বুধবার, এপ্রিল ২৪

অহম ও অশ্রুমঞ্জরি : নিবিড়তম ছায়াভাস্বর

0

‘সন্ধ্যা বুঝি, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে’

বিস্ময়ে জেগে উঠি! এ বিস্ময় দীর্ঘসময়ের, দীর্ঘকালের। কেন অথবা কীভাবে এই বিস্ময়ের উৎস এবং বিস্তার, এটাও অন্য আরেক বিস্ময়।

হিংসা আর বিদ্বেষ ভরা এই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে এত নিবিড় হতে পারেন কোনো মানুষ, এমন বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে উঠতে দূরে দেখা যায় পয়-গম্বর কোনো পাখির কুহক যেন সন্ধিপ্রকাশে মিইয়ে যায়।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা! আমাদের বাড়ির পেছনদিকে কবিতার মতো যে আলপথ খুলে গেছে দিগন্তের দিকে তাকে মনে পড়ে। শেষ বিকেলের গায়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বুঝি সন্ধ্যা। নদীর উপর ছায়া ফেলে আছে সারি সারি গাছ। অস্তসূর্যের দিকে। কবির এই দৃষ্টির কাছের ক্ষণিক দাঁড়াই। সন্ধ্যাকে দেখার অনুষঙ্গে কবি আবার লিখছেন—

‘যে স্বর অনন্তের কাল ছিঁড়ে ভেসে আসছে যেন পিতৃঋণ থেকে, তার ভেতর প্রতিভাসিত আমাদের স্মৃতি ও বধিরতা’

বধিরতা আর স্মৃতি একে অপরের ভেতর এসে আবার যেন মিশে যাচ্ছে সুপ্রতীম এই সন্ধ্যার ভিতর। সন্ধ্যার অনুষঙ্গ নিয়ে কবি আবার লিখছেন—

‘শান্ত জল/ তার কেশভার নত হয়ে আছে/ নিরাশ্রয়, মাটির দেয়াল বেয়ে সন্ধ্যা নামছে’। সন্ধ্যাকে আশ্রয়বিহীন করে দিয়ে কবি যেন রাত্রির দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন আনমনে!

ঘুমের কিনার থেকে জেগে ওঠেন কবি। কবির কল্পনায় যাকিছু দৃশ্য আঁকা চোখ বন্ধ করলে যেন ভেসে ওঠে। বাঁশপাতার শব্দ থেকে ঝিঁঝিদের রব এসবের সাথে তাঁর জন্মাবধি সখ্যতার শ্রুতিধারা।

ঘুমের কিনার থেকে জেগে ওঠেন কবি। কবির কল্পনায় যাকিছু দৃশ্য আঁকা চোখ বন্ধ করলে যেন ভেসে ওঠে। বাঁশপাতার শব্দ থেকে ঝিঁঝিদের রব এসবের সাথে তাঁর জন্মাবধি সখ্যতার শ্রুতিধারা। ‘আমিও কী ঘুমিয়ে পড়েছি কিংবা জেগে উঠছি ফের’। ঘুম আর জাগরণের ব্রাহ্মমুহূর্তে এসে কবি এঁকে রেখেছেন সারি সারি ছায়ার ভাস্বর। যেখানে খুব সন্তর্পণে থেমে থাকতে হয় দীঘলবাঁকের কাছে।

থেমে থাকার অনুষঙ্গ থেকে ভাবতে গেলে, আমার সর্বকালীন মজ্জাগত রোগ কোনো লেখকের লেখায় বিশেষ কোনো অংশে আটকে থাকা। আবার সেই কবি কিংবা লেখকের আদল অচিরেই কল্পনার ভিতর কে যেন এঁকে দিয়ে যায়। অনুপম মণ্ডলের কবিতা পড়তে পড়তে বারবার একজনের কথা মনে পড়ে আমার। বহুদিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ পড়েছিলাম। সেই উপন্যাসে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র ছিল ‘ভরত’। যতগুলো পর্বে ভরত দৃশ্যমান ছিল, ভাবতাম আমিই ভরত। কবি অনুপমের কবিতা পড়তে পড়তে বারংবার এখন মনে হয় আমি নই, আসলে ভরত আর অনুপম কোথায় এসে যেন মিশে যাচ্ছেন একই ধারায়। ভরতের বিলম্বিত পঞ্চম সওয়ারীর সম যেন কবি অনুপমের শেষ মাত্রা। ভরতের চারিত্রিক স্থির অনুকম্প আর কবি অনুপমের প্রকৃতিজ ধারাভাষ্য বহুদূর দিগন্তে সমরেখ হয়ে যাচ্ছে যেন।

কবির লেখায় সুরের আঘাত এসেছে বহুবার। যেমন বিভাব কবিতায় দেখা যায় ‘ক্ষুদ্র এই কণ্ঠ নিয়ে বসে আছি/ শোকাকুল পাতাগুলো একে একে কোলের উপর গড়িয়ে নামছে’

যে পাতাগুলোর কথা কবি এখানে বলেছেন আমার মনে হয়েছে কোনোভাবে এটা যেন সুরেরই অনুষঙ্গ। সুর এমনই এক অতিজাগতিক বিষয় যার কাছে মানুষ চেতন অবচেতনে অবিমিশ্র আশ্রয় স্বীকার করে। ‘একটা ডাহুক’ কবিতায় কবি লিখছেন—

‘এই কী তোমার অসীমের পথ?
শিরীষের ছায়ার ভেতর,
মন্দ্রস্বরে একটা ডাহুক ডেকে উঠল
যেন সে অলঙ্ঘ্য পথের বার্তা,
সুর খুঁজে নিভৃতে তোমার শ্রান্ত প্রাণের’ পরে তুলে ধরল
অপার নিদ্রার মোহ’

এই যে ডাহুকের ডাক আর অনন্তের পথে একটা ধীরতার সুর কেঁপে উঠছে এ তো কল্যাণ ঠাটের অঙ্গ, কবি এখানে কবিতার ভিতর খুলে রেখেছেন। আবার এক জায়গায় কবি লিখছেন—

‘একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকছে
কোথায়, কোন বনপ্রান্ত, ভরে আছে শনশন শব্দে।

মাঠের ওই শীর্ণ পথ ধরে যারা ফিরেছে সন্ধ্যার কিছু আগে,
তাদের মাথার উপর আশ্রয়হীন খরের ঘরখানি।

একটা সুর ঘুর্ণায়মান নির্জনতার মধ্যেও
অন্ধকারে জড়িয়ে আছে আমাকে, ঝিঁঝিঁকে, পথকে।’

এই অনুষঙ্গ কোনো না কোনোভাবে সন্ধিপ্রকাশ রাগ শ্রী এর কথাই বলে যাচ্ছে অগোচরে।

তবে পাঠ করতে করতে কোথাও আবার যেন মনে হয়েছে কিছু কিছু কবিতার লিরিক একই ভাবনার আত্মবিস্মৃতি। নিরাময়তার ভিতর যেন স্বল্প জ্বরের চিহ্ন।

তবে পাঠ করতে করতে কোথাও আবার যেন মনে হয়েছে কিছু কিছু কবিতার লিরিক একই ভাবনার আত্মবিস্মৃতি। নিরাময়তার ভিতর যেন স্বল্প জ্বরের চিহ্ন।

কবির ভেতর যে নিজস্ব নিসর্গ লুক্কায়িত সেখানে প্রকৃতির বিস্তৃত মোহন আলো থেকে একটু একটু আলো এনে সাজিয়ে রেখেছেন এক একটা কবিতার টুকরো। পাঠের পর যেখানে মিশে যেতে হয় নিবিড় ছায়ার মতো, অশ্রুর বিহ্বলের মতো।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৯৪ সালের ২৫শে জুলাই ত্রিপুরার একটা ছোট্ট গ্রাম চেবরীতে। ২০১৭ সালে কারিগরি শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে ত্রিপুরা সরকারে প্রকৌশলী পদে কর্মরত। কবিতার অনন্তপথে হেঁটে যাওয়াই সময় ও যাপনের সারাৎসার মনে করেন সম্রাট।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।