বুধবার, মার্চ ২৭

ভুঁইচাপা : রোমেল রহমান

0

সারা রাত তুলকালাম ঝড় শেষ হবার পর, ভোরে যখন ফিচফিচে বৃষ্টি শুরু হয় আব্দুল জলিল তখন ছাতা নিয়ে বের হন জঙ্গলের গাছগুলো দেখতে! বের হতেই উঠোনে আব্দুল জলিল দেখেন একটা আস্ত মানুষের মাথা পড়ে আছে! যেন ধড় থেকে মাথাটা ছিঁড়ে কেউ ফেলে রেখে গেছে। এখনো রক্ত স্পষ্ট! মাথাটার চোখ পিটপিট করছে! তার মানে মাথায় প্রাণ আছে! আব্দুল জলিল এগিয়ে যান, মাথাটার কাছাকাছি যেতেই মাথাটা বলে ওঠে, ‘ভালো আছেন জ্ঞানী মানুষ? একটু পানি দেওয়া যায়? পিপাসা লাগছে খুব!’ মাথাটার মাথা ভর্তি দীঘল চুল! আব্দুল জলিল মাথাটার চুল ধরে ঘরে নিয়ে আসেন! কয়েক বছর আগে তার এক বন্ধু এখানে জীবনযাপনের জন্য এসেছিলেন একটা অ্যাকুরিয়াম সঙ্গে নিয়ে! মাছ-শূন্য সেই চারকোনা অ্যাকুরিয়ামের কাচের মধ্যে মাথাটাকে ফেলে দিয়ে আব্দুল জলিল কয়েক মগ জল ঢেলে বেরিয়ে যান গাছগুলো দেখতে!

মাথাটার চোখ পিটপিট করছে! তার মানে মাথায় প্রাণ আছে! আব্দুল জলিল এগিয়ে যান, মাথাটার কাছাকাছি যেতেই মাথাটা বলে ওঠে, ‘ভালো আছেন জ্ঞানী মানুষ? একটু পানি দেওয়া যায়?

আব্দুল জলিল তার বাড়ির চারদিকে ছড়ানো জমিতে বিচিত্র গাছ লাগিয়ে জঙ্গল সাজিয়েছেন। গ্রামের লোকেরা এখন ডাকে জঙ্গলবাড়ি! আব্দুল জলিল এই বিরাট জায়েদাদ নিয়ে থাকেন। সঙ্গে থাকে এক তরুণী। গ্রামের দুষ্ট লোকেরা বলে এই মেয়ের সঙ্গে আব্দুল জলিলের ফষ্টিনষ্টি!

আব্দুল জলিল তার ‘নবরাষ্ট্র কাঠামো’ প্রকল্প ভাবনার জন্য এইখানে তার জ্যান্ত মাজার স্থাপন করেছিলেন! আব্দুল জলিল ঝিম মেরে থাকতে পছন্দ করেন বলে হয়তো গাছপালা নিয়ে থাকেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন নবরাষ্ট্র কাঠামো ভাবনার বিবিধ দিক-দর্শন, আলাপ বিলাপ নিয়ে! সম্ভবত বৃক্ষদের জবান গণমাধ্যম শুনতে পায় না এটা তার জন্য আপাত সুখকর! তার একরোখা জীবনের মধ্যে আচমকা একটা মাথা উড়ে এসে পড়ায় নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি হবার কথা! কিন্তু আব্দুল জলিল নিরাসক্ত ভাবে মাথাটাকে ঘরে তুলে নেন!

আব্দুল জলিল বিদেশ থেকে আচমকা দেশে ফিরে আসেন নাড়ীর টানে কিংবা গণহিতসাধনের বাসনা নিয়ে। কেননা তিনি একরাতে স্বপ্নে দেখেন, কার্ল মার্কসের ছবিতে একটা ছোরা বসানো আর ঠিক তার পাশের ফ্রেমে তার একটা বিরাট ছবি! এর পরই দেশে ফিরে তিনি এই বিরাট ভূমি ক্রয় করেন! দেশে থাকার সময়ে রাজধানীতে তিনি জানান দিয়ে আসেন তার পুরানা অনুসারীগণের মধ্যে যে, এই রাষ্ট্রকাঠামো ভুয়া! চাই একটা নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা! তরুণেরা চিরকাল আগুন ভালোবাসে বলেই সময় লাগে না আব্দুল জলিলের ইশারায় লাফিয়ে উঠতে অগ্নিশিখাদের! ‘রাজধানী ছাড়’ নামের আহ্বান তরুণ চিন্তকদের চিন্তার জলে ঢিল ছুঁড়ে তরঙ্গ তোলে! ফলে তারা দলে দলে নেমে আসতে থাকে আব্দুল জলিলের এই গ্রামে! আব্দুল জলিল তার অতি মেধাবী তরুণ বন্ধুদের জন্য এই বাড়ির ভেতরে সারি সারি কুঠুরি বানিয়ে দেন! সেই সব ঘরে আব্দুল জলিলের যুবক যুবতী বন্ধুরা স্ব-সঙ্গী বসবাস এবং তত্ত্ব চর্চা শুরু করেন! সন্ধ্যায় বসে, ‘ভাবনা আলাপ’ নামে আসর—যেখানে প্রত্যেকে নির্ধারিত বিষয়ে তাদের ভাবনা উপস্থাপন করেন! এই অংশে সবাই মৌন হয়ে একে একে সকল আলাপির আলাপ শোনেন! এর দ্বিতীয় অংশের নাম ‘তর্ক বাসর’ এই অংশটা দুর্দান্ত! এখানে সবাই একে অপরকে ছিঁড়ে ফেলে নির্দয় তর্ক দিয়ে! এর থেকে নির্যাস নিয়ে আব্দুল জলিল তার ভাবনাকে যোগ বিয়োগ করতেন! এবং ফলাফলগুলো নবরাষ্ট্র কাঠামোর মুখপত্র ‘নবচিন্তায়’ মুদ্রিত হয়ে সমগ্র দেশের তরুণ বুদ্ধিকারদের মধ্যে একটা হুল্লোড় তুলত! গ্রামের লোকেরা যদিও আব্দুল জলিলের এই কীর্তি নিতে নারাজ হয়ে ওঠেন! কেননা তারা আব্দুল জলিলের এই বিদ্রোহের সূতিকাগারকে বলে, বেলেল্লাখানা! তবু গ্রামের লোকেরা আব্দুল জলিলের কিছুই ছিঁড়তে পারে না।

গ্রামের লোকেরা যদিও আব্দুল জলিলের এই কীর্তি নিতে নারাজ হয়ে ওঠেন! কেননা তারা আব্দুল জলিলের এই বিদ্রোহের সূতিকাগারকে বলে, বেলেল্লাখানা! তবু গ্রামের লোকেরা আব্দুল জলিলের কিছুই ছিঁড়তে পারে না।

কেননা তিনি বিদেশ থেকে যেই সুতা বেয়ে এসেছেন এখানে সেই সুতার মাঞ্জায় যথেষ্ট ধার! ফলে আব্দুল জলিল আরেক কাণ্ড ঘটান এবার! তিনি তার শিষ্যদের অনুরাগি শিষ্যদেরও আনতে শুরু করেন এবং তাদেরকে এই বাড়িতে ঠাঁই না দিয়ে ছড়িয়ে দেন গ্রামে! গ্রামের মধ্যে তারা থাকতে শুরু করে এবং সন্ধ্যায় আব্দুল জলিলের বাসায় আয়োজিত চিন্তা ভাবনার মজমায় জমায়েত হয়ে শূন্য ভান্ড পূর্ণ করে নিয়ে জীবন যাপন করতে থাকে! ফলে তাদের জীবন যাপনে নবচিন্তার ছিটেফোঁটা থাকায় সেগুলো চু্ইয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে গ্রামের মাটিতে এবং গ্রামের লোকদের সাথে তাদের বিবাদ লাগতে শুরু করে! ব্যাপারটা আব্দুল জলিলকে আনন্দ দেয়। কেননা, তিনি টের পান যে তার বাহিনীর কাজ জমিনে ছড়াতে শুরু করেছে! ‘বিবাদ থেকেই আবাদ!’ এই ফর্মুলা দিয়েছিল তার এক শিষ্য! এই ছেলের নাম বিহঙ্গ! এটা তার ছদ্ম নাম! মূল নামের বিলুপ্তি ঘটিয়ে সে এই নাম নিয়েছে! সঙ্গে আছে তার বান্ধবী পাতা! এই মেয়ে এক বিদুষী! এরা দুজনে এখানে এসে জানিয়ে দিয়েছে তারা এসেছে মূলত ব্যাপারস্যাপার দেখতে! তারা কেউ আব্দুল জলিলের শিষ্য নয়! এই শেষের বাক্য শুনে আব্দুল জলিলের আগ্রহ জন্মেছে এদের উপর! তারপর তিনি একটি কুঠুরি খুলে দিয়েছেন এই যুগলকে। যেন এরা আনন্দে থাকতে পারে এবং চিন্তায় শরিক হতে পারে! প্রথমদিনের তর্কে এরা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলে দেয় এবং জানিয়ে দেয়, ‘…আপনাদের এই মিউমিউ কারবারে কিচ্ছু হবে না! রাষ্ট্র কিছু ক্লাউন পোষে, বা পুষতে হয় চিন্তার দুনিয়া স্বাভাবিক আছে এটা বিশ্ববাসীকে দেখাতে, সেই প্রকল্পের মধ্যে আপনারা তেল হিসেবে কাজ করছেন! গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের কাসুন্দিতে কয়েক ফোটা বাউল ফকিরি ভাবের যেই লেবেল জুড়ে নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর হুজুক তোলা হচ্ছে তার পাত্রে একটা বড়ো ফুটো হচ্ছে আপনারা সবাই ভেবেই যাচ্ছেন জনগণকে ভাউরা! মানে আপনারা নিজেরা আমোদে খাচ্ছেন দাচ্ছেন, যে জীবনের কথা বলছেন সেই জীবন নিজেরা যাপন না করেই! এবং আপনারা সেটা আপনাদের সমান স্তরের সাথে আলাপ করে যাচ্ছেন জনগণকে বাইরে রেখে! জনগণ কি আপনার সমান মেধাবী নাকি আপনি তাদের থেকে নিম্ন মানের?’ এইসব বাক্যের পর আব্দুল জলিলসহ সকল তরুণ বুদ্ধিজীবীরা বিব্রত কিংবা ধাক্কা খায়! ফলে তরুণদের একটা দল বিহঙ্গ এবং পাতার ভক্ত হয়ে ওঠে! তারা ওস্তাদ বলে ডাকতে থাকে! পাতা আব্দুল জলিলকে বলে, ‘…আপ্নে আপনার তথাকথিত শিষ্যদের শিষ্য যারা আছেন তাদেরকে ডাকেন এইখানে এবং গ্রামে ছড়ায়ে দেন! তারা হাঙ্গামা লাগাক!’ এই ফর্মুলার নিরিখে আব্দুল জলিল ডাকে সবাইকে! বিহঙ্গ বলে, ‘…এই ছেলে-মেয়েগুলো গ্রামে যেইসব সমস্যা বা সংঘাতে জড়াবে তার থেকে আমরা সমাধান বের করে আনব! প্রতিটা বিষয়কে দেখতে হবে আক্রমণকারীর আক্রমণ করার কারণ কি এবং কেন সে আক্রমণ করে এই হিসেবে! এবং কীভাবে আমাদের কাজটা করলে সে আক্রমণ করত না সেই রাস্তার সন্ধান আমাদের করতে হবে!’ ফলে আব্দুল জলিল টের পায় এদের রাস্তায় আগালে তার নাম ছড়াবে! কাজ আগাবে! এদের ব্যক্তিগত চাওয়াপাওয়া তেমন কিছু নাই! এই আন্দোলনের সকল ফলাফল তার নামেই প্রচারিত হবে—ফলে ভয়ের কিছু নাই! এবং আব্দুল জলিল তার প্রকল্প ভেঙে দিলেন একদিন সান্ধ্য আড্ডায়! তিনি জানালেন আমাদের আপাতত কাজ হয়ে গেছে এখন আপনারা ছড়িয়ে পড়েন দেশের নিজ নিজ প্রান্তে! আবার যখন দ্বিতীয় ফিকিরের কাজ শুরু হবে তখন সবাই আসবেন, জমায়েত হবে!

উপস্থিত তরুণ বুদ্ধিকারীদের মধ্যে আচমকা হিজিবিজি লেগে যায়! তারা চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে অনাস্থা জানায় আব্দুল জলিলের উপর! কিন্তু তার ভূমিতে বসে তার বিরোধিতা টেকে না! ফলে এই তরুণদের ঝাঁক ফিরে যায় হতাশা নিয়ে! তারা বেশিরভাগই ফেরে রাজধানীতে! সেখানে তারা প্রথমত আব্দুল জলিলের গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে এবং সে যে একজন এজেন্ট এই জাতীয় প্রচারণা জারি রাখে যা আব্দুল জলিলকে আরও বিখ্যাত করে তোলে এবং রাষ্ট্র চিন্তিত হয়ে ওঠে একটা নতুন বিশৃঙ্খলার আশংকায়!

যদিও আব্দুল জলিলের সঙ্গে বিহঙ্গের বিরোধ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেননা আব্দুল জলিলের নিয়ত পরিষ্কার লাগে না বিহঙ্গের কাছে! ফলে একদিন এমন ঝড়ের রাতে আব্দুল জলিল বিহঙ্গকে পুঁতে ফেলে বাগানের গভীর মাটিতে! পাতা এর কিছুই টের পায় না

আব্দুল জলিল বিহঙ্গ এবং পাতাকে রেখে দেয় তার বাড়িতে! তারা তিনজন চিন্তার বিকাশ ঘটাতে শুরু করে! যদিও আব্দুল জলিলের সঙ্গে বিহঙ্গের বিরোধ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেননা আব্দুল জলিলের নিয়ত পরিষ্কার লাগে না বিহঙ্গের কাছে! ফলে একদিন এমন ঝড়ের রাতে আব্দুল জলিল বিহঙ্গকে পুঁতে ফেলে বাগানের গভীর মাটিতে! পাতা এর কিছুই টের পায় না কেননা তাকে তার প্রিয় মাদকে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল সেই রাত্রে! ফলে পরদিন থেকে পাতাকে আটকে রাখা হয়! দীর্ঘ বন্দিত্বের একটা স্তরে পাতা আব্দুল জলিলের আনুগত্য মেনে নেয় কিংবা সে অভিনয় করতে থাকে আনুগত্যের। মূলত সে খুঁজে যাচ্ছে বিহঙ্গকে!

বহু বছর পর গত পরশু বিহঙ্গের মাথা ভুঁইচাপা থেকে মাটি ফুঁড়ে জেগে ওঠে বনের গভীরে। যেখানে তাকে পুঁতে রাখা হয়েছিল! কিন্তু আচমকা গতরাতে উন্মাদ ঝড় ওঠে—যা রাষ্ট্রের মতো নির্দয়—সেই ঝড়ের ঝাঁপটা তাকে গোড়া থেকে ছিঁড়ে সেই বাগানের মধ্যে থেকে আব্দুল জলিলের উঠোনে এনে ফেলে!

আব্দুল জলিল যখন বাগানের গাছপালা দেখে ঘরে ফিরতে উঠোনের কাছাকাছি এসে পৌঁছান তখন তিনি দেখেন, পাতা একটা ছোট্ট গর্ত খুঁড়ে সেখানে বিহঙ্গের গলাটা বসিয়ে মাটি দিয়ে গেঁথে দিচ্ছে! মাথাটা জেগে আছে! ভেজা চুলগুলো শেকড়ের মতো মাটি স্পর্শ করে আছে! আব্দুল জলিল চুপচাপ এসে দাঁড়ায়! পাতা বলে, রাষ্ট্র আসলে আপনার মতো একটা চরিত্র! তবে আমি বিহঙ্গবৃক্ষ রোপণ করে দিলাম, এবার পাতা গজাবে! আমার অপেক্ষা শেষ হে ঘৃণিত প্রাজ্ঞ!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও নাট্যকার। প্রকাশিত কবিতার বই : বিনিদ্র ক্যারাভান (২০১৫, অনন্যা)। বাংলাদেশের খুলনায় থাকেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।