বুধবার, এপ্রিল ২৪

অনেক দিনের আমার যে গান

0

Startডা ডা ডা ডাম— লুডভিগ ভ্যান বিথোভেনের পঞ্চম সিম্ফনির শুরুর এই নোটগুলো সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ধুন। ১৮০৮ সাল থেকে আজ অবধি এই কালজয়ী সিম্ফনি ‘ভাগ্যের সিম্ফনি (Symphony of Fate)’ নামে পরিচিত। বিথোভেনের মতে ‘This is the sound of fate knocking at the door.’। এই সিম্ফনির সৃষ্টিকালে তিনি আসলেই ভাগ্যের সাথে লড়াই করছিলেন। ক্রমশ বধিরতা গ্রাস করছিল তাঁকে। ১৭৯৮—১৮১৪, এই ১৬ বছরে তিনি সম্পূর্ণভাবে বধিরতায় নিমজ্জিত হন। কোনো চিকিৎসা তাঁকে নিরাময় দিতে পারেনি। চিকিৎসকরা তাঁর অবস্থার অবনতি হতে পারে বলে সংগীতচর্চা বন্ধ রাখতে বলেছিলেন। উত্তরে তিনি লিখেছিলেন : ‘আমার নিজের জীবন থামিয়ে দিতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, কেবল সংগীতই আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।’

’যদি প্রেম দিলে না প্রাণে
কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?’

জীবনকে কি গান থেকে আলাদা করা য়ায়? কিংবা গান থেকে জীবন?
‘গান শেষ আর জান শেষতো একই কথা… আমার যেদিন থেকেই জ্ঞান, সেদিন থেকেই গান’ —স্মরণীয় এই উদ্ধৃতির উৎস সংস্কৃতিমনা বাঙালি পরিবারে বেড়ে ওঠা কাউকে বোধ হয় জানিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

গীত, নৃত্য আর বাদ্য— এই তিনের সমন্বয়ে সংগীত। ‘সংগীত’ শিল্পের সে আদি মাধ্যম, যাকে কোনো সীমারেখায় বাঁধা যায় না। গীত চলে তার আপন ভঙ্গীতে, তারই অনুসরণে নৃত্য, আর সংগত করে বাদ্য। ত্রিমাত্রিক ত্রিভুজাকার ইনফাইনাইট। স্থাপত্যে ত্রিভুজ বা ট্রায়েঙ্গেল সবচেয়ে শক্তিশালী ফর্ম, সব থেকে ডাইনামিক—স্থাপত্যকেও বলা হয় ‘হিমায়িত সংগীত’। সংগীতও বোধ করি একই কারণে এত গতিময়, এত মুখরিত। ত্রিভুজ প্রেমের গল্পের মতোই আকর্ষক।

‘সমস্ত ধর্মই বিভিন্ন ভাবে একই গান গায়। পার্থক্যগুলি কেবল বিভ্রান্তির, মায়া এবং অহংকার। এই দেয়ালের তুলনায় ওই দেয়ালটিতে আছড়ে পড়া সূর্যের আলো কিছুটা আলাদা দেখায়, এবং অন্য দেয়ালটি হয়তো এদের চেয়েও অনেক আলাদা, অথচ আদতে সব একই আলো।’

রুমি বলেছেন— ‘সমস্ত ধর্মই বিভিন্ন ভাবে একই গান গায়। পার্থক্যগুলি কেবল বিভ্রান্তির, মায়া এবং অহংকার। এই দেয়ালের তুলনায় ওই দেয়ালটিতে আছড়ে পড়া সূর্যের আলো কিছুটা আলাদা দেখায়, এবং অন্য দেয়ালটি হয়তো এদের চেয়েও অনেক আলাদা, অথচ আদতে সব একই আলো।’ বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্নভাবে সংগীতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ গীর্জার ঘন্টাধ্বনিতে, আজানের উদ্বাত্ত আহ্বানে, রাসলীলা কিংবা নটরাজ শিবের তাণ্ডবে সেই সংগীতই ফিরে এসেছে বার বার তার নিজস্ব মহিমায়।

1-banging-and-blowing-the-first-musical-instruments-1393243277-view-1

“Neanderthal” হাড় দিয়ে তৈরি আদিম বাঁশি

অনুকরণপ্রিয় মানুষ যখন প্রকৃতির সুন্দর শব্দ ও ছন্দ আপন কণ্ঠস্বরে বন্দি করতে চেয়েছিল, তখন থেকেই সংগীতের যাত্রা। ধারণা করা হয় যে, পৃথিবীর প্রথম বাদ্যযন্ত্রটিও সম্ভবত মানব-কণ্ঠস্বর। গুনগুন করা এবং শিস দেওয়া থেকে শুরু করে কান্না-হাসি, পাখির কুজনের অনুকরণ, জলের কলতানের পুনরাবৃত্তি, হাঁচি-কাশি এবং হাই তোলার মাধ্যমে আপন কণ্ঠস্বর বিশাল আকারের শব্দ তৈরি করতে পারে। সংগীতের ইতিহাস তাই মানুষের ইতিহাসের মতোই পুরোনো। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা হাড় এবং হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি আদিম বাঁশির সন্ধান পেয়েছেন, যা প্রায় ৪৩,০০০ বছরেরও বেশি পুরোনো, এবং সম্ভবত অনেক প্রাচীন সংগীত-শৈলী মৌখিক ধারাবাহিকতায় এবং ঐতিহ্যক্রমে সংরক্ষিত হয়েছে।

‘Hurrian Hymn No. 6’ কে বিশ্বের প্রথমতম সুর হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে পুরোপুরি টিকে থাকা প্রাচীনতম সংগীত রচনা হয় প্রথম শতাব্দীর এ.ডি. (first century A.D. ), যা একটি গ্রীক সুর ‘সিকিলোস এপিটাফ’ নামে পরিচিত। গানটি তুরস্কে এক মহিলার কবরস্থানে একটি প্রাচীন মার্বেল কলামে খোদাই করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোহা-সংকলন গীতিপদাবলি চর্যাপদের চর্যাগানগুলোই বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীনতম সংগীত হিসেবে বিবেচ্য।

প্লেটো বলেছিলেন ‘অন্তর্জীবনের প্রবেশদ্বার হলো সংগীত’। সংগীত যতটা কাব্যিক, ততটা বৈজ্ঞানিক, এবং ততটাই দার্শনিক। অতি সাধারণ কথায় বলতে গেলে সংগীত-বিজ্ঞান রূপায়িত স্বরের কম্পন, শ্রুতি, বিকাশ নিয়ে ব্যাখ্যা এবং পর্যালোচনা করে। পাশ্চাত্যে ‘সংগীতের নন্দনতত্ত্ব’ (Aesthetic of Music) দর্শনের একটি শাখা, যা সংগীতের শিল্প, রুচিবোধ এবং সংগীতে সৌন্দর্যের সৃষ্টি বা উপলব্ধি নিয়ে কাজ করে। সংগীত-নন্দনতত্ত্ব সংগীত রচনার উৎস, প্রকার, বিকাশ, উদ্দেশ্য, অভিনয়, উপলব্ধি এবং তাৎপর্য বিশ্লেষিত করে। প্রাক-আধুনিককালে সংগীতের নান্দনিকতা ছন্দ এবং সুরের গাণিতিক এবং মহাজাগতিক (mathematical and cosmological dimensions) অন্বেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে (অষ্টাদশ শতাব্দীতে) মনোযোগ স্থানান্তরিত হয় সংগীত-শ্রবণ অভিজ্ঞতা, গানের সৌন্দর্য এবং সংগীত উপভোগের আনন্দের প্রতি। এই দার্শনিক রূপান্তর বা philosophical shift-এর নেপথ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট যিনি সংগীতের লিরিককে এবং বিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক পিটার কিভি, জেরোল্ড লেভিনসন, রজার স্ক্রটন এবং স্টিফেন ডেভিসের যারা সংগীতের ভিজুয়াল আস্পেক্টকে গুরুত্ব দেন।

সংগীত-নন্দনতত্ত্ব এতটাই ব্যাপক এবং জটিল যে, সহজ এবং অল্প কথায় এর স্বরূপ প্রকাশ করা কঠিন। নন্দনতত্ত্বের প্রাথমিক পর্যায়ে সংগীতের composition বা কাঠামোগত সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হতো। পরবর্তীতে যখন গীতিকারতা (Lyricism), সঙ্গত (Harmony), সম্মোহনবাদ (Hypnotism), আবেগময়তা (Emotiveness), সাময়িক গতিবিদ্যা (Temporaral Dynamics), অনুরণন (Resonance), আনন্দময়তা (Playfullness) আর রং (Color) এবং সর্বাপরি দৃশ্যায়ন (Visualization) চলে আসে তখনই জন্ম হয় বিতর্কের। সংগীতের নন্দনতত্ত্ব তাই সংগীতকে প্রথাগত সুর-তাল ও ছন্দের বাইরে আরও এক অন্য ডাইমেনশনে নিয়ে যায়। বাস্তবতা থেকে উত্তীর্ণ করে পরাবাস্তবতায়।

Ludwig van Beethoven

Ludwig van Beethoven

সংগীত-নন্দনতত্ত্বের বিচারে বিথোভেনের পঞ্চম সিম্ফনির কম্পোজিশন চারটি মুভমেন্টে বা চলনে বিভক্ত:

প্রথম চলন: ক্রোধ, বেদনা, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষোভ (Anger, Pain, Betrayal, Rage)
দ্বিতীয় চলন: মর্যাদাপূর্ণ সমর্পণ (Dignified resignation)
তৃতীয় চলন: ক্রোধের পূনর্জাগরণ ও
আলোড়ন, লড়াই করার ইচ্ছা (Anger building again. Desire to fight stirring again)
চতুর্থ চলন: বিজয় নির্ধারণ (Determination to Triumph)

বিখ্যাত পঞ্চম সিম্ফনির শুরু চারটি স্ট্রাইকিং নোট দিয়ে— ডা ডা ডা ডাম। এই চারটি নোটে এক অস্হিরতা, অনিশ্চয়তা আর অজানা ভয়ের সংকেত (unknown destiny) আছে।

দ্বিতীয় চলনটি প্রথমটি থেকে একেবারেই আলাদা। প্রথম থিমের মতো সাসপেন্স, অশনিসংকেতের খেলা নেই এতে, দ্বিতীয় থিমটি খেলে আলতোভাবে। সমঝোতার মনোভাব নিয়ে চলতে চলতে দ্বিতীয় থিমের শেষের দিকে ‘woodwinds, horns’ শ্রোতার কান ও মনকে এক্সপোজিশনের পুনরাবৃত্তির জন্য প্রস্তুত করে এবং প্রথম থিমটির স্বভাবের মধ্যে ফিরে আসে।

দ্বিধা দিয়ে শুরু হয় তৃতীয় চলন। তবে ধীরে ধীরে বিস্ফোরিত হয়ে ঝংকারে যুদ্ধংদেহী পুরো অর্কেস্ট্রা সেনাবাহিনী নিয়ে রুখে দাঁড়ায় যেন ভাগ্য আর সময়ের বিপরীতে। যুদ্ধের ঘোষণা জানায়।

চতুর্থ এবং চূড়ান্ত চলনটি হলো বিথোভেনের এ মহাকাব্যের উপসংহার। প্রথম থিমের মতো সাসপেন্স দিয়ে শুরু হলেও, এই চলনে বিথোভেন চারটি থিমের সাথে আবারও পরিচয় করিয়ে দেয় নতুন আঙ্গিকে। তারপর সব থিম সম্মিলিত হয়ে উজ্জ্বল, প্রফুল্ল একটি স্বরে পরিবর্তিত হয় এবং শ্রোতাকে এক আসন্ন সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে সমাপ্তিরেখা টানে।

লুডভিগ ভ্যান বিথোভেন জানতেন তাঁর জীবন এক ভয়াবহ পরিনতির দিকে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাঁর জীবনযাপন এবং পারফর্মার হিসাবে তাঁর ক্যারিয়ারও বধিরতার সাথে হয়েছে শেষ। যদিও জানতেন নিজের সৃষ্টিকে উপভোগ করার স্বাদ তিনি আর কোনো দিনই পাবেন না, তবুও বধিরতার কাছে পরাজিত হননি এই মহান সুরকার, ম্যাস্ট্রো কম্পোজার। শুধু হৃদয়ের শ্রবণেই সৃষ্টি করেছেন একের পর এক কালজয়ী মহাকাব্যিক কম্পোজিশন। একজন বধির সংগীতস্রষ্টার এ অবিস্মরণীয় পদক্ষেপ অবিশ্বাস্য হলেও এখানেই সংগীতের সেই তৃতীয় চোখ, শ্রবণের বাইরের সেই অলৌকিক ভুবন, নন্দনতত্ত্বের সেই ফোর্থ ডাইমেনশন।

সংগীত যে আসলে অনেকটাই ভিজ্যুয়াল, সেটা মেনে নিতে আমরা অনেকেই পারি না। অথচ যখন আমরা একটি মিউজিক পিস বা গান শুনি, তখন অবচেতন মনেই প্রিয় শিল্পীর অবয়ব অথবা কতগুলি দৃশ্যকল্প রচনা করতে থাকি। তৈরি করতে থাকি কিছু শেপ বা আকৃতি, রং বা ছবি যা আমাদের নিজস্ব মিউজিকাল এক্সপ্রেরিয়েন্সেরই প্রতিফলন।

শাস্ত্রীয় সংগীতের নান্দনিকতা কেবলমাত্র সংগীতকেই (pure music) কেন্দ্র করে, ভিজ্যুয়াল উপাদানকে কেন্দ্র করে নয়। শাস্ত্রীয় সংগীত শ্রোতার গহীন গভীরে নাড়া দেয়, আলোড়িত করে, কিন্তু ঘুরে-ফিরে সংগীতের শ্রুতি-প্রকৃতিকে মূখ্য করে তোলে। ধ্রুপদী সংগীত দৃষ্টিগোচর হবার বিপরীতে শ্রুতিমধুরতার এবং শ্রবণনির্ভর।

সংগীত যে আসলে অনেকটাই ভিজ্যুয়াল, সেটা মেনে নিতে আমরা অনেকেই পারি না। অথচ যখন আমরা একটি মিউজিক পিস বা গান শুনি, তখন অবচেতন মনেই প্রিয় শিল্পীর অবয়ব অথবা কতগুলি দৃশ্যকল্প রচনা করতে থাকি। তৈরি করতে থাকি কিছু শেপ বা আকৃতি, রং বা ছবি যা আমাদের নিজস্ব মিউজিকাল এক্সপ্রেরিয়েন্সেরই প্রতিফলন। বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক বা জনপ্রিয় সংগীত ভিজ্যুয়ালাইজেশনে আরেক মাত্রা নিয়ে আসে। শ্রুতিনির্ভরতা থেকে সংগীতকে যুগপৎ শোনার ও দেখার জিনিস করে তোলার মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। বাণিজ্যিক ও বিনোদনমূলক আগ্রহের দিকে মনোনিবেশ, সর্বসাধারণের কাছে আবেদন সৃষ্টির জন্য গানকে সাজানো, সংগীতে লঘুভাব ও বহুমাত্রিকতার অভাব সমালোচানার জন্ম দেয়, এবং শাস্ত্রীয় সংগীতই উচ্চতর শিল্প হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যদিও আমেরিকান দার্শনিক রিচার্ড শুসথারম্যানসহ আরও অনেকেই এ ধারণার বাইরে ভিন্নমত প্রকাশ করেন, এবং জনপ্রিয় সংগীতকেও আ্যসথেটিক কমপ্লেক্সিটির ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় সংগীতের সমপর্যায়ের মনে করেন।

অবিশ্বাস্য হলেও মিউজিকলিস্টদের গবেষণায় দেখা গেছে, সংগীত উপভোগের পর আমরা যা মনে রাখি তার আশি শতাংশ ভিজ্যুয়াল। শিল্পীকে কেমন দেখাচ্ছে, অবয়ব বেশভূষা, নাচের কোরিওগ্রাফি, ভেন্যুর ডেকোর এবং আরও অনেক কিছুই সংগীতের পাশাপাশি মনে জায়গা করে নেয়। শুধুমাত্র শোনার ক্ষেত্রেও সেই সময়ের আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিকতা, রোদ না বৃষ্টি… মানসিক অবস্থান, সুখ-দুঃখ, অভিমান… কোনো শহর বা গ্রাম, রেলস্টেশন… ফুলের সুবাস, নদী-সাগর…আমাদের মনের মধ্যে চিরতরে আঁকা হয়ে যায়। তাইতো সংগীতের মূর্ছনা মনে করিয়ে দেয় মায়ের মুখ, প্রেমিকার শাড়ির আঁচল, টেনে নিয়ে যায় ফেলে আসা মেঠো পথে। সংগীত শুধু আর সংগীত হয়ে থাকে না, হয়ে ওঠে কিছু সময়ের দলিলপত্র। ব্যক্তিগত আনন্দ, ক্ষত, ক্ষরণের অনুভূতির রং-এ যত্নে আঁকা কোনো জলজ্যান্ত পেইন্টিং।

Rabindranath Thagor

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘অনুভূতির বাইরে রসের কোনো অর্থই নেই।… সৌন্দর্যরসের সঙ্গে অন্য সকল রসেরই মিল হচ্ছে ঐখানে, যেখানে সে আমাদের অনুভূতির সামগ্রী।’ —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

‘রঞ্জয়দি ইতি রাগ’—যে স্বর রচনা মানুষের চিত্তরঞ্জন করে তাকে বলা হয় ‘রাগ’। প্রাচ্যে সংগীতনন্দনতত্ত্ব বিষয়টা প্রাশ্চাত্যের থেকে আলাদা হলেও এর মূলভাব বা দর্শন একই সূত্রেই গাঁথা। শাস্ত্রীয় সংগীতে রাগ মানবচিত্তে এক ধরনের রঞ্জক ধ্বনির আবহ সৃষ্টি করে। সৌন্দর্যরস, বিভিন্ন ঋতু পর্যায়, দিনের বিভিন্ন ভাগ, মনের বিভিন্ন ভাবাবেগ, লক্ষণ, গ্রহ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তিরাশিটিরও বেশি রাগ রয়েছে শাস্ত্রীয় সংগীতে। রবীন্দ্রচৈতন্যে নন্দনতত্ত্বে ‘আত্মার দান’— আধ্যাত্মিকতা, ‘সৌন্দর্য’ ও ‘আনন্দ’, ‘ভাববাদ ও বাস্তববাদ’ নানামাত্রার তাৎপর্যপূর্ণ। পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি রবীন্দ্রতত্ত্বের এই বিভিন্ন পর্যায় প্রাশ্চাত্যের সংগীতনন্দনতত্ত্বের বিভিন্ন চলনের পরিপূরক।

‘সত্যই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই সত্য’— রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘নির্বস্তুক রূপরস সত্য, বিজ্ঞানও অধিবিদ্যার অন্তর্গত হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জগৎ শিল্পকলারই ভুবন। শিল্পের নান্দনিকতা প্রসঙ্গে আমরা যে সৌন্দর্যের কথা বলি তা সাধারণ অর্থে নয়, সৌন্দর্যবোধের গভীরতার অর্থেই বলে থাকি।’

বাউল সংগীতে দেহতত্ত্ব ও আত্মতত্ত্বের পরাবাস্তবতা, সরল জীবনদর্শন, ভক্তি, সৃষ্টিতত্ত্ব প্রাচ্যের সংগীতকে নন্দনতত্ত্বের উচ্চতর পর্যায়ে আসীন করে। লালনের ‘বাড়ীর পাশে আরশীনগর’ কখনো বা ‘অচিন নগর, কখন ও ‘খোদার আরশ’ আবার কখনও ‘মাতৃজঠর’।

Lalon sketch by Jyotirindranath Tagore

লালন ফকির ।। প্রতিকৃতি : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না। একবার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে আচেনারে চেনা’ রূপকার্থে তাই লালনের নন্দনতত্ত্ব ‘ঐরূপে নিহার রাখে অনুরাগী যারা’।

‘মহাবিশ্বের সব কিছুতেই ছন্দ আছে, সব কিছুই নৃত্যপর’— মায়া এঞ্জেলো।

সংগীত আবেগের প্রকাশ এবং ভাব বিনিময়ের বাহন। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো ভাষায়, কিংবা যেকোনো বাদ্যযন্ত্রের সাথেই বাজানো হোক না কেনো, এর অন্তর্নিহিত ভাবাবেগ তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করা যায় শুধুমাত্র একটি ধুনের মাধ্যমে। সংগীত সংবেদনশীল, সার্বজনীন। মানুষকে সংঘবদ্ধ করার, বিভিন্ন সংস্কৃতিকে একীভূত করার এক অনির্বচনীয় ক্ষমতা ধারণ করে সংগীত, সব ধর্ম-গোত্র আর জাতিকে এক সুরে বাঁধে। বব মার্লে বলেছেন, ‘আমার সংগীত সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করে, যা বেঁচে থাকতে ও মরতে শেখায়’। জাগরণী সংগীত কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গান, জন লেননের ‘ইমাজিন’, কি জর্জ হ্যরিসনের ‘বাংলাদেশ’ তাই বইয়ে দিতে পারে জনজোয়ার, বদলে দিতে পারে ইতিহাস। জাগতিক সব সৃষ্টি এক সুর এবং ছন্দে বাঁধা। প্রতিটি হৃদকম্পন একই লয় ও ছন্দে চলে। সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, ঋতু-পরিবর্তন, জোয়ার-ভাটা কোনো কিছুই সেই তাল ও ছন্দের বাইরে নয়। আর সেখানে ছন্দপতন হলেই মহাপ্রলয়। তাই তো কবি বলেছেন:

‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি।’

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি লায়লা ফারজানা পেশায় স্থপতি। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন (আরবান ডিজাইন ও স্থাপত্যবিদ্যায়) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো থেকে। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটি স্কুল কনস্ট্রাকশন অথোরিটিতে স্থপতি হিসাবে কাজ করছেন। এর বাইরেও লায়লা ফারজানা একজন নাট্যশিল্পী এবং শিল্প ও সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে তার সাবলীল যাতায়াত। নিউইয়র্ক-এর ডিস্টুডিওডি আর্কিটেক্টস এবং ইঞ্জিনিয়ার্স (দ্য স্টুডিও অফ ডিজাইন) তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, যেখানে তিনি ‘সাসটেইনেবল-আর্কিটেকচার’ এর চর্চা করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।