মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩

নীলা টাওয়ারের ছাদে কেউ বৃষ্টিতে ভেজে না : উম্মে ফারহানা

0

১.
বৃহস্পতিবার
সিঁড়িঘর ছাড়া বাদবাকি পুরোটা দালান অন্ধকার। শুধু ছয়তলার একটা ঘরে জানলার সামনে মোবাইল ফোনের আলো জ্বালিয়ে কয়েকজন লোক তাস পেটাচ্ছে। শায়লা ব্যালকনি থেকে লোকগুলোকে দেখতে দেখতে ভাবে, তাস খেলাটা কেন কখনো শেখা হয়ে উঠলো না তার। এই আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিংটা যখনই দেখে সে, কাপড় মেলে দেওয়ার সময় বা টবে পানি দেওয়ার সময়, ছোটোবেলায় শোনা একটা গল্প মনে পড়ে। কালিবাড়িতে শায়লার দূর সম্পর্কের এক খালা থাকতেন, সেই খালা বেড়াল কুকুর পুষতেন, মানুষের অনাথ বাচ্চাদেরও পালন করতেন। তেমনই এক পালিত মেয়ে তাকে বলেছিল গল্পটা। বিস্তারিত মনে নেই, তবে একটা ভূত সেখানে বাড়ি সেজে থাকে। যারা সেই বাড়িতে বসবাস করে তারা জানেও না যে বাড়িতে কোনো ভূত নেই, বাড়িটা নিজেই একটা ভূত।

সাধারণত ভূতের গল্পে বনজঙ্গল, পুরনো রাজপ্রাসাদ কিংবা পোড়োবাড়ি থাকে, বহুদিন কোনো লোক সমাগম ঘটেনি এমন পরিত্যক্ত দালানকে ভূতের বাড়ি মনে হতে পারে। একটা নির্মীয়মান ভবন, যেখানে জীবিত মানুষের যাতায়াত আছে, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আরও অনেক মানুষ বসবাস করবে, শিশুরা খেলবে, গৃহিনীরা রাঁধবে, মানুষের জীবনের স্পন্দনে ভরে উঠবে সবগুলো তলা, তেমন বাড়িকে ভূতের বাড়ি মনে হবার কোনো কারণ নেই।

গল্পের এক পর্যায়ে বাড়িটাকে ধুতে ধুতে সব রং উঠে যায়, তখন বোঝা যায় যে ওটা আসলে বাড়ি নয়। রং ওঠা দালানটা, যা আসলে ভূতের দেহ, নিশ্চয়ই এই তৈরি হতে থাকা সাততলার মতন ছিল না, চোখ বুজলে শায়লা কালিবাড়ির সেই বারান্দাটাকে দেখতে পায়, যেখানে বসে টাংস্টেন বাল্বের আলোতে খালার বানানো আমড়ার আচার খেতে খেতে সে গল্পটা শুনেছিল।

কিন্তু যেকোনো প্রকাণ্ড দালান দেখলেই শায়লার সুদূর শৈশবে শোনা সেই গল্পের কথা মনে পড়ে, এমনকি বসুন্ধরা সিটি যখন বানানো হচ্ছিল, তখনো একবার তার মনে হয়েছে, কালিবাড়ির খালার বাসায় শোনা সেই ভূতবাড়ির কথা। গল্পের এক পর্যায়ে বাড়িটাকে ধুতে ধুতে সব রং উঠে যায়, তখন বোঝা যায় যে ওটা আসলে বাড়ি নয়। রং ওঠা দালানটা, যা আসলে ভূতের দেহ, নিশ্চয়ই এই তৈরি হতে থাকা সাততলার মতন ছিল না, চোখ বুজলে শায়লা কালিবাড়ির সেই বারান্দাটাকে দেখতে পায়, যেখানে বসে টাংস্টেন বাল্বের আলোতে খালার বানানো আমড়ার আচার খেতে খেতে সে গল্পটা শুনেছিল। ভূত মানেই অশরীরি, তাদের দেহ থাকে কী করে, সেই প্রশ্নও সে করেনি গল্প বলিয়ে মেয়েটিকে। খালার বাড়িতে অনেক গাছ ছিল, হাস্নুহেনার ঝাড়, সাদা জবা, বোতল ব্রাশ ফুল, একটা ফুলের নাম যে বোতল ব্রাশ হতে পারে তা জেনে খুব বিস্মিত হয়েছিল সে। বড়ো হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বাজে দিক হলো, মানুষের বিস্ময়বোধ কমে যায়। যা কিছু ঘটুক না কেন, মানুষ আর বিস্মিত হতে পারে না। ছোটোবেলা কালিবাড়ির ‘জঙ্গলবাড়ি হাউজ’ দেখে তার যে বিস্ময়বোধ তৈরি হয়েছিল, সেই বিস্ময়বোধকে পরাজিত করেনি অন্য আর কোনো বিস্ময়বোধ। আর কোনো বিপন্ন বিস্ময়বোধ।

রান্নাঘরে প্রেশারকুকারের সিটি বেজে ওঠে। শায়লা বারান্দার মোড়া থেকে উঠে রান্নাঘরে যায়। রফিকের আজকে আসতে দেরি হবে, সে বলেছে খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে। কিছু করার নেই, ডাক্তার বিয়ে করার আগে ভাবা দরকার ছিল, তাদের ডিউটির দিন রাত ঠিক থাকে না, শুক্র শনির ঠিক থাকে না, জন্মাষ্টমী ক্রিসমাস ঈদ-ই-মিলাদুন্নবি থাকে না— জাতীয় কথা শুনতে চায় না আর সে। ঘুমাবার আগে কিছুক্ষণ গান শোনার জন্য কম্পিউটার চালু করে। টিভিতে ইউটিউব চালিয়ে নিলে গানের চেয়ে ছবির দিকে মনোযোগ বেশি চলে যায় তাই। ডাউনলোড করা গান খুঁজে বের করে, ফোল্ডার থেকে। গান চালিয়ে দিয়ে একা একা খেতে বসে।

ঘুমাবার প্রস্তুতি হিসেবে অনেক কিছুই করতে হয় তাকে। একবার গোসল করতেও হয়। বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকায় না, গান শুনতে শুনতেই গোসল করবে। পানির উত্তাপ পরীক্ষা করার সময় হঠাৎ করে তার মনে পড়ে বাথরুমের ছোটো জানালাটার কাচ টেনে দেওয়ার আগেই কামিজটা খুলে ফেলেছে। রফিক একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল কেন সে বাথরুমের জানলা না আটকে গোসল করে না, তার কি ধারণা ওপাশের বিল্ডিং থেকে কেউ তাকিয়ে থাকবে তার বাথরুমের জানলা দিয়ে? দেখতে হলেও তো বাইনোকুলার লাগার কথা। মাঝের প্লটের পুরনো আমলের দোতলাটা বেশ বড়োই। তাই তাদের বাথরুম যেসব ফ্লোর থেকে দেখা যাবে সেগুলো অনেকটা দূরে। রফিকের কাছে এই সাবধানতা হাস্যকর লাগে তাই।

তড়িঘড়ি জানলার কাচ আটকায় শায়লা, আটকাবার আগে ওপাশের দালানের একটা অন্ধকার জানলায় সিগারেটের আগুন ওঠানামা করতে দেখে। ভূতেরা আগুন ভয় পায়, কাজেই এটা কোনো মানুষ, নির্মান শ্রমিক হবার কথা, যারা তাস খেলে তাদেরই একজন হবে হয়তো।

তড়িঘড়ি জানলার কাচ আটকায় শায়লা, আটকাবার আগে ওপাশের দালানের একটা অন্ধকার জানলায় সিগারেটের আগুন ওঠানামা করতে দেখে। ভূতেরা আগুন ভয় পায়, কাজেই এটা কোনো মানুষ, নির্মান শ্রমিক হবার কথা, যারা তাস খেলে তাদেরই একজন হবে হয়তো। একটা অ্যানেকডোট মনে পড়ে তার, ‘ভাই আপনি কি ভূতপ্রেত বিশ্বাস করেন? জি ভাই করি, মানুষ বিশ্বাস করি না’। একা ফ্ল্যাটে ‘পথের শেষ কোথায়’ শুনতে শুনতে তার মনে হয় একে এভাবে পালটে নেওয়া যায়, ‘আপা, ভূত ভয় পান? না আপা, মানুষকে পাই’। বাথরুম থেকে বের হয়ে প্লে লিস্ট পাল্টায় সে। এয়ার সাপ্লাই ছাড়ে, আই নো জাস্ট হাউ টু হুইসপার… আই ক্যান মেইক ইউ এনি প্রমিস দ্যাট হ্যাড এভার বিন মেইড অ্যান্ড আই ক্যান মেইক এভরি স্টেইডিয়াম রক… ডু ইউ রিয়েলি ওয়ানা সী মি ক্রল? অ্যান্ড আ’ম নেভার গনা মেইক ইট উইদাউট ইউ… অ্যান্ড আ’ম নেভার গনা মেইক ইট লাইক ইউ ডু, মেইকিং লাভ আউট অফ নাথিং অ্যাট অল…

 

২.
শুক্রবার
রফিক সারাদিন ধরে ঘুমাচ্ছে। শায়লা ঘরদোর গুছিয়ে, খানিকক্ষণ শাহীন আখতারের ‘সখী রঙ্গমালা’ পড়ে দুপুরের ভাতঘুমকে চোখ থেকে তাড়ায়। ঘর গোছানো বলতে অযথাই কিছু কুশন কভার পাল্টানো, বইয়ের শেলফের প্রায় অদৃশ্য ধুলো ঝাড়া, গৃহকর্মিনী যেসব কোনা কখনো পরিষ্কার করে না সেগুলো পরিষ্কার করা। সবাই তাকে বলে, দিনে না ঘুমিয়ে, মেডিটেশন করে, গ্যাজেট ব্যবহার না করে, গরম দুধ খেয়ে, চা কফি কমিয়ে ঘুমের বড়ি ছাড়াও ঘুমানো যায়। তাই সে এইসবগুলোই চেষ্টা করে যায়। নিয়ম করে ঘন্টাখানেক হাঁটে, যোগব্যায়াম করার চেষ্টা করে। আজকে একটু বাদলা দিন, তাই ঘুমটাকে তাড়ানো মুশকিল হচ্ছে। একবার সে কুণ্ডলি পাকিয়ে রফিকের পেট জড়িয়ে ধরে শোয়, তারপর ঘুম চলে আসার ভয়ে আবার উঠে টিভি চালায়। বৃষ্টিটা জোরে আসতে শুরু করলে জানলা আটকাতে গিয়ে চোখ পড়ে আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিংটার দিকে। কেন জানি তার ইদানিং এই দালানটার প্রতি বিতৃষ্ণা হচ্ছে, সে খুব সচেতনভাবে একে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে বলেই হয়তো, বার বার চোখ পড়ে যাচ্ছে। রং ছাড়া দালানটাতেও শ্যাওলা ধরেছে এখনই, কোনো কোনো ফ্লোরে গ্রিল লাগানো হয়েছে, কয়েকটিতে থাই গ্লাস। কি কুৎসিত এই নতুন আমলের দালানের নকশা! সানশেড বলে কিছু নেই। বৃষ্টির দিনে খোলা জানলায় বসার উপায় নেই, গরমে জানলার দুই পাল্লা ওয়াইড ওপেন করে দেওয়ার জো নেই।

পাল্লা টেনে দিয়ে পর্দাগুলোকেও টান টান করে দেয় সে। ঘরে এক বিষণ্ন আবছা আলো বিকেলবেলাই সন্ধ্যা নামিয়ে দেয়। রফিককে ঘুম থেকে না তুলে নিজের জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে সোফায় বসে শায়লা। গতকাল রাতের ঘটনাটা বলা হয়নি, বললেও রফিক পাত্তা দিত না তেমন।

পাল্লা টেনে দিয়ে পর্দাগুলোকেও টান টান করে দেয় সে। ঘরে এক বিষণ্ন আবছা আলো বিকেলবেলাই সন্ধ্যা নামিয়ে দেয়। রফিককে ঘুম থেকে না তুলে নিজের জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে সোফায় বসে শায়লা। গতকাল রাতের ঘটনাটা বলা হয়নি, বললেও রফিক পাত্তা দিত না তেমন। শায়লার বড়ো বোন শম্পা যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ত তখন নাকি একবার ক্যাম্পাসে একটা কালো গাড়ি করে আসা লোকের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। কতটা সত্যি আর কতটা গালগল্প সে বিষয়ে শম্পা নিজেও নিশ্চিত নয়— সেই লোকের কাছে নাকি অনেক মেয়ের ফোন নম্বর ছিল, মেয়েদের হলের সামনে দাঁড়িয়ে সে মাস্টারবেট করত আর ফোন করে জানলা দিয়ে বাইরে দেখতে বলত। মেয়েরা যখন অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দিল তখন জোরে শিষ বাজানো শুরু করল। গল্পের এই অংশ বেশ দুর্বল। ফোন নম্বর অনেক ভাবেই জোগাড় করা যায়, কিন্তু কোন মেয়ে কোন ঘরে থাকে, সেই ঘরের জানলা দিয়ে ক্যাম্পাসের কোন অংশ দেখা যায়, ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়ালে ঠিক সেই মেয়েই দেখতে পাবে সেটা জানা মুশকিল। আর মেয়েরা কোনো অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে যে কেউ জানলায় তাকাতে বললেই তাকাবে কেন? প্রেমিক দাঁড়িয়ে থাকলে হলের জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে পারে কোনো মেয়ে, অপরিচিত লোকের কথায় কেন কেউ দেখবে বাইরে? নাকি লোকটা হরবোলাও? মেয়েদের পরিচিত কণ্ঠস্বর নকল করতে পারে! শম্পা এসব তথ্যের কোনোটাই বিশ্বাস করেনি। তার নিজের ঘরটাও হলের বাউন্ডারির দিকে ছিল, এ ব্লকে। তাই বেশ কিছুদিন রাতে একা ঘরে ঘুমাতে ভয় পেত। টান টান করে জানলা আটকে রাখত, একদিন খুব জোরে শিসের আওয়াজ শুনেও ছিল।

শম্পার কাছ থেকে গল্পটা শুনে গা গুলিয়ে উঠেছিল শায়লার, একটা হোতকা মোটা টাকমাথা লোক, মুখে কুচ্ছিত হাসি নিয়ে প্যান্টের জিপ খুলে মাস্টারবেট করছে আর তার আরেক হাতে মোবাইল ফোন। একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে সে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে কালো একটা গাড়ি পার্ক করা— এমন একটা ছবি কল্পনায় দেখতে পেয়েছিল। শম্পার শিস শুনতে পাওয়ার ব্যাপারটাকে ভীত মনের কল্পনা ধরে নেওয়া সম্ভব হতো হয়তো, কিন্তু অনেকেই এমন কালো গাড়ি নিয়ে বহিরাগত লোকটিকে দেখতে পেয়েছিল। প্রক্টরিয়াল বডি কিছুদিনের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে, মিডিয়া ঠেকায়। সাংবাদিকরা জানেনি বলে ক্যাম্পাসের বাইরের কেউ কিছুই জানেনি। এমন তো হতেই পারে যে ওই বিল্ডিংটার নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে এমন বিকৃত মানসিকতার কেউ আছে, যে বাথরুমের দিক বরাবর জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এই বিল্ডিঙের বারোটা ফ্লোরের সব কটাতে একই জায়গায় বাথরুম রয়েছে, একদম নিচের দুই তিনটা বাদে সবগুলিই সেখান থেকে দেখা যাবার কথা।

এমন বিচ্ছিরি জিনিসটা মনে পড়াতে শায়লার চিন্তায় তিক্ততা ভর করে। সে আবার গুটিশুটি মেরে কাত হয়ে শোয়া রফিকের পেটের কাছে গিয়ে শোয়। রফিক কাতর কণ্ঠে বলে, আমি আরেকটু ঘুমাই? প্রচণ্ড অভিমান হয় শায়লার, জড়িয়ে ধরার জন্য বাড়ানো হাতটা সরিয়ে নেয় সে।

উঠে গিয়ে চপ্পল পায়ে গলায়। চাবি দিয়ে বাইরের দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে লিফটে ওঠে। আন্ডার কনস্ট্রাকশন বাড়িটা এই বিল্ডিঙের চেয়ে মাথায় খানিকটা খাটো। কয়েকটা ফ্লোর কম হবে হয়তো। তাই এখান থেকে পুরোটা ছাদ দেখা যাচ্ছে। ছাদ দেখে বাড়িতে জনমানবের আনাগোনা টের পাওয়া যায়। বার্জার পেইন্টের খালি বালতিতে লাগানো নয়নতারা ফুল দেখে শায়লার মনে পড়ে শহিদুল জহিরের কথা। শেষ বিকেলের আশ্বিনের হাওয়া চমৎকার ফুরফুরে হবার কথা হলেও এখন ক্লাইমেট চেঞ্জের পাল্লায় পড়ে সেই বাতাস কোথায় যেন লুকিয়েছে। বরং ইলশেগুঁড়ি পড়ছে বেশ। এই বৃষ্টিটাও শায়লার ভালো লাগে। মনে হয় জীবনের বিভিন্ন না পাওয়া মেটাতে বৃষ্টিতে ভেজা উচিত সবার। ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাওয়া যায়। একটা জীবনের বঞ্চনা ক্ষমা করে দেওয়া চলে।

সেই বাড়িটার ছাদের ঘরে কিছু একটা নড়ে ওঠে, কেউ কি বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ছাদে উঠছে? ভালোমতো দেখে সে নিশ্চিত হয়, ছাদে কেউ নেই। কেউ বৃষ্টিতে ভিজছে না।

 

৩.
শনিবার
সকালে হাঁটতে বের হওয়া যায়নি বৃষ্টির জন্য। রফিক গেছে এক ছোটোবেলার জিগরি দোস্তের বাড়ি। শায়লাকে বলেছে শম্পার বাসা থেকে ঘুরে আসতে। পুরুষ মানুষদের বাইরের একটা জগত দরকার হয়— বউকে বাদ দিয়ে বাডি ট্যুরের দরকার হয়। জানে সে এসব কথা। নিজের সময় কাটাবার নানা উপায় তার কাছেও আছে। ডিআইওয়াই করা, বই পড়া, ছবি দেখা, শম্পার বাড়ি গিয়ে শম্পার শাশুড়ি ননদের কুটনামির গল্প শুনে আসা। শায়লার শনিবারগুলো এভাবে কেটে যায়। বিকেলে হাঁটতে বের হয় না সে সচরাচর, তাই রাস্তার ভিড় আর লোকজনের ঢিলেঢালা চলাফেরা দেখে একটু একটু একা লাগতে থাকে তার। সে ঠিক করে কোনো শপিং মলে গিয়ে কিছু লিপস্টিক আর নেইলপইশ কিনবে। নেইল পলিশ কেনাটা তার শখ, পরা হয় না অত একটা। স্কুলে যাবার সময় সাজ বলতে একটু ফেইস পাউডার, কাজল আর লিপস্টিক। ফেইস পাউডারটা শুধু ঘামে চকচকে হওয়া ঠেকাবার জন্য, ফর্সা হবার ইচ্ছা নেই তার।

হাঁটবার সময় রাস্তার পাঁক কাদা আর যানবাহন ঠেকানো বেশ ঝামেলার মনে হয়, সকালে এসব নেই, বেশ ফাঁকা থাকে পথঘাট। সে একটা নির্জন গলি খুঁজে এলোমেলো হাঁটতে থাকে। কালিবাড়ির সেই প্রকাণ্ড বাড়িটা এখন দেখতে কেমন হয়েছে, আছে নাকি ভেঙে বানানো হয়েছে কোনো বহুতল বসতবাড়ি তা জানতে মন চায়। খালার সেই বাড়িটা ছিল একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। বাড়ির পিছনে কুয়া ছিল, টানা বারান্দায় পাখির খাঁচা ঝুলত, বসার ঘরে বিরাট গদিওয়ালা সোফা, নায়িকারা দোল খায় এমন রকিং চেয়ার, আর দেয়ালে হরিণের শিং ওয়ালা মাথা। যা কিছু টিভি বা সিনেমায় দেখা যেত কিন্তু বাস্তবে বিরল তেমন সব জিনিসে ঠাসা ছিল বাড়িটা। ঘরের ভেতর বেশ কয়েকটা বেড়ালের স্বতস্ফূর্ত চলাফেরা, ভেতরে উঠানে কুকুরের রাজকীয় ভঙিতে শুয়ে থাকা, সব কিছুই কেমন যেন খান্দানি টাইপ। শায়লা বুঝতে পারে না কালিবাড়ির খালার পৈতৃক বাড়ি কেন তার মাথায় ঘুরছে।

বাড়িদের কি আত্মা থাকে? বাড়িগুলোকে ভেঙে ফেললে কি সেই আত্মাগুলো ভূত হয়ে যায়? হয়ে যায় ভূতবাড়ি কিংবা বাড়িভূত? সেই যে বাড়িটাই আসলে ভূত ছিল, সে হয়তো ভূত জন্মের আগে জীবিত বাড়ির দেহে ছিল।

বাড়িদের কি আত্মা থাকে? বাড়িগুলোকে ভেঙে ফেললে কি সেই আত্মাগুলো ভূত হয়ে যায়? হয়ে যায় ভূতবাড়ি কিংবা বাড়িভূত? সেই যে বাড়িটাই আসলে ভূত ছিল, সে হয়তো ভূত জন্মের আগে জীবিত বাড়ির দেহে ছিল। ধুর, জীবিত বাড়ি বলে আবার কিছু আছে নাকি? আর যদি সেই বাড়ি জীবিতই হয় তাহলে তো সে আর জড়বস্তু হতো না।

আনমনে চলতে চলতে হঠাৎ সে হোঁচট খায় একটা আধলা ইটে। স্নিকার পায়ে থাকাতে ব্যথা পায়নি তেমন, কিন্তু চমকায় ভীষণ। দাঁড়িয়ে যায় হতভম্ব হয়ে। যে বাড়ির সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে সেটার নাম নীলা টাওয়ার। শায়লা একটুও অবাক হয় না যখন বুঝতে পারে যে অলিগলি পেরিয়ে সে আসলে সেই শ্যাওলা ধরা আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিংটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যেটার পেছন দিকটা তার দক্ষিণের ব্যালকনি আর শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুম আর লিভিং রুম থেকে দেখা যায়। নিচের তলাটা পুরো খালি, সম্ভবত গ্যারাজের জন্য রাখা। সেখানে ইট বালু সুড়কির স্তুপ দেখা যায়। কিন্তু কোনোরকম কর্মচাঞ্চল্য টের পাওয়া যায় না। কোনো নির্মাণ শ্রমিকের চলাফেরা দেখা যায় না, গলার আওয়াজ পাওয়া যায় না। একজন দারোয়ান গোছের লোক ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে জিজ্ঞেস করে, ‘বাসা ভাড়া নিবেন?’ শায়লা মাথা নেড়ে না করে দেয়।

সামনে এগোতে গিয়ে তার চোখে পড়ে নীলা টাওয়ারের গ্যারাজে একটা কালো গাড়ি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।