বুধবার, এপ্রিল ২৪

যেভাবে গল্প হয়

0

নয়টার দিকে ফোনটা এল। রাত নয়টা না, সকালবেলা।

আমি রাতে ঘুমোতে পারি না। করোনার মধ্যে দিনরাতের সাইকেল পুরোপুরি কলাপস করে গেছে। থাকি ঢাকায়, চলি নর্থ আমেরিকার টাইমে। দিনে ঘুমাই আর সারা রাত জেগে থাকি।

লকডাউন চলছে। বাসা থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। যেহেতু বাসাতেই থাকতে হচ্ছে রাতে ঘুমিয়ে কী এমন হাতিঘোড়া হবে!

সারা রাত ছটফট করে ভোরবেলা বিস্কুট-টিস্কুট কিছু একটা খাই। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ঘুমোনোর আয়োজন করি। সাধারণত সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আমার চোখ দুটো লেগে আসে। আজকের ঘটনাও তা-ই। এর মধ্যে উপদ্রবের মতো ফেসবুক মেসেঞ্জারে এই ফোন।

মেসেঞ্জারে ফোন এলে যে অ্যালার্ট টোন বেজে ওঠে তা যথেষ্ট ইরিটেটিং। বেশ কর্কশ মনে হয় আমার কাছে। শুনতে ভালো লাগে এমন কোনো টিউন বসাতে চেয়েছি। পারিনি। হয়তো উপায় আছে কোনো, আমি জানি না।

আমি যারপরনাই বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করলাম। ফোন বাজতেই থাকল। যে ফোন করেছে সে বোধ হয় ঠিক করেছে, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে আমার সাথে। আমি ফোনটা টেনে নিয়ে দেখলাম— সামিয়া রহমান কলিং…।

সকালে ঘুমানোর আগে মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমাই। কোনো রিস্কে যাই না। আজ কী কারণে যেন ভুলে গিয়েছিলাম। তাতেই এই বিপদ। আমি যারপরনাই বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করলাম। ফোন বাজতেই থাকল। যে ফোন করেছে সে বোধ হয় ঠিক করেছে, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে আমার সাথে। আমি ফোনটা টেনে নিয়ে দেখলাম— সামিয়া রহমান কলিং…।

সামিয়া নামে কাউকে আমি চিনি না। ফেসবুকে প্রায় চার হাজার ফ্রেন্ড আমার আছে। সবাইকে আলাদাভাবে চেনা সম্ভব না। ফতুয়া পরা এক মেয়ের বুক পর্যন্ত ছবি ভেসে উঠেছে মেসেঞ্জার প্রোফাইলে। কাটা কাটা চেহারা। চুলগুলো কোঁকড়া। চওড়া কপালে একটা ছোট্ট টিপ। প্রোফাইল পিকচারটা ফটোগ্রাফ নয়, জলরঙে আঁকা। একেবারে জীবন্ত। যে এঁকেছে, সে চোখ দুটোতে আলাদা যত্ন নিয়েছে। বড়ো বড়ো দুটো চোখ কথা বলছে। বয়স ৩০-এর আশপাশে হবে। আমার কি মেয়েটাকে চেনার কথা? স্মৃতি হাতড়ে কিছুই মনে করতে পারলাম না।

একটা সুন্দর মেয়ে জলে ভাসা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই ফোন কতক্ষণ রিসিভ না করে থাকা যায়? ঘুম ঘুম গলায় বললাম, হ্যালো।

ও প্রান্ত থেকে কেউ কোনো কথা বলল না।

আমি আবারও বললাম, হ্যালো।

মিষ্টি গলায় কেউ একজন বলল, আপনি বোধ হয় ঘুমাচ্ছিলেন। সরি।

গলা যত মিষ্টিই হোক, এ ধরনের কথা শুনলে মেজাজ খারাপ হয়। মনে হয় বলি, বুঝতেই যখন পারছেন আমি ঘুমাচ্ছিলাম, ফোনটা কেটে দেন। পরে ফোন করেন। সরি বলার তো দরকার নাই। আলবিদা বলে ফেলেন। আমি আরাম করে ঘুমাই।

আমি চুপ করে থাকায় ও প্রান্ত থেকে আবারও বলল, আমি সরি।

এবার আর ‘ইটস ওকে’ টাইপ কিছু না বলে উপায় নেই। এ রকম মিষ্টি গলার মেয়ে দুবার সরি বললে তাকে ইগনোর করা যায় না।

মেয়েটা বলল, আপনার সাথে আমার খুব জরুরি কথা ছিল।

জি বলেন, আমি বললাম।

আমার নাম সামিয়া । সামিয়া রহমান।

জেনে খুশি হলাম। আমার নাম আলভী। আলভী আহমেদ।

ও প্রান্তে সামিয়া রহমান একটু থতমত খেয়ে গেল। আমার গলার টোনে রসিকতার কোনো সুর নেই। সে খানিকটা সময় নিয়ে বলল, আপনি কি জোক করতেছেন আমার সাথে?

জি আপু, আমি বললাম, তা একটু করতেছি।

দেখেন ভাই, আমি একটা সমস্যায় পড়ছি। আপনার হেলপ দরকার। জোক করবেন না প্লিজ।

সরি সামিয়া । আপনি বলেন। আমি শুনতেছি।

ফোনে বলা সম্ভব না। আমরা কি কোথাও মিট করতে পারি?

মিট করবেন!

হ্যাঁ। খুব জরুরি দরকার।

এখন তো লকডাউন। গাড়িঘোড়া বন্ধ। বাসা থেকে তো বের হওয়ার উপায় নেই। কোথায় মিট করবেন?

আপনার বাসায় আসতে পারি।

বাসায় আসবেন! চেনেন আমার বাসা?

না। অ্যাডড্রেস দেন। খুঁজে বের করে ফেলব। বা মেসেঞ্জারে আপনার লোকেশন শেয়ার দেন। আমি ট্র্যাক করে চলে আসতেছি।

আমি মনে মনে একবার বললাম, মারছে আমারে!

সামিয়া বলল, আমার খুব জরুরি দরকার।

আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম। কে এই সামিয়া রহমান? আমার সাথে তার কী দরকার? একেবারে বাসা পর্যন্ত চলে আসবে!

মানুষ হিসেবে আমি অত্যন্ত অসামাজিক। কোনো আড্ডায় যাই না। আত্মীয়স্বজন এড়িয়ে চলি। খুব প্রিয় কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া কাউকে বাসায় আসার অনুমতি দিই না। মেয়েদের বেলায় অবশ্য এই নিয়ম খানিকটা শিথিল করা যায়। সুন্দরীদের জন্য আমার মনের মধ্যে সব সময় খানিকটা জায়গা খালি থাকে।

ফেসবুক তো মানুষের প্রাইভেসির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে মনে হচ্ছে। যে কেউ যখন-তখন ফোন দিয়ে দিচ্ছে। ফোন নম্বর জোগাড় করার ঝামেলা নেই। আবার লোকেশন ট্র্যাক করে বাসায়ও নাকি চলে আসবে! মহা যন্ত্রণা!

মানুষ হিসেবে আমি অত্যন্ত অসামাজিক। কোনো আড্ডায় যাই না। আত্মীয়স্বজন এড়িয়ে চলি। খুব প্রিয় কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া কাউকে বাসায় আসার অনুমতি দিই না। মেয়েদের বেলায় অবশ্য এই নিয়ম খানিকটা শিথিল করা যায়। সুন্দরীদের জন্য আমার মনের মধ্যে সব সময় খানিকটা জায়গা খালি থাকে।

সামিয়া খুকখুক করে কেশে একবার গলা পরিষ্কার করে নিল। বলল, আপনি অনুমতি দিলে আমি এখনই আসতে পারি।

আমি বুঝতে পারলাম, ভালো বিপদে পড়েছি। সহজে নিস্তার মিলবে না। ফেবিকলের মতো এই মেয়ে লেগে আছে। কিন্তু কেন লেগে আছে?

আমার গাট ফিলিং বলল, তাড়াহুড়ো করা যাবে না। আগে বুঝতে হবে মেয়েটার উদ্দেশ্য। সেধে বিপদ ঘাড়ে নেওয়ার মানে নেই। আপাতত সুন্দরী কোটায়ও সামিয়া রহমানকে চান্স দেওয়া যাবে না। বাসার লোকেশন শেয়ার করার তো প্রশ্নই ওঠে না। ফেবিকলের এই জোড়া ছোটাতে হবে। আর সে জন্য দু-একটা মিথ্যা বলা অন্যায় নয়। বললাম, আপু আমি তো গোপালগঞ্জে! ঢাকায় নাই। আপনি কী করে আসবেন?

গোপালগঞ্জে! সে অবাক হয়ে বলল।

হ্যাঁ। লকডাউনের আগেই চলে আসছি। আমার দেশের বাড়ি গোপালগঞ্জ। ঈদের পর ফিরব ঢাকায়।

ফোনের অপর প্রান্তে নীরবতা নেমে এলো। বুঝলাম, সে মনের মধ্যে কথা গোছাচ্ছে। কিছু একটা ভাবছে। আমার মনে হলো, ফোনের অন্যপাশে দেশলাইয়ের কাঠি ঘষার শব্দ পেলাম। সিগারেট খায় নাকি মেয়েটা? দারুণ তো।

আমিও বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম। তখনই সামিয়া বলল, ঠিক আছে। আমি ঈদের পর আবার ফোন দেব।

আমি ফোন কেটে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সিগারেট আর ধরানো হলো না। ছাড়া ছাড়া ঘুম হলো। দুপুর তিনটার দিকে ঘুম থেকে উঠে পেট ভরে ভাত খেলাম। তারপর আবার ঘুম। সন্ধ্যাবেলা হাই তুলতে তুলতে ল্যাপটপ খুলে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করলাম। গল্পের নায়িকার নাম সামিয়া রহমান। সে বেশ মোটাসোটা, খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে। বয়স ৫৫। রাস্তায় দলা করে থুতু ফেলে। শপিং ছাড়া কিছু বোঝে না। সবার সাথে ঝগড়া করে। বিহারি ক্যাম্পের চাপ খেতে ভালোবাসে। সুদূর উত্তরা থেকে চাপ খেতে মোহাম্মদপুর আসে। একবার খাওয়া শুরু করলে থামতে পারে না। গপাগপ সাটাতে থাকে। গোটা দোকান খেয়ে ফেলে।

হারুকি মুরাকামির একটা ছোটোগল্প আছে— ‘কারনাভাল’। ‘ফার্স্ট পারসন সিংগুলার’ নামে তাঁর একটা গল্পের বই বেরিয়েছে এপ্রিলে। সে-ই বইয়ের ছয় নম্বর গল্প। গল্পটাতে ভয়ংকর কুৎসিত এক মেয়ের বর্ণনা আছে। গল্পের শুরুই হয়েছে এভাবে, ‘Of all the women I’ve known until now, she was the ugliest.’ ইচ্ছে করেই সামিয়াকে সে-ই চরিত্রের ছাঁচে ফেলে দুনিয়ার যত ইরিটেটিং ব্যাপার তার মধ্যে ঢোকানোর চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ।

এক-দুই ঘণ্টা পর বুঝলাম, এভাবে হবে না। একটা মেয়ের ব্যাপারে শুধু শুধু বিরক্ত হওয়া যায় না। প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। ছবি দেখে যেটুকু বুঝেছি, সামিয়া যথেষ্ট মিষ্টি একটা মেয়ে। চেহারাটা গ্রেসফুল। গলার স্বরে মাদকতা আছে। যত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলাম ততই সে আমার মাথার মধ্যে চেপে বসল। আমি বুঝতে পারলাম, মাথায় অন্য একটা কিছু ঢোকাতে হবে। একদম ডিফরেন্ট একটা কিছু। অনুবাদের ট্রাই করব নাকি?

‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ অনুবাদ করার একটা অফার আছে আমার হাতে। নামকরা এক প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রস্তাবটা এসেছে। শিশুতোষ আলিফ লায়লা ভার্সন না। ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’ হবে নাম, পূর্ণাঙ্গ ভার্সন—অ্যাডাল্ট এডিশন। ধুন্ধুমার সেক্স থাকবে পাতায় পাতায়। পাবলিশারের সাথে টাকাপয়সার বিষয়টা সেটেল হয়নি বলে কাজ শুরু করিনি। সেটা খানিকটা এগিয়ে রাখা যায়। গুগল করে অ্যারাবিয়ান নাইটসের তিনটা সংস্করণের মোবি ফাইল নামালাম।

স্যার রিচার্ড ব্যাটন আর ড. জে সি মারদ্রুসের ইংরেজি অনুবাদ দুটো বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু সেগুলোর সাইজ দেখলে গায়ে জ্বর আসে। বাংলায় এই বই অনুবাদ করলে দুই হাজার পৃষ্ঠার কম হবে না। ইলাস্ট্রেশন আছে প্রচুর। তার খরচ আছে। এত মোটা বইয়ের দাম ধরবে কত? তিন হাজার টাকা? তিন হাজার টাকা দামের বই কে কিনবে? এ কাজ হাতে নেওয়ার মানে হলো, আমি কত বড় নির্বোধ সেটা গলা উঁচু করে সবাইকে জানানো।

অ্যারাবিয়ান নাইটসের পেঙ্গুইন সংস্করণটা আকারে তুলনামূলক ছোটো। সাড়ে ছয় শ পৃষ্ঠার। বইটার মোবি ফাইল নামিয়ে কিন্ডেলে পড়ার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। মন বসছে না। মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করে বিঁধছে। কাঁটাটা উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত বিঁধতেই থাকবে। ফোন টেনে নিয়ে মেসেঞ্জারে সামিয়া রহমানকে ফোন দিলাম। রাত তখন দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট।

ও প্রান্ত থেকে প্রায় সাথে সাথেই ফোন ধরল সামিয়া । বলল, হ্যালো।

কোনো ভণিতা না করেই বললাম, সকালে ফোন দিছিলেন আপনি। সরি, তখন কথা বলতে পারি নাই।

ইটস ওকে।

বলেন এখন, বললাম আমি, কী বলবেন…? যদি সমস্যা না থাকে।

আমি আসলে মুখোমুখি বসে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

কাল বিকেলে বাংলামোটর চলে আসেন।

আপনি না গোপালগঞ্জে! সকালে বললেন আমাকে।

মিথ্যা বলছিলাম।

ও।

এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলাম। মনে হলো, আমাদের কথাগুলোকে ডিপ ফ্রিজে বন্দি করে রেখেছে কেউ। সেগুলো জমে যাচ্ছে। জমে পুরোপুরি বরফ হওয়ার আগের মুহূর্তে বললাম, বাতিঘর চেনেন? বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের সাততলায়। বইয়ের দোকান। কফিও পাওয়া যায়। কফি খান তো?

খাই।

চলে আসেন তাহলে।

আচ্ছা। আমি আসব।

ঠিক আছা। খাতা খাতা কাথা হোতা পারা।

মানে?

মানে, ঠিক আছে। খেতে খেতে কথা হতে পারে। জোক করলাম।

এ কেমন জোক?

মুরাদ টাকলা ল্যাংগুয়েজে বললাম।

মুরাদ টাকলা কী?

আপনি জানেন না! আচ্ছা, আপনাকে শেখাব কাল। খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ল্যাংগুয়েজ। গুগল করতে পারেন। বাংলায় লিখবেন, মুরাদ টাকলা। তারপর দেখবেন, দারুণ সব রেজাল্ট আসবে। হাসতে হাসতে মরে যাবেন।

বুঝলাম না আপনার কথা।

বুঝতে হবে না। আমি এমনিই অনেক কথা বলি। সব কথা বোঝার জন্য না। জোক করার চেষ্টা করতেছিলাম। সে চেষ্টা মাঠে মারা গেছে।

ব্যাড জোক।

আচ্ছা। এরপর থেকে আর ব্যাড জোক করব না আপু। সরি।

ঠিক আছে। কিন্তু যে জায়গাটার কথা বললেন সেটা লকডাউনে খোলা আছে?

কোন জায়গা? বাতিঘর?

হুম।

খোলা, বললাম আমি, ৫টায় আসবেন। শার্প ফাইভ।

সামিয়া একটু ভেবে নিয়ে বলল, আপনি কিন্তু শুধু শুধু কষ্ট করতেছেন। চাইলে আমি আপনার বাসায়ও আসতে পারি।

দরকার নাই। বাতিঘরে আসেন। বাসায় আসার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে। এত তাড়াহুড়োর কিছু নাই।

মানে!

মানে নাই, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, এটাও একটা জোক। ব্যাড জোক।

 

 

Alvi Ahmed_Motifপরদিন আমি দুপুর নাগাদ পুলিশের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। মুভমেন্ট পাস বের করতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। রাস্তায় উবার-টুবার কিছু চলার কথা না লকডাউনে। যার পারসোনাল ভেহিকল নেই তার জন্য বের হওয়াটা সমস্যা। মোহম্মদপুর থেকে ভেঙে ভেঙে তিনবার রিকশা চেঞ্জ করে বাংলামোটর পৌঁছালাম। লিফটের সাতে যখন পৌঁছেছি, তখন ঘড়িতে কাটায় কাটায় পাঁচটা।

লিফট থেকে নেমেই চারদিকে চোখ বোলালাম। বাতিঘরে মাছিও পরেনি। সেলস কাউন্টারে একজন আছে। বসে বসে ঢুলছে। বেচাবিক্রি নেই। একদম পশ্চিম দিকের কোনায় শুধু একটা মেয়ে দাঁড়ানো। সাধারণ বাঙালি মেয়েদের চেয়ে বেশ খানিকটা লম্বা। ব্ল্যাক জিন্স আর ফতুয়া পরে আছে। কোঁকড়া চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়ানো। বই দেখছে সে। মেয়েটা যে সামিয়া বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হলো না।

আমি পেছনে গিয়ে চমকে দেবার ভঙ্গিতে বললাম, হাই।

সে চমকাল না। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, হ্যালো।

সামিয়া , রাইট?

হ্যাঁ।

আমি দেখলাম, তার মুখে হাসি লেগে আছে। হাসিটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব? এই হাসি উষ্ণ নয়। আবার খুব যে মাপা বা ফরম্যাল তা-ও নয়। ঠোঁটের এক কোনে হাসিটা সিগারেটের মতো ঝুলে আছে। ১০১-টা অর্থ থাকতে পারে সে-ই হাসির । অর্থ বুঝতে হলে মানুষটাকে জানতে হবে প্রথমে। আমি জানার জন্য সামিয়াকে ভালো করে দেখলাম।

মেসেঞ্জারে তার যে ছবি দেখেছি তার সাথে খুব বেশি পার্থক্য নেই। টানা টানা চোখ, বড়ো বড়ো। চওড়া কপাল, আঁকানো ভ্রূ। নাকটা বোচা। কিন্তু মনে হচ্ছে, লম্বা নাক হলে তাকে একেবারেই মানাতো না। গয়না পরেনি কোনো। বিস্ময়করভাবে সিম্পল তার উপস্থিতি। মুখে সে-ই বিখ্যাত নাতিশীতোষ্ণ হাসি ঝুলে আছে। ঠোঁটদুটো একবারের জন্যও ফাঁকা হয়নি হাসার সময়। তারমানে ক্লোজড পারসোনালিটি। ইজি গোয়িং না। এরকম একটা মেয়ে আমার সাথে দেখা করার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়বে কেন?

সামিয়া বলল, টাইমিং ঠিক আছে একদম। আমি ভাবতেছিলাম, আমাকে অনেকক্ষণ ওয়েট করতে হবে।

আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম, টাইমের ব্যাপারে আমি খুব সেনসিটিভ। এক সেকেন্ড এদিক-সেদিক হলে খুব মেজাজ খারাপ হয়। আমার প্রথম প্রেম ভাঙছিল কীভাবে জানেন?

কীভাবে?

আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে আইবিএর গেটে দেখা করার কথা ছিল। বিকেল চারটায়। আমি তিনটা পঞ্চান্ন থেকে সেখানে দাঁড়ায়েছিলাম। চারটা পনেরো পর্যন্ত ওয়েট করছি। মেয়েটা আসে নাই। এরপর ফোন বন্ধ করে বাসায় চলে গেলাম। আর কোনো দিন দেখা করি নাই।

সত্যি?

না মিথ্যা। জোক করলাম।

ব্যাড জোক।

আমি হেসে বললাম, মেয়েরা দেরি করে আসবে এটাই স্বাভাবিক। ছেলেরা একা একা অনেকক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকবে। তারপর মেয়েটা ধীরেসুস্থে আসবে। এগুলো হলো নিয়ম।

সামিয়া আমার কথা শুনে মিষ্টি করে হাসল। ভুল দেখলাম কি না জানি না, মনে হলো, ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁকা হলো এবার। যাক, এই মেয়ে তাহলে ঠোঁট ফাঁকা করে হাসতে জানে! বাঁচা গেল। পারসোনালিটি ওপেন হতে শুরু করেছে। গ্রেট।

সামিয়া বলল, তাহলে তো আমি পুরোপুরি মেয়ে হতে পারি নাই, না? টাইমের আগেই চলে আসছি। ছেলেদের মতো অভ্যাস করে ফেলছি।

আমি বললাম, তা কিছুটা করছেন। বলেন, এখন আপনার কথা শুনি।

এখানে তো বসার জায়গা নাই। দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে কথা বলতে হবে। তা ছাড়া কফির দোকানও তো বন্ধ। খাতা খাতা কাথা হোতা পারা না?

আমি হো হো করে হেসে বললাম, মুরাদ টাকলা ল্যাংগুয়েজ দেখি এক রাতেই শিখে ফেলছেন। ভেরি গুড প্রোগ্রেস। জোস। আই লাভ ইট।

দুটো টুল জোগাড় করে একটায় সামিয়াকে বসতে বললাম। মুখোমুখি আর একটা টুলে বসে বললাম, আপনার এখানে আসতে সমস্যা হয় নাই তো?

সামিয়া বলল, না।

বেশ।

আপনাকে কিন্তু আর একটু বেশি বয়সী ভাবছিলাম, সে বলল।

কী রকম?

না, লেখেন-টেখেন। এ রকম ছেলে-ছোকরা টাইপ কিছু হবেন ভাবি নাই।

আমি হেসে বললাম, ফোরটি ক্রস করছি। এনিওয়ে, এবার শুরু করা যাক। আপনার জরুরি কথাগুলো বলেন।

সামিয়া আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল। আঙুল দিয়ে ওড়নার একটা সাইড পেঁচাচ্ছে সে এখন। কিছু বলছে না। আমি বুঝতে পারলাম, যে কথাটা বলার জন্য সে অস্থির হয়ে উঠেছিল, সামনাসামনি সে কথা বলতে হেজিটেট ফিল করছে।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আন ইজি লাগলে আজ বলতে হবে না। অন্য একদিন শুনব।

সামিয়া উদাস গলায় বলল, সুমনকে আপনি কীভাবে চেনেন আলভী ভাই?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কোন সুমন?

কোন সুমন মানে? আপনি কয়জন সুমনকে চেনেন?

অন্তত তিন জনকে। সুমন খুবই কমন একটা নাম। আপনি বাংলামোটর থেকে হেঁটে হেঁটে মগবাজার মোড় পর্যন্ত যান। অন্তত ১০ জন সুমন রাস্তায় পাবেন। কোন সুমনের কথা বলতেছেন আপনি?

শান্তিনগরের সুমন।

শান্তিনগরের সুমন!

হুম। আর্টিস্ট। ভালো ছবি আঁকে।

কিছু মনে করবেন না, তাকে চিনতে পারতেছি না আপু। সুমন নামে কোনো আর্টিস্টের সাথে আমার পরিচয় নাই।

আমার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারটাও সুমনের আঁকা।

হ্যাঁ, ছবিটা দেখছি। ভালো আঁকছে। স্পেশালি আপনার চোখগুলো। কিন্তু আমি অত্যন্ত সরি যে এখনো আমি তাকে চিনতে পারতেছি না।

ওই যে কিন্ডেল ডিভাইস বিক্রি করল যে ছেলেটা। মনে পড়ছে?

এবার আমার মাথায় ঢুকল পুরো বিষয়টা। আমি একটা গল্প লিখেছিলাম। একটা ছেলে কিন্ডেল বিক্রি করবে বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। তখন এক মেয়ে সে-ই কিন্ডেল কিনে নেয়। ব্যাপারটা সেখানেই থেমে থাকেনি। কিন্ডেল কেনাবেচা শেষেও তারা একজন আরেকজনকে মিট করতে থাকে। আউটডোর ইনডোর সব ধরনের ডেট করে।

শেষ পর্যন্ত জানা যায়, মেয়েটা বিবাহিত। ছেলেটা তখন খুব কষ্ট পায়। ওই গল্পটা প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল। সামিয়া আমার গল্পের সেই সুমনের কথা বলছে।

সে আমার চোখে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ও কোথায় আছে এখন? ফোন বন্ধ অনেকদিন ধরে। ফেসবুক প্রোফাইল ডিঅ্যাকটিভেটেড। বাসায়ও গেছিলাম ওর। পাই নাই।

আমি হতবাক হয়ে বললাম, কার বাসায় গেছিলেন আপনি, সুমনের?

হ্যাঁ। দারোয়ান বলল, সুমন ওই বাসা ছেড়ে দিছে। প্রায় এক বছর আগে। নতুন বাসার ঠিকানা দিয়ে যায় নাই।

মানে কী?

মানে আপনি জানেন না? না জেনে ওই গল্প লিখছেন? সুমন আপনাকে আমাদের সব কথা বলে নাই? নিশ্চয়ই বলছে।

‘আমাদের’ মানে! আপনি আর সুমন?

হুম।

আমি সামিয়ার দিকে তাকালাম। ওর চোখে ঠাট্টার কোনো আভাস নেই। ও যা বলেছে, মিন করেই বলেছে। আমার মনে হলো, আমি একটা হাইপোথেটিক্যাল জগতে ঢুকে পড়েছি। কে এই সামিয়া ? আমার গল্পের মেয়েটা?

আমি মনে মনে একটা গল্প বানালাম। লিখলাম। পত্রিকায় ছাপা হলো। কিছু লোক গালি দিল। কিছু লোক প্রশংসা করল। বিষয়টা এক বছর আগে মিটে গেছে। দ্য টপিক ইজ ওভার। এখন সেই গল্পের চরিত্র সামনে এসে দাঁড়ালে তো মুশকিল! আর যত দূর মনে পড়ে, সে-ই গল্পে মেয়েটার কোনো নাম ছিল না। এই সামিয়া এখন নিজেকে সে-ই নামহীন মেয়ে বলে দাবি করছে। ভয়াবহ ব্যাপার! দিনের পর দিন বাসায় শুয়েবসে কাটাচ্ছি বলে আমার নিজের মাথায় কি গন্ডগোল দেখা দিল নাকি?

এবার আমার মাথায় ঢুকল পুরো বিষয়টা। আমি একটা গল্প লিখেছিলাম। একটা ছেলে কিন্ডেল বিক্রি করবে বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। তখন এক মেয়ে সে-ই কিন্ডেল কিনে নেয়। ব্যাপারটা সেখানেই থেমে থাকেনি। কিন্ডেল কেনাবেচা শেষেও তারা একজন আরেকজনকে মিট করতে থাকে। আউটডোর ইনডোর সব ধরনের ডেট করে।

সামিয়া বলল, চুপ করে আছেন কেন?

আমি বললাম, সামিয়া আপনার বড়সড় কোনো ভুল হচ্ছে। আমাকে সুমন নামে কেউ কোনো গল্প বলে নাই। আপনাকেও আমি চিনি না। আপনাদের গল্প আমি কী করে লিখব?

বানায়ে লিখছেন বলতে চান?

চাওয়া না-চাওয়ার প্রশ্ন না। গল্পটা বানানো। হান্ড্রেড পারসেন্ট বানানো।

মিথ্যা কথা।

আশ্চর্য! আমি মিথ্যা কেন বলব?

কারণ, সুমন আপনাকে নিষেধ করছে। সে আপনাকে রিকোয়েস্ট করছে, আমি যদি কন্ট্যাক্ট করি তাহলে আপনি যেন আমাকে তার ঠিকানা না দেন।

কী যন্ত্রণা! সুমন বলে কেউ নাই। বা থাকলে আছে। আমি তাকে চিনি না।

আবার মিথ্যা কথা!

মিথ্যা না সামিয়া।

সামিয়া থেমে থেমে অনেকখানি সময় নিয়ে বলল, আমার যন্ত্রণাটা একবার ভাবেন ভাইয়া। হ্যাঁ, আমি একটা ভুল করছি। সুমনের সাথে চিট করছি। কাজটা আমার উচিত হয় নাই একদম। আমার যে হাজবেন্ড আছে, না জানায়ে ওর সাথে প্রেম করতেছিলাম। আসলে ওকে আমার তখন এত ভালো লাগল! মনে হচ্ছিল, হাজবেন্ডের ব্যাপারটা বললে ও হয়তো আমার সাথে আর মিশবে না। আবারও বলতেছি, আমি ভুল করছি। কিন্তু আমি তো সেই ভুলটা ধরে বসে নাই। শোধরাতে চাচ্ছি।

আমি চুপ করে রইলাম।

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হাজবেন্ডের সাথে আমার কখনো বনে নাই। ডিভোর্সের প্লান ছিল অনেকদিন ধরেই। এ বছর জানুয়ারি মাসে ফাইনালি কাজটা করে ফেলছি।

ডিভোর্স দিয়ে দিছেন?

হ্যাঁ।

কী ভয়ংকর কথা!

সুমনকে সত্যিই আমি অনেক পছন্দ করি। আমি জানি, সুমনও করে। এখন আর কোনো বাধা নাই। সে সময় আমি ভুল করছিলাম। বড়ো একটা ভুল।

আমি ঘামতে শুরু করেছি ততক্ষণে। বাতিঘরে আজ কাস্টমার নেই বলে এসি চালানো হয়নি। ফ্যানও সবগুলো চলছে না। গুমোট গরম। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। একটা সিগারেট না ধরালেই নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে এভাবে বসে এই মেয়ের আজগুবি কথা শোনার মানে নেই। মেয়েটা নিজে সম্ভবত মেন্টাল কেস। আমাকেও পাগল বানিয়ে ফেলবে।

কে কোথাকার সুমন? তার জন্য আমার এই ভোগান্তি কেন? আমি বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প লিখেছি। সুমন, মিথিলা, দিপা, নীতু এই নামের কারও সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। কিন্তু এই নামগুলো নিয়ে আমি গল্প লিখি। কিন্তু তা-ই বলে সত্যিকারের কোনো সুমন কিছু করলে সে-ই দায়দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়বে কেন? ভালো বিপদে পড়া গেল! এখান থেকে দ্রুত কেটে পড়ার একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি। বললাম, সামিয়া এখানে অনেক গরম। চলেন নিচে যাই।

সামিয়া প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, আমি ওকে কোনোভাবেই রিচ করতে পারতেছি না। প্লিজ, আপনি তার অ্যাডড্রেসটা আমাকে একটু দেন। আমি তো সরি বলার একটা সুযোগ পেতে পারি। পারি না?

কী মনে হলো আমার জানি না। দুম করে বলে বসলাম, সুমন অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।

কী! সামিয়া অবাক হয়ে তাকাল।

আমি বললাম, সিডনিতে। নীল নামে সিডনির একটা মেয়ের সাথে ওর পরিচয় হয় ফেসবুকে। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে। তারপর ওরা বিয়ে করে ফেলে।

সামিয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো মিথ্যা বলে ফেলার পর সেটাকে সত্য করতে কিছু ডিটেইল যোগ করতে হয়। ধরা যাক, আপনি একটা মিথ্যা বলবেন। মিথ্যাটাকে সত্য করতে কিছু স্পেসিফিক তথ্য জুড়ে দিতে হবে। বাজার থেকে আম কিনেছি এ কথাটা যদি মিথ্যা হয়, তাহলে সে-ই আম কেনার ব্যাপারটাকে সত্য করার জন্য এভাবে বলতে হবে, বাজার থেকে আম কিনলাম। হিমসাগর। ১০০ টাকা কেজি। দোকানদার ১৩০-এর নিচে ছাড়বেই না। আমি ৫ মিনিট ধরে মুলামুলি করলাম।

যারা লেখালিখি করে তারা মিথ্যাকে সত্য বানানোর খেলাটা বেশ ভালো পারে। আমি সিডনির গল্পটায় কিছু ডিটেইল যোগ করা শুরু করলাম। বললাম, নীলের বাড়ি খুলনায়। সিডনিতে থাকে। ওখানকার একটা ডে কেয়ার সেন্টারে জব করে। দেশে বেড়াতে আসছিল ২০১৯-এর ডিসেম্বরে। আপনার মতো এত লম্বা না সে। তবে খুবই মিষ্টি মেয়ে। গাল দুটো ফোলা ফোলা। দেখলেই গাল টিপে দিতে ইচ্ছা করে। সুমন আর নীল ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করে। একেবারে ঘরোয়াভাবে। ফরচুনেটলি আমি উপস্থিত ছিলাম সে-ই বিয়েতে। করোনার কারণে মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্ট বর্ডার ক্লোজ করবে বলে ঘোষণা দেয়। তাড়াহুড়ো করে ওরা দুজন সিডনি চলে যায়।

আমি যখন এই কথাগুলো বলছিলাম, সামিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি থেমে যাওয়ার পরও তার দৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন হলো না। কিছু বলল না।

আমি গল্পের লুপহোলগুলো নিয়ে একটু ভাবলাম। একটা বড়ো ত্রুটি রয়ে গেছে। বিয়ের সাথে সাথে সুমনের পক্ষে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া সম্ভব না। স্পাউস ভিসা এপ্লাই করতে হয়। অনুমতি পেতে বেশ সময় লেগে যায়। ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করে মার্চে চলে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। সামিয়া সেটা ধরতে পারেনি। আমি হাফ ছাড়লাম।

দু মিনিট পার হয়ে গেল। সে কোনো কথা বলছে না। জায়গাটা ভয়ংকর নীরব মনে হলো আমার কাছে। পৃথিবীতে কোনো শব্দ নেই? নাকি আমি কানে শুনতে পাচ্ছি না? বধির হয়ে গেছি!

সামিয়ার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। চোখ দুটো টলমল করছে। যেকোনো মুহূর্তে পানি গড়িয়ে পড়বে। আমার মনে হলো, টুল থেকে উঠে ঝেড়ে একটা দৌড় দিই। গল্প লেখার এই মারাত্মক বিপদ জানলে জীবনেও এ কাজ আমি করতাম না। মনে মনে বললাম, খোদা, এবারের মতো এই বিপদ থেকে আমাকে বাঁচাও। আমি মানত করতেছি, এই ঈদে আমি নামাজে যাব।

সামিয়া থেমে থেমে বলল, আমার প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল, এ রকম কিছু একটা শুনব। আপনি আমাকে শুরুতেই বললেন না কেন? কেন লুকালেন?

কারণটা আপনি জানেন, বললাম আমি, সুমন আমাকে বলতে নিষেধ করছে। ও আমার বন্ধু। একদম স্কুলফ্রেন্ড। ও কোনোকিছু বলতে নিষেধ করলে সেটা আমাকে শুনতে হবে। হবে না? আর সে নিষেধ না করলেও হয়তো আমি আপনাকে বলতাম না।

কেন?

আপনি এত কিউট একটা মেয়ে! আপনার মুখের ওপর কী করে বলি এ রকম কথা? আপনি কষ্ট পেলে আমার ভালো লাগবে!

সামিয়া চোখের পানি গিলে ফেলল। চোখের পানি গিলে ফেলা যায় না। গ্র্যামাটিক্যালি ভুল কথা। কিন্তু ঠিক এই কথাটাই আমার মনে এলো। এক ফোঁটা পানিও তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল না। মুখটা লাল হয়ে গেল। এক ভয়ংকর অপমানবোধ তাকে পেয়ে বসেছে ততক্ষণে। রিজেক্টেড হয়েছে টের পেলে মেয়েদের মুখের চেহারা এভাবে বদলে যায়। কোনো মেয়ে নিজে থেকে একটা ছেলেকে বাতিল করতে পারে। কিন্তু তাকে কেউ অপমান করে চলে গেছে, এটা মানা সোজা নয়।

সামিয়া সাপের মতো হিসহিস করে বলল, ও আমার সাথে এ রকম করতে পারে না। ওর জন্য আমি আমার হাজবেন্ডকে ডিভোর্স দিলাম। আর ও!

আমি চুপ করে রইলাম।

ও কেন এমন করল? সামিয়া প্রায় চিৎকার করে উঠল।

ভাগ্যিস বাতিঘরে আজ লোকজন নেই। আমি মিনমিন করে বললাম, আমি একটা মিথ্যা কথা বলছি। আসলে ঠিক মিথ্যাও না। একটা সত্য গোপন করছি।

কী সত্য?

সুমন মারা গেছে।

হোয়াট!

সিডনি যাবার কয়েক মাস পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে। রোড অ্যাকসিডেন্ট। সুমন আর নীল দুজনেই মারা যায়।

সামিয়া একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে অবিশ্বাস। আমি চোখ সরালাম না। একবার চোখ সরালেই এই মেয়ে বুঝে যাবে আমি মিথ্যা বলেছি। চোখে চোখ রেখে পলকহীন তাকিয়ে থাকার সে-ই ছেলেবেলার খেলা শুরু হলো।

আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে অনেকখানি সময় নিয়ে সে-ই অ্যাকসিডেন্টের একটা নিখুঁত গল্প বানালাম। ধীরে ধীরে বললাম, আমার আর সুমনের এক কমন ফ্রেন্ড আছে- জাহিদ। আমরা তিনজনই আইডিয়ালে পড়তাম। জাহিদকে চেনেন আপনি?

সামিয়া দুদিকে মাথা নাড়ল।

যে নেই তাকে চেনার প্রশ্নই ওঠে না। আমি জাহিদকে চেনানোর জন্য বললাম, জাহিদ গত সাত বছর ধরে ক্যানবেরা থাকে। সিডনি থেকে ৩ ঘণ্টার ড্রাইভ। সুমন আর নীল সিডনি যাবার পর থেকেই জাহিদ ওদেরকে বলতেছিল ক্যানবেরা থেকে একবার ঘুরে আসতে। আজ যাব, কাল যাব করে ওদের যাওয়াই হচ্ছিল না। মাস ঘুরতে ঘুরতে অক্টোবর চলে আসল। প্রতিবছর অক্টোবরের শুরুতে ক্যানবেরায় একটা বড়ো ফেস্টিভ্যাল হয়। বাংলায় বলা যায়, বসন্তবরণ উৎসব। ফেস্টিভ্যালে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় চারদিক। দেশের নানাপ্রান্ত থেকে মানুষ সে সময় ক্যানবেরা ছুটে যায়। সুমন আর নীল অক্টোবরের দুই তারিখ সকাল বেলা রওয়ানা দেয় ক্যানবেরার উদ্দেশ্যে।

এই পর্যন্ত বলে আমি মাথাটা নীচু করে ফেললাম। একটা দীর্ঘ পজ নিতে হবে এখন। এ ধরনের গল্প একটানা বলে যাওয়া যায় না। বিরতি নিতে হয়। দুঃখের ভান করতে হয়। এবং সে-ই বিরতিতে গল্পের বাকিটুকু ভাবতে হয়।

সামিয়া বলল, তারপর?

আমি ধীরে ধীরে বললাম, গাড়িটা নীল চালাচ্ছিল। একটা হুন্দাই আই-৩o সেডান, অ্যাশ কালারের। ওরা এম-৫ মোটরওয়ে ধরে হাইওয়েতে ওঠার চেষ্টা করতেছিল। পথে পড়ে কাটলার ডিসি পয়েন্ট। সেখানে একটা ব্রিজ আছে। সে-ই ব্রিজের নিচে ইমারজেন্সি লাইনে কিছুক্ষণের জন্য থেমে ছিল গাড়িটা। হঠাৎ পেছনের একটা বড়ো কেনওয়ার্থ লরি নিয়ন্ত্রণ হারায়। মাতালের মতো ধেয়ে এসে ধাক্কা মারে হুন্দাই সেডানকে। স্পট ডেথ হয় দুজনেরই।

আমি খেয়াল করলাম, সামিয়া হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বললাম, জাহিদের মুখে শুনছি পুরো ঘটনা। এতবার শুনছি যে দৃশ্যটা মুখস্থ, যেন ঠিক আমার চোখের সামনেই ঘটে গেছে।

এরপর আরও প্রায় দশ মিনিট টানা মিথ্যা বলে গেলাম। একটার পর একটা ছোটো ছোটো ডিটেইল যোগ করলাম সে-ই অ্যাকসিডেন্টে। বলতে বলতে একসময় আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো, ব্রিজের নিচে সত্যিই এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এতগুলো মিথ্যা বলার পরেও আমার মনে কোনো অপরাধবোধ তৈরি হলো না। সুমন আমার তৈরি করা একটা চরিত্র। তাকে আমি তৈরি করতে পারি। প্রেম করার অনুমতি দিতে পারি। সিডনি পাঠিয়ে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে মেরেও ফেলতে পারি।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এতগুলো মিথ্যা বলার পরেও আমার মনে কোনো অপরাধবোধ তৈরি হলো না। সুমন আমার তৈরি করা একটা চরিত্র। তাকে আমি তৈরি করতে পারি। প্রেম করার অনুমতি দিতে পারি। সিডনি পাঠিয়ে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে মেরেও ফেলতে পারি।

কিন্তু সামিয়া তো আমার কল্পনার কেউ না। সে আমার সামনে এই মুহূর্তে দাঁড়ানো। জলজ্যান্ত এক মেয়ে। শুধু মেয়ে হলেও হতো, সে সুন্দরী। সুন্দরী মেয়েদের চোখ ভিজে গেলে আমি চোখে-মুখে অন্ধকার দেখি। হৃদয় পোড়ার গন্ধ পাই। সামিয়া যেন কষ্ট না পায়, সেটা দেখা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?

আমি আড়চোখে তাকালাম। দেখতে পেলাম, একটু একটু করে তার মুখের লালচে আভা কেটে যাচ্ছে। চোখে পানি জমছে আবার।

সুমনকে মেরে ফেলাই ঠিক সিদ্ধান্ত। কোনো সন্দেহ নেই। সে মরে গেছে বলে সামিয়া তাকে ক্ষমা করে দেবে। মৃত লোকদের ব্যাপারে আমরা মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখি না। সামিয়া এবার সুমনকে সত্যিই ভুলে যেতে পারবে। নতুন করে জীবন শুরু হবে তার।

আমরা দুজন চুপচাপ বসে রইলাম প্রায় পাঁচ মিনিট। সামিয়ার মাথা নিচু। কী ভাবছে আমি জানি না। কোমলস্বরে বললাম, আপনি বাসায় যাবেন না?

ও হ্যাঁ, কথাটা বলে সামিয়া মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল।

তাকে দেখে মনে হলো, সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল লিফটের দিকে। পা টেনে টেনে হাঁটছে। একটা মানুষ যখন হেরে যায়, তখন তাকে তার নিজের ছায়া মনে হয়। আমি দেখলাম, একটা ক্লান্ত ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে। ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেলে খেলনা পুতুল যেমন চলতে চলতে থেমে যায়, তেমন করে লিফটের সামনে গিয়ে থেমে গেল সামিয়া । স্থির হয়ে দাঁড়াল। আমি টুল ছেড়ে উঠলাম।

সে ফিরে তাকালো আমার দিকে। তার চোখ দেখে আমার ভয় হলো। ঠোঁটে একটা সান্ত্বনাসূচক হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। ওই চোখে তাকালে সান্ত্বনা আসে না।

আমি প্রথমবারের মতো খেয়াল করলাম, সামিয়ার পরনে মিডনাইট ব্লু কালারের ফতুয়া।

আমার গল্পে নামহীন সে-ই কিন্ডেল-কন্যা ঠিক এই ফতুয়াটাই পরেছিল।

 

 

Alvi Ahmed_Motif[সমস্যা হচ্ছে, এতক্ষণ যা বললাম সেটাও একটা গল্প। এই গল্প পড়ে যদি কেউ আলভীকে খুঁজতে শুরু করে তাহলে তাকেও সরিয়ে দিতে হবে। সিডনিতে তো আর পাঠানো যাবে না। রিপিট হয়ে যাবে। অ্যাডিলেড বা মেলবোর্নে পাঠাব? রোড অ্যাকসিডেন্ট নয় এবার আর, প্লেন ক্র্যাশ।

কিন্তু আমার যে বেঁচে থাকতে খুব ইচ্ছা করে।]

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

আলভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ কৌশলে স্নাতক। পেশাগত জীবনে যন্ত্রপাতির খটমট বিষয়ে না গিয়ে বেছে নিয়েছেন অডিও ভিজুয়াল ফিকশন নির্মাণ। টেলিভিশন মিডিয়ার জন্য নাটক রচনা ও পরিচালনা করেন। সিনেমার বড় পর্দায়ও অভিষেক হয়েছে। লেখালেখি তার নেশা। নিজের নাটক, সিনেমার জন্য গল্প, চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে তার লেখার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। আলভী আহমেদ হারুকি মুরাকামির তিনটি উপন্যাস অনুবাদ করেছেন—'নরওয়েজিয়ান উড', 'হিয়ার দ্য উইন্ড সিং' এবং 'পিনবল, ১৯৭৩'। বইগুলো বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে, মুরাকামির গল্প সংকলন, 'কনফেশনস অব আ সিনেগাওয়া মাংকি'। প্যারালাল ইউনিভার্সের ওপর তার প্রথম মৌলিক উপন্যাস 'জীবন অপেরা' ২০২১-এ প্রকাশিত হয়েছে। ১১ জন নিঃসঙ্গ মানুষকে নিয়ে লেখা 'ব্লাইন্ড স্পট' তার প্রথম গল্পগ্রন্থ। ইংরেজিতে লেখা তার পেপারব্যাক গল্পগ্রন্থ 'ঢাকা ড্রিমস' অ্যামাজনে ফিকশন বেস্ট সেলার ক্যাটাগরিতে শীর্ষে ছিল তিন সপ্তাহ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।