
সেইন্ট দানিয়েল
সেইন্ট দানিয়েল ছিলেন প্রাচীন ইরাকের ধর্মগুরু। তাঁর জন্ম আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬২০–৫৩৮ সালের মধ্যে।
দানিয়েলের কবিতা একই সঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মঅভিযোগের দলিল। তিনি প্রশ্ন তোলেন—চিন্তাশীল মস্তিষ্কের উৎস কোথায়, নৈতিকতার নামে কে মানুষের খুলির ভেতর নরক গড়ে তোলে। তারুণ্য, দাম্ভিকতা, পাগলামি ও অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা—সব মিলিয়ে মানুষ কীভাবে নিজের মনের গোপন স্বরকে চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়, সেই কঠিন সত্যও উন্মোচিত হতে দেখা যায় তার কবিতায়।
এই কবিতাগুলো পাঠককে স্বস্তি দেয় না; বরং অস্বস্তির মধ্য দিয়েই জীবনের গভীরতর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সেইন্ট দানিয়েলের কবিতা তাই কেবল অনুভূতির প্রকাশ নয়—এ এক নির্দয়, অথচ সৎ আত্মবিশ্লেষণের শিল্প।
সেইন্ট দানিয়েল-এর কবিতা
১.
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে
যারা নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে,
কেউ বা ফাঁসিতে ঝুলে যায়, কেউ বিষ খায়,
কেউ আবার ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেয়,
কেউবা নিজের কব্জিতে ব্লেড চালায়,
রক্তপাত ঘটায়—যতক্ষণ পর্যন্ত না মৃত্যু আসে।
এবং আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে
যারা প্রেমকে নির্বাচন করে—
ধীরে ধীরে এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে মৃত্যুর
দিকে এগিয়ে যায়।
২.
তোমাদের চোখ,
যদিও তারা কথা বলতে পারে না;
তাদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচাতে দেখি আমি।
এবং আমার হস্ত-যুগল,
যদিও তারা ক্ষতবিক্ষত নয়—
কিন্তু সেখান থেকে অপর প্রান্তের কাগজের উপর
রক্ত উপচে পড়ে।
৩.
রাত্রিকালীন নৈঃশব্দ্য থেকে
নেকড়ের দীর্ঘ আর্তনাদ শোনা যায়।
নির্ঘুম বিছানা থেকেও
বেরিয়ে আসে সত্যবদ্ধ প্রার্থনা বাণী।
অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে
নৃত্য করে জোনাকি পোকার দল।
এবং
দুঃখভারাতুর হৃদয় থেকে ঝরে পড়ে
সুন্দরতম কবিতা।
৪.
কে দিয়েছে আমাকে এই চিন্তাশীল মগজ?
কে সেই ধর্ষকামী ধর্মাবতার?
কে সেই নৃশংস জারজ,
যে আমার খুলির ভেতর পুরে দিয়েছে একটা আস্ত নরক?
৫.
খুব ভালো করেই জানি, আমার ভেতরে বোকামি কাজ করে এই কারণে যে
আমি বয়সে এখনও যথেষ্ট তরুণ—
আমার ভেতরেই এই স্বার্থপরতা এবং দাম্ভিকতা আসে তারুণ্যদীপ্ত উদ্দীপনা থেকে
এবং এই স্বার্থপরতা এবং দাম্ভিকতা দ্রুতই রূপান্তরিত হবে পাগলামিতে;
কেউ যখন তরুণ এবং সুন্দর থাকে তখন তার পাগলামি আরও বলবান হয়
এবং দ্রুতই সে অমরত্বের দিকে এগিয়ে যেতে চায়।
আমার ভেতরের দাম্ভিকতার বীজ শরীরী নয় এর বীজ অনেক গভীরে প্রোথিত,
এটা পারমার্থিক।
কেউ কি আমাকে বলবেন—
সেই ব্যক্তির চেয়ে কে বেশি দাম্ভিক হতে পারবে যে তার মস্তিষ্কের
গোপন স্বরকে অনায়াসে অমরত্বের দিকে ঠেলে দিতে চায়।
সম্ভবত আমি সত্যিকার অর্থে পাগল হয়ে গেছি;
কিন্তু এ কথাও ঠিক যে কেবলমাত্র পাগলরাই আজীবন বেঁচে থাকে।
৬.
কিছু হতভাগ্য আত্মাদের মধ্য থেকে ঈশ্বর
কাউকে কাউকে কবি বানান—
এরপর তাদের উপর দাহ্য পদার্থ ছিটিয়ে দেন
এবং তাদেরকে আগুনের উপর ঝুলান।
শুধুমাত্র কিছু একটা পোড়ার বিনিময়েই সেই আগুন থেকে
বিচ্ছুরিত হয় আলো;
৭.
নিঃসঙ্গতা একটা উপহার—
যদি তুমি নিজেকে ভালোবাসো তবেই।
তাই একাকিত্বকে ভয় পেয়ো না;
নিঃসঙ্গতা এমন একটা জিনিস যা তোমাকে
শেখাবে কিভাবে একাকিত্বকে আলিঙ্গন করতে হয়।
৮.
সে আমার বিছানায় শোয়া ভঙ্গিতে,
সম্পূর্ণ উদোম,
তার চোখ, লজ্জাবনত এবং প্রীতিকর;
সুগন্ধযুক্ত, আমার বায়ুতন্ত্রে কামনা উপচে পড়েছিল,
তার চুল ছিল সুদীর্ঘ এবং গুচ্ছবদ্ধ, ছিল কুচকুচে কালো
যেমন নিরীহ রাতের ঘন অন্ধকার ঘিরে রাখে আমাদের;
তার ত্বক বিছানা পাশের ল্যাম্পের মতো পিঙ্গল
যা শিখাহীন উজ্জ্বল আলোর শিখা হয়ে আভা দিচ্ছে।
তার দেহের সমস্ত অংশই সৌন্দর্যমণ্ডিত,
সে মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ত্রুটিহীন।
এবং আমি একজন অনিশ্চিত মানুষ;
বুঝতে পারি না কোথা থেকে স্পর্শ করা আরম্ভ করব।
৯.
হে সুন্দরের নশ্বরী;
যদি তোমাকে একথা বলি যে,
আমি পাগল হয়েই বেশি আনন্দিত,
তাহলে তুমিও কি আমার সঙ্গে পাগল হবে?
১০.
তুমি হওয়া ছাড়া তোমার কাছে আর কোনো বিকল্প নেই;
হতে পারে এটা তোমার জন্য আশীর্বাদ, হতে পারে অভিশাপ।
নিশ্চয় তুমি তোমাকে মিথ্যা বলতে পারো, অবশ্যই অন্য কেউ নয়।
কিন্তু তোমার মৃত্যুশয্যায় তুমি ঠিকই অনুধাবন করতে পারবে যে
তুমি আসলে কে ছিলে।
আসন্ন মৃত্যুই একজন মানুষকে সর্বাধিক সৎ করে তুলতে পারে
অন্য কিছু নয়।
মৃত্যু অকৃত্রিম, খুবই অকৃত্রিম।
জীবিতাবস্থায় প্রায় পুরোটা সময় আমরা জীবন নামক একটা
ধোঁকার সম্প্রসারণ করি মাত্র।

জন্ম : ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ালেখা শেষে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। লেখালেখি করেন প্রাণ থেকে। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: ‘যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব’, ‘অতীতা, দুঃখরা পাখি হয়ে গেল’, ‘বাংলাদেশে হৃদয় মেশে’, অনুজ্জ্বল চোখের রাত (কবিতা)। গল্পগ্রন্থ: ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’। এই পাণ্ডুলিপির জন্য তিনি জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা থেকে ইতিকথা মৈত্রী সাহিত্য সম্মাননা-২০১৭ লাভ করেছেন।।