শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

প্রেমের গল্প : স্লিপিং পিল : মৌলি আজাদ

0

এই নিয়ে তিন বার স্লিপিং পিল খেয়ে মরতে মরতেও বেঁচে গেল উপমা। আজই স্টমাক ওয়াশ করে বাসায় ফিরল সে। খুব দুর্বল লাগছে তার। পেট মোচড়াচ্ছে। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। মন ও শরীর দুটোই বিরক্তি ও অস্বস্তিতে ভরা। গলাটা শুকিয়ে আসছে দেখে বিছানার পাশে রাখা বোতল থেকে পানি গলায় ঢালে। সাইড টেবিলে তাদের স্বামী স্ত্রীর বাঁধানো ফটোর দিকে তাকিয়ে মাথায় রক্ত চড়ে যেন তার। মাথার চুল খামছে ধরে সে। পানির বোতলটা ছুড়ে মারে। খাট থেকে নেমে ধীরে আলমারির দিকে হেঁটে যায়। আলমারিতে থাকা শাড়ির ভাঁজ থেকে ঘুমের বড়িগুলো বের করে এনে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে।

কেউ আমার না, এমন কি স্লিপিং পিলগুলোও আমার সাথে বার বার বিট্রে করে। আমি মরে শান্তি পেতে চাই। অকাজের স্লিপিং পিলগুলো আমাকে তাও করতে দেয় না। তাহলে আমাকে ভালোবাসা দাও? না, তা দেবার মতোও তো কারো ইচ্ছা নেই। নিজে নিজে বিড়বিড় করে এসব বলে বিছানায় ধপাস করে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে উপমা।

কেউ আমার না, এমন কি স্লিপিং পিলগুলোও আমার সাথে বার বার বিট্রে করে। আমি মরে শান্তি পেতে চাই। অকাজের স্লিপিং পিলগুলো আমাকে তাও করতে দেয় না। তাহলে আমাকে ভালোবাসা দাও? না তা দেবার মতোও তো কারো ইচ্ছা নেই।

একটু ওপাশে যাও তো আমি শোবো— স্বামী রহমানের কথা শুনে সম্বিত ফেরে তার।

যার বউ এই নিয়ে তিনবার স্লিপিং পিল খেয়ে মরতে মরতে বাঁচছে সেই লোক কিভাবে এত নিঃস্পৃহভাবে ঘুমানোর কথা বলতে পারে তা ভেবে পায় না উপমা।

রাগে মাথার রগগুলো টনটন করতে থাকে। স্বামীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে তুমি কি একজন স্বাভাবিক মানুষ নাকি রোবট? রহমান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে এত রাতে এভাবে তুমি চিৎকার করছ— এটা কি স্বাভাবিক?

উপমা ক্ষিপ্ত গলায় বলে হ্যাঁ আমি অস্বাভাবিক। আর এই অস্বাভাবিকতার জন্য তুমি দায়ী। আমার প্রতি তোমার দিনের পর দিন বঞ্চনা আমাকে এই অস্বাভাবিকতার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। তুমি আমাকে এই পাঁচ বছরে কয়টা দিন সময় দিয়েছ? কয়টা কথা বলেছ আমার সাথে? এসবের কি হিসাব আছে তোমার কাছে?

রহমান বলে— আমাকে এখন একটু ঘুমাতে দাও।

লাল চোখে উপমা রহমানের নির্লিপ্তভাবে ঘুমের চেষ্টা করার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোলবালিশটা ছুড়ে ফেলে ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় উপমা। বারান্দায় গিয়ে ইজি চেয়ারে শরীর এলিয়ে দুলতে থাকে। সামনে কালো নিকষ অন্ধকারের মাঝে লক্ষ লক্ষ তারা উপমার চোখের সামনে মিটমিট করে জ্বলছে। উপমার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া চার পাশে আর কোনো শব্দ পাওয়া যায় না।

কখন যে সকাল হয়েছে তা টের পায়নি উপমা। টের পাওয়া মাত্রই বুঝতে পারে রাতটা সে বারান্দার ইজি চেয়ারেই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা সকাল নয়টার ঘরে। ঘর পুরো খালি। রহমান বেরিয়ে গেছে তার হসপিটালের ডিউটিতে। মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে এসে খাবার টেবিলে বসে সামান্য কিছু খেতে চেষ্টা করে। হঠাৎই চোখ চলে যায় দেয়াল ক্যালেন্ডারে। ক্যালেন্ডারে বড়ো বড়ো করে লেখা ৫ই ফেব্রুয়ারি সংখ্যাটা যেন ক্যালেন্ডার ফুড়ে উপমার চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। উপমা ভুলে যেতে চায় যে আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী। ‘তাদের’ কথাটা মনে করে হাসি পায় উপমার।

ঘরে পায়চারি করে উপমা। বারবার তার মন চাচ্ছিল রহমান ফোন করে তাকে হ্যাপি এনিভারস্যারি বলে একটা সারপ্রাইজ দিক। অবশ্য উপমা জানে তা কোনোদিনই হবার নয়। গত পাঁচ বছর ধরে রহমানকে দেখছে তো উপমা। এসব ফিলিংস তার মধ্যে একদমই নেই। রহমানের ফিলিংস জানার পরও উপমার মন বারবার মোবাইলে রহমানের ফোনের প্রত্যাশায় থাকে। শেষমেশ না পেরে উপমা নিজেই রহমানকে ফোন করে।

: আজকের দিনটা একদম ভুলে গেলে।

: আজ কি?

: তোমার একদম মনে পড়ছে না— আজ যে আমাদের একটা বিশেষ দিন।

: নাতো?

: তুমি এমন কেন, আজ যে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী তা কি ভুলে গেছ?

: ওহ তাই? দুঃখিত মনে না রাখার জন্য। তুমি রেস্ট নাও। আমি অপারেশন করতে ঢুকব।

: আমি রেস্ট চাই না। আমি আজকের দিনটায় শুধু তোমাকে চাই। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে চাই। তুমি কি এসব কিছু বোঝ না?

: স্যরি ডিয়ার, আমাকে এখন ওটিতে ঢুকতে হবে— বলে ফোনটা রেখে দেয়।

ফোন কেটে দেবার পর উপমার কানে বাজতে থাকে শুধু রহমানের ‘স্যরি ডিয়ার’ শব্দটা। উপমা ভাবে— যাক লোকটা তাহলে ডিয়ার শব্দটা জানে। জীবনে এই প্রথম লোকটার মুখে ডিয়ার কথাটা শুনল উপমা। তাহলে কি ধীরে ধীরে লোকটার মন গলছে? তার স্বামী আসলে রোবট নয়, মানুষই? হঠাৎ ভালো লাগায় ভরে যায় উপমার মন। ভালো লাগা থেকে উপমা ঘরের কাজ করতে ছুটে যায়। সদ্য বিবাহিতা তরুণী বউটির মতো একবার বিছানা ঝাড়ে তো আরেকবার স্বামীর এলোমেলো করে রাখা কাপড়গুলো গোছায়। আজ তাদের বিবাহবার্ষিকীর কথাটা মনে করে স্বামীর পছন্দের পাঁচফোড়নসহ মাংস রাঁধে। রান্নার সময় উপমা এমনভাবে রাঁধতে থাকে যেন আজই রহমান প্রথম তার রান্না খাবে। বারে বারে ঝোল চাখে। একবার মরিচ চাখে তো আরেকবার হলুদ। শেষমেষ স্বামীর মন নরম করার জন্য একটু চিনিই যেন মাংসে ছিটিয়ে দেয়। চিনি দিয়ে জিভ কাটে উপমা। কিন্তু চেখে দেখে মন্দ হয়নি। রান্নার পর আজ বিশেষ দিন দেখে একটু সাজেও যেন। রোবট রহমানের কাছ থেকে আজও জানা হয়নি উপমার— সে তার বউয়ের হালকা না ভারী সাজ পছন্দ করে। সাজগোজ করে এঘর ওঘর পায়চারি করে উপমা। ঠিক করে আজ আর দুপুরে একা সে খাবে না। রহমান নিশ্চয়ই আজকের দিনটি মনে করে হলেও বাসায় খেতে আসবে। সেইসাথে কয়েকটা গোলাপ যদি তার জন্য নিয়ে আসে তাহলে তো কথাই নেই। কত্ত কিছু যে আবোল-তাবোল ভাবে উপমা!

আজ তাদের বিবাহবার্ষিকীর কথাটা মনে করে স্বামীর পছন্দের পাঁচফোড়নসহ মাংস রাঁধে। রান্নার সময় উপমা এমনভাবে রাঁধতে থাকে যেন আজই রহমান প্রথম তার রান্না খাবে। বারে বারে ঝোল চাখে। একবার মরিচ চাখে তো আরেকবার হলুদ। শেষমেষ স্বামীর মন নরম করার জন্য একটু চিনিই যেন মাংসে ছিটিয়ে দেয়।

ওদিকে ঘড়ির কাটা শুধু টিকটিক করে বয়েই চলে। এক সময় ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে উপমার। চোখ যখন খোলে উপমা— দেখে ঘর অন্ধকার। চারপাশে মশা ছাড়া উপমার দ্বিতীয় সঙ্গী নেই। সকাল-দুপুরের প্রচণ্ড ভালোলাগাটা তার মন আর শরীরে এতটুকু অবশিষ্ট নেই। পূর্বের সেই ক্লান্তি তার উপর যেন আবারও চেপে বসে। মাথাটা দপদপ করতে থাকে উপমার।

অবশেষে রাতে রহমানের আর দশটা দিনের মতোই গৃহপ্রবেশ। উপমার মনে হয় কোনো মানুষ নয় একটা রোবট যেন তার চারপাশে ঘুরছে। উপমার সকালের ঘর সাজানো, রান্না করা, গোলাপফুল, বিবাহবার্ষিকী এসব কথা মনে করে বমি আসতে থাকে যেন। ইচ্ছা হয় আরও কয়েকটি ঘুমের ঔষুধ গিলতে। কিন্তু কার জন্য এসব গেলা? সে কি বুঝবে তার কষ্ট?

উপমা তাই আগামীকাল থেকে কোনো কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত রাখতে চায় নিজেকে। সকাল থেকেই নিজের কষ্টকে চাপা দিয়ে উপমা শুধু ভাবতে থাকে কি করলে তার এই দুঃসহ জীবন যাপন থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে। বারান্দায় ধুলো পরা হারমোনিয়ামের দিকে চোখ যায় তার। বিয়ের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে সে গান গাইতো। বাবার বাড়ি থেকে হারমোনিয়ামটা নিয়ে এলেও একদিনের জন্যও গলা সাধা তার হয়নি। সে বোঝে গান নিয়ে ব্যস্ত থাকা তার দ্বারা হবে না। একপাশে অবহেলায় সরিয়ে রাখে হারমোনিয়ামটা।

তাহলে সে কী করবে? কী করবে? কী করবে? উপমার চোখে কেবল ভাসতে থাকে বিভিন্ন রংয়ের সিডাস্কিন।

সিডাস্কিনের চিন্তাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করে উপমা। মাথা থেকে পুরোটা যায়ও না যেন। উপমা টলানো পা নিয়ে হেঁটে যায় বাড়ির একরুমের ছোট্ট লাইব্রেরিতে। উপমা আসার আগে এ বাড়িতে ডাক্তারি পেশার বই ছাড়া আর কোনো বই ছিল না। রোবটের মতোন স্বামীর সাথে ক্লান্তিকর জীবনযাপনের মধ্যম পর্যায়েই উপমা বুঝেছিল বইয়ের কাছেই তার দারস্থ হতে হবে। আর তাই বাড়ির এই রুমটিকে নিজ হাতে বই দিয়ে সাজিয়েছে। লাইব্রেরির বেশির ভাগ বই-ই তার নিজের, পুরোনো। এক সময় কতই না বই পড়ত উপমা! খেতে খেতে পড়ত, হাঁটতে হাঁটতে পড়ত, রান্না চড়িয়ে গল্পের বইয়ে ডুবে গিয়ে রান্না পুড়িয়ে মায়ের বকা খেত উপমা।

দাদী তার মাকে বলতেন, আরে বিয়ের পর বই পড়া কোথায় যাবে! মেয়ে মানুষের বিয়ের পর বইয়ের খোঁজ রাখার সময় কই? স্বামী ওকে বইয়ের কাছে ঘেষতে দিলে তো! তখন তারা দু জন দু জনকে নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকবে যে, বইগুলো তখন হবে কেবল উইপোকার খাবার।

মা আর দাদীর এসব কথা শুনে উপমা মনে মনে দারুণ লজ্জা পেত। সত্যিই তার জীবনে এমন একজন আসবে যে তার সব অস্তিত্বকে নিমিষে উড়িয়ে দিয়ে তার সমগ্র দখল করে নেবে— ভাবত উপমা। অতীত থেকে ফিরে উপমা ভাবে দখল করে নেওয়া তো দূরের কথা সামান্য জায়গাও পায়নে সে তার স্বামীর মনে।

বিষণ্ন উপমা কোনো বইয়েই বেশিক্ষণ মনোনিবেশ করতে পারে না। শুধু তার চোখগুলো কালো অক্ষরের উপর দৌড়াদৌড়ি করে। উপমা আরও বই হাতরায়। এই সেলফ থেকে ওই সেলফে হাতড়াতে হাতড়াতে জীবনানন্দের কবিতার বই বের হয়ে আসে। বইয়ের ভাঁজ খোলার সাথে সাথে অসংখ্য ছোটো ছোটো চিরকুট টুপটুপ করে পড়তে থাকে নিচে।

উপমা হাঁটু ভেঙে বসে। ওমা, এই চিরকুটগুলো এখানে এলো কীভাবে? তবে কি বন্ধু সজলের দেওয়া চিরকুটগুলো সে তার প্রিয় কবির বইয়ে রেখেছিল? বই রেখে খুঁজে পাওয়া চিরকুটগুলো নিয়ে বসে সে। অনেক দিন পর ভালোলাগার একটা অনুভূতি ফিরে আসে যেন উপমার জীবনে। চিরকুটগুলোর গন্ধ নেয় উপমা।

উপমা হাঁটু ভেঙে বসে। ওমা, এই চিরকুটগুলো এখানে এলো কীভাবে? তবে কি বন্ধু সজলের দেওয়া চিরকুটগুলো সে তার প্রিয় কবির বইয়ে রেখেছিল? বই রেখে খুঁজে পাওয়া চিরকুটগুলো নিয়ে বসে সে। অনেক দিন পর ভালোলাগার একটা অনুভূতি ফিরে আসে যেন উপমার জীবনে। চিরকুটগুলোর গন্ধ নেয় উপমা।

চিরকুটগুলো পড়ছিল আর হাসছিল। ভাবছিল, হায়রে পাগল ছিল সজল! চিরকুটগুলো পড়তে পড়তেই সজলকে কবে শেষ দেখেছিল তা মনে করার চেষ্টা করেও সে। স্পষ্ট কিছু নয়, ভাসা ভাসা মনে পড়ে— সজল কোনো এক বিষয়ে অতি তুচ্ছ একটা মিথ্যা বলছিল উপমাকে। যা নিয়ে উপমার মাথা ঘামাবার কথাই নয়। কিন্তু উপমা বেশ একটা গালি দিয়েছিল সজলকে।

সজল বলেছিল— ‘এই ওষ্ঠ বলছে নীরাকে ভালোবাসি, এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যা কি মানায়’? উপমা বুঝেছিল সজলের মনের অবস্থা। পারিবারিক বিভিন্ন সংস্কার, দু জনের বয়স সবকিছু চিন্তা করে উপমা সজলকে এরপর আর বেশি প্রশ্রয় দেয়নি। সজলকে এড়িয়ে চলতে চলতে সত্যিই সজল চলে গিয়েছিল উপমার জীবনের বাইরে। জীবনানন্দের বই আর চিরকুটগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে উপমা তাকিয়ে ভাবে, ‘সত্যিই জীবনে পাগলামির দরকার আছে’।

হঠাৎ ডোরবেলের শব্দে সচকিত হয় উপমা। দৌড়ে দরজা খোলে সে। ভীষণ ক্লান্ত ভঙ্গিতে রহমান ঘরে ঢোকে। উপমা তাকে একটু জিরিয়ে নিয়ে খেতে আসতে বলে। কিন্তু রহমানের যেন সময়ের খুব অভাব। ঘরে ঢুকেই কাপড় ফেলে গোসল করে বেড়িয়েই খাবার টেবিলে বসে সে। গপাগপ খেয়ে যায়।

: আজ খুব বেশি ক্লান্ত লাগছে? কয়টা অপারেশন করেছ?

রহমানের উত্তর নেই।

: কিছু হয়েছে?

রহমান শুধু গপাগপ খেয়ে যায়।

: তোমাকে আর একটু সজনে-ডাল দেই।

রহমানের উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই রহমানের পাতে ডাল ঢেলে দেয়।

: কেমন হয়েছে?

: হু।

: হু কি?

: ভালো।

রহমানের যেন খুব তাড়া উপমাকে পাশ কাটানোর। আর উপমা যেন তাকে আরও বেশি কাছে টানার জন্য ব্যাকুল। খাবার থেকে ছাড়া পেয়েই রহমান টিভি সেটের সামনে খেলার চ্যানেল নিয়ে বসে। উপমাও পাশে গিয়ে বসে। খেলা না বুঝলেও উপমা রহমানকে সঙ্গ দিতে চায়।

রহমানকে দেখে মনে হয়, উপমা রহমানের পাশে থাকায় রহমানের ভারী অস্বস্তি হচ্ছে। কেমন যেন একটা আরষ্টভাব রহমানের। উপমার খুব ইচ্ছা হয় রহমানের পায়ের উপর পা দিয়ে বসে খেলা দেখতে। কিন্তু রোবট স্বামীর পায়ে পা না দিয়ে আলতোভাবে কেবল হাতটা ছোঁয় উপমা। কোনো অনুভূতি নেই রহমানের। যেন পাশে কোনো মানুষ নেই। সামনে জড়বস্তু টিভির ভেতরেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। উপমা বেশ কয়েকবার হালকা চিমটিও মারে রহমানকে। তাতেও নড়নচড়ন নেই তার। উপমার মনে হয় এ কী জীবিত নাকি মৃত মানুষ? ইশারা, ইঙ্গিত, স্পর্শ কোনোকিছুতেই যখন তাকে জাগানো যায় না তখন উপমা কথার আশ্রয় নেয়।

: খেলা দেখতে দেখতে কিছু খাবে?

রহমান না সূচক মাথা নাড়ে।

: খাও না! কোক আনি। কোক খেতে খেতে খেলা দেখো।

: তোমার ইচ্ছা।

উপমা ভাবে, যাক রোবটের দেহে তবে ধীরে ধীরে উপমার প্রতি আগ্রহ আসছে। উপমা সোফা ছেড়ে দৌড়ে যায় খাবার রুমে। ফ্রিজ থেকে নিয়ে আসে কোকের বোতল। দুজনে একসাথে বিয়ের এতবছর বাদে কোক খেতে খেতে খেলা দেখবে— ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয় উপমা। আনন্দের আতিশয্যে কোক ঢালতে গিয়ে অনেকখানি কোক পড়েও যায়। ভিজে যায় উপমার নিজ পছন্দে কেনা দামী কার্পেট। কিন্তু উপমার আজ আর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। কোক ঢেলে তাতে বরফ কুচি দিয়ে স্বামীর হাতে দেয় সে।

বোকার মতো স্বামীকে প্রশ্ন করে উপমা— কেমন লাগছে কোক?

: কোকের আবার ভালো মন্দ কী?

নিজের প্রশ্নে নিজেই লজ্জিত হয় যেন উপমা।

উপমা বলে আমার ইচ্ছেতেই কোক খাচ্ছ, তাই না? আমি না খেতে দিলে কি খেতে?

: না।

পরক্ষণেই উপমা বলে— না বলছি আর কী, আমার সাথে বসে খেলা দেখছো তা কেমন লাগছে?
রহমান নিরুত্তর।

: আমি যে এত রাতে সেজেগুজে বসে তোমার সাথে খেলা দেখছি, তা কি তুমি লক্ষ্য করেছ?

রহমান গলায় কেবল কোক ঢালে। ফিরে তাকায় না উপমার দিকে।

উপমা তার স্বামীর মুখ থেকে শুনতে চায়— আজ তাকে কেমন লাগছে?

রহমান ঠায় টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে।

: তোমার কি আমার ইচ্ছাগুলোর কোনো দাম দিতে ইচ্ছে করে না?

রহমান নিরুত্তর।

উপমা আবারো বলে— একবার বল আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? যদি খারাপ লাগে তবে তাই বলো।

উপমার হাত থেকে বাঁচার জন্যই বোধহয় রহমান বলে— ভালো।

: আমার রূপে কি তোমার আঁখিতারা দুটো ডুবে মরতে চাচ্ছে?

রহমান নিরুত্তর।

উপমা আবারো খোঁচায়।

: তুমি কি জানো এটা আমার কথা নয়, এটা একটা কবিতার লাইন।

রহমান নিরুত্তর।

উপমা বলে— এত বছর আমার সাথে আছো, আমার কী ভালো লাগে তোমার?

: রান্না।

উপমা খুশি হয়ে বলে— তাহলে তুমি নিজে থেকে কেন এ কথাটি আমাকে বলনি?

: এটা বলার কি আছে!

: তুমি কি জানো দাম্পত্য জীবনে যে মাঝেমাঝে Compliments এর দরকার হয়?

রহমান নিরুত্তর।

: আমার কোন দিকটা তোমার খারাপ লাগে এবার বলো।

: ভেবে দেখিনি।

: আচ্ছা এবার বলো তো আমার জন্মদিন কবে?

রহমান নিরুত্তর।

: জানো, আমি তোমার জন্মদিন সর্ম্পকে সব জানি। তুমি জন্মেছো ভরা শীতের রাতের বেলায়। আমার খুব কাঁথা পেঁচানো ছোটো রহমানের ছবি দেখার শখ ছিল। আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে সব শিশুর মতোই জন্ম মুহূর্তে তুমি কোমল ছিলে নাকি গম্ভীর ছিলে?

তোমার কি আমার মতোই আমার বিষয়ে এসব জানতে ইচ্ছে হয়নি?

রহমান বেশ রাগত স্বরে বলে— না।

উপমা বলে— কিন্তু কেন? চার দেয়ালের মাঝে আমাদের শুধু দু জন মানুষের বাস। আমরা কি আমাদের দু জনের সবকিছু জানব না? তা না হলে কি বাঁচা যায়, তুমি বল?

রহমান বলে— বাঁচার জন্য এসব লাগে না। বাঁচার জন্য যা যা প্রয়োজন তা আমাদের সব আছে। এসব স্রেফ ন্যাকামি।

রহমানের কথা শুনে উপমার কিছুটা আশাভঙ্গই হয় যেন।

: সব স্বামী-স্ত্রীরা কত জায়গায় ঘুরতে যায়। তোমার কি কখনো আমায় নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করে না?

: আমার সময় নেই।

: একজন আরেকজনের জন্য যদি সময় বের না করি তাহলে কি হবে! তুমি তোমার পেশেন্টদের সময় দাও না?

: হু।

: আমাকেও তো তোমার পেশেন্ট ভেবে কিছুটা সময় দিতে পার— তাই না?

রহমান একটু ব্যাঙ্গাত্মক হাসে।

: আচ্ছা, তুমি তো কার্ডিওলজিস্ট? কত মানুষেরই না হার্টের চিকিৎসা কর— তাই না?

: হু।

: আমার মনে হয় আমার হার্টের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। তুমি কি একটু চিকিৎসা করবে?

রহমান বেশ বিরক্ত হয়ে বলে— তোমার মাথা বোধহয় ঠিক নাই। আবোল তাবোল বকছো কেবল। তুমি ঘুমাতে যাও। আমি তোমার জন্য খেলা দেখতে পারছি না।

উপমা বলে, আমার চেয়েও কি তোমার খেলা দেখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

রহমান কিছু না বলে খেলা দেখা ছেড়ে বিছানায় যায়। রহমানের পিছু নেয় উপমা। বিছানায় গিয়েই একপাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকে রহমান। উপমা গিয়ে রহমানের গায়ে গড়িয়ে পরে।

রহমান নির্বিকার থাকে।

: আচ্ছা তোমার কি এখন আমাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে না?

: আমি টায়ার্ড।

: একজন নারী তোমাকে বিছানায় ডাকছে এ সময়ও তোমার টায়ার্ড লাগছে? তুমি কি জীবন্ত মানুষ না মৃত, রোবট নাকি অন্যকিছু? তোমার কি আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না? তোমার কি আমার কোনো ব্যাপারে আগ্রহ আসে না? তুমি এমন কেন? তুমি কি বোঝ না এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না। শুধু পেট ভরা থাকলেই হয় না, ভালোবাসা লাগে জীবনে। চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বলে উপমা বালিশ ছুড়তে থাকে রহমানের দিকে।

রহমান উপমাকে পাগল বলে বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যায়।

উপমা একা বিছানায় শুয়ে কাঁদতে চায়। কিন্তু পারে না। তার কেবল হাসি আসতে থাকে। তার কানে বাজে তাকে করা তার স্বামীর উক্তি ‘পাগল’। উপমা মনে মনে হাসে আর বলে আমি পাগল তাই না? আমি পাগল। আরে পাগলামির তুমি কী বোঝ?

উপমা একা বিছানায় শুয়ে কাঁদতে চায়। কিন্তু পারে না। তার কেবল হাসি আসতে থাকে। তার কানে বাজে তাকে করা তার স্বামীর উক্তি ‘পাগল’। উপমা মনে মনে হাসে আর বলে আমি পাগল তাই না? আমি পাগল। আরে পাগলামির তুমি কী বোঝ? তুমি তো একটা যন্ত্র। শুধু ছুড়ি দিয়ে হার্ট কাট আর হার্ট বন্ধ কর। জানো কি এই হার্টের আসল কাজ কী? তুমি কী তা জান? জানি, জানো না। যাদের হৃদয় আছে তাদেরকে তোমার মনে হয় পাগল। তুমি তো জানো না— ‘সত্যিই এ জীবনে পাগলামির কতটা দরকার আছে’।

উপমা কথাগুলো নিজের মধ্যে কেবল আউরাতে থাকে। বিছানা থেকে টলতে টলতে উঠে উপমা এগিয়ে যায় ড্রয়ারের দিকে। যেখানে রাখা আছে অজস্র স্লিপিং পিল। পিলগুলো হাতে নিয়ে উপমা খেলতে থাকে। মনে হয় যেন এরাই উপমার আসল ভালোবাসা। মুঠোভর্তি স্লিপিং পিল গলাধকরণ করে উপমা হাসতে থাকে আর আউরাতে থাকে ‘তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলি…’।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

হুমায়ুন আজাদ কন্যা। উপপরিচালক : ইউজিসি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।