শুক্রবার, মে ৩

অভিনবকে লাবণ্যর খোলা চিঠি : সুবর্ণা গোস্বামী

0

১.

তোমাকে লেখা প্রথম চিঠিতে বলেছিলাম আমার ভালোবাসার কথা। আজ একযুগ পর সেই বিনম্র ভালোবাসা হয়ে ওঠে স্মৃতিকাতর আর অভিমানী। আমাদের একটুকরো ভালোবাসার কথা ভাবতে ভাবতে সমুদ্রকে খুব বেশি রহস্যময় মনে হয়। তোমার পাশাপাশি যখন হেটেঁছি সমুদ্রের কোল ঘেঁষে তখনও সেই মায়াবিনীকে এত গভীর মনে হয়নি, তবে আজ মনে হচ্ছে। বুঝি সে-ই প্রথম বুঝেছিল আমাদের গভীরে হাহাকার করে ভালোবাসতে না পারার ব্যথা। আমরা নিজেরাই বুঝিনি তখন আমাদের মনে কোন স্রোতস্বীনি পাড় ভাঙছে নিরবধি। আমাদের হৃদয়ের নীরবতা সরব হয়নি তখন, তখনও তোমার শব্দের চোরাবালিতে জীবন সমর্পণ করিনি। তখনও আমরা কেবলি বন্ধু।

তবে কি সমুদ্রই বেঁধেছিল আমাদের হৃদয়ের উত্তরীয়? বুঝি সমুদ্রদেবতাই চেয়েছিলেন তোমার স্মৃতির সাথে আজীবন ঘর করব আমি। সমুদ্রদেবতাকে প্রণাম জানাই। তিনি অবলীলায় আমার হৃদয়ের বিরামহীন কান্নায় তোমার ভালোবাসা প্রবাহমান রেখেছেন। আজও…

 

২.
আগের চিঠিটা পোস্ট করেছি, যদিও খামের উপর কোনো ঠিকানা লেখা ছিল না। যদি কোনো মন্ত্রবলে সে পৌঁছে যায় তোমার দরজার ছোট্ট ডাকবাক্সে এই প্রত্যাশায় আমার মতিভ্রম। আমি জানি না তুমি কেমন আছ, জানতে চাই একথা দৃঢ় প্রত্যয়ে বলতে পারছি না। অহেতুক কৌতূহলে কলরব বাড়বে শুধু। তার থেকে নির্জনের একাকীত্ব অনেক ভালো।

সেদিন সমুদ্রের কথা বলেছি, আজ সেতুর। সত্যি কোনো দিন আমাদের মধ্যে কোনো সেতু ছিল কি? নাকি দূরত্বের অথই নদী সাঁতরে পার হওয়ার অসম্ভব কল্পনায় দুঃখ পেয়েছি কেবল।

একসময় পথ চলতে চলতে বন্ধুত্বের ওপর প্রেমের প্রলেপ পড়ল। সেটা এতই গাঢ় ছিল যে শত চেষ্টাতেও মুছতে পারলাম না। তখন আমি সমর্পিত তোমার জোছনার অন্ধকারে। আমি শুকনো পাতার মতো লক্ষ্যহীন উড়ে চললাম, কত দিন কে জানে? দিন মাস বছরের হিসেব তখন ছিল না আমার।

আমাদের দুজনকে নাকি বেশ মানায়, সবাই বলত একথা। আমি জানি তুমি অন্তত এ কথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করনি। শুধু মৃত্যু উপভোগের নেশায় বাঁচিয়ে রেখেছিলে আমায়।

অবশেষে তোমার কাঙ্ক্ষিত সেই মৃত্যু হলো। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মৃত্যুর সান্নিধ্যে আমি জীবন অতিক্রম করেছি। মৃত্যুও এত দীর্ঘ হতে পারে জানা ছিল না। এখন জানি।

 

৩.

চিঠি লেখায় সন্মোধনের একটা রীতি আছে। সেই প্রচলিত প্রথা মেনে ‘প্রিয় অভিনব’ কথাটি লিখতে পারলাম না। ক্ষমা করো। হৃদয়ে তোমার জন্য ভালোবাসা যতখানি, ঘৃণাও নেহাত কম নয় তার থেকে। তাই অভ্যাসের বশে ‘প্রিয়’ কথাটি তোমাকে লিখে নিজেকে ঠকালাম না।

তোমার কুশলে আমার প্রয়োজন নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই উত্তরের। এটা বেশ ভালো। মনের কোণ ভরে থাকে ক্ষমা করে দেয়ার অপুর্ব ঐশ্বর্যে। তুমি খেলেছ অনেক আমাকে নিয়ে, ঠকিয়েছ বিস্তর। সব জেনেও তবু মুছতে পারিনি তোমার দেয়া লাল টিপ। আজও আমি সিঁদুরের আড়ালে তোমার দেয়া রং সিঁথিতে চড়াই। যেভাবে তুমি বিলিয়ে দিয়েছ আমাদের ভালোবাসার রত্নকোষ, সেভাবেই আমিও এই রিক্তের বেদনা ছড়িয়ে দিলাম মহাকাশে। এটাই হয়তো আমার বহু কাঙ্ক্ষিত সূক্ষ্ম প্রতিশোধ।

আগের চিঠিটা লেখার পরমুহূর্তে যেখানে ভালোবাসার বীজ উপ্ত ছিল, সেখান থেকে অঙ্কুরিত হলো অস্থিরতা ও ক্রোধ। ছন্নছাড়া মনে তোমাকে লিখতে পারলাম না। আজ মন শান্ত। তুমি যা করেছ তা তোমারই থাক, ওই গুপ্তধনে আমার কাজ নেই। আমি আমার প্রেম ও বেদনার সুমদ্র নিয়ে দিব্যি আছি। বিভক্ত হৃদয় থেকে আজ প্রথমবার তোমাকে আশীর্বাদ করছি, তুমিও ভালো থেকো।

 

৪.

স্মৃতির আকাশ অনেকটাই কুয়াশাকাতর এখন, তবুও মেঘ ভেঙে উঁকি দেয়া কিছু সঞ্জীবনী স্মৃতি, মাতাল করে মাঝ বিকেলে। তাদের আসা-যওয়া বড্ড এলোমেলো, না আসে সময়ের হিসেব কষে না আসে তীব্রতার হিসেবে। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে তোমার চোখের কথা। বুঝি তোমার চোখই ছিল একমাত্র সত্যভাষী। সেখানে একটা নিমজ্জিত কৌতুক ছিল আমার জন্য, মনে হতো আমার ছেলেমানুষির স্রোতে গা ভাসানো তুমি কোনো বৃদ্ধ বটগাছ।

কিন্তু শেষদিনে, যেদিন শেষবারের মতো তোমায় দেখি, জল দেখেছিলাম তোমার দুচোখে। আমার চোখের জলের প্লাবনের তুলনায় সেটা নেহাতই একপশলা বৃষ্টি। তবু আজ পর্যন্ত ওটুকুই আমার স্তব্ধ দুপুরে সুদূর থেকে ভেসে আসা রবীন্দ্রসংগীত।

আমি বিশ্বাস করেছিলাম তোমার ঠোঁটকে। ক্রমাগত মিথ্যের ফুলঝুরি, যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়া আতশবাজির টুকরো টুকরো আলো; দৃশ্যত সত্যি, কিন্তু এর থেকে মিথ্যে খুব বেশি নেই পৃথিবীতে। তবু কথা দিয়েছিলাম ওই কথাগুলোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচব। শত চেষ্টা সত্ত্বেও তোমাকে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি ভাঙতে পারিনি।

সবসময় শুনে এসেছি সত্যের শক্তির কথা, মিথ্যেরও প্রচণ্ড শক্তি আছে যদি কেউ তা সত্যিকার বোকামিতে বিশ্বাস করে। আক্ষরিক অর্থে বোকা ছিলাম আমিই।

 

৫.
ঘড়ির স্থুলতর কাঁটাটি দুইয়ের ঘরে। সবাই এখন ঘুমে অচেতন। সংসার নামক সমঝোতা আর শৈশব নামের এক টুকরো জীবন সবাই নিদ্রাদেবীর কোলে, কেবল অবাধ্য ভালোবাসা নামক দু-একটা চার চাকার গাড়ি রাজপথের নিরবতা ভেঙে ছুটে যায় অজানা গন্তব্যে। আজকাল রাত জাগাটা প্রায় অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। সেই কবে তোমাকে স্বপ্ন দেখার ভয়ে সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি বারান্দায় একলা বসে, তারপর থেকে তোমার স্বপ্ন আসুক বা না আসুক— ঘুম দিব্যি ছুটির আমেজে রাত কাটাচ্ছে।

তুমি কি আজ জানতে চেয়েছ অভিনব আমি কেমন আছি? মনে হলো একটু আগে কোনো দিক্ভ্রান্ত সুগন্ধ এসে তোমার প্রশ্নটুকু আমার চারপাশে ছড়িয়ে আবার হারিয়ে গেল। উত্তর দেবো এমন সাধ্য কী! উদাসীন এই জীবনের ভালো-মন্দের হিসেবের খাতা খোলা হয়নি আর। তবে ‘আছি’ এই শব্দটুকু বলা যায় বাস্তবতার স্বার্থে।

আশা রাখি আমার এই বেঁচে থাকার দুঃসংবাদটুকু ভোরের কোনো কাক বহন করে নিয়ে যাবে তোমার রুপোলি বারান্দায়। ভয় পেও না, সে কোনো দিনই ছিনিয়ে নেবে না তোমার হাত ভর্তি আলোর ঐশ্বর্য। আমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিতে শেখেনি, এটা তুমি জানো।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি জন্ম একত্রিশ এ জুলাই নওগাঁর মহাদেবপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতোকত্তর।বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। গ্লোরি কলেজে প্রভাষক পদে কর্মরত। প্রকাশিত কবিতার বই দুটি। কীর্তিনাশা (২০১৩) আর জলের জ্যামিতি (২০১৭)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।