মঙ্গলবার, মার্চ ১৯

জলবন্দি মুখের বিভা : শৈবাল নূর

0

Motif-01জগতের ঘটমান নানা লৌকিক, অলৌকিক যা হয়তো পরিমাপে উচ্চ কিংবা তুচ্ছ সকল ঘটনার সাথে আমাদের চিন্তা, বিকাশ, মনন এবং ভাষার নিখুঁত যোগাযোগ আদি থেকে আজ অব্দি শৈল্পিক বুনন হয়ে প্রবাহমান রয়েছে। প্রতিনিয়ত জগৎ থেকে গ্রহণ, বর্জন এবং তার সাথে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে সেই কবে যে আমরা তা প্রকাশের এক অমোঘ পথ হিসেবে কবিতাকে বেছে নিয়েছিলাম, সেসব আজও আমার অজানা। তার অনেক পরে হয়তো আমরা সে ভাষা প্রকাশকে কবিতা বলে স্বীকৃতি দিয়েছি। আর বিপত্তির শুরু ওখানেই—

কবিতা নিয়ে হাজারও সংজ্ঞা আমরা নানা সময় দেখতে পাই। তারপরও কবিতা কী— এমন প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হচ্ছে। তাহলে কবিতা কি সংজ্ঞাতীত? না— তা কী করে হতে পারে!

কবিতা যেহেতু নানান ধরন, কাঠামো বা আবরণের হয়ে থাকে, সেজন্যই এর সংজ্ঞা নানান জনের কাছে নানাভাবে এসেছে। মানব মনের বৈচিত্র্য, চিন্তার এবং ভাষাশৈলীর ভিন্নতা আছে বলেই কবিতা আজও মুক্ত। যা কোনো একক সংজ্ঞায় থিতু নয়। এটি প্রবাহমান এবং সর্বদাই নতুনত্বের দাবিদার।

তবে কেন কবিতা নিয়ে এতো প্রশ্ন! এর নিশ্চয় প্রয়োজন আছে বইকি৷ যা চিরকালের প্রশ্ন, তার উত্তর চিরদিন নতুনভাবে আমাদের সামনে এসেছে। কবিতা যেহেতু নানান ধরন, কাঠামো বা আবরণের হয়ে থাকে, সেজন্যই এর সংজ্ঞা নানান জনের কাছে নানাভাবে এসেছে। মানব মনের বৈচিত্র্য, চিন্তার এবং ভাষাশৈলীর ভিন্নতা আছে বলেই কবিতা আজও মুক্ত। যা কোনো একক সংজ্ঞায় থিতু নয়। এটি প্রবাহমান এবং সর্বদাই নতুনত্বের দাবিদার।

এ. ই. হাউসম্যান বলেছেন, ‘কবিতা যতটা-না বুদ্ধিগ্রাহ্য তার চেয়ে বেশি শারীরিক’

আর কবিতাকে শুধু শাব্দিক ধরেও এগুনো যায় না। কখনো তা চিন্তার, মননের বা কখনও কখনও শারীরিক তো বটেই।

‘জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা’
বা ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়শা আক্তার’

এভাবেও কবিতার সংজ্ঞায়ন আমরা কবিতার মধ্য দিয়ে পাই, তবু তাকে পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা হিসেবে দাবি করতে পারি কি?

তবে কবিতার প্রধানত দু’টি ধারণা নিরূপণ করা যায়৷ যা, প্রথমত ব্যক্তিগত। আর দ্বিতীয়টি হলো সামাজিক বা সর্বমহলে গ্রাহ্য৷ আসলে ব্যক্তিগত সংজ্ঞায়নই পরে গ্রহনযোগ্যতার ভিত্তিতে সামাজিক রুপ লাভ করে৷ তবে আমি মনে করি, কবিতা নিজেই নিজের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে।

একটি উৎকৃষ্ট ভাষাশৈলী যখন কবিতায় রূপ নেয়, তখন আমরা তার কাছে বারবার ফিরে যাই, আমাদের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের নিরাময় খুঁজতে।

 

২.
এই ঘূর্ণয়মান পৃথিবীতে নিরবধি মানুষের নানা বিবর্তন ও আবিষ্কারের সাথে সাথে কবিতাও তার অবস্থান, আকুতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করে চলেছে। এ এক এমন সিলসিলা, যার প্রতিনিধিত্ব কখন কে করবে, তা বলা ভীষণ দুরূহ। তবে জগতে কবিতার ধারণা অব্যাহত আছে বলেই আমি হয়তো আজ আমার শব্দের সাথে কবিতার সংযোগ ঘটাতে এসেছি।

সেই প্রথম যৌবনে, বাবা লিখতেন বলে আমার শরীরে তার একটু আঁচ লেগেছিল। তবু কবিতায় ঝাঁপানো হয়নি তখনও। কিন্তু তারপর যৌবন এলো, প্রেম এলো, বোধের নানা মাত্রার উন্মোচন হলো। আর রক্ষা হলো না৷ তাই নিজের আধো আধো কথাদের স্পষ্ট করতে এসে এমন এক ভাষা-জগতের ফাঁদে পড়ে গেলাম, যা কূলহীন দরিয়ায় সাঁতার দেবার মতো।

তারপর যৌবন এলো, প্রেম এলো, বোধের নানা মাত্রার উন্মোচন হলো। আর রক্ষা হলো না৷ তাই নিজের আধো আধো কথাদের স্পষ্ট করতে এসে এমন এক ভাষা-জগতের ফাঁদে পড়ে গেলাম, যা কূলহীন দরিয়ায় সাঁতার দেবার মতো।

এই তো শুরু হলো জীবনের নতুন বাঁক৷ আমার ভাব, ভাবনা, চিন্তা, অদেখা, আকাঙ্ক্ষা, আলেখ্য, কাম, অপ্রাপ্তি, ক্রোধ আরও শত সুরের এক নিপুণ যোগসূত্র ঘটানোর চেষ্টা যে ভাষাকে ভিত্তি করে, তাকে কবিতার ভাষা ধরে আমৃত্যু নিজেকেই জানার এ নির্মোহ প্রয়াস।

কবিতার ভেতর দিয়ে নিরন্তর নিজেকে জানার, বোঝার যে প্রচেষ্টা— তা আমার ভেতরের ভাব রসের সাথে ওতোপ্রতো ভাবে মিশে আছে৷ তাই তো ভাষাকে বলি, তুমি কী করে কবিতা হয়ে ওঠো গো— আমি যেন তোমার মাঝেই নিয়ত আত্মহুতি দিতে চাই৷

 

৩.
কবিতাকে জীবন ঘনিষ্ঠতার বাইরে আদৌ ভাবা যায় কি— জীবনের কত কত রূপ, ব্যঞ্জনা আর মাধুর্য। তার ভেতর চড়ুই পাখির মতো কবিতার নিত্য আনাগোনা, বসবাস।

জীবনকে মাঝে মাঝে ভাবি পাহাড়চূড়ার কোনো হাওয়াঘর৷ যা মধুময় দৃশ্যের স্থিরচিত্র। লালনের গানের কথায় আট-কুঠুরি। আর অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অতিবাহিতের প্রতিকূলতা সজাগ চোখে পড়ে৷ সেখানে কবিতাকে শ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই মনে হয়৷ যা সর্বক্ষণ আমাদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করে। আত্মার ভেতর দিয়ে বইতে থাকে নিরবধি।

কবিতার সাথে জীবনের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আমার একটা স্মৃতির কথা বলি— চাঁদরাত। সেদিন ছিল ঈদ৷ তবু কী এক অভিমানে রাত শুরুর দিকে আমি গৃহত্যাগ করলাম। সচারাচর মন বিষণ্ন হলে আমি জলের কাছাকাছি যেতে পছন্দ করি৷ তাই সেদিনও শরণাপন্ন হলাম জলের কাছে। আমাদের গ্রাম থেকে তিন-চার গ্রাম পশ্চিমে বয়ে গেছে বাঙালী নদী৷ আজও ব্রিজ হয়নি বলে, প্রাচীন প্রথার মতো রয়েছে খেয়া পারাপার। আস্থার মতো সেই ঘাটে বসে আমি চাঁদ ও জলের রমন দেখতে লাগলাম। মায়ের আঁচলের মতো মৃদু বাতাসে মন হালকা হয়ে এলো। ধবধবে সে চাঁদের রাতে খেয়া পারাপারের নৈঃশব্দ্যে আমার ভেতর শব্দেরা বুদবুদ উসকে দিল। লিখতে শুরু করলাম…

 

ধবধবে চাঁদরাতে খেঁয়া পারাপারের নৈঃশব্দ্যে
বৌ আমার ঝাঁপ দিল নদীতে

চাঁদের ভেতর, বৈবাহিক আয়নার অতলে
সহসা ঢেউ খেলে যায়

বৌ আমার সাঁতার জানে না

শুনেছি— নারী নদীর সহজাত
সেখানে জোয়ার ভাটায় চাঁদ ওঠে, আসে অমাবস্যা

অথচ আজ— জলে এ কার ছায়ামুণ্ডু!

 

এভাবে আমার দেখা ও কল্পনার সংমিশ্রণে আরও কিছু পঙ্‌ক্তি প্রবাহে কবিতাটি পূর্ণতা পেল। যার শিরোনাম দিলাম ‘চাঁদরাত’।

 

৪.
মাঝে মাঝে কবিতার সাথে নিগূঢ় প্রেম-দ্বন্দ্ব হয়৷ আর কবিতা অভিমানী প্রেমিকাদের মতো কিছুকাল অবসর পেতে চায়৷ শুনেছি সকল কবির-ই এমন বিরতিকাল থাকে৷ তবে এটাকে দ্বন্দ্ব বলি কী করে—

যখন বিপন্ন অসুখের মতন কবিতা শিরায় মিশে যায়। তখন সে অসুখ নিয়ে বসবাস করতে করতে তা জীবনের বন্ধু হয়ে ওঠে!

দ্বন্দ্বকে হয়তো আমরা বৈপরীত্যের অবস্থান দ্বারা বুঝতে চেষ্টা করি। কিন্তু কবি আর কবিতার দ্বন্দ্ব ভিন্ন কিছু হয়তো। আমার কাছে তো তাই—

তবে সকল দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে যখন নিজের ভাষা ও প্রকাশের মাঝে কোনো অস্পষ্টতা থাকে না৷ রাতের নদীর ঢেউভাঙা শব্দের মতো হৃদয়ের কথারা অক্ষরে, শব্দে রূপান্তরিত হয়ে পাতাঝরার কৌশলে ঝরতে থাকে, সুরের ব্যঞ্জনা ছড়ায় আর ক্রমশ অলৌকিক আদল তৈরি করে।

একজন কবির বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র হলো আকাঙ্ক্ষা। আর তা মৃত্যুকেও অতিক্রম করে৷ তাই সে সবসময় তার না-লেখা কবিতার দিকে ধাবিত হয়৷

 

৫.
প্রাণ সংকুলান মরুতেও একটি গিরগিটি বাঁচার আকাঙ্ক্ষা রাখে। হয়তো আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে না আমৃত্যু। একজন কবির বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র হলো আকাঙ্ক্ষা। আর তা মৃত্যুকেও অতিক্রম করে৷ তাই সে সবসময় তার না-লেখা কবিতার দিকে ধাবিত হয়৷ সেই না-লেখা কবিতাই নির্বাণের মতো কবির গন্তব্য হয়ে থাকে৷ আমি তাই জীবন নিংড়ে আমার নিজের খোঁজ করি। নিয়ত আমার না-লেখা কবিতার কাছে পৌঁছাতে চাই। কিন্তু কেন এই চাওয়া!

আমি যত কবিতাই লিখি না কেন, তবু আয়নায় দাঁড়ালে আয়নার ভেতর আমার না-লেখা কবিতা চাঁদের বুড়ির মতো আমাকে ডাকে। তাই হয়তো একটি কবিতায় লিখেছিলাম—

 

তবু,
আয়না দেখার ছলে হত্যা করব না নিজেকে

 

এমনই ভাবনা, তাড়না প্রতিনিয়ত তাড়া করে ভেতরে ভেতরে৷ যখন পড়ি ‘জলে নিচে ও কার নৃমুণ্ড ভাসে’— তখন নিজের ভেতরের আমিকে চেনার বাসনা বিরল-প্যাঁচার চোখ হয়ে সারারাতের অন্ধকারে চেয়ে থাকে। আর এমনই আধো-কল্প, আধো-বাস্তব জীবনের শরীর আমি আমার না-লেখা কবিতা মাঝে খুঁজেতে যাই বলেই হয়তো, আমার আকাঙ্ক্ষারা ব্রহ্মাণ্ডের ধীর বিবর্তনের আয়নায় মুখচ্ছবি হয়ে চেয়ে থাকে৷

আমি অমিতাভ সীমারেখা ধরে আমার না-লেখা কবিতার খোঁজে নিজেকে চেনার, জানার আমৃত্যু মোহে স্থির জলের ছায়ায় বসে আছি। আর অক্ষরের মতো টুপটাপ পাতাঝরা মাত্রই নিখুঁত জলবিম্ব অবলীলায় প্রসারিত হচ্ছে। প্রসারিত হচ্ছে আমার মানবজন্মের শুশ্রূষায়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবিতা লেখেন মূলত; পাশাপাশি গদ্য লিখতে চেষ্টা করেন। প্রকাশিত বই: যামিনী ও মরমী ধনুক ( কবিতা)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।