রবিবার, অক্টোবর ১৩

পিটার হান্টকের কবিতা : শিশুবেলার গান

0

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল
হাঁটতো-চলতো নেড়ে-নেড়ে দুই হাত

চেয়েছিল ছোটো, নদী হোক বড় নদী
আর নদী হোক খরবেগ দুদ্দার,

এঁদো ডোবাখানি বিশাল সাগর হোক

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল
সে যে শিশু সেটা নিজেই জানতো না
সবকিছু ছিল গভীর আবেগে ভরা
বাঁধা ছিল প্রাণ সকল প্রাণের সুরে

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
ছিলো না মোটেই কারোর সাতে বা পাঁচে,
ছিলো না কিছুই যাকে বলে অভ্যেস

পায়ের উপর আড়াআড়ি পা-টি তুলে
বসতো, বসার পরেই লাগাতো দৌড়,

ছবি তুলবার সময় মুখটি তার
ঢাকা পড়ে যেতো কপাল-গড়ানো চুলে;

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
সেটাই সময় ছিল যে জিজ্ঞাসার

আমি কেন আমি, তুমি কেন নও আমি?
এইখানে আছি, সেইখানে কেন নই?

সময়ের শুরু কখন হয়েছে, আর,
এই আকাশের, বলো, কই অবসান?

জীবন কি নয় স্বপ্নের ভ্রম সূর্যের অবতলে?

আমি যা দেখছি, আমি যা শুনছি, আমি যে গন্ধ পাই
এসব কি নয় পৃথিবীর মিছে মায়া,

এসব কি নয় এর আগেকার
আর কোনো পৃথিবীর?

শুভ-অশুভের কতো না কাহিনি শুনি!
অশুভ নামের আদতেই কিছু আছে?

এই ‘আমি’, মানে, আজকের এই আমি,
জন্মের আগে ছিলাম না কেন তবে?
কেন একদিন থাকবো না আর ‘আমি’?

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
ভাতের দলাটি, মটরদানাটি এবং পালংশাক,
সেদ্ধ করা সামান্য ফুলকপি
খেতে গিয়ে তার গলায় আটকে যেতো;

কিন্তু এখন দিব্যি সে খায় সবই
এমন তো নয়, না খেয়ে উপায় নেই!

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
এক রাত্তিরে ভেঙে গেলো তার ঘুম,
দেখলো নিজেকে আর কারো বিছানায়;

…এমন ঘটনা এখনো তো ঘটে যায়।

তখন যাদের চেহারায় ছিলো জাদু,
কপালের ফেরে অনেকের সেই রূপ,
ঝরে গেছে আজ, লাবণ্য নেই কোনো

দু-চোখে ভাসতো বেহেশতি উদ্যান,
আজ সে-মোহন স্বর্গশোভন ছবি
ফিকে হয়ে গেছে, আছে শুধু ভাবনায়;

…আজ কিছু নেই! ধু-ধু শূন্যতা, হৃৎ-কম্পন ছাড়া!

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
থাকতো খেলার আহ্লাদে মশগুল,
সেই উৎসাহে যদিও পড়েনি ভাটা;
বাদ সাধে তাতে কাজ-ঘিরে উদ্বেগ!

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
এক রুটিতেই, একটা আপেলে
হয়ে যেত ভরপেট

…এখনো দিব্যি এটুকু হ’লেই চলে;

 

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
মুঠো ভরে যেতো কয়েকটি জামফলে;

…আজও ভরে মুঠো যেমন ভরতো আগে,

কাঁচা আখরোট খেয়ে মুখ বিস্বাদ
যেমনটি হতো, এখনো তেমন হয়

উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর
আরও উপরে উঠতে চাইতো মন;

যেতো যে-শহরে, এর চেয়ে ঢের বড়
শহর-ভ্রমণে যাবার জাগতো সাধ,
…সেই প্রিয় সাধ আজও আছে অবিকল;

লোভাতুর শিশু পাড়তে চেরির ফল
গাছ বেয়ে-বেয়ে উঠে যেতো মগডালে

…সরল সে-লোভ, উচ্ছ্বাস অমলিন;

অচেনা লোকের সামনে লজ্জা পেতো;
এখনো তেমন রয়েছে লাজুক সে

থাকতো যেমন, এখনো অধীর থাকে
প্রথম তুষারপাতের অপেক্ষায়

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
গাছ তাক করে ছুড়ে দিতো তার লাঠি

বর্শার মতো সেই লাঠি পাক খেয়ে
সেইখানে আজও অবিরত কেঁপে যায়

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ জানুয়ারি। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার গড়াডোবা ইউনিয়নের সাখড়া গ্রামে। পিতা মুকদম আলী, মা বেগম নূরজাহান (সরু)। দুজনই প্রয়াত। বন্ধু শিরিন সুলতানা ও পুত্র অর্ক মাজহারের সঙ্গে থাকেন ঢাকায়। পেশা সাংবাদিকতা। কৈশোরে নিরুদ্দেশযাত্রা। দীর্ঘ ভবঘুরে জীবন। যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ে। বিশেষত হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে। ঘৃণা করেন বৈষম্য, জাতিবৈর, সকল প্রকারের অন্ধতা। ঘৃণা করেন পৃথিবীকে খণ্ডক্ষুদ্র-করে-দেওয়া সীমান্ত নামের ‘খাটালের বেড়া’। লেখেন মূলত কবিতা। কালেভদ্রে সাহিত্যশিল্প বিষয়ে গদ্যও লেখেন। বিচিত্র বিষয়ে প্রচুর অনুবাদও করেন ইংরেজি থেকে বাংলায় আর বাংলা থেকে ইংরেজিতে।

কবিতাবই: ‘দর্জিঘরে একরাত’, ‘মেগাস্থিনিসের হাসি’, ‘দিওয়ানা জিকির’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘রাত্রি ও বাঘিনী’ ও ‘বসন্তরূপক হাসি’।

অনুবাদগ্রন্থ: ‘কবিতার ট্রান্সট্রোমার’ নোবেলজয়ী সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমারের বাছাই করা কবিতার অনুবাদ সংকলন। ‘দূরের হাওয়া’ প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ২০০ কবিতার অনুবাদগ্রন্থ।

পুরস্কার ও সম্মাননা: ১. ‘জীবনানন্দ দাশ কবিতাপুরস্কার ২০১৯’ ২. ভারতের পশ্চিমবঙ্গের (কলকাতার) ঐহিক সাহিত্যগোষ্ঠির ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা ২০২০’ ৩. ’নির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের জন্য ’বেহুলাবাঙলা বেস্টসেলার বই সম্মাননা ২০১৯' ৪. রাত্রি ও বাঘিনী কাব্যগ্রন্থের জন্য 'শব্দঘর-নির্বাচিত সেরা বই-২০২১' সম্মাননা পুরস্কার।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।