শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

বোধ

0

শেষরাতের তুমুল বৃষ্টি রাস্তার দুধারে পানি জমিয়ে রেখে এখনো তার তাণ্ডবের জানান দিচ্ছে। এ বছর প্রকৃতি যেন বৈরি, সব বেশি বেশি। ঝড়-বৃষ্টি-গরম, বন্যাও হয়ে গেল মাঝে। শীতকালে শীতটা যখন ঠিক মতো পড়ল না তাতেই বোঝা গিয়েছিল সামনে কি হতে যাচ্ছে!

ভেজা রাস্তায় প্লাস্টিকের স্যান্ডেলে মচমচ শব্দ তুলে দ্রুত হেঁটে চলেছে জামাল। চলার গতিতে যেন ট্রেন ছুটে যাওযার ব্যাস্ততা। লম্বা প্রায় ছয় ফুট, তাগড়া জোয়ান তবে বুদ্ধির ধার ততটা না। হাতের দুলুনিতে বাজারের ব্যাগটা শিশু পার্কের স্যান্টামারিয়া রাইডের মতো একবার শুন্যে উঠছে, একবার নিচে নামছে। তার চোখমুখ জুড়ে উদ্বেগের ছাপ। সময় মতো পৌঁছতে পারবে তো! হেমন্তের রাত্রে শিশির পড়ার কথা, তা না হলো ঝুপ ঝুপে বৃষ্টি! এ বছর বৃষ্টি আর ছাড়বে না। ভোর রাত্রের দিকে যখন বৃষ্টি নামল, ঘুমটা এলো জাকিয়ে। কাঁথা গায়ে জড়াতে জড়াতে আধো ঘুমে তার মনে হচ্ছিল বড় বড় ফোটায় শিশির ঝরছে টিনের চালে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে বড় দেরি হয়ে গেল। ঘাবড়ে যাওয়া জামাল মনে মনে বলল, ‘আরেব্বাস্ নয়টা বাজে! উকিল সাহেবরে বাড়িতে পাইলে হয়। এতোক্ষণে তো কোর্টে চইলে যাওয়ার কথা। আজ আমার কপালে দুঃখ আছে।’

সেই কবে থেকে জামাল উকিল সাহেবের বাঁধা গোলাম হয়ে গেছে। উকিলের ফাই-ফরমাস সব তার খাটতে হয়। ’এই যা তো জামালি বাজারটা করে নিয়ে আয়। যা তো রাজমিস্ত্রী ডেকে নিয়ে আয়। দেখ তো, পানির কলটা নষ্ট হলো ক্যান? যা তো জামালি কবুতর একটা খুঁজে পাওয়া যাইতেছে না, কোন বাড়িতে গেল দেখ!’ জামাল ছোটে। ছুটতে থাকে।

উকিল সাহেব রাজনীতিতে নব্য কিছু পোস্ট পজিশন পেয়েছে। তার কল কাঠি নাড়ায় কাজ হয়। এ জন্যই তো সে তার পেছন পেছন হন্যে হয়ে ঘোরে। উকিল সাহেব মাঝে মাঝে এমন কিছু কাজ করে যা দেখে জামাল মাটিতে মিশে যায়।

আবার কখনো ফরমায়েশ হয়, বল তো জামালি পাড়ায় আজকে কোথায় কি ঘটলো? সব খবর জামালকে রাখতে হয়। পাড়ার কোন ঘরের মেয়ে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে— উকিল সাহেবের প্রতিনিধি হয়ে জামাল সেখানে হাজির। কোন ঘরের ছেলে গলায় দড়ি দিল, খবরের পেছনের খবর খুঁজতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে জামাল। উকিল সাহেবের বিনা পয়সার ভৃত্য জামালি। পাওয়ার মধ্যে এখন পর্যন্ত পেয়েছে এই নামের পেছনে অতিরিক্ত একটা হ্রস-ই কার।

উকিল সাহেব রাজনীতিতে নব্য কিছু পোস্ট পজিশন পেয়েছে। তার কল কাঠি নাড়ায় কাজ হয়। এ জন্যই তো সে তার পেছন পেছন হন্যে হয়ে ঘোরে। উকিল সাহেব মাঝে মাঝে এমন কিছু কাজ করে যা দেখে জামাল মাটিতে মিশে যায়। এই তো সেদিন উকিল সাহেব হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটল তার নেতার বাড়ি। নেতার কি যেন পদোন্নতি হয়েছে। তাকে অভিনন্দন জানাতে ছুটছে। নেতার বাড়ির বারান্দা অব্দি পৌঁছে দেখে ফুলের বুকেতে ভরে গেছে মেঝে। উকিল সাহেব জামালের কানে কানে বলল, ‘জামালি একটা ভুল হইয়া গেছে, খালি হাতে আসা ঠিক হয় নাই।’
তাইলে এখন কি হবে মামা, ফিরা যাবো?
আরে না, তুই থাকতে ফিরা যাবো ক্যান?
জামাল ক্ষণিকের জন্য ভাবে, তারে আবার ভ্যাট দিয়া না বসে। দুই জায়গার বিনা পয়সার ভৃত্য হওয়া ছিল তার কপালে! সে ভয়ে ভয়ে বলল, এখন কি করবেন মামা?
শোন জামালি, ওইখান থেকে একটা বুকে তুইলা ল, কেউ যেন আবার না দেখে। তুইলা আমার পিছে পিছে হাঁটা ধরবি। সবাই ভাববে আমিই আনছি। সোজা ধরাইয়া দিব নেতার হাতে।
জামাল ভাবে, এরকম বুদ্ধি না থাকলে নেতার চ্যালা হওয়া যায় না।
জামাল তার লম্বা হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় একটা গ্লাডিওলাস-গোলাপের বুকে।
এবছর শীতকালেই তো, রিলিফের কম্বল আসছিল গরিবের জন্য। উকিল সাহেব যা পদাধিকার বলে পাইছিল তার অর্ধেক ধরে রাতের বেলা বিক্রি করে দিল দোকানে। বলে কিনা এ বছর শীত পড়ছে কই?
সেই গাট্টিও বহন করতে হলো তারই। মনে মনে শুধু বলল, ‘কম্বল চুরির অভ্যাস তোদের গেল না!’

জামালের মাঝে মাঝেই উকিলের ফাই-ফরমাস খাটতে খাটতে ক্লান্তি এসে যায়। তারপরও ছুটতে হয়, বাপ তারে এই গ্যাড়াকলে ঝুলাইয়া রাইখা গেছে। মনে মনে সে বাপের চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করে। পরক্ষেেণই আবার ভাবে— না, এ তো তারই প্রায়শ্চিত্য। উকিলের পিছে তার এখন যে দৌড় দৌড়ানো লাগতেছে, তার সিকি ভাগও যদি বাপের জন্য করত তাহলে তার আজ এই দশা হইত না।

সে ছিল এক বাপের একমাত্র ছেলে। শহরে পৌরসভার ভিতরে এক বিঘা জায়গা জুড়ে তাদের বসত ভিটা। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মা-ও নাই। এক বিঘে জমির ওপরে তাদের মূল বাড়ি বাদ দিয়ে সেমি পাকা টিনের ঘর আছে চারটা। বাবা ওগুলো ভাড়া দিত। সেই ভাড়ার টাকাতেই তাদের সংসার চলত। জামালির মাথায় লেখা-পড়া কিছু ঢুকল না। ম্যাট্রিক পাশটাও করতে পারল না। বয়স একুশ হতে না হতেই বাপ বিয়ে দিয়ে দিল লম্বা চওড়া দশাসই চেহারার জামালের। আর এই বিয়েটাই কাল হলো।

জামালের বৌ বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। তার আর কোনো ভাই-বোন নাই। মেয়ে বড় আহ্লাদী। সে ঘর গেরস্থালি একেবারেই পেরে ওঠে না। বছরে আট মাস সে বাপের বাড়িতেই পড়ে থাকে।

ওদিকে জামালের বাবা রেয়াজ শেখের দেখা-শোনার কেউ নাই। জামালও বৌ-এর পিছে পিছে গিয়ে ওঠে শ্বশুর বাড়ি। সে বিয়ের এতা বছর পরও বৌ-এর আকর্ষণ এড়াতে পারে না।
তো রেয়াজ শেখের দেখভাল করে ভাড়াটে সালাম আর তার বৌ।
সেবার রেয়াজ শেখের মাইলড স্ট্রোক হলে সালাম আর তার বৌ-ই তাকে সেবা যত্ন করে বাঁচিয়ে তুলেছে।
পরে খবর পেয়ে জামাল তার বৌ নিয়ে হাজির হলেও বাপ তার সালামের বৌয়ের সেবা নিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতে লাগলেন।

জামালের বৌ বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। তার আর কোনো ভাই-বোন নাই। মেয়ে বড় আহ্লাদী। সে ঘর গেরস্থালি একেবারেই পেরে ওঠে না। বছরে আট মাস সে বাপের বাড়িতেই পড়ে থাকে।

সালামের বৌ’র সেবার সুযোগে ছেলের বৌ আবার বাপের বাড়ি যেতে লাগল ঘন ঘন। এর মধ্যে দ্বিতীয় বারের স্ট্রোকে রেয়াজ শেখ পরপারে পৌঁছে গেলেন।

আর তার তিন দিনের মাথায় মিলাদের আসরেই সালাম ফাটালো বোমাটা। রেয়াজ শেখ নাকি সালামের সেবা যত্নে খুশি হয়ে সালামি হিসেবে তার সম্পত্তির অর্ধেকটা তাকে দানপত্র করে দিয়ে গেছে।

সালাম সেই দানপত্র সবার সামনে মেলে ধরল। জামালের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। একি কাণ্ড! বাপ তারে এইভাবে ঠকাল! জীবদ্দশায় বাপ তারে একবারও বলে নাই— ওরে বাবু, এতো ঘন ঘন শ্বশুরবাড়ি যাস না, আমার অসুবিধা হয়। বললে কি সে আর যেত! বৌকেও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এ বাড়িতে রাখার চেষ্টা করত না! কিন্তু তা না করে ওই সালাম ভাড়াটেকে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দিল! ও তো ঠিক মতো ভাড়া-টাড়াও দিত না। তার বিনিময়ে না হয় একটু সেবা করল, তাই বলে সম্পত্তি লিখে দিতে হবে! সে তার বিশাল শরীরটা নিয়ে ঠাস করে মেঝেতে বসে পড়ল। সে তখন চোখে অন্ধকার দেখছে। বাপ ঠিক কোন অংশটা লিখে দিছে? যে অংশে বাড়িঘরগুলো আছে সেই অংশ না কি যে অংশে পুরনো সব গাছ গাছালি আছে সেই অংশ? যে অংশই দেয় তাতেই তার লস।

কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, বাপটা ঠিকই করেছে, যেমন কুকুর তেমন মুগুর। এমন সময় কথা বলল আনিসউদ্দীন উকিল। তিনি পাড়ার উকিল। এই মিলাদ মাহফিলের একজন অতিথি। তিনি বললেন, কিন্তু তোমার দলিল তো দেখি রেজিস্ট্রি হয় নাই সালাম। এর কি ভিত্তি আছে? সালাম বলল, আমি তার সেবা করছি মাত্র। তার মৃত্যু কামনা করি নাই, তেমন কিছু করলে রেজিস্ট্রি অফিসে যাইতে সময় লাগত না।

তুমি তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়া তারে দিয়া লেখাইয়া নাও নাই তার প্রমাণ কী আছে? আইনের সামনে তো এই দলিল টিকবে না।

এই কথায় যেন জামালের ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো। সে নড়ে-চড়ে বসল। আর সেই নড়-চড় চলছেই। পরদিন সকাল থেকেই সে উকিলের গোলামে পরিনত হয়েছে।

মামলা করা থেকে শুরু করে সাক্ষি জোগাড় করা। তারিখে তারিখে পয়সা খরচ তো আছেই। যাদের সাক্ষি মানা হয়েছে তাদেরও ফাই-ফরমাশ খাটতে হয়। বাড়ির সুপারিটা, নারকেলটা, ফলটা-মূলটা, ডিমটা-মুরগিটা— যখন যে যা চায় তাই তার সামনে হাজির করতে হয়।

মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো এর মধ্যে উকিলের বাপটাও পড়ল অসুস্থ হয়ে। স্ট্রোক করে তার এক পা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। উকিলের বাপকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া। রাতের বেলা বৌ-বাচ্চা রেখে সেই বুড়োর নাইট ডিউটি করা, তার শৌচকর্ম করানো সবই এখন জামালকে করতে হচ্ছে। বুড়ো একটু সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে জামাল ভেবেছিল এইবার সে নিস্তার পেল। কিন্তু তা আর ঘটল কই! ওই প্যারালাইসিসের রোগির রোজকার ব্যায়াম করানো, ধরে ধরে হাঁটানোর চেষ্টা করানোও তার ওপর ন্যাস্ত হলো।

রোজ বিকেলে বুড়োর পায়ে এক বিশেষ কবিরাজি তেল মালিশ করতে করতে জামাল ভাবে, বাপের জন্য এই সেবা করে নাই বলে বাপ তারে বঞ্চিত করল। বাপের সেই সম্পত্তি উদ্ধার করার জন্য তার সেই সেবাই দিতে হচ্ছে উকিলের বাপকে। সালামও তো তার বাপের সেবা যত্নই করেছে, স্বার্থে করুক আর বিনা স্বার্থে— করাটাই তো আসল কথা। জামাল ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সব ফেলে কেমন যেন ভূতগ্রস্থের মতো সে হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে। মনের মধ্যে কিসের এক দোলাচল। মামলাটা কি তাহলে সে তুলে নেবে!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক জন্ম: ফেব্রুয়ারি ১, ১৯৭৭। বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও আমেরিকান ওয়ার্লড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর। পেশা: ব্যবসা। উপন্যাস জাতিস্বর, পৃথিবীলোক, কালের নায়ক, বায়বীয় রঙ এবং আন্ডারগ্রাউন্ড গল্প সংকলন: জগৎ বাড়ি। কিশোর গল্প সংকলন: সবুজ ঘাসে মুক্ত বেশে। রাজনৈতিক নিবন্ধ: অরক্ষিত দেশে অবরুদ্ধ সময়ে। পুরস্কার: আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১০।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।