শনিবার, এপ্রিল ২০

বারোমাসিয়া কিস্‌সা কিংবা আরো কিছু উপকথা

0

Start১.
৩২ বছর ধরে গ্রাম থেকে পুরো চৈত্র মাস শহরে ঘুরে বেড়ান জনক মণ্ডল, শিবের গাজন নিয়ে।
সঙ্গী চন্দ্রনাথ ঢুলি।
নাচে আর গানে, পাঁচালীর সুরে সুরে তিনি তুলে আনেন লোকায়ত এক ভোলানাথকে।
তারপর কত গল্প হয় তাদের সাথে।
দেশ ছিল পাবনায়। ১৯৭২ এ দেশ ছেড়েছেন।
কিন্তু দেশ হারাননি তিনি।
পাবনার গ্রামগুলি, গঞ্জ হাটের আলো আর গ্রামীণ যাত্রার গল্প জুড়ে জুড়ে এক আখ্যান বলে চলেন
জনক মণ্ডল।
তার চোখে কি তীব্র এক আকুতি। মায়া।
আর জীবনঘোর লেগে থাকে। আমিও ভিজে উঠি!

২.
জনমভরের দেখা দিয়ে যাপন কেটে যায় মানুষের।
ছোটো ছোটো দেখা গুলি জীবনের গল্প কুড়িয়ে আনে।
নদীর চরে ফাল্গুনের বিবাগী বাতাস।
বাওকুমটা বাতাসে গানের সুর ঘুরে ঘুরে মরে—
‘আজি ছাড়িয়া না যাইস
বাচ্চা মৈশাল রে’
তখন ফজলু মিঞার বাড়ির খোলানে ধান ঝাড়তে থাকা মেয়ে বউরা দেশ গ্রামের গল্পে ডুবে যেতে থাকে।
এইভাবে একটা পরিসর তৈরি হতে থাকে।
রসুনখেতের পাশে নদী রেখে গেছে সরু জলরেখা।
দৌড়ে পালানোর আগে চকিত তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যের শেয়ালেরা।
জীবন বয়ে চলে প্রবাহিত জলস্রোতের মতো।
বুধবারের হাট থেকে সুবলসখা যখন বাড়ি ফিরতে থাকে তখন কেমন এক মায়া তাকে উন্মনা করে দেয়। সে কয়েক দণ্ড দাঁড়ায়। গতজনমের স্মৃতি তাকে তাড়িত করতে থাকলে সে তার স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনতে থাকে গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল।
সিতানন্দের সারিন্দা।
এভাবে জন্ম জন্ম জীবন কেটে যায়।
জোড়া মহিষের দেশে, সুপুরি গাছের পৃথিবীতে এভাবেই মায়া আর ম্যাজিক নিয়ে বয়ে যায় মস্ত মানবজীবন।
হাসি কান্না দুঃখ পুলক বাদ্য বাজনা ভরা জীবন কেবল ছড়িয়ে দেয় গান—

‘কচু পাতের পানি যেমন রে
ও জীবন টলমল টলমল করে’

৩.
তখন মধ্য নদীর চর থেকে ইসমাইল শেখের জোড়া মহিষের চকিত ডাক উঠে আসে। নদীর জলে গা ডোবানো সেই জোড়া মহিষের ডাক কিভাবে মিশে যেতে যেতে একসময় গাছপালা, ঝাড়ঝোপেই ডুবে যায়। তখন ইসমাইল শেখের চোখে কি এক দূরাগত স্মৃতিহীনতা! এভাবেই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে মানুষকে বারবার স্মৃতিতেই ফিরে যেতে হয়। তাকে স্মৃতিময় হয়ে উঠতে হয়। প্রেক্ষিত জুড়ে নদী, জলরাশি, নদীর চর, অগুনতি হাঁস, চৈত্রের ধুলো আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই জোড়া মহিষ।ইসমাইল শেখের অন্যমনস্কতায় পুরোন এক দেশকাল প্রবেশ করতে থাকে। আর এই প্রবেশ ও প্রস্থানের মাঝখানে গানের ধুয়ো ওড়ে—

‘আজি বাথানে না যান
ও মোর মৈশাল রে’

ইসমাইল হেঁটে যেতে থাকেন রসুনখেতের পাশের আলের ওপর দিয়ে। তাকে রাস্তা চেনাতে থাকে সেই জোড়া মহিষ। মস্ত এক কালখণ্ড রচিত হয় এভাবে আর দৃশ্যের পর দৃশ্যে ঘন ঘন হোচট খেতে থাকে ইসমাইল শেখের জোড়া মহিষ।

৪.
‘হলদি রে হলদি
হলদিবাড়ির হলদি’

সেই কবে মেখলিগঞ্জে তিস্তার চর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে চরবসতি থেকে এক প্রাচীন মানুষের কণ্ঠ থেকে এই গানের সুর উঠে আসছিল। আর সেই সুর ঘুরে ঘুরে চর, বসতি আর নদী তিস্তায় বুঝি ডুবে যাচ্ছিল। এত বছর পেরিয়ে আবার সেই কালখণ্ডে ফিরে যেতে চায় জীবন। আর আমি দেখি মস্ত সেই দেওয়ানগঞ্জের হাট। ভরা হাটের উজানে একা একা হেঁটে যাচ্ছেন ফকির, মিসকিন আর গা-গঞ্জের মানুষেরা। আমি হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর ভেতর খুঁজতে থাকি ঘোড়া জোতদার, ধনী বাড়ি আর পদুমোহন বরাইকের কাঠের খড়ম। হেলাপাকরি থেকে ভান্ডানি যাবার রাস্তায় সেই উদাসীন জোড়া মহিষের পিঠে বাচ্চা মৈশাল আর সেই মৈশাল একা একাই গেয়ে উঠেছিল বিরহের গান। জীবনে এভাবেই কত কত গল্প জমে ওঠে।
আমি দেখে ফেলি রাখালকাকুর মাকে,আপনমনে যিনি শোলোক বলছেন—

‘শামুক খাজারে আমার বাড়ি আয়
রকম রকম শামুক দিমু
হলদি দিমু গায়’

রিয়ালিজম এভাবেই গড়িয়ে যাওয়া ব্যাটারির মতন কখন কিভাবে একটা ম্যাজিক নিয়ে আসে বুঝি আমাদের জীবনে!

৫.
একটা ব্যপ্ত পৃথিবী থেকে গান ভেসে আসে—
‘কালা বাইগোন ধওলা রে
সাধু বাইগোনের গোড়ায় কাঁটা’
তখন লোকদেবতার থানে বাদ্য বাজে। বাজনা বাজে। কাদোপন্থে অনন্ত গাড়িয়াল।
জোতদারবাড়ির খোলানে বসে আমি দেখি শত শত বছর আগেকার এক দেশকাল নুতন পৃথিবীতে ফিরে আসছে।
ছোটো পাখি। হাঁসের বহর।
ফেলে আসা কাঠের খড়ম।
আসিরুদ্দিন পাইকারের পালাগানের আসর।
রংপুরের গান শুনি। গোয়ালপাড়ার গান শুনি।
হাতিমাহুত আর মৈশালের গান শুনি।
বিভোর হই। চোখে জল আসে।
লোকসংগীত আমার শিক্ষক। আমাকে জীবন চেনায়। আমাকে যাপনের গন্ধে ডুবিয়ে মারে।
বালাবাড়ির ওপর দিয়ে ভেসে আসে গান—

‘আজি ছাড়িয়া না যান
ও মোর বাচ্চা মৈশাল রে’

৬.
এভাবে জীবন হয়ে ওঠে উদযাপন। বৈশাখ থেকে চৈত্র বারোমাস জুড়ে জুড়ে কেবল গান থাকে। নাচ থাকে। কত কত দেখা। থাকে। দেখানো থাকে। বাদ্য কিংবা বাজনার উপর খুব ঝুঁকে পড়তে থাকেন আদ্যনাথ ধনী। আর চোত-বোশেখের কালবৈশাখী ঝড় ঢেকে দিতে থাকে সব ও সমস্ত দৃশ্যখণ্ড।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

সুবীর সরকার বাংলা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ নাম। জন্ম ১৯৭০ সালের ৩ জানুয়ারি। নয়ের দশকে লিখতে আসা এ কবি উত্তরের লোকজীবনের সাথে জড়িয়ে আছেন তীব্র ভাবে। ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে কবিতা গদ্য সহ বিভিন্ন ধারায় অনায়াস যাতায়াত করেছেন। ভাষার প্রায় সব কাগজে নিয়মিত লেখালিখি করছেন। ১৯৯৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতাবই প্রকাশিত হয় কবিতা পাক্ষিক থেকে। গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ও গদ্যের বইগুলো- ধানবাড়ি গানবাড়ি, মাহুত বন্ধু রে, নির্বাচিত কবিতা, বিবাহ বাজনা, নাচঘর, উত্তরজনপদবৃত্তান্ত, মাতব্বর বৃত্তান্ত, ভাঙা সেতুর গান। পেশায় শিক্ষক এ কবি ভালোবাসেন রবিশস্যের খামার বাড়ি, সাদা ঘোড়া আর যৌথ যাপনে চাঁদের আলোয় কবিতা আড্ডা, লোকগানের আমেজ। কবিতা পাক্ষিক সম্মান ইতিকথা সাহিত্য পুরস্কার শিতলগড় সাহিত্য সম্মান কবিতা করিডোর সম্মাননা তোর্ষা বিশেষ সাহিত্য সম্মাননা বিবৃতি সাহিত্য পুরস্কার সমিধ কবিতা সম্মাননা আলপনা স্মৃতি সম্মাননা সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ স্মৃতি পুরস্কার।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।