শনিবার, নভেম্বর ৯

নির্বাচিত দশ কবিতা : জ্যোতি পোদ্দার

0

১.
ঘোরানো প্যাঁচানো মুখের আদল দেখেই বুঝেছি
তুমি যে ঘাসের কথা বলছো
…………………………………সে আমার প্রাণসখা;
মহাপ্রাণে এক সাথে গেথেঁছি উড়ন্ত ডানার
………………………………….কম্পমান বিষয়আশয়;
এমন কী গৃহের বিবাদ আর পুষ্পমুখী যৌনগন্ধ।

মনুষ্য জগত ছেড়ে কয়েক মাইল দূরে এই দূরবাসী
পড়শী উদ্ভিদে রেখেছি আমার বিশ্বাস।
আর গুড়িগুড়ি আলোকণা জড়িয়ে ছড়িয়ে
……………………..যে বিত্তের বেসাতি উদ্ভিদ গড়েছে
সেখানে কোনো মালিকানা নাই
পদ পদবি নাই
ক্রিয়াকেই মেনেছে জীবনের সাধর্ম।

আমি বিশেষ্য সমাজে বংশোদ্ভূত নাগরিক
বিশেষায়ণে বিশেষায়িত না করলে বুঝি—
…………………….মনুষ্য সমাজের অপমান হয়।

ক্রিয়ার ক্রীড়া বুঝিনি বলে এখানে আমি অনাহুত নই
তাহাদের জন মেনে যেন আমাকে করেছে
……………………………………….কম্পমান ডানার সৌরভ।
আর গুড়িগুড়ি আলোকণা বৃষ্টিকণা
পাজরের হাড় যেন—ঠিক যেন নয়— সত্যি সত্যি আমি
তাহাদের জন;
একই ক্রিয়ার ক্রীড়ামোদী।
খেলতে খেলতে শিখে নিতে হয় এই ভুবনের মানবিক গুণ।

নতমুখী ঘোরানো প্যাঁচানো মুখের আদল
ক্রিয়াকে মেনেছে জীবনের সাধর্ম।
আমি বিশেষ্য সমাজে বংশোদ্ভুত নাগরিক—
…………………………………………….বিশেষ্য পদবাচ্য
ক্রিয়ার ক্রীড়া আমাকে আঁকড়ে নিয়েছে ঘাসের পাঁজরে।

 

২.
কাছাকাছি কোথাও অরণ্য নেই— বাড়িঘর শপিংমলে ঠাসা
বন বিভাগের নার্সারি আমার একমাত্র ভরসা।
এখানেই পেতেছি আমার পদ্মাসন।

আশ্রম বলতে এইটুকু— ছোটো চালা ঘর, সারি সারি টব
আর টবে লাগানো চারাদের শৈশবকাল— একটু একটু দুলছে
বাতাসের সাথে ভয় ও শঙ্কার ভেতর।
চারাদের হাসিখুশি দুলদুল
ঘুমলাগা আধবোজা চোখের মতো মোলায়েম।

কালো পলিথিন সামনের দিকে কাৎ করে রেখেছি
……………………………………………………….রোদ ও জল
গড়িয়ে গড়িয়ে যেন ভিজিয়ে দেয় আমার উঠান;
উঠান বলতে এক চিলতে উঠান— দশ বাই দশের বর্গক্ষেত্র।
এখানেই কাক ও কোকিল
ব্যাঙ ও বেজি
আর কুকুর ও বিড়ালদের নিত্য যাওয়া আসা।
আমার ফাইফরমাশ খাদ্যের বিনিময়ে কর্মসূচী
………………………………….বাস্তবায়নের ভার নিয়েছে স্বেচ্ছায়;

গুরুবাক্য শিরোধার্য নিয়ে সদা প্রস্তত
………………………..আমার শিষ্য শাবকের দল।

 

৩.
ধ্যানবিন্দু আমি এইসব দেখি আর দেখতে দেখতে
……………………………………………………ডুবি আমি
ডুবি আমি জলাশয়ে।

এই জলাশয়ে কোনো পদ্ম নেই— পদ্ম নেই মানে কোনো পদ্ম নেই।
না ফোটা পদ্ম
না কুঁড়ি
না পদ্মের ডাঁট।

পাকে পাকে জড়িয়ে জড়িয়ে দু’হাত ভরে যে পাক
তুলেছি সেখানে পঁচা শামুক ভাঙা আয়না চিরুনি
শিশু খেলনা আর চিতার পোড়া কাঠ
আর কবেকার গেরস্থ বাড়ির পেতলের ঘটি
উঠলেও কোনো মাটি তুলতে পারিনি।

আর পারিনি বলেই পদ্ম নাম্নী কোনো ষোড়শী বানাতে
……………………………………………….পারলাম না।

আহা!! পদ্ম—পদ্মিনী আমার
এখন কে তবে আমার আশ্রমে ধ্রুপদী নৃত্য করবে?
ধুপ কর্পূর পুজার উপচার সব যে বিফলে গেল!

পাকের গভীরে ডুবতে ডুবতে একবার পদ্মা নামে
একটি নদীর সাথে দেখা হয়েছিল।
…………………………..খুব ধীরে ধীরে বইছে দক্ষিণে
উৎসবাড়ি মহাশুন্যতায়
সারা দেহে ময়লার স্তুপ আর ডিজেলের ভ্যাপসা গন্ধ মেখে।

শরীরে জোয়ার এখন পড়তির দিকে।
উপরন্তু শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মেদ আর মেদ
……………………………….আর ভারি তলপেট।
সে এখন যে কোনো বিগত মহিলা।

যোগী আমি রমতা সাধু বহতা জল।
আর্শিবাদ করি পদ্মা তুমি বিগত মহিলা সংসারি হও
আর্শিবাদ করি পদ্মা তুমি বিগত মহিলা সংসারি হও
আর্শিবাদ করি পদ্মা তুমি বিগত মহিলা সংসারি হও

৪.
ধ্যানি আমি যোগী আমি বহতা জল রমতা সাধু
না পদ্মিনী আমি তোমাকে আরাধনা করিনি।
পদ্মাসনে বসেছি বলেই তুমি আমার আশ্রমে
বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়বে?

আমি জানি তুমি নর্তকী শ্রেষ্ঠা
……………………………..বণিকের কণ্ঠাহার তুমি
তুমি কথা বললেই বেড়ে যায় পণ্যের ব্র্যান্ডভ্যালু।
তোমার শরীর খাঁজকাঁটা
…………………..নিতম্ব নিখুঁত
হাস্যমুখ স্কেল দিয়ে মাপা
জানো তুমি আঙুলে আঙুল জড়িয়ে রাসনৃত্য
পাটভাঙা এমন হাসির কদর রাজপাটে নির্ধারক নিক্তি।

আমি যোগী নিজের খেয়ালে নিত্য থাকি চিত্ত নিয়ে
………………………এমন পদ্মিনী নিয়া আমি কী করিব?
আমি বনিক নই—নই অ্যাড ফিল্মমেকার
অথবা হাওয়া বদলের জন্য কোনো রিসোর্টে তোমাকে
………………..নিয়ে যাব তেমন খেয়াল আমার নেই।

আমি পদ্মাসনে বসা যোগী রমতা সাধু বহতা জল।
ওগো কিঙ্করি পদ্মিনী, তোমাকে লইয়া আমি কী করিব?
ওগো কেশনন্দিনী তোমাকে লইয়া আমি করিব?

৫.
গত জন্মে ধ্যানস্থ ছিলাম ভূজাঙ্গ আসনে।
তুমি কী দেখোনি আমার কর্তিত গলা হাত মুণ্ডু আর নাভীমুল?

নিজেই নিজেকে দংশন করে করে হয়েছিলাম নীলকণ্ঠ।
দেহের জমিন জর্জরিত করেছিলাম সিবা-গেইগির বিষে।

সেই বিষে বিষহরি পালাল পাতালে।
………………………সেই বিষে বিষহরি পালাল পাতালে।
বসত ভিটায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বাস্তুসাপ
সেই বিষে আর পাল্টাতে পারেনি প্রাক্তন খোলস।
প্রশ্নচিহ্নের মতো আর ফনা তুলে করেনি ফোঁস।

নীলকন্ঠ আমি করেছি সিবা-গেইগি পান।
দেহের জমিন জর্জরিত করেছিলাম সিবা-গেইগির বিষে।

পাহাড়-পর্বত আবাদি জমিন নারীর জরায়ু
আর জলের শরীরে
বাণের জলের মতো বিষ ঢেলেছ কর্পোরেট।
আকন্ঠ ডুবেও দেহের জমিন বাঁচাতে পারিনি, পদ্মিনী।

পদ্মিনী ও পদ্মিনী, তোমাকে আমি চিনি
তুমি খাঁজুরাহে আঁকা নিশ্চুপ বেশরম নারী
তোমাকে দেখেছি বিকিনি পড়া সী বীচে
তোমাকে দেখেছি বিল বোর্ডে রঙিন মিহিদানা আলোর ঝালরে।
সাগুদানার মতো ফর্সা শরীর নিয়ে চুলখোলা তুমি হাঁটছো রেম্পে।

ত্বক সচেতন তুমি মাখো ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী।
এই সব তুমি— তুমিই পদ্মিনী।

জানি আমি বীণ আর দূরবীনে তুমি সমান পারঙ্গম।
তোমার ভ্রু-প্ল্যাগে যে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে
সেখানে ভূজাঙ্গ ধ্যানী নিমিষেই শবাসন।

নীলের শরীরে ধরাও চিতার আগুন।
কাঠে নীলদেহ সহজে ছাই হলেও হতে পারে
চিতাকাঠ জেনো পুড়ে পুড়ে
অসমান বিষকাঠও কয়লা।

৬.
আমি ফরেস্ট ডির্পাটমেন্টের করিডোরে পদ্মাসনে বসেছি
ফরেস্টার বাবু পরিবার নিয়ে শহরে থাকেন।
সব সময় আসার ফুসরত না পেলেও
বেতন ড্র করতে ঠিক ঠিক আসেন প্রতিমাস।

মোটা মোটা বই পড়িতে পড়িতে তিনি কুঁজো হয়ে গেছেন বলে
চোখ তুলে আকাশ সমান ইউক্লিপটাস দেখতে পান না।
আমি পদ্মাসনে বসে বসে দেখি পাখিশূন্য বন।

পালকের ওড়াওড়ি নাচানাচি শূন্য বন।
আর দেখি শুন্য বনে বৃক্ষরোপন সপ্তাহ।

দেখতে দেখতে যোগী আমি পদ্মাসনে আঁতিপাঁতি খুঁজি
কোথায় আমার শরীরের শেকড়বাকড়
কোথায় বনের হাজার হাজার ধমনী
কোথায় কেটেছে দাইমা নাড়ির বন্ধন।

ধ্যানী আমি যোগী আমি ঘাটে ঘাটে খুঁজি
………………………….আমার দিগন্ত চরাচর।
আমার অখণ্ডমণ্ডলাকার।

 

৭.
যে বছর লীজের বছর উন্নয়নের বছর
সেই বছরেই বণিকেরা নিয়ে এলো
রবার বাগান
…………….আকাশমণি
আর স’ মিলের করাত আর করাতী

সেই বছরই আমি উৎখাত—
আশ্রমে আগুন আর আগুন
আগুনের তাপে অরণ্য হইল নার্সারি।

আহা! আহা!!
সুন্দর আলির বায়স্কোপে ভেসে ভেসে
আইয়া পড়ল ইকো পার্কে
……………………….সারি সারি গাড়ির বহর
আর ডিস্কো ড্যান্সারের পিকনিক পার্টি।

বনচিরে গগন বিদারি হিন্দিগানের মাইক
আর ট্রাকে ট্রাকে বন ঢুকছে শহরে।

আমি যোগী কেবলই ছিন্নভিন্ন কাঁটামুণ্ডু ছিন্নমস্তা
আমাকে মাথায় তুলে নাচছো তুমি পদ্মিনী
আমাকে মাথায় তুলে নাচছো পদ্মিনী
আমার আর কোথাও যাবার নেই।

বেনিয়া কাছে ডেকে ফিসফিস করে
ফিসফিস করে কথা কয়—
কী যেন কী যেন বিড়বিড় করে কানের ভেতর সীসা ঢালে
ও বাবু আমাগো গান্নি দিয়া কী করিবার চাও
ও বাবু আমাগে ঘরের নকরি দিয়া কী করিবার চাও
আমাগো গান্নি খেতে গেছে
আমাগো গান্নি বন্দরে গেছে
হলুদ আদা মরিচ চাও নিয়া যাও
বাতরে চিনামাটি আছে তাও নে বাবু
ও বাবু আমাগো গান্নি দিয়া কী করবি

বাবু ও বাবু নে নে আমাগো তুমদা টামাক ঢোল
বাবু ও বাবু নে নে আমাগো বানাম মাদল বাঁশি—
বাজা তোর ইচ্ছামতো। পাতা নাচিবে পাখি নাচিবে
নাচিবে রে বনবিবি নাচিবে নাচিবে শিবের শিবানি।
ও বাবু ও বাবু গান্নি তুই চাস না

 

৮.
এই টিলা কৈলাসের ছড়ানো পা।
এই টিলা বনবিবির জড়ানো শরীর
এই টিলা মাদার মেরীর মেলানো শীতল পাখা
এই টিলা সাংসারেক আচিক মান্দি আর হাজং কোচের
……………………………………….পেতে দেয়া সবুজ শরীর

ও সুন্দর আলি ভাই তোমার বায়োস্কোপে ধইরা রাখো তামাম ইতিহাস।

আমি যোগী বনের সাথে বেঁধেছি আমার প্রাণের বহতা জল
আমি যোগী বনের সাথে বেঁধেছি আমার প্রাণের বহতা জল
আমি যোগী বনের সাথে বেঁধেছি আমার প্রাণের বহতা জল

৯.
পাতার ভেতর পাতা উল্টে পাতার শরীরে লিখি কতিপয় বিবমিষা
পাতাবোন তুমি পাতাভাই তুমি তোমার শরীরে আগুন;
আগুনের গুনগুন আর লালে লাল রক্তজিভ
…………………………………………..ঢেলে দিচ্ছে ঢেলে দিচ্ছে বিষভাণ্ড

আমি যে শোলার পুতলা মেলায় মেলায় ঘুরি
ও কারিগর ও কারিগর মরি মরি আমি মরি

ও ডাকিনী ও যোগিনী কালরাত্রি অমাবস্যা
……………………………….এমন রাতেই তুমি শুষে নিলা প্রাণ?

লাল রক্তজিবে বুনো গন্ধ— গন্ধের ভেতর নরমুণ্ড-মালা
উড়ছে উড়ছে বাতাস বাতাসে ভাঁজকরা অন্ধকারে;

মুণ্ডহীন খাঁজকাটা পাতারশরীর
……………………………..মন্ত্রে নাচে
…………………………………….তন্ত্রে নাচে
নাচে তান্ত্রিকের গোল গোল মাদকচাহনি

ও শিব শ্মশানবাসী ওঠো তুমি ওঠো
…………………………….শব দেহ নিয়ে কী করিবে তুমি
খোল আলোর পরতে পরতে আলোভাঁজ
সাদা সাদা সাগুদানা আলোবিন্দু
……………………………….আর নয়া পয়সার ঝলক;

তুমি কাল কালীর যাত্রাবিন্দু।

আমি যে শোলার পুতলা মেলায় মেলায় ঘুরি
…………………………….আমি যে চিনির ঘোড়া
আমি যে চিনির হাতি
তাপে ভাপে চাপে পাতার ভেতর পাতা উল্টে
পাতার কোমলা শরীরে লিখি যাপনের বিবমিষা

 

১০.
আমি কোনোকালেই বইয়ের পাতা
……………………..ভাঁজ করে রাখি না।

যখনই খুলি ঠিক সেখানেই খুলি
যে পাতায় রেখে গেছি তাকে।

অন্ধকারেও জানি কোথায় তালার নাভী
………………….কোথায় দরজার ছিটকিনি।
চাবির ছড়া থেকে ঠিক ঠিক বের
করতে পারি গোল নাভী
তালার চাবি কোনটি?

ঠিক জায়গায় চোখ রাখি
যেখানে আটকে রেখে গেছি চোখ।

চোখ খুব সন্তর্পণে জেগে তোলে
আমার ঘুমন্ত চোখ।

বইয়ের কান মলে দিতে আমার ইচ্ছে করে না।
কান মলার কান গরম করা লাল লজ্জ্বা
এখনও আমার পিছু ছাড়েনি।
বাঁধানো ফ্রেমের মতো ঝুলে
………………………আছে স্মৃতি ও দেয়ালে।

হাতের আঙুল নেড়ে নেড়ে বুঝি
এই সেই অক্ষর শরীর।
এই সেই সগ্রাণতা।
ঠিক জায়গায় রেখেছি আমার আঙুল।
এই কেঁপে ওঠা ঝঙ্কৃত রক্তমাংস শরীর
………………………ভারী গরম নিশ্বাসে
দুলে উঠছে
ফুলে উঠছে
ভরাটে শব্দের তলপেট।

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। নয়ের দশকের কবি। বাড়ি শেরপুর জেলার নালিতা বাড়ি। পেশা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। প্রকাশিতকাব্যগ্রন্থ: ‘(a+b)2 উঠোনে মৃত প্রদীপ’ (১৯৯৭), ‘সীতা সংহিতা’ (১৯৯৯), ‘রিমিক্স মৌয়ালের শব্দঠোঁট’ (২০০২), ‘ইচ্ছে ডানার গেরুয়া বসন’ (২০১১), ‘করাতি আমাকে খুঁজছে’ (২০১৭) এবং ‘দুই পৃথিবীর গ্যালারি’ (২০১৯)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।