সোমবার, এপ্রিল ২২

শিমুল সালাহ্উদ্দিনের আখ্যানকাব্য : যারাপথ মেঠোপথ আমপাতা তারাপথ কাঁঠালপাতা

0

আমার শৈশবের নদী তুরাগ আর আমার দেখা প্রথম কবি, ছোটমামা আল ইমরানকে, শান্তি ও আমাকে না মেরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওসব বড় হলে করতে হয়; আমরা, লালফুলফ্রকপরা শান্তি, হাফপ্যান্ট আমি, মনে আছে, লজ্জা পেয়েছিলাম…

 

আঁকাবাঁকা পথ
……………ঘুট্ঘুটে আঁধার কেটে
এইমাত্র পথ হারালো যে জোনাকী
……………….বিষকাটালির ঝাড়ে—
মনে হলো, অদৃশ্য এমনি কারো
………………………….ত্রস্তে
চলে যাওয়া ধুমশলাগুন…

তুরাগের জল
পেন্সিল-রঙে আঁকা এলোমেলো সন্ধ্যালাল জলের কল্কল
অনুভূত হয় একশোভাগ মনের সৌষ্ঠব—

…………………..…………..দক্ষিণে চেয়ে এই নদী
চারশো বছরের বুড়ো শহরের জল,
না না পানি,
যেইখানে নিল বাঁক
কোনকালে কোন কহর সদাগর প্রতিদিন এসেছে সেখানে!
………………………..এখানে তাঁর আশ্চর্য ডিঙার ভাসানে!

আসমানেত্তে কি ধুপ্ করে পড়ে জ্যাঠার অপরূপ রূপকথা—
কহর সদাগর, সোনাভান,
……………………….আশিমণি ডেগের পুরাণ!

ঢাকার অদূরে আর গ্রাম নেই বলে এখানেই শ্যুটিং,
চম্পা-ববিতার ঠোঁটের রঙে ‘তোমার কাঙ্খের কলসী
গেলো জলেতে ভাসি’ হাফপ্যান্ট ভেজায় জুলহাস ভাই,
যদিও তখন ক্লাস সিক্স, গলাগলি আমাদের
অন্যরকম ব্যাপারও আছে, হয়েছে কত যে কিছু এদিক-ওদিক—

একবার দুইটি কিশোর গাঙ্-পাড়ে, পাকাধানক্ষেতে,
……………..সোনালি ধানের বেড়ায় ঘেরা নির্জন আলে
কাঁচা ডালে ব্লেড আটকিয়ে চেঁছেছিলো বাল,
বড় হওয়ার ঝাল পেয়েছিল টের,
…………………….ঘুমভেঙে দেখে ফেলা বাবা হয়েছিল
পাটক্ষেতে শান্তির সাথে বউ বউ খেলে—

এখানে বসেই উত্তর খুঁজেছি কত করে, জীবনের কাছে
কী পেলাম কিংবা জীবন পেয়েছে কী আমার কাছে?

এ জীবন শব্দহীন বলেই যেখানে জানি
…………………..কি করে যে লাগে পাঁজরে ঝাঁঝর
…………………..…………………..প্রেমকিয়া হাওয়ার আদর!
বেদম বেদন ও কষ্টের মাঝে টুকরো একটু সুখঝিলিক আশ

রহস্যনিবিড় কোন পথ বেয়ে আসে
দ্রুতপ্রস্থানের এমন সমন নিয়ে!

ঘনতর হয় সন্ধ্যা-আঁধার, ও রাত তোমার
………………………..অতিথিরা এসে গেছে,
এলো চিরকেলে দায়িত্বশালিনী—
শুকতারার মুখ মহান শূন্যে জ্বলজ্বল,
…………………..………ধীরে খুব শামিয়ানা ফেঁড়ে
তারার গুলিস্তাঁ—
………………ক্রতু, অত্রি, বশিষ্ঠ, মরীচি, অঙ্গিরা, পুলহ, পুলস্ত্য

আঁধার গাঁয়ের মেঠোপথ আমার গাঁয়ের তারাপথ
…………………..…………….ম্লান হয়ে আসে ঘুমে
আর কি ইচ্ছে হয় হিসেব মেলাতে ভেবে আজ
…………………..……………জীবনের ঝরাপাতাগুলি?

দেখে বা না দেখে ফিরে আসা
…………………..যত পাতা ফুলেদের শৈশব-ঈর্ষা
জীবন বাবুর মতো সেও হয়তো
…………………..…………এই হৃদয়ের নাম—

হয়তোবা তোমারও। হয়তো তোমাদেরও।
হয়তোবা এ-ই সকলের হৃদয়ের নাম এমন
সর্বজনীন নিটোল আঁধিয়ার রাতে।

ওষুধ বস্ত্র ইটভাটামলে থামন নেমেছে তুরাগের জলে;

………………………………….ভেশাল-জাল লতাকলমি
শাপলাশালুকফুল
…………………..……………..পাড়ে বাঁধা নৌকাদুটো—
সবাই আঁটকে গেছে
…………………..এখন ঘোলাটে কাঁচ তুরাগের জল
…………………..এবং ঘোলাটে কাঁচ হয়েছে হৃদয়
অথচ ঘষাটে কাঁচ এসব বাস্তব—
…………………..…………..এই মনে সব আছে
তাই সব সত্য আছে
সত্যের প্রয়োজনে যেমনটি হওয়া চাই

…………………..…………………..হৃদয় তেমনি নাই।

শুধু ‘তোমার’ লিখতে না পারার বিস্মরণে মনে আছে
‘সত্যই সুভিক্ষ যে, সত্যের মত স্বাদ অন্য কিছুতে নাই,
…………………..…………………..সাধ তাই পায় না জীবন।

কবির ছদ্মবেশে আমি বসেছি এখানে,
ক্ষয়িষ্ণু বটের গুঁড়ি, মাটিহীন হাঁড়কাঁকাল
………………………….খাতা আর কলম, ইচ্ছে করে সব তার
শৈশবের বুকে রেখে আসি…

এখন দৃষ্টি যেখানে আমার
…………………..…..সেটাকে দেখি না।
হৃদয় এখন
…………….বহুধাতরঙ্গ
হচ্ছে ফেনিলতর;
…………………হৃদয়ে আমার চড়া?

ভাবতে ভাবতে দেখি খাতাটি হঠাৎ ইবোনাইট বোর্ড হয়ে যায়।
তারপর একটুকরো ব্লটিং পেপার; ছোট্ট হাতপাখা
…………………………আয়না হয়ে যায়। কলম এভাবে থার্মোমিটার।
পরে পাটশোলা, পেন্সিল, ছিটকিনি, আইসক্রিম কাঠি।
যতক্ষণ না নিচ্ছি হাতে, চিত্তের লকআপে এই চেহারা ধারণ করে তারা।
লেখা হয় না আমার। শুধু বসে থাকা।

ফোকাস ও ডিফোকাস।
…………………..ডিফোকাস ও ফোকাস।

এইতরো বসে থাকা, চলে যাওয়া এ দিয়ে কি অস্তিত্ব পথিক
আমি হারাই সকলি?

একতিল
…………দুইতিল
তিল তিল করে
…………………..নিজের অঙ্গবিশেষ হারাই, হারানোই হয়;
…………………..…………………..হারাই হারাই সদা পাই ভয়?
ডুবলো কি সই অন্তরে তোর নিজের অন্তর্জলী?

দিনের গাঙকিণার হতে ওপারে যখন
বড়টিলাটির পূবপাশে দুটো শ্যাওড়ার মোকাবেলা;
…………………..…………………..উঁচু দুই সহোদরগাছ;
ওয়ারিশ নিয়ে পৌঁছুতে সিদ্ধান্তে যেনো
কোনো বোর্ড বসিয়েছে তারা
দেখে মনে হয়, এমন রাত্রিরপটে তারা আজ আকাশের ছায়া,
বশিষ্ঠ, মরীচি, অঙ্গিরা, আধিরা।
……………………….আমি ও আমার ছায়া প্রশান্ত এপারে।

কোন অনুজ্ঞা অন্তরের কিছুমাত্র শাসন
এইখানে নাই, সকল খাদ্য আছে সব প্রণোদনা

অথর্ব বাঁশির সুর, তারার প্রমন্দ আলো
চাঁদ সদাগর, সপ্তর্ষির রথে চড়ে সমগ্র আকাশ পেড়োয়
কোন অনুজ্ঞা অন্তরের কিছুমাত্র শাসন
…………………..………….এইখানে নাই,
পেলব হৃদয় নির্মাণে শাসন বলে কোন সঠিক-সুস্থ্য
উপাদান নাই।

কণ্ঠে তবু হৃদয়ের বন্দনা চাই
রক্তিম সবুজ প্রাণ; আত্মার বন্দনা চাই
দুই চোখ থেকে, মাথা থেকে, বুক থেকে, হৃৎপিণ্ড থেকে,
বেরোয় ব্যাপন করে চঞ্চল যকৃৎ অপাঙক্তেয় আত্মার কোলাহল
সুবর্ণ ফড়িং হয়, লাফিয়ে লাফিয়ে যায় কাঁটামেহেদি কচুড়িপানা ফুলে
প্রবল ঝাঁকায়

ভালোমন্দের প্রভেদ ভুলে যাওয়া পাপ,
এই আত্মাকে এই রাতে মনে হয় এক চিমটি বাতাস!
…………………..…………………..বা খানিকটা কালো আলো!

এই রাত্রি কিনেছে আমাকে অনামা চিমটিখানি বাতাস ভেবে!
ওঠা হয় না এখান থেকে, আগন্তুক আঁধারের সুরে
সুরের তিরাশি কুটুম, ঘুমের সুবাসমাখা অন্ধ-অন্ধকারে
তারাপথ মেঠোপথ আমপাতা-নদী
…………………..………….এক রঙে রঙা বলে সব
ইচ্ছেমত সেজেগুজে হাজারটা রঙে আসে চেতনায়;

চেতনের শব।

হাঁটুভাঁজ করে বসি, মাথাগুঁজে দু’হাতের পেটে
দু’চোখ বন্ধ করি। অনুভূতির সত্য ছাড়া
এখন আর কিছু নাই। চারহাতপা আঙুলের মাথা থেকে শুরু করে
অস্তিত্বের কেন্দ্রের দিকে গুঁটিয়ে আনি
অনুভূতির দিককল্পনা।

আমার হাত আমার পা
আমার শরীর
আমার তলপেট
গহীন মেঘাঞ্চল
যৌনকক্ষ
আমার বক্ষ
আমার ঊরু

এই সমুদয়
‘আমার’-কে বাইরে রেখে
ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হই
মৌলিক আমার কেন্দ্রে;

আভাস পাই ক্ষুদ্র নয়; বড়ো, বিস্তারিত করবার পালা নিজেকে এবার…

আমি বিস্তারিত হই। আমি বড় হই। ভয়ার্ত গতিতে
পার হয়ে মেঘের দেশ তারাপথ হয়ে তারার রাজ্য ছুঁই…
বশিষ্ঠ, মরীচি, অঙ্গিরা, ক্রতু

…………………..…….অনুভূতি দিয়ে সব হয়!
আত্মা, জীবন, সময় ও সত্যগুলি অনুভূতি ছাড়া কিছু নয়
বলে তুরাগের তীর থেকে মরীচি ঘুরে আসা যায়!

ও জীবনবাবুর সুচেতনা,
তোমার কুটির আর কতদূর বলো, কতোটা দুর্জয়!

মামুর বাড়ি কহুতদ্দুর ॥ আরো আছে বহুদ্দুর ॥
কে গায় মাথার ভেতরে এমন নিদয় সুর ধরে!

দেখো ভাবনার মেঠোপথটাতে
দেখো ভাবনার তারাপথটাতে
দেখো ভাবনার আমপাতাটিতে

আড়ালের বুক খুলে একটুকু
সহজিয়া ধুলো দাঁড়িয়েছি
এ ক্ষয়িষ্ণু বটবৃক্ষ; অথচ আজ ছায়াবালিকাটি

শৈশব শান্তির আঁচল-আঁচালে বসে জীবন দুপুরে
তুরাগের জল
কহরদরিয়া
জ্যাঠার কিসসা
ক্ষয়িষ্ণু বট
ভেহালের জাল
আউশের ধান
নাশিলা পরাণ,
প্রথম সোনা ফোঁটানো সঙ্গী জাহাঙ্গীর-জুলহাস,
বউবউখেলা শান্তি, গোপনতার বালকদুপুর,
মনে করে চুরি করা কলার কাদি মায়ের বকুনি মার
এইটুকু কাঁদি ক্রন্দন আর
অপার হয়ে বসে থাকা তুরাগ বয়ে যায়
আমপাতা তারাপথ কাঁঠালপাতা ছুঁয়ে
…………………..…………স্বপ্নসম্ভব সন্ধ্যার দিকে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, সাংবাদিক, গবেষক ও গণমাধ্যম পরামর্শক। জন্ম: ১৭ অক্টোবর, ১৯৮৭, ঢাকার উপকণ্ঠে, তুরাগে। পৈতৃক নিবাস গাজীপুরের টংগী থানার মুদাফা গ্রামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট ও আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনি’র। আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনি’র জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন চারটি দলীয় মঞ্চপ্রযোজনা। অন্তর্জালে সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলোচিত আয়োজন ‘InতাঁরView with শিমুল সালাহ্উদ্দিন’ এর পরিকল্পক ও উপস্থাপক তিনি। এছাড়া তিনি নির্বাচিত কবিদের নিয়ে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ‘কবির কবিতা পাঠ’ এর আয়োজক সংগঠন ’গালুমগিরি সংঘ’র প্রধান সমন্বয়ক। তাঁর প্রকাশিত ৪ টি কাব্যগ্রন্থ: শিরস্ত্রাণগুলি (ঐতিহ্য, ২০১০), সতীনের মোচড় (শুদ্ধস্বর, ২০১২), কথাচুপকথা…(অ্যাডর্ন বুকস্, ২০১৪), ও সংশয়সুর (চৈতন্য, ২০১৬)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।