শনিবার, এপ্রিল ২৭

মায়া সিনেমা : পল্লব ভট্টাচার্য

0

বাড়িতে বইয়া, পুস্তানি লাগাইয়া, ছেঁড়া বই জোড়া দিয়া, সেলাই বাঁধাই করতে করতে, নিত্যগোপালের পিঠ যতটা কুঁজো হইছে, বয়সের কারণে ততটা হয় নাই। তবু আজকাল যখন অনেকেই পেছনে তারে কুঁজা গোপাল ডাকে, তখন নিজেরে সে বুড়াই ভাবতে চায়। তা বুড়া মানুষের যেমন হয়, তারও তেমন শখ আহ্লাদের মৃত্যু হইছে। কিন্তু মৃত্যু কি ঠিক ঠিকই হইছে, না কি ভেতরে ভেতরে এখনো জ্যান্ত আছে, সে নিজেও বোঝে না। বয়স পঞ্চাশ মানেই যে সব শখ আহ্লাদের মৃত্যু, তেমনও না। তবুও, মীরা যখন বলে, সিনেমা যামু, তখন শখ আহ্লাদের চেয়েও বেশি মনে হয়, টাকা।

সুচ দিয়া এক-একটা বই এফোঁড়-ওফোঁড় করতে করতে গোপাল নিজের মনেই বলে, শালার সিনেমা। আজকেই দুই হাজার ক্যাশ মেমো কাটিং বাইন্ডিং করে, পৌঁছাইয়া দিতে হবে। দিলেই যে টাকা পাওয়া যাইব, তারও বিশ্বাস নাই। তবে রতু বাবু মানুষটা খারাপ না। বিপদেআপদে চাইলে টাকাপয়সা ধার দেন। কিন্তু রতু বাবুও কোনো তালেবর লোক না, ছোট্ট লেটারহেড প্রেস, আয় কম। চাইলেই সব সময় পাওয়া যায় না। তবে ক্যাশে টাকা থাকলে কিছুমিছু দিয়া, গোপাল বাইন্ডাররে হাতে রাখেন। গোপাল বোঝে সবই, কিন্তু কী আর করা। আদায় কম থাকলে, মাসের পনেরো তারিখের পর, রতু বাবুও ফতুর বাবু। কাজেই, সিনেমা যামু কথাটা তার কানে আর শখ আহ্লাদের কথা থাকে না, একটা প্রচণ্ড বোমার মতো ফাইট্যা ওঠে।

মীরা আবার বলে, সিনেমায় যামু কিন্তু আজ।

টাকা নাই। বলে গোপাল আবার তার সুচ সুতোর দিকে মন দেয়।

বছরে একটা সিনেমা দেখার কথা কইছি, তাও টাকা নাই, টাকা নাই। কবে আছিল তোমার টাকা? বলতে বলতে মীরা ঘরের ভেতরে ঢুইক্যা যায়। গোপাল ঘাড় ঘুরাইয়া একবার দেখে। তারপর আবার নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মন অত সহজ না, চাইলেই তারে ঘাড় ধইর‍্যা কাজে লাগানো যায় না। তার হাত সেলাইয়ের কাজ করতে থাকে ঠিকই, কিন্তু মন এ ঘাটে সে ঘাটে ঠোক্কর খাইতে থাকে।

ভেতরটা হুহু করে। বারান্দায় যেইখানে রোদ পড়েছে, সেইদিকে দেখতে দেখতে মনে হয়, বড়ো শ্যাওলা ধরা এই জীবন, নাকি জীবনটাই শ্যাওলা হইয়া গেছে! ভাসতে ভাসতে এমন এক ঘাটের রানায় ঢুকে গেছে যে, রোদের আলোও আর গায়ে লাগে না। অথচ ঝলমলা রোদের একটা সকাল তারও ছিল।

ভেতরটা হুহু করে। বারান্দায় যেইখানে রোদ পড়েছে, সেইদিকে দেখতে দেখতে মনে হয়, বড়ো শ্যাওলা ধরা এই জীবন, নাকি জীবনটাই শ্যাওলা হইয়া গেছে! ভাসতে ভাসতে এমন এক ঘাটের রানায় ঢুকে গেছে যে, রোদের আলোও আর গায়ে লাগে না। অথচ ঝলমলা রোদের একটা সকাল তারও ছিল। কইলে কেউ বিশ্বাস যাবে না, কিন্তু সেই দেশে অভাব সে তেমন করে টের পায় নাই আগে।

সব যেমনকে তেমন ফালায়া, সেই যে চলে আসতে হয়েছিল, আর যাওয়া হয় নাই। অল্প কিছু নগদ টাকা আর মায়ের গয়না, যা কিছু বাপে পোঁটলার মধ্যে নিয়া আসতে পেরেছিল, মাথা গোঁজা আর বেঁচে থাকার জন্য, সব গেছে। গোপালের যা কিছু আছে, সব অই পাড়ে আছে। মাঝে মাঝে গোপাল ভাবে, সব কি তেমনই আছে!

এইসব মনে হলেই গোপাল আনমনা হয়। সে তার নিজের হাতে বাঁধানো খাতাটা বের করে এক-একটা ছবির দিকে চেয়ে থাকে। তার মন তখন সাঁতার কাটতে থাকে। কেউ দেখে না। শুধু মীরা যদি দেখে ফেলে কখনো, তো হিসহিস করে ওঠে। – আদিখ্যেতা। এই বয়সেও ভীমরতি ছাড়ে না।

ভীমরতিই। এই পাড়ে আসার পর, তার সেই হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট হওয়া বয়সে, বাপের ভাঙাচোরা মুদি দোকানে পোঁটলা বাঁধার কাগজের সঙ্গে হঠাৎই পেয়ে গিয়েছিল, পাতাজোড়া সেই রঙিন ছবি। চোখ দুইটার দিকে চাইতেই, সে দেখতে পায়, বুড়িগঙ্গার উথাল-পাথাল ঘোলা জল। তার মন অই ঘোলা জলের দিকে দেখতে দেখতে উদাস হয়ে যায়।

যত বয়স বাড়ছে, অই ঘোলা জলের টান তত বাড়ছে। ইচ্ছা হয়, জামা কাপড় পাড়ে থুইয়া ছোটোবেলার মতো অই জলে ঝাপ দিয়া পড়ে।

এই আরম্ভ হইছে আদিখ্যেতা! বলতে বলতে মীরা রান্নাঘরে ঢুকে যায়। কখন যে আইসা পেছন থেইকা দেখছে, গোপাল টের পায় নাই। এখন কথাটা শুনে বুঝতে পারল, মীরা আসছিল। তাড়াতাড়ি নিজের খাতা সরাইয়া রাখে সে।

ক্যাশ মেমোর বইগুলি সেলাই করে সুতার গিট দিয়া রাখতে রাখতে, গোপাল একবার চোখের আন্দাজে বুঝে নেয় কয়টা বই হইল। সুতার কাজ শেষ হইলে আঠার কাজ। তারপরে সুনীতি প্রেসের কাটিং মেশিনে কাটিং করে, বিকাল বিকাল রতু বাবুরে পৌঁছাইয়া দিতে হবে। এই সময়ে একটা কাপ চা হইলে ভালো ছিল। আজকাল মাঝেমধ্যেই গলা শুকাইয়া ওঠে। কিন্তু মীরারে এখন চায়ের কথা কওয়া, আর সাপের লেজ দিয়া কান চুলকানো একই কথা। বাইরে গিয়া দোকান থেকে খাইতে পারে, কিন্তু হাতের কাজ আটকে থাকবে। গোপাল নিজের অজান্তেই গলা খাঁকারি দেয়।

দেখ গিয়া মণি, গলায় বোধ হয় লাটিমাছ ঢুকছে। রান্নাঘর থেকে মীরা খোঁচায়।

মণি এইবার মেট্রিক দিবে। মায়ের ঠিসারা ঠিকই বোঝে। ঘরের ভেতর থেকেই বলে, একটু চা করে দিলেই পারো।

মায়ের কথা মনে পড়ে গোপালের। কিছু চাইবার দরকার হয়নি, সব কেমন আগে আগেই বুঝে যেত। মণিও এমন। বাপের গলা খাঁকারিতেই বুঝে গেছে, একটু চা খাইতে চায়। গোপালের মনে একটা সুখ সুখ ভাব হয়। মনে মনে বলে, মা রে, ছেলে হইয়াও ক্ষমতা ছিল না, বাপ হইয়াও অক্ষম, তোরে কোনো সুখ দিতে পারলাম না।

কিন্তু মনের ভেতরের এই ভাবটা বেশিক্ষণ থাকে না। তার আগেই, মীরার খ্যাকখ্যাকানি তারে বাস্তবে ফিরায়ে আনে। চা কইলেই চা হয়? আনছে কালকে চা-পাতা? এতবার কইছি।

গোপাল এইবার সত্য সত্যই বিবশ হয়। মীরার কী দোষ! চা-পাতা আনতেই গেছিল সে। মীরাও বারে বারে কইয়া দিছিল। কিন্তু, এই কিন্তুর কথা সে কারে কয়! কে বুঝবে! মীরা বুঝবে না। মণির পক্ষে বোঝা অসম্ভব। মায়ে থাকলে হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পারত। এখন এই আধবুড়া বয়সে তারে বোঝার মতো কেউ নাই। অগত্যা, ঘাড় আরও গুঁজে, সে সুঁইয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে থাকে। সুঁইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে আসলে সে নিজেরেও বান্ধে। সেই গোপালরে এই গোপালের মধ্যে বান্ধতে না পারলে, থাকা বড়ো কঠিন হয়ে ওঠে। বান্ধতে চায়, মনে করে বান্ধতে পারছে, কিন্তু আসলে পারে কই!

চায়ের কাপ সামনে রাখতে রাখতে, মণি ফিসফিসাইয়া কয়, খাইয়া লও।

মণির দিকে চাইয়া, গোপালের চোখ ছলছলায়। ভেতরে কথার উথালপাথাল শুরু হয়। অথচ কোনো কথাই তার মুখে জোগায় না। সে ফ্যালফ্যাল কইরা মেয়ের দিকে চাইয়া থাকে।

কী হইছে! মণি জিজ্ঞেস করে। তারপর নিজেই বলে, চারু মাসির কাছ থেইক্যা চা-পাতা আনছি। আজকে আনলেই ফিরাইয়া দিমু।

গোপাল কী কয়, কী কইবে, তার চোখে শুধু জল জমে। সব ঝাপসা হইয়া যায়।

মায়ে ডাকে, গোপাল ত্বরায় আয়। সে শুধু ভাসে আর ডোবে। উঠতে মন চায় না। পানিখাউরি পক্ষীর মতো মাটি ধোয়া ঘোলাটে জলে ভাসতে থাকে। পরনের ইজের নদীর পাড়ে থুইয়া, যখন মন চায় তখনই সে বুড়িগঙ্গায় ভাসে। পুষ্কুরিণীতে ভাসার মতো না, বুড়ির জল আঙুলের মতো তিরতির কইরা তার সারা শরীরে হাত বুলাইয়া যায়। এক এক সময় শিউরিয়া ওঠে তার এগারো বছরের টিংটিঙে শরীর।

এই সময় তারে ভাবে পায়। জলের ভেতরে বুঝি-বা মাছ, মাছের মতোই, তার মনে হয় নিজেরে। জুনিয়র পাঠশালার বাহার, হরেশ, শংকর, আমিনুল সবাই, এমনকি মধু মাস্টারও জানে, সময়ে সময়ে গোপালরে ভাবে পায়। জলে যেমন, জলের দিকে চাইয়াও তেমন। বই-খাতা থুইয়া সে বাদামতলীর ঘাটে বইয়া থাকে। চুপচাপ, একলা। তখন বিকাল হয় হয়। বুড়িগঙ্গার বাদাম-খয়েরি জল অথৈ হইতে থাকে।

জলের ভেতরে বুঝি-বা মাছ, মাছের মতোই, তার মনে হয় নিজেরে। জুনিয়র পাঠশালার বাহার, হরেশ, শংকর, আমিনুল সবাই, এমনকি মধু মাস্টারও জানে, সময়ে সময়ে গোপালরে ভাবে পায়। জলে যেমন, জলের দিকে চাইয়াও তেমন। বই-খাতা থুইয়া সে বাদামতলীর ঘাটে বইয়া থাকে।

মায়ে আবার ডাকে, গোপাল ত্বরায় আয়।

উঠতে মন না চাইলেও, সে উঠে আসে। মাটিতে উঠেও সে আবার জলের দিকে দেখে। বুড়ি যেন কেমন এক আকুতিভরা চোখে তার দিকেই চাইয়া আছে। মন চায় না, তবু বুড়িগঙ্গার পাড় ছাইড়া ব্যাকল্যান্ড বাঁধের ওপর দিয়া হাঁটতে হাঁটতে তারে ঘরে ফিরতে হয়। মায়ের পিছে পিছে।

কী হইল, চা ঠান্ডা হইতাছে। গরম গরম খাইয়া লও।

মেয়ের কথায়, গোপাল আরও কুঁজো হয়। এক দীর্ঘ নিশ্বাসে এগারো বছরের ভাবে পাওয়া গোপাল রে বুকের থেকে বের করে, চায়ে চুমুক দেয়। গলায় একটা আরাম পায়। মেয়ের দিকে চায়। মণি যেন খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হইয়া গেল। টাকাপয়সা তো কিছু জমাইতে পারল না এত দিনে। কেমনে কী করবে এই ভাবনা আবার তারে পাইয়া বসে।

ভাগ্য ভালো, বাপ এই মাথা গোঁজার ঠাঁই-টা করে গেছিল। নইলে, গোপাল বাইন্ডারের পক্ষে সংসার চালাইয়া, বাড়ি বানানো সম্ভব ছিল না। তেরো পার হইয়া চৌদ্দয় পড়ছে মাত্র, সেই সময়ই বাপ ঠিক করে, আর না। দুই দুইবার দোকান লুট হইছে। আত্মীয়স্বজন, আগের পাড়াপড়শি, কেউ আর নাই। একে একে সবাই অই পাড়ে চলে গেছে। খবর যা পায়, অইখানে ওরা ভালোই আছে। এইখানে এখন আর গায়ের জবাব দেওয়ারও উপায় নাই। উঠতে বসতে এত দিনের চিন-পরিচিত মানুষগুলার মুখেও শুনতে হয়, আপনাগো দ্যাশে চইলা যান। যেন এই দ্যাশটা তার না। বুজুর্গ যে দুই-চাইর জন আছে, সলিমুল্লী চাচা, আরমান মুনশি, তাগোও আর তেমন দাপট নাই। তাদের বিচারবুদ্ধির কথা আর কেউ তেমন আমল দেয় না। নাজিবুদ্দিন, কুতুব মিঞা, হেই দিনের পোলাপান সব, মান-মান্যি কিছু নাই, এগো ধামাধারী হইয়া থাকতে মন চায় না। গোপালের বাপ ওই পাড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

টাকা পাইলে, মায়ে রে কয়টা টাকা দিয়ো আইজ। মণি এতক্ষণ পরে আবার কয়।

গোপাল সেলাই করতে করতে ঘাড় তুইল্যা চায়। বলে, দেখি, যদি পাই।

শেফালি মাসি, গীতা জেঠি, তরুদিদি সব্বাই ঠিক করছে আজকে সিনেমা দেখতে যাইব। মায়েরেও কইছে বারে বারে। উত্তমকুমারের একটা বই লাগাইছে চিত্রঘরে। না যাইতে পারলে মায়ে কিন্তু খুব কষ্ট পাইব। মণি যেন মায়ের মতোই তারে বোঝাইতে চায়। মা থাকলেও এমনই কইত।

গোপালের কিছু কইবার নাই। সে শুধু মাথা নাড়ে আর সেলাই করে।

কালকে পকেটে মাত্র দশ টাকা ছিল। বাড়ি থেকে বাইর হবার সময়, মীরা বারে বারেই মনে করাইয়া দিছে, চা-পাতা নাই। না আনলে সকালে চা হইব না। গোপাল ভাবতে ভাবতে গেছিল, পাবলিক লাইব্রেরির বই বাঁধানোর বিল হয়তো এত দিনে পাশ হইছে। তাইলে অন্তত তিনশ টাকা হাতে আইব। আসলে এই ভরসা তারে বড়ো বাবুই দিছিল। কইছিল, দিন সাতেক পরে খোঁজ কইরো।

খোঁজ করতেই সে গেছিল। বুড়া ঝরঝইরা একটা সাইকেল, প্যাডেল যত ঘোরায়, তত যায় না, তবু এইটা না থাকলে, শহরের এই প্রান্ত থেকে অই প্রান্তে, অর্ডার নেওয়া, বাইন্ডিং করে ডেলিভারি দেওয়া গোপালের পক্ষে অসম্ভব ছিল। এই সাইকেল আর মীরা এক সঙ্গে এই বাড়িতে আইছে। শ্বশুরের দেওয়া সাইকেল। হারকিউলিস মডেল। দামিই কইতে হবে।

সেইসব দিনে, সাইকেলে শাঁই শাঁই তুলে সারা দিন এই প্রেস, সেই প্রেস আর লাইব্রেরি করে, সন্ধ্যায় যখন ফিরত, মীরা খোটা দিয়া কইত, বাপ তো আমার লগে সতীন দিয়া দিছে।

সতীনই বটে। অই সাইকেলের জিলাই আলাদা। আর গোপাল যত্নও নিত খুব। সকালে উঠেই, পুরানো কাপড় দিয়া ঘষা মোছা, চেইনে তেল দেওয়া, তারপরে একটুক্ষণ রোদে দিয়া ঝকঝকা হইলে, গোপাল তার ওপরে রাজপুত্তুরের মতো বইত। মনে মনে কইত, চল আমার জাবাজ। তখন কাজও বেশি, ঘোরাঘুরিও বেশি। কিন্তু দিনে দিনে সেই সাইকেলের জিলা কমেছে। শরীরের রং চটেছে। ব্রেক, চেইনের গন্ডগোলে চলতে ফিরতে সব সময়ই লড়ঝড় করে। যত জোরে চালাইতে চায়, তত জোরে চলার দম আর এর নাই। গোপালেরও কি আছে? নাই। নাই। গোপাল নিজেই টের পায়। আপে উঠতে এখন আর দমে কুলায় না। আরও বেশি কুঁজো হয়ে যায়, আর খুক খুক কাশি কাশতে কাশতে প্যাডেল ঠেলে।

গতকালও সে বেরিয়েছিল সাইকেল নিয়া। রং চটা, লড়ঝড় সাইকেল চলতে ফিরতে কোঁকায়। তবু ছাড়ান নাই। আজকাল ভিড় বাড়ছে। চারদিকে গাড়ি, স্কুটার, মোটরসাইকেল ফাইফাই করে চলে যায়। এর মধ্য দিয়া, এই সাইকেল চালাইয়া যাইতে কষ্টই হয় তার, তবুও চলতে হয়।

যাইতে যাইতে সে লক্ষ করে, শহরটা কেমন যেন ন্যাড়ামুন্ডি হইয়া যাইতেছে। দালান আর দালান। আগে এত দালান আর সাইনবোর্ড ছিল না। এখন আর চিন পরিচয় কেউ ডাইক্যা জিজ্ঞেস করে না, কী গোপাল, কই যাও? মানুষের মুখের সব কথা যেন বিজ্ঞাপন কইয়া দেয়। আইতে যাইতে সে তাই বিজ্ঞাপনের দিকে চায়। বুঝতে চায়, মানুষে কী কথা কয় আজকাল।

চাইতে চাইতেই সে যাইতেছিল। দুপুরের রোদ ঠিক মাথার ওপর। ইচ্ছা হইতেছিল, কোথাও দাঁড়ায়ে একটু জিরায়। কিন্তু এই রাস্তায় একটা গাছও নাই, যে গাছের গায়ে সাইকেলটা হেলান দিয়া রাখবে আর ছায়ার মধ্যে একটু জিরাবে।

তখনই, সেই ঘেঁষাঘেষি ঠেসাঠেসি ভিড়ে, সে দেখতে পায় এক বিশাল পোস্টারে সেই দুই চোখ। ঘোলাটে বাদামি। বুড়ি গঙ্গার জলের মতো। রোদের আলোয় থিরথির করে কাঁপছে। মুহূর্তে গোপালের পা প্যাডেলের ওপরে থেমে যায়। বুড়া ঝরঝরা সাইকেলটার ব্রেক চেপে ধরে। ক্যাঁচক্যাঁচ করতে করতে একটু দূরে গিয়া থামে। ইংরাজিতে লেখা সিনেমার নাম। এর ওপরেই সেই মুখ। ঘোলা গাঙের মতো দুইটা চোখ। গোপালের মন উথাল-পাথাল করে। ইচ্ছা হয়, বর্ডারের খুঁটি একলাফে ডিঙাইয়া ঝাঁপ দিয়া পড়ে অই গাঙের গহিনে। কিন্তু, চাইর দিকে এমন পাহারা, সে চাইয়া থাকে, তবু ঝাঁপ দিতে পারে না।

মুহূর্তে গোপালের পা প্যাডেলের ওপরে থেমে যায়। বুড়া ঝরঝরা সাইকেলটার ব্রেক চেপে ধরে। ক্যাঁচক্যাঁচ করতে করতে একটু দূরে গিয়া থামে। ইংরাজিতে লেখা সিনেমার নাম। এর ওপরেই সেই মুখ। ঘোলা গাঙের মতো দুইটা চোখ। গোপালের মন উথাল-পাথাল করে। ইচ্ছা হয়, বর্ডারের খুঁটি একলাফে ডিঙাইয়া ঝাঁপ দিয়া পড়ে অই গাঙের গহিনে।

কী হইল? হা কইরা কী দেখেন?

দাদা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পোস্টার দেইখ্যা কী হইব, হলে গিয়া দেখেন।

পেছনে দুই জনের এই ঠিসারা শুনে, গোপাল ত্রস্ত ব্যস্ত রাস্তা ছাইড়া দাঁড়ায় ঠিকই, কিন্তু মনে মনে সে আর রাস্তায় দাঁড়াইয়া নাই। বহুদিন আগের একটি বিকালের কথা কেবল মনে পড়ে।

তখন আকাশ ছাই ছাই হওয়ার আগের নিভে যাওয়া লাল। তেজ নাই। গোপালের মন ভালা না। বাপ এই দেশ ছেড়ে কাল সকালে কোন দেশে যে যাইব ঠিক করেছে, সে জানে না। অই দেশ সে দেখে নাই। বুড়িগঙ্গার পাড়ে বইয়া তার মন থেকে থেকে ডুকরাইতে আছে।

ছাড়িয়া যাইতে এমন কষ্ট, কে জানত। বুড়ি তার দিকে চাইয়া আছে। সেই চোখে বেদনা না বিস্ময়, বোঝে না। আবছা খয়েরি চোখে, বুড়ি শুধু জিজ্ঞেস করে, কেন যাও? কেন যাও?

গোপাল নিজেও যদি জানত, কেন যায়, তবে উত্তর দিত। সে চুপ থাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা কষ্ট, বাপের ওপর রাগ, জমতে থাকে। মনে হয়, সে পলায়ে যায় এখনই। যাতে তারে আর খুঁজে না পায় কেউ। বুড়ি গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে গিয়াও মনে হয়, বুড়ি যেন নিজেরে গোটাইয়া নিতেছে। সে একবার বুড়ির দিকে চায়, একবার দূরের সবুজ গাছগুলার দিকে চায়। কিন্তু কিছুই নাগালে পায় না।

অনেক দূর থেকে যেন শুনতে পায়, আপনাদের প্রিয় প্রেক্ষাগৃহ মায়া সিনেমায় চলিতেছে … নাচে গানে ভরপুর হিন্দি রঙিন ফাইটিং চিত্র…

ভাঙা রিকশায় চোঙা মাইক বাজাইয়া কইতে কইতে যায়। গোপাল দেখে। রিকশার পেছনে সেই পোস্টার। সেই চোখ। বুড়িগঙ্গায় যেন ডাক দিতে আছে। আয় গোপাল, ত্বরায় আয়।

সে নিজেও টের পায় না, কিন্তু কুঁজো গোপালের বুড়া সাইকেল এই মায়া রিকশার পিছে পিছে চলতে থাকে। কানের ভেতরে বাজতে থাকে হিন্দি রঙিন, হিন্দি রঙিন। রিকশা থামে। গোপালের লড়ঝড় সাইকেলও থামে মায়া সিনেমা হলের সামনে। আর সে অবাক দাঁড়ায়ে থাকে এক বিশাল পোস্টারের সামনে। সেই পোস্টারে সিনেমার নাম নাই। ঘাড় কাত করা নায়কের ছবি নাই। নায়িকার মুখ নাই। শুধু দুইটা চোখ অথবা চোখও না, গাঢ় বাদামি এক গহিন গাঙ। মাটি ধুয়ে ধুয়ে কিছুটা ঘোলাটে যদিও, গোপাল টের পায় জল তবু বয়ে যায়। বুড়িগঙ্গা মরে নাই। শুধু জলের ওপরে নুয়ে থাকা একটা সবুজ টিপ না থাকায় কেমন যেন আধচেনা লাগে তার।

গোপালের শখ আহ্লাদ নাই। শখ আহ্লাদ রে কাটিং মেশিনে ফালাইয়া কাটতে কাটতে আজকের কুঁজো গোপাল।

তবু নিত্যগোপাল, এক্ষণে তার বুড়িগঙ্গারে সেইরূপে দেখতে চায় আবার। কিন্তু…

কুড়ি ত্রিশ কুড়ি ত্রিশ বিড়বিড় করতে করতে তার সামনে দিয়া একজন ঘোরে। ম্যাটিনি শো-য়ের সেকেন্ড বেল বাজতাছে। গোপাল বোঝে ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি হইতেছে। কাউন্টার বন্ধ। টিকিট যাদের আছে, তারা ভেতরে ঢুকতাছে একলা বা সঙ্গী লইয়া। গোপালের সঙ্গীও নাই, টিকিটও নাই। সে তার বুক পকেটে হাত দেয়। একটা দুমড়ানো মোচড়ানো দশ টাকা। এই টাকায় মায়া সিনেমা হলে এখন আর ঢোকা যাবে না। সে দাঁড়াইয়া থাকে পোস্টারের সামনে। একলা। অনেকক্ষণ। থার্ড বেল বাজতে শুরু করছে। দুই-এক জন যারা ছিল, তারাও হলে ঢুকে গেলে, গোপাল চারপাশে চায়। কেমন একটা শুনসান।

আর তখনই তার চোখে পড়ে এক দোকানের সামনে ঝুলতাছে অজস্র ঝলমলা টিপের পাতা। কী এক ঘোরের ভেতর সে সেই দোকানের দিকে আগাইয়া যায়। হাতে লয়। দেখে। একসময় একটা বড়ো বড়ো সবুজ টিপের পাতা দেইখাই তার মনে হয়, এই তো পাইছি।

জিজ্ঞেস করে, কত?

দশ টাকা।

নিত্যগোপালের কিছুই মনে পড়ে না আর। সে বুক পকেট থেকে কোঁকড়ানো দশটা টাকার নোট দোকানদারের দিকে আগাইয়া দেয়। ঝলমলা সবুজ একপাতা টিপ লয়। তারপর মায়া সিনেমা হলের দিকে আগাইয়া যায়। হাতে একটা সবুজ টিপ।

টাকা নাই, টাকা নাই। কই, এই টিপ কার লাইগা কিনছ? তার ছেড়ে রাখা জামা হাতে লইয়া মীরা হিসহিস করে। নুয়ে সেলাই করতে করতে গোপাল মুখ তুলে চায়। দেখে। সবুজ টিপের পাতাটি মীরার হাতে নাচতাছে। চোখে মুখে কী কদাকার ভঙ্গি করে মীরা আবার বলে, আমারে সিনেমায় যাওয়ার টাকা দেওয়ার মুরাদ নাই। এই টিপ কারে দেও? কিনতে টাকা লাগে না?

গোপাল মুখ নামায়ে সেলাই করতে থাকে। কুঁজো হয়। আরও কুঁজো হয়।

বুড়া হইয়াও ভীমরতি যায় না! মীরা গজগজ করতে থাকে।

গোপাল মুখ তোলে না আর। দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে একমনে সেলাই করতে থাকে ক্যাশ মেমোর বান্ডিল। বিকালের আগেই রতু বাবুরে পৌঁছাইয়া দিতে হবে। তার কানে আর কোনো কথাই যায় না।

সে ক্যাশ মেমো সেলাই করে ঠিকই, কিন্তু চোখ ঝাপসা। কিচ্ছু দেখতে পায় না।

মায়া সিনেমা হলের সামনে বুড়িগঙ্গার কপালে একটা সবুজ টিপ নিশ্চয়ই আজও লেগে আছে।

লাইব্রেরি যাওয়ার পথে, মায়ের লগে এই পাড়ে আইয়া বাপ একটা মুদি দোকান দিছিল। বয়স বাড়ে মাটি ধুয়ে জল ঘোলা হয়ে আছে।

গোপাল এইবার সত্যি সত্যি বোধহয় ঘর গোছায়।

পাকের ঘর থেকে এসেছিল উঁকি।

গোপাল এইবার সত্যি সত্যি লজ্জা পায়, সিনেমায় যাওয়ার সামান্য কয়টা টাকা সে মীরাকে দিতে পারে না।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক। অন্তর্মুখি স্বভাবের এই লেখক ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাস করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।