শনিবার, এপ্রিল ২৭

মৃতদের দেশে : মোস্তফা অভি

0

যখন আমার বয়স একুশ, আমার জীবনে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। ঘটনাটা আহামরি এমন কিছু নয় যা আপনাদেরকে আকর্ষিত করতে পারে। তবে কথাগুলো আপনাদের বলার জন্য আমি অপেক্ষা করছি আর আমার এটাও মনে হয়, কথাগুলো বলতে পারলেই আমার মুক্তি। সেদিন সন্ধ্যা থেকে শরীরটা বিবস, মনের ভেতর পুঞ্জীভূত মেঘগুলো বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়তে চাইছে। যদি আমি সমস্যাগুলোর কথা চিরকুটে লিখে একজন ডাক্তারের কাছে জানাই; তিনি আমার বুকের ওপর স্টেথোস্কোপ রেখে, একবার জিব দেখে আরেকবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলতে ফেলতে বলবে এটা— ইনসমনিয়া। গত কয়েকদিন ধরে আমার দুচোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই।

মেঘের দৈত্যগুলোর অট্টহাসি যেন বিদ্যুতের ঘন ঘন চমক, ওগুলো গুড়িম গুড়িম শব্দে জানালার বাইরে ফেটে পড়ছে। কয়েক মিনিট মেঘের দৈত্যরা এভাবে দাঁত কেলিয়ে অবশেষে অবসর নিয়েছে। ওদের অদৃশ্য উসকানি পেয়ে জানালার পর্দাগুলো হঠাৎ উড়তে শুরু করল। কয়েক মিনিট পর দেখি পর্দাগুলো জানালার সাথে আর মিশে নেই। ওগুলো গালিচার মতো অন্ধকারে আকাশের দিকে উড়ে চলছে।

আমার মনের অবস্থাটার কথা টের পেয়ে মেঘের দেশের প্রেতাত্মারা বুঝি উসকে গেছে। ওরা পুরো চরাচরে হল্লা করতে করতে বিল্ডিংগুলোর মাথার ওপরে রাশি রাশি কালো মেঘ জমা করেছে। মেঘের দৈত্যগুলোর অট্টহাসি যেন বিদ্যুতের ঘন ঘন চমক, ওগুলো গুড়িম গুড়িম শব্দে জানালার বাইরে ফেটে পড়ছে। কয়েক মিনিট মেঘের দৈত্যরা এভাবে দাঁত কেলিয়ে অবশেষে অবসর নিয়েছে। ওদের অদৃশ্য উসকানি পেয়ে জানালার পর্দাগুলো হঠাৎ উড়তে শুরু করল। কয়েক মিনিট পর দেখি পর্দাগুলো জানালার সাথে আর মিশে নেই। ওগুলো গালিচার মতো অন্ধকারে আকাশের দিকে উড়ে চলছে। পর্দাগুলোর সাথে আমিও ওদের পেছন পেছেন যে জগৎ, যে দেশ জীবনে কখনো দেখিনি, সেরকম একটা দেশে পৌঁছে গেলাম। সত্যিই আমি জানি না, ইহলৌকিক জগৎ ছেড়ে পরলৌকিক কোনো জগতে পৌঁছেছি কি না! আমার চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখছি—সুনসান এক নীরবতা, মেঘের সেই দানবগুলো কোথায়! মনে হয় আমাকে দেখে ওরা নিজেদের কোনো কোটরে লুকিয়ে রয়েছে। মর্ত্যের এক সাধারণ যুবকের অচেনা, অদ্ভুত দেশে একলা আগমনকে উপভোগ করছে ওরা। আমার পায়ের নিচের জমিনটা কালি মাখানো কালো খাটালের মতো মসৃণ, কালো। মাথার উপর দৃশ্যমান আকাশটা নির্ঘুম তাকিয়ে আছে চরাচরের দিকে। মনের ভেতর একগুচ্ছ অবরুদ্ধ বাসনার বেদনাময় ব্যঞ্জনা। অপরিচিত জগৎটা আচ্ছন্ন অদ্ভুত নীরবতায়।

আমি দূরের নিশানা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা নদী দেখতে পেলাম। নদীটা আরেকটি উন্মাতাল নদী থেকে লোকালয়ের দিকে প্রবেশ করেছে। পাড়ের দিকে পাতলা করে অল্প কয়েকটা বাড়ি-ঘর। সেখানে মানুষজন দেখা যায় না। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে রদ্যাঁর মতো মাটি দিয়ে তৈয়ার করা প্রাণহীন মানুষের পুতুল। মনে হয় পুতুলগুলো সুলেমান পয়গম্বরের বংশধর। আমি নদী থেকে বাঁক নেওয়া রাস্তাটা ধরে সামনে এগিয়ে চললাম। দৃষ্টির সীমানায় চোখে পড়ল ছোট্ট একটা বাজার।

আমি আশ্চর্য হয়ে ছয় বছর আগের সেই পরিচিত রমণীকে পথের মাঝে দেখলাম। কোনো সাজগোজ নেই, অনাড়ম্বর, গয়নাগাটিহীন যুবতী। শরীর থেকে সৌন্দর্য চুইয়ে চুইয়ে যেন অপরিচিত দেশের মাটিতে পড়ছে। আমি তাকে হাত উঁচু করে অভিবাদন জানালাম।

আমি ঠিক জানি না, কয়েক বছর আগের দিঘল রাতটির কথা তার মনে পড়ছে কি না! আমি যে বাড়িতে হাউস টিউটর ছিলাম, সে বাড়ির বড়ো মেয়ে ছিল সে। আমরা পাশাপাশি ঘরে ঘুমাতাম। পৃথিবীর বহু পরিচিত নারীকে নির্জন মধ্যরাতে আমি কল্পনা করতাম আর প্রায় প্রতি রাতেই কয়েকবার করে মাস্টারবেশন করে ঘুমাতাম। সেসময় আমার নির্ঘুম চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছিল। আর গালদুটো হয়ে গিয়েছিল ব্রণেভরা বিশ্রী, কদাকার। তবে আমি ঘুণাক্ষরেও পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা সুদর্শনাকে কল্পনা করতাম না। আমাদের থাকার ঘরটা টিনের ছিল বিধায় মাঝেমধ্যে আমি তার নড়াচড়া টের পেতাম। আর বুঝে নিতাম, যুবতী মেয়েটি আমারই মতন যে কাউকে কল্পনা করে অন্ধকারের দিকে চোখ তুলে তাকাতে তাকাতে রাত পার করছে। একদিন সেই সুন্দরী চুপিচুপি আমার ঘরে এলো। সে কোনো এক বাহানায় আমার মশারির ভেতর ঢুকে তার অস্থিরতার কথা প্রকাশ করল। আমি এতটাই ভিতুর ডিম ছিলাম, একবারের জন্যও তার দিকে সাহস করে হাত বাড়াতে পারলাম না।

আমি তাকে বললাম, বহুদিন পর আমাদের দেখা।

এটা সত্যি নাকি ভ্রম সেটা জানি না, তবে তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বহুবছর আগের চেনা একটা পথের দিশা পেয়ে গেলাম। যেটা ছিল তাদের বাড়িতে যাওয়ার সদর রাস্তা। কয়েক বছরের ব্যবধানে রাস্তাটার চেহারা পাল্টে গেছে অথচ সেই সময়, সেই স্মৃতি আর তখনকার সময়ের অনুভূতির গন্ধ আমি টের পেতে থাকলাম। সে আমাকে তার পেছন পেছন যেতে অনুরোধ করল।
মেয়েটি বলল—এটা তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে, আমি ছিলাম বহু যুবকের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের নারী। আর আমাকে ভেবে ভেবে ওরা অনন্ত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিত। আমাদের শহরেরই একজন সনাতন ধর্মের ছেলের সঙ্গে আমার ছিল প্রায় চার বছরের প্রেমের ইতিহাস। আমি সত্যি করে বলছি, তখনকার সময় আমি ঘটনাটা মোটেও জানতাম না। তাদের দুজনারই ছিল পারমার্থিক অনুরাগ আর একইসঙ্গে শারীরিক আকর্ষণ। দুজন দুজনকে ছাড়া ছিল অচল মানুষ। তাদের সম্পর্কের গভীরতা এতটাই নিবিড় ছিল যে, যুবতীর বিয়ের মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সনাতন ধর্মীয় যুবক অসুস্থ হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হলো না। কেমন এক অনির্বচনীয় দুঃখানুভূতি একজন প্রেমিকের মৃত্যু আমাকে ভাবান্তর করে দিল। মেয়েটির মনে কী চলছে আর সে কী অনুভব করছে জানি না। তবে আমি এখন নিজের অনুভূতিটাই বর্ণনা করতে পারি।

ধীরে ধীরে আমি যুবতীর মনের ভেতর প্রবেশ করতে লাগলাম। তার ভাবপ্রকৃতি যদিও একটু ধোঁয়াশার মতো, তবুও ছেলেটির মৃত্যুর জন্য তাকে ব্যথিত মনে করলাম। তার অশান্ত হৃদয় খোসা ছাড়ানো কমলালেবুর মতো নরম। ভেতরে গহিন অন্ধকার। ঠিক যেন আমাদের পায়ের তলার মাটির মতন। কিন্তু মেয়েটি ম্যাড়ম্যাড়ে গলায় শুধু সেই মৃত্যুটার কথাই বলল কিন্তু সেই মৃত্যুর আগে ছেলেটির যে যন্ত্রণা সেটা কতটা উপলব্ধি করেছে সে, কে জানে! মনে মনে আমার রাগ হলো তার ওপর। একবার ভাবলাম কৈফিয়ত চাই, কেন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সেই ছেলেটির ওপর। হঠাৎ বিশ্রী একটা গন্ধে চারপাশ ভরে গেল, আমার স্নায়ুতে কুটকুটে যন্ত্রণা, মেয়েটির বুক থেকে কাপড় খসে পড়ল। সেটা ঠিক করতে করতে বলল—ধর্ম, সব অধর্মই হলো ধর্মের মূল। অধর্ম হলো বেইমানি আর ধর্ম হলো আচার, বিশ্বাস। মানুষ মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও ধর্মের সংস্কার রক্ষা করতে মরিয়া।

প্রেম চির সত্য, অনেক বড়ো এর অর্থ, প্রেমের চেয়ে ধর্ম কখনো বড়ো নয়। আমি তাকে বললাম।

সেই সত্য আমিও উপলব্ধি করেছিলাম, মেয়েটি বলল। মানুষ টিনের বাক্সের ভেতর কোনোকিছু নিরাপদ ভেবে যেভাবে রেখে দেয় সেভাবেই ছেলেটিকে আমি মনের ভেতর পুষে রেখেছিলাম। আমি জানি না কতটা বিমর্ষ হয়েছিল ওর চিত্ত! কতটা ব্যথায় কাতর হয়ে, কতটা ঈর্ষায় পুড়ে পুড়ে মৃত্যুর মতো পথ বেছে নিয়েছিল। তুমি বিশ্বাস করো, আমি সবসময় চাইতাম আর কোনো সুন্দরী মেয়ের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে ও সংসার করুক। আমার চাওয়ার ভেতরের খাঁটিত্বকে তুমি সন্দেহ করো না।

সে কীভাবে মারা গেল? আমি মেয়েটির কাছে জানতে চাইলাম।

সিলেটের ছেলেটির সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি তাকে একবার দেখেছিলাম। পীযূষের চুলগুলো এতটাই লম্বা হয়েছিল, ওগুলো ঘাড় পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল। ওর কপালটা ছিল চওড়া আর পিঠটা ছিল দারুণ মসৃণ। প্রশস্ত বুকে একটা লোমও ছিল না। আমার এটা ঠিক মনে নেই, কাকে যেন বলতে শুনেছিলাম, বুকে পশমহীন পুরুষলোক বড়ো নিষ্ঠুর। হয়তো সেজন্যই আমি ওকে বলতাম—তুমি এতটাই নিষ্ঠুর, কেন না তোমার বুকে কোনো পশম নেই। আমি তো মনে মনে কোনো পুরুষের বুকের কুঞ্জবনে মুখ লুকাতে চাইতাম।

তুমি বিশ্বাস করো, ওগুলি ছিল আমার কথার কথা মাত্র। আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসতাম। এসব বলে ওকে খ্যাপানো ছাড়া আমার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

তোমাদের প্রেম কতটা গড়িয়েছিল? আমি তার কাছে জানতে চাইলাম।

—সে অনেক দূর বলতে পার। ওর বাড়িটা প্রায়ই ফাঁকা পড়ে থাকত। ওর মা-বাবা ছিল ঠাকুর দেবতার ভক্ত। মাঝেমধ্যে তারা কোনো ঠাকুরের আশ্রমে চলে যেত। আমরা সেই অবসর সময়টুকু যথেষ্ট গুরুত্ব দিতাম। আমি চুপি চুপি পেছনের দরজা দিয়ে ওদের বাড়িতে ঢুকে যেতাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আমরা তিন চারবার সঙ্গম করতাম। মাঝেমধ্যে এমনও হতো, ও লজ্জাবতী মেয়েদের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইত। কারণ ওর ধারণা, সমবয়েসি ছেলেদের তুলনায় ওর শিশ্ন ছিল আকারে ছোটো। তবে সেটা আমার তৃপ্তির জন্য কখনোই অন্তরায় ছিল না। আমি বারবার এই সত্যটা ওকে বোঝাতে চাইতাম।

যেহেতু ও ছিল সনাতনী সেজন্য তার শিশ্ন নিশ্চয়ই অন্যরকম ছিল। খৎনাহীন শিশ্নের মাথাটা বাড়তি চামড়ায় ঢাকা থাকত। আমি তাকে বললাম।

তুমি হয়তো জানো না, শৈশবের ছেলেখেলা চলার সময় আমি ঋতুমতী হই। আমার চাচাতো ভাই, যে আমার সমবয়েসি সে আমার ঋতুমতী হওয়ার উনিশ দিন পর ফুসলিয়ে সঙ্গম করেছিল।

আমারও অন্য কোনো পুরুষের গোপনাঙ্গ সম্পর্কে জানা ছিল না। হোক সনাতন বা মুসলমান। আমার কাছে সবটাকেই স্বাভাবিক মনে হতো। তুমি হয়তো জানো না, শৈশবের ছেলেখেলা চলার সময় আমি ঋতুমতী হই। আমার চাচাতো ভাই, যে আমার সমবয়েসি সে আমার ঋতুমতী হওয়ার উনিশ দিন পর ফুসলিয়ে সঙ্গম করেছিল। আমি তীব্র ব্যথা পেয়েছিলাম আর আমার মনে হয়েছিল মাথার ভেতর শিরাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। তখন, ওই সময়ে একজন পুরুষের শিশ্ন কেমন আকারের হতে পারে সে সম্পর্কে এমন কোনো ধারণাই আমার ছিল না। তবে পীযূষের সঙ্গে আমি নিয়মিত সঙ্গম করতাম। আমি কোনো ব্যতিক্রম অনুভব করিনি আর আমি সেই সুখটুকু খুব উপভোগ করতাম।

ওর সঙ্গে প্রেম চলাকালীন সময়ে সিলেটের ছেলেটির সঙ্গে আমার পরিচয়। নতুন ছেলেটির আমি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখেছিলাম। ছেলেটা দেখতে সুদর্শনও বটে। তবে আমি পীযূষের চেয়ে সিলেটের ছেলেটিকে প্রাধান্য দিতে লাগলাম। আমার বাবা-মাও ছেলেটিকে পছন্দ করলেন। নির্ধারিত তারিখে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। পীযূষকে বলার মতো আমার হাতে মোটেও সময় ছিল না।

মেয়েটি আমার কাছে জানতে চাইল, আমি কী করে মরে গেলাম? আমি তো মারা যাইনি। দিব্যি বহাল তবিয়তে আছি। তাছাড়া তুমি এমন প্রশ্ন কেনই-বা করলে? আমি মেয়েটিকে বললাম।

সে উত্তর দিল, এটা তো মৃতদের দেশ। কোনো জীবিত লোকের পক্ষে এখানে আসা সম্ভব নয়। ওই যে নদীটা দেখা যায়, খরস্রোতা। ওই জলে ভাসতে ভাসতে মৃতরা এখানে আসে। আর ওরা এখানে এসে নিজেদের মতো একটা করে বাড়ি পায়। যে বাড়িতে মৃত ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ থাকে না।

তাহলে তুমিও কি মৃত? আমি তার কাছে জানতে চাইলাম।

হ্যাঁ, আমিও মৃত। মৃত্যুর পর পীযূষের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছি। তুমি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পার। তাছাড়া তোমার মনে তো পীযূষকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। তুমি চাইলে সে সবের সমাধান করে নিতে পার।

আমি তোমার মৃত্যুর রহস্য জানতে চাই। তাছাড়া এখানে যখন এসেই পড়েছি আমার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে চাই। মেয়েটি আমাকে না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি বললাম।

মেয়েটি মুখে অতৃপ্তির ভাব নিয়ে বলল, দাম্পত্য জীবনের অলঙ্ঘনীয় কিছু গোপনীয়তা থাকে যা প্রেমের মধ্যে থাকে না। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমরা এমন কিছু সত্যের মুখোমুখি হই তখন যৌনতা, মিলন, প্রেম-সোহাগ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যায়। আমি সিলেটের ছেলেটির সংসারে মোটেও সুখী ছিলাম না।

সামনের পথটা সংগীতমুখর। এটা মৃতদের দেশের সংগীত। সানাইয়ের বিরহী সুরের মতো বাজে সংগীতের সুর। কখনো সুরের ধারাটা এতটা উসকে যায় যেন সুরটা শুনতে শুনতে মুহূর্তেই আমার মৃত্যু হয়ে যাবে। চারপাশে এমন এক চাপা নৈঃশব্দ্য আমি জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করি। আমার গলার স্বর কোনো প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে না। কেবল বুকের মধ্যে একটি দুর্মর শব্দ আছাড় খেতে থাকে। যেন মৃতদের দেশে এসে দ্বিতীয়বার আমার মৃত্যু হবে। অথচ আমি কিছুতেই আর দ্বিতীয় মৃত্যু চাই না। আমি আমার প্রেমিকাকে শুধু একবারের জন্য দেখতে চাই।

আমার সঙ্গিনী আমাকে বলল, যদি আত্মহত্যাকারীকে দেখতে চাও, তবে সে দৃশ্য বড়োই নির্মম। তুমি সহ্য করতে পারবে না। আপন হননকারী নিজেকে যে বস্তু দিয়ে হত্যা করেছে সেই সমবস্তুর মাধ্যমে সে বারবার মৃত্যবরণ করে। অথচ মৃত্যুর পর ঘুম থেকে যেভাবে শিশুরা জেগে যায়, একটু পরে সে সেভাবেই জেগে ওঠে। ধরো, যদি সে গলায় রশি বেঁধে ঝুলে পড়ে তাহলে বারবার সে ওভাবেই ঝুলতে থাকে। আর সে প্রভুর কাছে বারবার চিরকালীন মৃত্যু চায়। আবার যে বিষপানে আত্মহত্যা করেছে সে বারবার বিষের পেয়ালায় চুমুক দেয়। অনন্তকালের জন্য এই ধারাটা চলতেই থাকে অথচ সে থাকে অমর।

—তবুও আমি আমার প্রেমিকার মুখটা দেখতে চাই। যদি তা সম্ভব হয় তাহলে। আমি তাকে বললাম।

—সেটা সম্ভব, আমিও তোমার কাছে তোমার প্রেমিকার মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাই। এমনকি তোমারও।

সেটা ছিল একটা বিয়ের অনুষ্ঠান। শিশুগুলো ছিল ভোজবাজি, আতসবাজিতে ব্যস্ত। মেয়েরা নব দম্পতির জন্য ফুল আর মালা নিয়ে আসে। আমি সেই মেয়েগুলোর দলে অন্যরকম একটি মেয়েকে দেখেছিলাম। অন্যদের তুলনায় ওর পোশাক ছিল সস্তা, নিম্নমানের। তেমন কোনো সাজগোজ নেই, ঠোঁটদুটোতে হালকা হাসি ঝুলে ছিল। মাথায় আঁচল টেনে দেওয়া মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতেই পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলক দিয়ে উঠল। কেমন এক মৌনতা খেলা করেছিল ওর মুখের ওপর। অন্যরা বিয়েবাড়ির আলাপে মশগুল থাকলেও ও ছিল নীরব। হতে পারে, সেটা ওর পারিবারিক অর্থনৈতিক দীনতার জন্য। বিয়ের সমাজে অন্য যারা এসেছিল, তাদের পোশাকের আভিজাত্য ছিল চরমে। তারা উৎসবে মেতেছিল, উল্লাস করছিল। মেয়েদের সোনার অলংকারের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়েছিল উপস্থিত সকলের চোখে। আমি সেই মেয়েটির কাছে গিয়ে নামধাম জিজ্ঞেস করলাম। মেয়েটি এতটা হীনম্মন্যতার সাথে ওর পরিচয় দিয়েছিল, মনে হয় জগতে ওর চেয়ে অসহায় আর কেউ নেই।

সেদিন বিয়ে বাড়ির সমস্ত আয়োজন শেষ হয় মধ্যরাত পেরোবার পর। যতক্ষণ সম্ভব আমি ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। ওর দৃষ্টি আয়ত, চোখের প্রতিটি পলক ফেলা ছিল উজ্জ্বল হাসির মতো সুন্দর। চোখদুটো এত বেশি সুন্দর যে, পৃথিবীর যেকোনো রাজা বাদশার চোখ ওর দৃষ্টির দিকে তাকালে নির্ঘাত মোমের মতো গলে যাবে।

বিয়ে বাড়ির সমস্ত আয়োজন শেষ হয়ে গেলে আমি ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য আরেকটু সময় অপেক্ষা করলাম। ওর ছিল শান্তশ্রী মুখ; মনে হয় সমস্ত প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়াই করে করে বড়ো হয়েছে মেয়েটি। অনুষ্ঠান শেষে মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, ওর বাবা আরমান মুছল্লি পায়রা নদীর জেলে। আমি নির্বোধের মতো ভেতরে ভেতরে স্বগতোক্তি করলাম, শেষ পর্যন্ত জাইল্যার মাইয়া! তোমাকে হয়তো বোঝাতে পারব না কতটা রূপবতী ছিল মেয়েটি। আমি আকারে ইঙ্গিতে মেয়েটির প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহের ব্যাপারে জানালাম। সেদিন বিয়ে বাড়ির সমস্ত আয়োজন শেষ হয় মধ্যরাত পেরোবার পর। যতক্ষণ সম্ভব আমি ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। ওর দৃষ্টি আয়ত, চোখের প্রতিটি পলক ফেলা ছিল উজ্জ্বল হাসির মতো সুন্দর। চোখদুটো এত বেশি সুন্দর যে, পৃথিবীর যেকোনো রাজা বাদশার চোখ ওর দৃষ্টির দিকে তাকালে নির্ঘাত মোমের মতো গলে যাবে।

মেয়েটিকে নিয়ে আমার মনের ভেতর ঘোর, আমি ওর বাড়িতে মুরব্বিদের কাছে আমার ইচ্ছের কথাটা জানাতে চাইলাম। কথাগুলো বলতে যেদিন আমি ও আমার বন্ধু মোনায়েম ওদের বাড়িতে গেলাম, কেমন একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম মনের ভেতর। প্রশস্ত, বিক্ষুব্ধ নদীর তীরে উঁচু বেড়িবাঁধের পাশে ছোটো একটা ঘর, কতগুলো খড় আর কুটো জমা করা ছিল বাড়ির প্রবেশপথে। উঠোনটা ছোটো কিন্তু জাল, প্লাস্টিকের পিপে, কন্টেইনার আর ছোটো ছোটো সোলার নাসায় ভরা। ঘরটা এতটাই নিচু ছিল, কোনো গাছের আড়াল থেকে তাকালে আর দেখা যায় না। আমি ফুলবাবুর মতো পোশাকে পুরোদস্তুর সাহেব আর আমার সাথে আমার বন্ধু মোনায়েম। আমাদের দুজনকে দেখে ওর বাবা হকচকিয়ে গেল। লোকটি ছিল শারীরিকভাবে দুর্বল, গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে আর গোল গোল চোখদুটো সামনের দিকে বেরিয়ে আসছে। ঝুঁটিওয়ালা পাখির ঝুঁটির মতো কয়েকগাছি দাড়ি তার। ধামার মতো পেটটা ফোলা, যে কারো চোখে পড়ার মতো। যদিও বয়স অতটা হয়নি তবুও হাবভাবে বুড়ো। তাকে যে কেউ দেখলে মনে করবে, সে কাওলা কালিঞ্জিরির রোগী। আমাদের দেখে লোকটি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি আমাদের মুখের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন, যেন দুজন দেবদূত তার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার বন্ধু মোনায়েম আমাদের উদ্দেশ্যের কথা বলল আর লোকটি শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি জানতে চাইলেন, তার মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল একবার এবং সে স্বামী পরিত্যক্তা এসব বিষয়ে আমাদের জানা আছে কি না! আমরাও লোকটির মতো সংবাদটি শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। সত্যিই আমরা কোনোকিছু না জেনেই গিয়েছিলাম।

তবুও আমি মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ভাবলাম, আমি তো শুধুমাত্র মেয়েটিকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব, ওর পরিবারকে নয়। এমনকি ওর এই নিচু ঘর, জঞ্জালে ভরা উঠোন, পচে আসা মাছের জলের গন্ধ এসবের কিছুই আমি নেব না। একজন সুন্দরী বউ চাই আমার, এটাই সত্যি। যদি ওর পড়াশোনা না জানা থাকে তবে আমি ওকে শিখিয়ে নিতে পারব। যদি কম জানে তবে আরও পড়িয়ে নেব। আমার নিজস্ব জগৎ আর পরিবেশে গড়ে তুলব ওকে। সেদিন আবার ওকে দেখেছিলাম, অলংকারহীন একটা মেয়ে যে এতটা সুন্দরী হতে পারে, আমার স্কুল-কলেজ, বন্ধু-বান্ধব মহলের সমাজে আর দেখিনি।

আমি আরমান মুছল্লির মেয়েকে বিয়ে করতে চাই, বিষয়টি আমার পরিবারকে জানালাম। কিন্তু আমার পরিবার এমনভাবে বেঁকে বসলেন, যেন কোনো বাঁদির মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব করেছি। আমার কিছু বন্ধু, যাদের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের ওঠাবসার ইতিহাস, ওরাও আমাকে দু’কথা বলতে ছাড়ল না। আমার পরিবার আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলল তবু আমার এক কথা—আমি সেই মেয়েটিকেই বিয়ে করতে চাই।

দ্রুত আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন নড়েচড়ে বসলেন। তিন দিনের মাথায় আরেকটি সুন্দরী মেয়ের ফটো এনে দেখালেন। কিন্তু আমার মনের ভেতর গভীর হয়ে গেড়ে আছে সেই মেয়েটির বসবাস। সবকিছুর পরও আমি মেয়েটির সঙ্গে গোপনে দেখা করলাম। আমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে ওকে কথা দিলাম, কোনোদিন ওর জীবনের অতীত নিয়ে কথা তুলব না।

মেয়েটির চোখ ছলছল করে উঠল। আমার মুখের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারল না সত্যি তবে ওর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা দৃঢ় পায়ের অবস্থান আলগা করে দিল। ও এতটাই হালকা হয়ে গিয়েছিল, নাড়া দিলে যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারত। আমি ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম, আমি ইতিহাস পাল্টে দিতে চাই।

এসবের কয়েকদিন পর আমার বিয়ের কথাবার্তা উঠল। মেয়ে আমার বাবার মতো সমান মর্যাদার অধিকারী। অর্থবিত্তের জৌলুস নেই তবে সমাজে তার সততার যথেষ্ট সুনাম আছে। আমার বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না কোনো স্বামী পরিত্যক্ত মেছো আরমানের মেয়েকে বিয়ে করাতে। পরিবারের সবাই যখন ভাবছে কী করে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানটি গাম্ভীর্যপূর্ণ আর ব্যঞ্জনাময় করা যায়। তখন মেয়েটি বলল, আমি রাজি থাকলেই ও ঢাকার লঞ্চে চড়ে উধাও হয়ে যেতে পারে। আমি অচিন্তনীয় কাজটি করা থেকে পিছিয়ে গেলাম। বিয়েটি না করার জন্য পরিবারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করলাম। কিন্তু তাদের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতিতে কোনোভাবেই ভাটা পড়ল না। তখন ছিল বসন্তকালের মধ্যসময়, তেজদীপ্ত রোদের আকাশে পৃথিবী ঝলমল করছে। আমাদের বাড়ির চাপপাশের বেড়াগুলো কাগজের ফুলে সজ্জিত হয়ে উঠল। অপরাহ্ণে খবর এলো একটা নির্জন বাঁশ ঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে মেয়েটি শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহর ছিল বহুদূর। ইঞ্জিলচালিত নৌকায় মেয়েটিকে নিতে নিতে কয়েকটা জোর শ্বাসটান দিল ও পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে যায়।

বসন্তের কোনো এক প্রদোষকালে পৃথিবী থেকে সেরা ফুলটি ঝরে পড়ল। আমাদের বাড়ির সকল আনন্দে জল পড়ে নিভে গেল। পরিবারের সবাই বাড়িতে তালা লাগিয়ে পালিয়ে গেলাম। যদি আরেকবার তার দেখা পাই তবে তাকে বলতে চাই, অনন্তকাল তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

আমি ঠিক জানি না, মৃত্যুর সময় মেয়েটি কতটা ব্যাকুল হয়েছিল আমার জন্য। তবে আমার ঔরষের যে সন্তানটি ও পেটে ধারণ করেছিল, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সেই অনাগত শিশুটির জন্য কেঁদেছিল নিশ্চয়ই! আমি ওর এমন পরিণতি চাইনি।

আমার সঙ্গী মেয়েটি বলল, এই যে খরস্রোতা নদীটা দেখা যায়, বিক্ষুব্ধ। এই নদী পেরিয়ে ওপার গেলে সুদৃশ্য একটা নগর তোমার চোখে পড়বে। সেখানে সারিসারি কতগুলো ঘর। প্রত্যেক ঘর থেকে ভেসে আসে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফটরত মানুষের আর্তনাদ। তুমি চাইলে তোমার প্রেমিকাকে সেখানে দেখে আসতে পার। যদি তুমি এখনো কোনো জীবিত মানুষ হও তবে তুমি এসব দেখতে পাবে না। আর যদি মৃতদের কেউ হও তবে নিশ্চয়ই সবকিছু দেখবে।

আমি নিঃসঙ্গ ধ্যানজনিত অমগ্নতায় ডুবে রইলাম। তারপর সঙ্গিনীকে বললাম, বিষণ্ন ক্লান্ত গাছেদের পাতার মতো মরে গিয়ে, বাতাসে উড়তে উড়তে ধুলোর সাথে মিশে গেছি আমি। সত্যিই আমি জীবিতদের কেউ নই। সত্যিই মরে গেছি আমি। একজন আমাকে ভালোবেসে মরে গেল আর আমি মরলাম আরেকজনের জন্য। তবে আমার কাছে দিনের আলোর সেই মেয়েটিই দৃশ্যমান যে আমাকে একদিন ভালোবেসে মরে গেছে। আমি যাকে ভালোবাসতাম তাকে না পাওয়ার বেদনার ভার বইতে পারিনি আমি। পড়াশোনা শেষ করে যেদিন চাকরিতে জয়েন করলাম, ঠিক পনেরো দিনের মাথায় প্রেমে পড়লাম মেয়েটির। ও ছিল লাজুকলতার মতো। লজ্জাবতী পাতা যেভাবে কোনোকিছুর স্পর্শ পেলে বুজে যায় ঠিক সেরকমই শিউলি আমার স্পর্শ পেলে লজ্জায় মর মর হয়ে চোখ বন্ধ করে থাকত। পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়েটা সম্ভব না সেটা জানতাম। কারণ ও ছিল অবসরপ্রাপ্ত মেজরের মেয়ে আর আমি নিতান্তই সাধারণ ঘরের ছোটো চাকুরে যুবক। আমরা গোপনে বিয়ে করলাম, সংসার করার স্বপ্নে দুজনেই ছিলাম বিভোর। প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই সংসারের ছোটোখাটো জিনিসপত্র কিনলাম। আমরা পালিয়ে সংসার করতে চাইলাম। বিয়ের একমাস সতেরো দিন পর ও বেঁকে বসল, আমাদের বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখতে বলল। ততদিনে ওর বাবা সবকিছু জেনে আমাকে যেকোনো বাহানায় ডেকে পাঠাল আর আমি ওর বাবার জেরার মুখে পড়লাম। লোকটা ছিল তদন্তকারী পুলিশের মতো চৌকশ আর সাহসী। অর্থবিত্ত তাকে দুঃসাহসী করেছিল বিধায় সবকিছু জেনে আমাকে বেধড়ক পেটাল আমার প্রেমিকার সামনেই। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করেও ওকে অস্বীকার করিনি। আমি দৃঢ় প্রত্যয়ে অনুনয়ের ভঙ্গিতে তার কাছে নতজানু হলাম। খোদার প্রতি যেমন বিনীতভাবে আমরা প্রার্থনা করি, ঠিক সেভাবেই। আমি আমার প্রেমিকাকে পাওয়ার আকুল আকুতি জানালাম। কিন্তু বেওয়ারিশ কুকুরের মতো ওর বাবা লাত্থি দিতে দিতে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। আর ও ছিল পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল।

আঁধারের গাঢ়তর পরতের সাথে সাথে পৃথিবী আমার কাছে ছোটো আর অর্থহীন মনে হতে লাগল। আমার মহামূল্যবান জীবন আমার কাছে হয়ে পড়ল মূল্যহীন। ক্ষুধা নেই, পিপাসা নেই শুধু প্রাণের ভেতর নিরর্থক হাপিত্যেশ। কেমন এক ঘোরের ভেতরেই সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মাহুতি দেওয়ার।

বাসায় ফিরে সারা বিকেল কাঁদলাম। কতশতবার ফোন করলাম আমার প্রেমিকাকে কিন্তু ওর ফোন হয়তো চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। পৃথিবীর উঁচুনিচুর পার্থক্য এতটাই মর্মপীড়াদায়ক আমি প্রেমের বিরহে জর্জরিত হতে লাগলাম। না পাওয়ার বেদনা আমাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলল। রাত যতটা নিকটবর্তী হলো, আঁধারের গাঢ়তর পরতের সাথে সাথে পৃথিবী আমার কাছে ছোটো আর অর্থহীন মনে হতে লাগল। আমার মহামূল্যবান জীবন আমার কাছে হয়ে পড়ল মূল্যহীন। ক্ষুধা নেই, পিপাসা নেই শুধু প্রাণের ভেতর নিরর্থক হাপিত্যেশ। কেমন এক ঘোরের ভেতরেই সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মাহুতি দেওয়ার। মধ্যরাতের কোনো অর্থবহ সময় নিজের গলায় রশি লাগিয়ে পাখার সাথে ঝুলে পড়লাম। হয়তো তখন আমার মা আমাকে নিয়ে স্বপ্নের ভবিষ্যৎ পথ রচনা করছিল। অন্য কোনো প্রেমিক যুগল সুখের মিলনে মত্ত ছিল আর আমি গোঁ গোঁ করতে করতে হাত পা অসাড় করে দিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে এলাম। পরশু থেকে আমার নিথর দেহটা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, গন্ধ ছড়াচ্ছে চারপাশে। আজ আমার মৃত্যুর সপ্তম দিন চলছে।

নদীটা পেরিয়ে গেলাম সেই পুরোনো পদ্ধতিতে। উড়ে উড়ে বাতাসের সাথে। নিচের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ আমার ভেতর কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না। ওপারে সত্যিই সারি সারি বাড়ি। ছোটো ছোটো ঘর, প্রতিটি ঠিক মৃতদের আসল বাড়ির মতন। মেয়েটির বাড়িটা চিনতে কষ্ট হয়নি, যে আমার জন্য আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল নিজের শরীরে। বাড়িটার জীর্ণ দশা আর বেড়া বেয়ে কতগুলো লতা পাকিয়ে উঠেছে উপরের দিকে। বাড়ির চারপাশ আগাছায় ভরা। কেউ একজন, যাকে প্রহরী ভাবা যায়, তিনি বললেন, এই বাড়িটা প্রায় পঞ্চাশ বছর হয় এখানে আছে। সত্যপুরীতে বাড়িটি মালিকের অধস্তন দু-পুরুষের হাতে গিয়ে পড়েছে। আজ এ পর্যন্ত এই ঘরের বাইরে কতগুলি বাঁশের নোয়ানো মাথার নিচে একজন সুন্দরী রমণী দাউদাউ করে আগুনে জ্বলছে।

প্রহরী এমনভাবে মেয়েটির প্রথম আসার দিনের বর্ণনা দিচ্ছিল যেন আমি চোখের সামনে সেই দৃশ্যটা দেখছি। তার সেই বর্ণনায় লোকটির মনের ভেতর থাকা মেয়েটির প্রথম সৌন্দর্য আমার হৃদয়ের ভেতর গিয়ে পৌঁছেছে।

মেয়েটি আমাকে দেখে ভেতর থেকে অভিবাদন জানাল। ও বলল, এসো হে ভেতরে এসো। আমার যে সৌন্দর্যে একদিন তোমার চোখ পুড়ে গিয়েছিল আজ সেসবের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

একটা আস্ত জগৎ। নদীর ধারের ছোটো একটা গ্রাম, মাথার ওপর স্বচ্ছ আকাশ। একটা ভাঁজ করা পর্দার মতো পরতে পরতে খুলে যাওয়া বীভৎস মৃত্যুর জগৎ। কী একটা রূঢ় আওয়াজ কানে ভেসে এলো, দূর হ বেইমান!!

দুনিয়া ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল, জানালায় ভোরের আলো প্রবেশ করল। একটা ভেজা কাক গাছের ডালের ওপর কা কা করছে। ঘুম ভেঙে গেলে দেখি, ঘামে ভিজে পুরো শরীর একাকার।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মোস্তফা অভি মূলত তরুণ গল্পকার। জন্ম বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার বিঘাই গ্রামে ১৯৮৪ সালে। পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতোকত্তোর। পেশায় ব্যাংকার। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকে বেশ কিছু গল্প ছাপা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত উভয় দেশের বিভিন্ন সাহিত্যপত্রে ছাপা হয়েছে বেশ কিছু লেখা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ দুটি। ‘বাজপাখির পুনর্জন্ম’ এবং ‘সিএস খতিয়ান ও একটি মামলার ইতিবৃত্ত’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।