সোমবার, ডিসেম্বর ২

শাহেদ কায়েসের কবিতা : অনিবার্য স্বপ্নভ্রমণ ও একাকিত্বের ছাপচিত্র : অতনু তিয়াস

0

কবিতা মনের ভারাক্রান্ত মেঘগুলোকে অনুভবের উষ্ণতায় বৃষ্টি করে ঝরিয়ে দেয়। আমাদের একান্ত মাঠ হয়ে ওঠে সবুজ, ভরে ওঠে ফসলের সোনালি সম্ভারে। কখনো দ্রোহের বজ্রবিদ্যুৎ চেতনায় আঘাত হানে অনাচারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার জন্য। একটি মহৎ কবিতা ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি, সমাজবাস্তবতা ও জীবনদর্শন পেরিয়ে মহাজাগতিক মন্দ্রিত ছন্দের প্রতিধ্বনি। পাঠক তার হৃদয় খনন করে বোধের গভীর থেকে তুলে আনে কুচি কুচি হীরকখণ্ড। যেখানে প্রিজমের প্রতিটি পিঠে আবিষ্কৃত হয় বহুবর্ণিল জীবনের রূপ রস গন্ধ। কবিতা তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় জীবনবোধের নিজস্ব আয়নার সামনে।

কবি শাহেদ কায়েস এক অনন্য কবিজীবন যাপন করেন। আপাদমস্তক কবি তিনি। নব্বইয়ের শীর্ষ কবিদের অন্যতম শাহেদ কায়েস জীবনকে পাঠ করেন অপ্রচল ধারায়। অনেকটা জুয়াড়ির মতো। নিজেকে নিয়ে বাজি ধরেন আগ্রাসী বাস্তবতার টেবিলে। কখনো নিজেকে চ্যালেঞ্জের মতো ছুড়ে দেন নৈরাজ্যবাদী হাওয়ার বিরুদ্ধে। বিরুদ্ধ স্রোতে ঠেলে এগিয়ে যাওয়াই যেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ। তিনি এক নিঃসঙ্গ শেরপা। তবে ব্যক্তি শাহেদ কায়েস যতটা বন্ধুবৎসল, ততটাই সামাজিক। কিন্তু জনারণ্যে হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই একা হয়ে যান। যেমন তিনি তাঁর ‘নিঃশব্দ অ্যাবাকাস’ কবিতায় বলেছেন—‘মানুষগুলো হাঁটে—/স্বপ্নের ঘোরে হাঁটে, নিঃশব্দ একাকী’। তাই তো শাহেদ কায়েস আলাদা। জীবনানন্দের ভাষায়, ‘সকল লোকের মাঝে ব’সে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা?’। শাহেদ কায়েস ঠিক তেমনই। তিনি ঘাস ঘাসকে চুমু খেতে দেখেন। আকাশে সাইকেল চালাতে ইচ্ছে করে তাঁর। ইচ্ছে করে মহাশূন্যে হেলান দিয়ে মহাকালের ক্যানভাসে প্রতীক্ষার রঙে স্বপ্ন আঁকতে। তাঁর ভেতরে সারাক্ষণ উড়ে বেড়ায় এক বোহেমিয়ান পাখি। সেই বোহেমিয়ান পাখিটি খুঁজে ফেরে—শৈশব-সখীর গভীরে ঘুমিয়ে পড়ার ওম, ললাটির দামাল কৈশোর। জীবনের প্রয়োজনে ঘুরেছেন বিভিন্ন দেশ। কিন্তু শেকড়ের টান তাঁকে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছে জন্মগ্রাম ললাটিতে।

স্বনির্বাচিত কবিতা

স্বনির্বাচিত কবিতা |শাহেদ কায়েস | ধরন: কবিতা | প্রকাশক: ভাষাচিত্র | প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত | মুদ্রিত মূল্য: ৩৯৮ টাকা

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। একই বই একযোগে প্রকাশ করেছে তিনটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান—আগরতলার ‘নীহারিকা’, কলকাতার ‘কবিতা আশ্রম’ এবং বাংলাদেশের ‘ভাষাচিত্র’। কবিতাপাঠকের এই আকালের দিনে এমন একটি উদ্যোগ নিশ্চয়ই আশা জাগানিয়া। বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা, চূড়ায় হারানো কণ্ঠ, মায়াদ্বীপ, কৃষক ও কবির সেমিনার, সহজিয়া প্রেমের কবিতা, নৈরাজ্যবাদী হাওয়া—এই ছয়টি কাব্যগ্রন্থ থেকে কবির নিজের বাছাই করা কবিতা সংকলন ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’। সময়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই কবিতাগুলোকে সাজানো হয়েছে।

‘বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা’র কবিতাগুলো কবির শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যে ভরপুর সময়কালের জলছবি। প্রকৃতি, প্রেম, দ্রোহ, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, ‘পেছনের দিকে তাকালে ঝলসে যাওয়া স্মৃতি’ তর্পণ আর স্বীকারোক্তির প্রচ্ছন্ন অভিঘাতে উদ্ভিন্ন তাঁর কবিতার দেহসৌষ্ঠব। সেই স্বীকারোক্তি ব্যক্তি শাহেদ কায়েসের মতোই ঋজু ও সৎ। যেটুকু আড়াল, যেটুকু রহস্যময়তা, যতটুকু অবগুণ্ঠন তা কবিতার নিজস্ব সৌন্দর্য, অনেকটা নারীর হিজাবের মতো কিংবা ঘোমটার মতো। তবে এ কথা বলতেই হয়, তাঁর কবিতার রন্ধনশালায় গণিত, জ্যামিতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি অপরিহার্য আনাজ হিসেবে অনায়াসব্যবহৃত। শুধু তা-ই নয়, ঐতিহ্য আর পৌরাণিক মিথের ব্যবহার তাঁর কবিতাকে করেছে আরো উপাদেয়—‘…স্বপ্নের ফোড়ে ফোড়ে দ্রৌপদীর শাড়ির আঁচল/ স্বপ্নে চলে যায় অজন্তা/ অজন্তার দেয়ালচিত্রে স্বপ্নচোখ মাছ!’

‘চূড়ায় হারানো কণ্ঠ’-এর কবিতাগুলোর অধিকাংশই কবির রক্তাক্ত হৃদয়ের ছাপচিত্র বলে মনে হয়। বিপন্ন প্রকৃতি, বিপন্ন মানবতা, হিংসা-দ্বেষ, সামাজিক অহং, হিংস্র অন্ধকার কবিকে শঙ্কিত করে। তিনি বলেন, ‘তীব্র লাল, রেণুতে আগুনের তৃষ্ণা/ এগিয়ে আসছে নগ্ন হাত…/ নীল রক্তের ঘুম ভেঙেছে/ ধেয়ে আসছে শৃঙ্খলহীন কুকুর/ খুলে পড়ে আলোর মুখোশ/ ভেতরে কী হিংস্র আঁধার!’—কবিতা : সামাজিক অহং। তাই তো ‘বেঁচে থাকার লজ্জায় মানুষ প্রার্থনা করে শেষ নিশ্বাস!’ কেন না, ‘দেশে দেশে গড়ে ওঠে আশ্বিৎস/ কখনো ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, আর্মেনিয়, ফিলিস্তিন!’ (কবিতা : আশ্বিৎস)। এতসব অনাচার, অসংগতি, হানাহানি, ক্ষমতার লড়াই, পরাধীনতা, অনিশ্চিতির ভাঙা গান বুকে নিয়ে বিপন্ন পথচলা কবির স্বগতোক্তি—‘…এই জন্ম সীমিত সময়ে অনিশ্চিত বিচরণ/ ভিন্ন-ভিন্ন সামাজিক পরিচয়/ বিপন্ন এতটা পথচলা/ শুধু জীবনের জন্য এতটা রক্তপাত!’ এরপরই কবির চিরায়ত জিজ্ঞাসা—‘জন্ম উৎস মা, কোথায় আমার গন্তব্য!’

‘মায়াদ্বীপ’ কবির স্বপ্নে ঘেরা ছোটো এক দ্বীপ। এই দ্বীপের মানুষের জন্য কেবল তার কলম থেকেই রক্ত ঝরেনি, শরীরও থেকেও ঝরেছে রক্ত! মায়াদ্বীপের জন্য কবির কী অসম্ভব মায়া! বেহুলা ও পদ্মাবতী যাদের লৌকিক জীবনের সুখ-দুঃখের সাথী— সেই ভাসমান জলজ জীবনের লোকাচার, সংগ্রাম, হাসি-কান্না, আনন্দের সাথে একাত্ম হয়ে যান তিনিও। তারই উজ্জ্বল স্মারক ‘মায়াদ্বীপ’-এর কিছু কবিতা। ‘ঘরে-বাইরে কুয়াশা,/ খোলা আছে সব দরজা-জানালা/ আগুনের পরশ লাগা জলদাস;/ বহু বছরের বঞ্চনার কাহিনি…/ ধেই ধেই নেচে ওঠে ক্ষুধা/ আর সব মিথ্যা, চারপাশের জগৎ-সংসার…’ (কবিতা : মায়াদ্বীপের উপকথা)। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কবির স্বভাবজাত দ্রোহ, ক্ষোভ অভিব্যক্ত হয়েছে এখানেও—‘আমি ভালো নাই বন্ধু, আজ আমি ভালো নাই/ রক্তমাখা হাত বাড়িয়ে বন্ধুত্ব চেয়ো না কখনো আর।/ কাঁটাতারে ঝুলে আছে বাংলাদেশ! (কবিতা : কাঁটাতারে ঝুলে আছে বাংলাদেশ)।

আরেকটি কবিতা উল্লেখ না করে পারছি না—‘হাওয়া ওঠে, বিপরীতমুখো।/ ঢেউয়ে ঢেউয়ে চরভাঙা মানুষের দীর্ঘশ্বাস/ ঋণগ্রস্ত আমাদের মস্তিষ্ক ও হৃদয়/ … … ‘কোথায় মুখোশ, কোথায় বর্ম।’/ এত এত মানুষের ভিড়ে মুখ নিয়ে/ আমি এখন কোথায় যাই।’ এই বিপরীতমুখো হাওয়ার যুগে যারা গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যেতে পারে, তারাই টিকে থাকে। যদিও এই টিকে থাকা তেলাপোকার মতোই! চেতনা বন্ধক দেওয়া এত এত মুখোশের ভিড়ে মুখ নিয়ে কবি খুব অসহায় বোধ করেন। এত আত্মপ্রতারণা, এত ছলচাতুরির ভিড়ে সহজিয়া জীবন ঢেউয়ে ঢেউয়ে চরভাঙা মানুষের দীর্ঘশ্বাসের মতোই। কিন্তু তাই বলে কি তিনি তার মুখকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ফেলবেন? নিশ্চয়ই না। কেননা তিনি জানেন, ‘… স্রোতের বিরুদ্ধে চলা জীবন তো এক জীবন্ত কবিতা/ নগ্ন পায়ে কিছু মানুষ আজও শিরদাঁড়া উঁচু করে হাঁটে!’ কবিও সেই শিরদাঁড়া উঁচু করে হাঁটা মানুষের দলেই সামিল হতে চান।

‘কৃষকের কাছে বউ আর ভূমিই তো সব/ তাঁকে চাষ করতে হয় পরম আদরে/ কত তার খুনসুটি! কত ছলাকলা!/ কতই না প্রস্তুতি বীজ ছিটানোর আগে!’ (কবিতা : কৃষক ও কবির সেমিনার)। এখানে একই সঙ্গে দুই শিল্পাঙ্গনের কৃষকের প্রসঙ্গ এসেছে—এক কৃষক ভূমি চাষ করে খাদ্যশস্য ফলান, আরেক কৃষক শব্দ চাষ করে ফলান কবিতা। একজন পেটের খোড়াক জোগান দেন, আরেকজন জোগান মনের খোড়াক। কৃষক রচনা করেন বউ-মাটি-আদরের শিল্পকলা। কবি রচনা করেন বোধ ও বোধির রূপ রস গন্ধ! কৃষক ও কবি মিলেমিশে একাকার হয়ে যান সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। কিন্তু জীবনের এত যে আয়োজন, এত যে রং, এত যে চেতনার মেলবন্ধন, তারপরও বিষণ্ন সন্ধ্যায় যেন সব ম্লান হয়ে যায়। কবিহৃদয়ে বেজে ওঠে একার সন্ন্যাস—‘সন্ধ্যায় প্রতিটি ঘরই শূন্য…/ … … তাঁর ফেলে যাওয়া নিশ্বাস/ পায়চারি করছে সন্ধ্যায়…/ ঘর না বাহির, জন না নির্জন/ কোথায় মানুষ বেশি একা!’

কবির এই একাকিত্ব, এই শূন্যতাবোধের আঁচ লেগেছে সিরিজ কবিতা ‘সহজিয়া প্রেমের কবিতা’য়ও। ‘সন্ধ্যায় স্টেশন ছেড়ে গেল শূন্যতার ট্রেন/ সেই থেকে উড়ছে একা বোহেমিয়ান পাখিটি’। সেই একাকিত্ব জোনাক-জ্বলা সন্ধ্যায় নির্বাক করস্থানের মতো। যেখানে তিনি ফেলে এসেছেন শৈশব, যেখানে শুনতে পান শীর্ণ ব্রহ্মপুত্র নদের জলের অধরা বিস্মৃতি।

এই যে প্রকাশ্য ও অদৃশ্য পথে অবিরাম চলা, স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনের অনিবার্য স্বপ্নভ্রমণ, নৈরাজ্যবাদী হাওয়ার প্রতিকূলে এগিয়ে যাওয়া; তারপর আসে ক্লান্তি, আসে ঘুমিয়ে পড়ার অমোঘ আহ্বান। তখন মানুষ অজান্তেই ফিরে যায় নিজের অতীতের কাছে, শেকড়ের কাছে। কিন্তু সেখানেও কি মুক্তি মেলে? ‘দল বেঁধে শূন্যতা ঝাঁপ দিচ্ছে নবীন কবরে/ সারারাত গোর-খোদকের আলাপ শুনি/ সেই জোনাকিদের কোথাও দেখি না আর।’ একটু শান্তির খোঁজে অতীতে আশ্রয় চাইলেও কেবল অন্ধকারে গোর-খোদকের আলাপই শোনা যায়, ক্ষীণ আলোর শেষ ইশারাটুকুও যেন মুছে যেতে থাকে জীবন থেকে। বইয়ের সর্বশেষ কবিতা ‘শূন্যতা’ যেন আমাদের সেই বার্তাই দেয়।

সবশেষে বলা যায়, কবি শাহেদ কায়েসের ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ গ্রন্থটি অন্তর ও বাহিরের প্রকাশ্য ও অদৃশ্য বিচিত্র বাস্তবতাকে ভিন্নতর স্বরে একসূত্রে গাঁথার প্রয়াস। যা জীবন ও জগতের আলো-আঁধারে মোড়ানো অপার রহস্যময়তাকে উন্মোচনে প্রবৃত্ত। বইটির বহুল পাঠ কাম্য।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৭৫। ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার ঔটি গ্রামে, মাতুলালয়ে। শৈশব কেটেছে পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা থানার লাউটিয়া গ্রামে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : রাংসার কলরোল [২০০৭, ঐতিহ্য]; আমি অথবা অন্য কেউ [২০১৮, ঐতিহ্য]। সম্পাদনা : ছোটোকাগজ ‘অথবা’। লেখালেখির পাশাপাশি গান বাঁধেন এবং গান করেন। বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও নাটকে প্রকাশিত তাঁর বেশকিছু শ্রোতাপ্রিয় গান রয়েছে। সম্মাননা :  ‘মায়ের জন্য ভালোবাসা’ গীতিকবিতার জন্য ২০০৯ সালে পেয়েছেন ডেইলি স্টার-স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আয়োজিত ‘সেলিব্রেটিং লাইফ’ অ্যাওয়ার্ড; বঙ্গবন্ধু লেখক ফোরাম প্রদত্ত ‘গুণীজন সম্মাননা-২০১৮’। কবিতার জন্য পেয়েছেন নজরুল-চর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান অগ্নিবীণা প্রদত্ত ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য সম্মাননা-১৪২৪’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।