শুক্রবার, মার্চ ২৯

দস্তয়েভস্কি পাঠের পর…

0

ফিওদর দস্তয়েভস্কি নিয়ে আমি এমন কী বলতে পারি, যা আগে কেউই বলেনি। বোর্হেস-ফ্রয়েড থেকে শুরু করে ওরহান পামুক পর্যন্ত অনেক মায়েস্ত্রোই দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে লিখে গেছেন, তাঁকে কুর্ণিশ জানিয়ে গেছেন। বোর্হেস নাকি বলেছিলেন, দস্তয়েভস্কি আবিষ্কার করা অনেকটা ভালোবাসা আবিষ্কারের মতো, কিংবা সমুদ্র আবিষ্কারের মতো। পামুক বলেছিলেন ‘ব্রাদার কারামাজভ’ পড়ে তার  জীবন বদলে যাওয়ার গল্প। তাঁর মনে হয়েছিল, এরপর জীবন আর আগের মতো থাকবে না। এমন অসংখ্য লেখা কোট করে দিলেই একটা লেখা অবশ্য দাঁড়িয়ে যায়। কিংবা তাঁকে নিয়ে  লেখা ঢাউস বই ও আর্টিকেলগুলোতো আছেই। কোনো একটা ধরে শুরু করলেই তো হয়। কিন্তু সেসব কথা কি আমার কথাগুলোয় বলতে পারবে? যা আমি দস্তয়েভস্কি পড়ে অনুভব করেছিলাম? মনে হয় না। দস্তয়েভস্কি পাঠের অভিজ্ঞতা এতই মৌলিক যে, তা কারো বর্ণনায় উঠে আসা অসম্ভব। তবে এটুকু স্বীকার করে নিতে হয় যে, বোর্হেস এক বর্ণও মিথ্যে বলেননি।

আরো চার পাঁচ বছর আগে প্রথম পাঠে দস্তয়েভস্কি যে অনুভূতি নিয়ে এসেছিল তা ছিল অনেকটাই  ভাঙাচোড়া ও অপরিণত। গত বছর লকডাউনের সময় তাই দ্বিতীয়বার হাতে তুলে নিয়েছিলাম দস্তয়েভস্কি। পামুকের মতো আমিও বলতে পারি, দস্তয়েভস্কি পাঠের পর এই আমি এবং পাঠের আগের আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। বদলে যাওয়া এক মানুষ। কথাটা শুনতে হয়তো ক্লিশে, কিন্তু আমি মনে করি যারা দস্তয়েভস্কি পড়েছেন তাদের কেউ কেউ আমার সঙ্গে একমত হবেন।

শুরুটা করেছিলাম ‘ইডিয়ট’ দিয়ে। এরপর একে একে ‘অপরাধ ও শাস্তি’, ‘সাদা রাত’, ‘জুয়াড়ি’ এবং ‘ব্রাদার কারামাজভ’ পড়ে শেষ করি। যেন একটি জীবনচক্র সম্পূর্ণ হলো। প্রিন্স মিশকিন থেকে শুরু পরে রাসকোলনিকভ হয়ে যা শেষ হয়েছে কারামাজভ ভাইদের দিয়ে। এ এক অদ্ভুত জার্নি। যেন নিজের জীবনকেই ছিঁড়ে খুড়ে দেখার মতো। দস্তয়েভস্কি পাঠ মূলত অনেকটা আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতো। যেখানে কেবল আপনি নিজের চেহেরা দেখতে পান এমন না। এর মধ্য দিয়ে আপনার অতীত বর্তমান ভবিষ্যতকেও দেখতে পাবেন। জানতে পারবেন মানুষ আসলে দেখতে কেমন? মানুষের কাছ থেকে তার আড়ালগুলো কেড়ে নিলে মানুষ একইসঙ্গে কতটা প্রাকৃতিক তাও দস্তয়েভস্কি আপনাকে বলে দেবে। পাশাপাশি দস্তয়েভস্কি পাঠ সবসময় আপনার নার্ভের পরীক্ষা নেবে। যেমন কারামাজভ শেষ করার পর যে অনুভূতি আমার মনে জন্ম নিয়েছিল তা মৃত্যুশয্যায়ও মনে থাকার মতো। যেন আমার অস্তিত্বের ভিত ধরে কেউ টান দিয়েছিল সেদিন। কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একসময়। এরপর সেই দৃশ্যগুলো স্বপ্নে ফিরে এসেছিল বারবার। ঠিক কাছাকাছি ধরনের অনুভূতি এর আগে কেবল দুইবার হয়েছিল। কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ ও আলবেয়ার কামুর ‘আউটসাইডার’র প্রথম লাইনগুলো পড়ার পর। কিন্তু তারপরও সেই অনুভূতি এতটা তীব্র ও মৌলিক ছিল না। আর কোনো কিছুই এমন অনুভূতির জন্ম দিতে পারে না। তাই কারামাজভ পাঠ শেষ করার সেই মুহূর্তটির কথা ভাবলে এখনো শিউরে উঠি। গায়ে কাটা দিয়ে যায় এবং শিরদাঁড়ায় বয়ে যায় শীতল অনুভূতি। হয়তো বাকি জীবনও আমাকে একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে এবং এই বই আমার কখনো দ্বিতীয়বার পড়ার সাহস হবে না। এভাবে কেউ কখনো আমাকে সত্য ও বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়নি; কেউ না। আর কোনো বই পড়ে আমার এমন অনুভূতি জন্ম নেয়নি। এটা অনেকটা নতুন জন্ম নেয়ার মতো, বোর্হেসের ‘আলেফ’র সেই অদ্ভুত মুহূর্তটি যেন আমি বাস্তবিকভাবে কারামাজভ পাঠের মধ্যে দিয়ে অনুভব করলাম।

কারামাজভ পড়ার আগ পর্যন্ত ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টকে মনে হতো দস্তয়েভস্কির সেরা কীর্তি। কিন্তু কারামাজভ পাঠের পর সেই অনুভূতি পুরোপুরি বদলে গেল। আর কোনো কিছুই এই বইয়ের মতো না। এতটা মৌলিক ও অনন্য। যে কারণে এই বইটি সবসময় প্রাসঙ্গিকও বটে। আজ থেকে ৫০০ বছর পরও যদি পৃথিবী টিকে থাকে, তখনো কেউ না কেউ এমন মুগ্ধতা ও অস্তিত্বহীনতার অনুভূতি নিয়ে পাঠ করবে এই বইটি। এটা মানুষকে মূলত তার নিজের গল্প বলে, তার ইতিহাস বলে এবং সর্বোপরি বলে তার নিজের সৃষ্টি ও ধ্বংসগাথা। তাকে দেখিয়ে দেয়, মানুষ হিসেবে আসলে সে কেমন হতে পারে! বইটি পড়ার সময় আমার কখনোই তিনটি ভাই ও তাদের বাবাকে আলাদা চরিত্র বলে মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছে, এগুলো সবই একজন। একটিই চরিত্র, কেবল আলাদা আলাদাভাবে বর্ণিত হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে এই চরিত্রগুলোকে ধারণ করি। এগুলোর ভারকে বহন করি।

দস্তয়েভস্কি পড়ার পর আমার আরো একটা কথা বারবার মনে হয়েছে। পৃথিবীর মানুষকে সহজেই দুভাগে ভাগ করা যায়, যারা দস্তয়েভস্কি পড়েছে এবং যারা দস্তয়েভস্কি পড়েনি। দস্তয়েভস্কি পাঠ আপনাকে নরকের দুয়ারে দাঁড়িয়ে স্বর্গ দেখাবে, যেখানে কোনোটাতেই আপনি হয়তো কখনোই প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ, দস্তয়েভস্কি যে যন্ত্রণা, দুঃস্বপ্ন, আশা ও সম্ভাবনার উন্মোচন ঘটাতে চান তিনি নিজে এবং তার চরিত্রগুলো তার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। এমনকি সেই সম্ভাবনা ও যন্ত্রণার দুয়ারে কড়া নাড়ার জন্য পাঠক হিসেবে আপনি নিজেও যেতে চাইবেন না। সেই সম্ভাবনা ও যন্ত্রণাগুলো আপনার কাছে কেবল ফাঁপা পাত্র বলেই মনে হবে। আপনি বরং নরকের দুয়ারে দাঁড়িয়ে স্বর্গ দেখার স্বাদটুকুই নিতে চাইবেন, সেটুকুই তাকিয়ে দেখতে চাইবেন, যা আপনাকে আরো একটু মানুষ করে তুলবে। আরেকটু বেশি রক্তমাংসের মানুষ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও কথাসাহিত্যিক জন্ম ১৯৮৮, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই : সূর্যাস্তগামী মাছ (কবিতা) ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার (কবিতা) শেফালি কি জানে (না কবিতা, না গল্প, না উপন্যাস) ক্ল্যাপস ক্ল্যাপস (কবিতা) দ্য রেইনি সিজন (কবিতা) প্রিয় দাঁত ব্যথা (কবিতা) বিষাদের মা কান্তারা (উপন্যাস) সন্তান প্রসবকালীন গান (কবিতা)

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।