ্ঞান আমাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখিয়েছে। আমি মনে করি, প্রত্যেকটি আলাদা মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় আছে, তা হলো একটি উপন্যাসের উৎস, এমনকি অনেক গল্পের উৎপত্তিস্থল। সুতরাং আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করছি, যেখানে সম্ভাব্য অবস্থায় কম-বেশি পাঁচ শ’ কোটি গল্প এবং উপন্যাস আমাদের চারপাশে বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়া মনোবিজ্ঞান বিষয় পছন্দ করার দ্বিতীয় কারণ ছিল, এটা একজন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে মানুষের কথা শুনতে হয়। অন্যের কথা শোনা এমন একধরনের ক্ষমতা, যা আপনি প্রশিক্ষণে ব্যবহার করতে পারেন এবং লোকেরা আপনাকে যা বলছে, তার জন্য আপনি আরও বেশি সহজ হতে পারেন।

 

প্রশ্ন: কোন অভিজ্ঞতা আপনার সাহিত্যকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে?

ওলগা: আমার জীবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিজ্ঞতা যা সত্যিই আমার কাজের সঙ্গে শক্তভাবে সম্পর্কিত, আমার মনে হয় আমি যে মুহূর্তে গ্রামে চলে যাই এবং তারপর… কারণ গ্রামে আমি আমার শিশুকাল কাটিয়েছি। পরবর্তীতে আমি বড়ো শহরে গিয়েছি এবং একধরনের বিশৃঙ্খল জীবন পেরিয়ে আমি আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে এসেছি। আমি আমার মধ্যে আলাদা মানসিক অবস্থা আবিষ্কার করেছি, যা আমার লেখার জন্য খুবই ভালো হয়েছে। এছাড়া গ্রাম আমাকে একাগ্রতা, নীরবতা ও অভ্যন্তরীণ নিঃসঙ্গতা দিয়েছে।

 

প্রশ্ন: লেখার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনি সবচেয়ে বেশি কী উপভোগ করেন?

ওলগা: আমি মনে করি, সবচেয়ে মজার এবং রহস্যময় জিনিস হলো চরিত্র নির্মাণ করা। শুরুতে আমার মনে হয় সত্যিই আমি কিছু উদ্ভাবন করেছি, কারণ আমার গল্পের জন্য একটি চরিত্র বা একটি ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি এ-ও বুঝতে পারি যে, নির্মিত চরিত্রগুলো বাইরে থেকে আমার গল্পে এসেছে। সুতরাং ইতোমধ্যে সেগুলো কোথাও বিদ্যমান রয়েছে। তাদের আকৃতির মতো দেখায়, তবে ঘোলাটে এবং তা শারীরিক ভাবে নয়। এছাড়া সেই প্রক্রিয়ার আরও একটি ধাপ আছে। আমি শুনতে পারি যে, তারা একে অপরের মধ্যে কি বলছে অথবা তারা আমার সঙ্গে কি কথা বলছে। সুতরাং বলা যায় যে, এটাই আমার লেখার সেরা মুহূর্ত। বিষয়টি অবশ্যই অসাধারণ, খুবই গভীর এবং তাতে বিশেষ সংযোগ ও সম্পর্ক আছে। একজন বর্ণনাকারী হিসেবে বা একজন লেখক হিসেবে আমার চরিত্রগুলো নিশ্চিতভাবে আমার কাছ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছে এবং আমিও তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। কিছু বিশেষ কারণে কখনও কখনও চরিত্রগুলো আমাকে অবাক করে দেয়, যা আগে আমি সেগুলো সম্পর্কে জানতাম না। বিষয়টি সত্যিই খুব রহস্যময়। এ বিষয় নিয়ে আমার লেখার ইচ্ছে আছে। অবশ্যই লেখার অনেক ধরনের দিক-নির্দেশনা রয়েছে। কারণ প্রথমত লেখককে গবেষণা করতে হয় অথবা একটি সম্পূর্ণ গল্প উদ্ভাবন করতে হয়; যা অন্য পুস্তক এবং অন্যান্য ধারণার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে কথা বলে। এছাড়া কিছু তথ্য টুকে রাখার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। তারপর পুরো গল্পটি লেখার এবং অবয়ব দেওয়ার জন্য শুরু করতে হয়। সুতরাং এত সব দিক-নির্দেশনা রয়েছে যে, লেখালেখি সত্যিই বিরক্তিকর নয় এবং চরিত্ররা সেটাই পছন্দ করে। লেখালেখি আমার একমাত্র পেশা। কেননা আমি আর কিছু করতে পারি না।

 

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন আপনার মধ্যে এমন কিছু নির্দিষ্ট গুণাবলী রয়েছে, যা আপনাকে একজন ভালো লেখক তৈরি করবে?

ওলগা: আমার ধারণা যে, ভালো লেখক হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট গুণ প্রয়োজন, যা একধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করার ক্ষমতার মতো। তাই লেখার ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলা এবং কীভাবে গল্প বলতে হয় বা লেখাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তার জন্য আমাদের সময়ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি নিজেদের আয়ত্তে আনা দরকার।

 

প্রশ্ন: একজন নতুন পাঠককে আপনি আপনার কোন বই দিয়ে শুরু করার জন্য সুপারিশ করবেন?

ওলগা: আমার মনে হয়, এধরনের কোনো বই নেই। প্রথমত আমার জিজ্ঞেস করা উচিত যে, পাঠক কারা? যদি পাঠক তরুণ বা মধ্যবয়সী কিংবা মহিলা বা পুরুষ হয়— আমি জানিও না তারা অন্তর্মুখী বা বহির্মুখী; সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল। কিন্তু এমন কিছু বই আছে, যা আমি পছন্দ করি, এমনকি আমার নিজের কিছু বই আছে, যা আমি অন্যের চেয়ে বেশি পছন্দ করি। আমি মনে করি, এখনো এমন একটি বই আছে, যা সুইডিশ ভাষায় অনুবাদ করা হয়নি। গ্রন্থটির নাম ‘আনা ইন দ্য গ্রেভস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। বইটি সাইবার আবর্জনার মতো এবং সুমেরীয় পুরাণের ওপর ভিত্তি করে লেখা। সুতরাং বলা যায়, এ বইটি কিশোর-কিশোরীদের ভালো লাগবে।

 

প্রশ্ন: লেখক হওয়ার জন্য আপনাকে কে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন?

ওলগা: এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও কঠিন। কারণ তা নির্ভর করে আমার জীবনের কোন সময়কে প্রভাবিত করেছে সেই জিজ্ঞাসার উপর। কোনো এক বিশেষ ধরনের লেখার, যেমন উল্লেখযোগ্য উপন্যাস— এসবের প্রতি আমার অনেক আকর্ষণ ছিল। সুতরাং আমি বেশ সহজভাবে এবং নিশ্চিত হয়ে বলব যে, মধ্য-ইউরোপীয় ঐতিহ্যের অন্তর্গত লেখা, গল্প বলার স্টাইল এবং ভাষা আবিষ্কার উল্লেখযোগ্য। মধ্য-ইউরোপের লেখকদের মধ্যে আমি ব্রুনো শুলজের নাম উল্লেখ করব। কেননা তিনি একজন পোলিশ লেখক হিসেবে আমার লেখালেখিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি পোলিশ ভাষায় লিখেছেন এবং পোলিশ ভাষার মাধ্যমে তিনি অবিশ্বাস্য কাজ করেছেন। তবে আমি রূপক কাহিনি নির্ভর লেখাও পছন্দ করি, যার শেকড়ও রয়েছে মধ্য-ইউরোপে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফ্রান্‌ৎস কাফকার রচনা। তবে আমি অবশ্যই বলব যে, যখন তরুণী অর্থাৎ বেশ অল্প বয়সী ছিলাম, এমনকি কিশোরী ছিলাম, তখন আমি দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্যের প্রতি দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমি রাশিয়ান লেখকদের লেখা ভীষণ পছন্দ করি, কেননা তাদের লেখায় একধরনের বাস্তবতা এবং বিদ্রূপের মিশ্রণ দেখা যায়। সুতরাং এ প্রশ্নের জবাব খুবই দীর্ঘ হবে, যা সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে পারে।

 

প্রশ্ন: কীভাবে আমরা নারীবাদী কণ্ঠস্বরকে সাহিত্যে আরও বেশি করে প্রকাশ করতে পারি?

ওলগা: আমি মনে করি, ইতোমধ্যে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেছে এবং আমরা এখনো সেই প্রক্রিয়ার শুরুতে কোথাও আছি। একবার আমি তিনজন মহিলাকে, অর্থাৎ মা, দাদীমা এবং মেয়েকে, নিয়ে একটি বই লিখেছিলাম। সেখানে আমি তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে সত্য এবং অস্তিত্বশীল হিসেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি হয় এবং আমাদের জীবনে সেসব অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পোলিশ সমালোচকরা আমার সেই বইটিকে একধরনের রূপকাহিনি হিসেবে বর্ণনা করেছিল। তা কি ভালো অভিব্যক্তি ছিল? আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। কারণ যখন তারা ধারণা করেছিল যে, প্রধান চরিত্রগুলো মহিলা এবং লেখক একজন নারী, তখন বইটি অবশ্যই রূপকাহিনি হবে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, লেখকদের শুধু নারীদের নিয়ে লেখাই নয়, বরং সাহিত্যে নারী চরিত্রগুলোকে দার্শনিক এবং নৈতিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জের। বিশেষ করে সমসাময়িক প্রসঙ্গের মুখোমুখি হওয়া খুবই প্রয়োজন। কারণ আমরা যখন একজন মানুষের কথা চিন্তা করি, তখন আমি বলতে চাচ্ছি আমাদের মনের মধ্যে কোথাও না কোথাও একজন মানুষ বা মানুষের আকৃতি লুকিয়ে আছে। সুতরাং বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তা পরিবর্তন করা উচিত।

 

প্রশ্ন: আপনি আপনার কাজের মধ্যে সীমানা এবং জাতীয়তাবাদের মুখোশ উন্মোচন করেন। আপনি কি এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলবেন?

ওলগা: শুরুতেই প্রথম ও সহজ উত্তরটি আমার বেড়ে ওঠার জায়গার সঙ্গে যুক্ত করা উচিত, এমনকি আমি যেসব জায়গা বাস করতাম, সেগুলোরও সঙ্গেও সম্পর্ক রয়েছে। কারণ আমি জার্মান সীমান্তের কাছাকাছি এক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছি এবং এখন চেক সীমান্তের কাছাকাছি বসবাস করছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সীমান্তের বিশাল রাজনৈতিক পরিবর্তনের অংশ ছিল আমার পরিবার। সুতরাং তারা পোল্যান্ডের এক অংশ থেকে অন্য অংশে গিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অর্জিত হয়েছিল। তাই সীমানা সম্পর্কিত ঘটনা আমার শৈশবে এবং বর্তমান জীবনেও ভীষণভাবে উপস্থিত আছে। এছাড়াও বিমূর্ত দিক থেকে বিষয়টি চিত্তাকর্ষক। সীমান্ত আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ এবং আমরা সীমান্ত অতিক্রম করার গভীর প্রয়োজনীয়তা খুব গাঢ়ভাবে অনুভব করি। বিষয়টি এমন কিছু… আমার মনে আছে আমি যে ছোট্ট গ্রামে বাস করতাম, সেখানে বনের মধ্যে একটি সীমানা আগেও ছিল এবং এখনো আছে। সেখানে আমি আমার কুকুর নিয়ে যেতাম কেবলমাত্র সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য, এমনকি তা ছিল নিরেট আনন্দের জন্য। কেননা তখন আমি একজন মুক্ত মানুষ ছিলাম। আসলে প্রকৃত অর্থে সীমান্তের অস্তিত্ব ছিল না। আর অবশ্যই, বিশেষ করে জ্যাকবের বইয়ে, আমি পোল্যান্ডের একটি বহু-সাংস্কৃতিক দেশ হিসেবে দেশটির পূর্ববর্তী ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চেয়েছি, বিশেষ করে এমন একটি সমাজ হিসেবে যা অনেক ভাষায় কথা বলে এবং যা আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছি। তাই পোল্যান্ডের পুরনো চিত্রটি পুনর্নির্মাণের জন্য এ বিষয়টি খুবই প্রয়োজন।

 

প্রশ্ন: আপনি কী বলবেন যে, ভ্রমণ এবং স্থান পরিবর্তন করা আপনার কাজের অন্যতম মূল বিষয়?

ওলগা: হ্যাঁ, তাই। আমি বিশ্বাস করি, আমরা সবাই আমাদের মধ্যে কোথাও আছি, সম্ভবত আমাদের বংশানুগতির নিয়ন্ত্রক উপাদান অর্থাৎ জিন, হয়তো আমাদের মানসিকতা বা আমাদের যাযাবর প্রবৃত্তি, যা আমাদের জীবন তৈরি করে। এমনকি যদি আমরা পুরো জীবন এক জায়গায় বাস করি, তবুও আমরা কেবল সেই জায়গা অতিক্রম করার কথা ভাবি, যেখানে আমাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই গভীর প্রয়োজনটি আমার জীবনেও ভীষণভাবে উপস্থিত আছে। তাই ‘ফ্লাইটস’ উপন্যাসে আমি বিভিন্ন স্তরে স্থান পরিবর্তনের নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। পর্যটনের দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, তীর্থযাত্রার জন্য স্থান, স্বাচ্ছন্দ্যে কোথাও যেতে বা কোনো জায়গা মিলিয়ে দেখতে, এমনকি হারানো জায়গা এবং যেখানে আমরা আগে কখনো ছিলাম না, তা আমাদের জীবনকে খুবই সুস্পষ্টভাবে তৈরি করে। সুতরাং আমি বলব যে, এই বইটি কেবল স্থান পরিবর্তনের নির্দিষ্ট বিষয় নয়, স্থান পরিবর্তনে সাহিত্যের নির্দিষ্ট বিষয়ও।

 

প্রশ্ন: আপনার কাজের মধ্যে স্যাসটেইনেবলের বিষয়টি কীভাবে উপস্থিত হয়?

ওলগা: আমি সে ধরনের সক্রিয় কর্মী নই। আমি খুব নিউরোটিক এবং আপনি জানেন যে, বক্তৃতা করার সময় আমি খুবই নার্ভাস হয়ে যাই, বিশেষ করে অনেক মানুষের সামনে। আমি এ ধরনের যোদ্ধা নই, তবে আমি যা করতে পারি তা হলো, আমি কিছু চিন্তা-ভাবনা উদ্ভাবন করতে পারি এবং সেই চিন্তা-ভাবনাগুলো নিয়ে লিখতে পারি। আমি এমন একটি গল্প তৈরি করতে পারি, যা অন্য লোকদের মতো, যেমন ‘ড্রাইভ ইয়োর প্লাউ ওভার দ্য বোনস্ অব দ্য ডেড’, চালিত করবে। পরবর্তীতে অনেকে আমাকে বলেছেন যে, তারা উপন্যাসটি পড়ার পরে নিরামিষভোজী হয়েছেন। এটি সত্যিই একটা উল্লেখযোগ্য দিক। আমি যা করতে পারি, তাই করতে যাচ্ছি এবং বিষয়টি আমার কাজের সামান্য ক্ষেত্র। আর অবশ্যই সাহিত্য হলো বিশ্বকে বোঝার একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি, খুবই নির্দিষ্ট ও পরিশোধিত, অস্বাভাবিক এবং যোগাযোগের পরিশীলিত উপায়। সুতরাং আমার লেখায় আমি কেবল শিক্ষার সাধারণ ধারণাগুলো, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিপজ্জনক বিষয়গুলো কিভাবে মোকাবিলা করা যায় তা উল্লেখ করার চেষ্টা করতে চাই। তাই অনুগ্রহ করে বোঝার চেষ্টা করুন যে, আমি একজন সক্রিয় কর্মী নই। আমি এ কথাই বলব। আমাদের চেতনাকে আরও বিস্তৃত করার জন্য আমার কল্পনাকে ব্যবহার করি এবং এভাবে আমি আমার নিজের ভাষায় এ বিষয়ে লিখতে যাচ্ছি।

 

প্রশ্ন: পুরস্কারের অর্থকড়ি ব্যবহার করে আপনি যে ফাউন্ডেশনটি তৈরি করতে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে আমাদের বলুন?

ওলগা: আমার ঘোষণা এবং অনুধাবন করার পরে সেটাই ছিল প্রথম চিন্তা-ভাবনার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু আমি এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে আছি। আমি সবসময় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কিছু করার জন্য খুবই সক্রিয় ছিলাম। আমি অন্যদের কল্যাণে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করার জন্য বেঁচে আছি এবং বর্তমানে আমার সম্মুখে এমন একটি সম্ভাবনা রয়েছে, যা এখন আমি সত্যিই করতে পারি। আমরা একটি বিবৃতি লিখছি, বা কিভাবে, ইংরেজি শব্দ কী? সাহিত্যের সঙ্গে ফাউন্ডেশনের পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য এবং মূল লক্ষ্যগুলো যুক্ত করা হবে এবং অবশ্যই লেখক ও অনুবাদকদের জন্য ছোটো ছোটো বাসস্থান হবে। তবে আমি প্রাকৃতিক পরিবেশের দিকে মনোনিবেশ করতেও খুব আগ্রহী, বিশেষ করে আমাদের গ্রামে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ভবিষ্যতে করার মতো আমার আরও অনেক পরিকল্পনা আছে, যেমন প্রাণী অধিকার, যা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 

প্রশ্ন: উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখকদের আপনি একটি মাত্র কী পরামর্শ দেবেন?

ওলগা: জটিল প্রশ্ন। আমি জানি, অনেক ধরনের পড়াশুনা রয়েছে, যেমন সৃজনশীল লেখা। তখন কিভাবে লিখতে হয় এবং কিভাবে লেখার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়, লেখকেরা তা শেখার চেষ্টা করে। কারণ আমার জন্য লেখা একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া এবং তা শুধু কাগজে লেখার প্রক্রিয়া নয়, এমনকি একটি গল্প উদ্ভাবনও নয়। তবে এমন কিছু, যা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দিকের সঙ্গে খুব গভীরভাবে জড়িত। তাই আমার মনে হয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখকদের প্রতি আমার একটি মাত্র পরামর্শ আছে এবং তা হলো প্রচুর পড়াশুনা করা। আমি মনে করি, প্রতিটি লিখিত পৃষ্ঠার জন্য সবসময় এক হাজার পৃষ্ঠা পড়া উচিত।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।