শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

কবিয়াল মদন মোহন আচার্যের বন্দনাসংগীত

0

মনের উপনিবেশে আটকে থেকে বাংলার কবিগানকে আজ আর হয়তো অনুভব করা যাবে না। উপনিবেশিক গোলামিতে প্রান্তিক সংস্কৃতির মহাজাগতিক অনেক আচার ও ধারাকেও আজ আমরা খারিজ করে দিচ্ছি এবং দিতে যাচ্ছি। অবলুপ্তির এই বিষণ্ন পথে হেঁটে আমরা হয়তো কোনো ভাবেই অনুভব করতে পারব না নিরুদ্বিগ্ন শান্তিময় সহজসরল গ্রামীণ সমাজেও ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, তর্কভিত্তিক কবিগান। আপামর জনসাধারণ ছিলেন এই গানের শ্রোতা ও বিচারক। একটা যুক্তপূর্ণ এবং আন্তরিক পরিবেশে দীর্ঘ রাতের প্রহরে শ্রোতা এবং কবি জয়-পরাজয়ের বাইরে এসে জ্ঞান ও ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় নিজেদের সমর্পণ করতেন। শুধু বিনোদন নয়; ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণের বিনির্মাণের মধ্যদিয়ে এ-যেন সামাজিক দায়িত্ব পালন। সমাজ পরম্পরায়, কবিয়াল পরম্পরায় যুক্তি ও ভাষায় পুরাণ ও ইতিহাসের অনিবার্য কথনই হাজির হয়েছে বাংলার উঠানভিত্তিক আসরের গানে। ‘আমি কী হনুরে!’-এই অন্ধত্ব থেকে দূরে সমাজ ভাবনার ভেতর দিয়ে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিমগ্নতায়, ধর্ম ও আচারিক নিত্যতাতে প্রকৃত এবং প্রকৃতির ধারণাতেই হাজির করেছেন সময়ের শিল্পীবৃন্দ। কলোনিয়াল শিক্ষায় অবগাহন না করেও লজিক এবং ডিসকোর্সের চর্চা জনসংস্কৃতির ভেতরেই ছিল। আদব এবং যুক্তি দুটোই ছিল।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাস পড়ে, কিংবা সিনেমায় নাটকে ‘কবি’ উপন্যাসের চিত্ররূপ কিংবা এই সময়ের ফিল্ম ‘জাতিস্বর’ দেখে কিংবা ‘কবিয়াল এন্টুনি ফিরিঙ্গি’ নামের যাত্রপালার আলোকিত মঞ্চে বসে কিংবা পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় ধারা পায়ে ঘুঘুর বেঁধে কোমর দোলানো তর্জাগান শুনে পূর্ববাংলার কবিগান সম্পর্কে সামান্যতম অনুভব করা যাবে না।

বিদ্যাদেবী কিংবা বাকদেবী সরস্বতীকে নিয়ে কবিয়ালের এই গানটি আবদুর রহমান বয়াতির থেকে সংগ্রহ করেছি। কবি গানের এই সুর-সমাধির দেশে তিনি এখনও কবিগান বাঁধেন। আসরে কবর লড়াই করতে না পেরে নিজের ছোট্ট বই বাঁধাইখানার টং ঘরটায় বসে নির্জন দুপুরে একা একাই কবির লড়াই করেন। মানে, খাতা খুলে পক্ষ-প্রতিপক্ষ তৈরি করে কবিতা পড়েন। আবদুর রহমান বয়াতিও মদন সরকারের জীবন সায়াহ্নে কবিয়ালের কাছে কবিগানের দীক্ষা নিয়েছেন। এই বন্দনাসংগীত এবং গুরু সম্পর্কে বলতে গিয়ে বয়াতি বলেন,

বিদ্যাদেবী কিংবা বাকদেবী সরস্বতীকে নিয়ে কবিয়ালের এই গানটি আবদুর রহমান বয়াতির থেকে সংগ্রহ করেছি। কবি গানের এই সুর-সমাধির দেশে তিনি এখনও কবিগান বাঁধেন। আসরে কবর লড়াই করতে না পেরে নিজের ছোট্ট বই বাঁধাইখানার টং ঘরটায় বসে নির্জন দুপুরে একা একাই কবির লড়াই করেন। মানে, খাতা খুলে পক্ষ-প্রতিপক্ষ তৈরি করে কবিতা পড়েন। আবদুর রহমান বয়াতিও মদন সরকারের জীবন সায়াহ্নে কবিয়ালের কাছে কবিগানের দীক্ষা নিয়েছেন। এই বন্দনাসংগীত এবং গুরু সম্পর্কে বলতে গিয়ে বয়াতি বলেন—

কাকে কবিগান বলে? কীভাবে শুরু হয় কবিগান? কবিয়ালের কী ভুমিকা? দোহারের কী ভুমিকা? পক্ষ কবিয়াল কিংবা বিপক্ষ কবিয়াল আসরে কীভাবে অধিষ্ঠান করবেন, কতক্ষণ ধরে চলবে একপালা কবিগান— একটু একটু করে তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন।

সম্ভবত ১৯৯০ সালের অনেক আগেই, আমি আমার পরম গুরু মদন ঠাকুরের কাছে কবিগানের দীক্ষা নিয়েছি। নেত্রকোণা থেকে আমি বাংলার সহিলপুরে চলে যেতাম। উনার ছোট্ট কুটিরে সারাদিন কাটিয়ে রাতে ফিরতাম। এইটাই আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। কাকে কবিগান বলে? কীভাবে শুরু হয় কবিগান? কবিয়ালের কী ভুমিকা? দোহারের কী ভুমিকা? পক্ষ কবিয়াল কিংবা বিপক্ষ কবিয়াল আসরে কীভাবে অধিষ্ঠান করবেন, কতক্ষণ ধরে চলবে একপালা কবিগান— একটু একটু করে তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে, আমাকে পেয়ে তিনি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। উনার ছোট্ট উঠানটায় দীর্ঘ সময় ধরে তিনি প্রত্যেকটা বিষয় দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

আমি ছোটোবেলায় আসরে আসরে কবিগান দেখেছি। কিন্তু তিনি যখন শিখিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন রক্তের মধ্যে অন্যরকম একটা শিহরণ খেলে যাচ্ছিল। প্রথমে ফিরিয়ে দিছিলেন। দ্বিধা ছিল। কবিগান তখন শেষ হয়ে গেছে। কেউ বায়না করে না। গাওয়ার লোকও নাই। তাই হয়তো তিনি চাইছিলেন না। কিন্তু আমি কবিগান করব এই আগ্রহে উনার পিছনে ঘুরতে ছিলাম। শেষে দীক্ষা দিলেন। সামনে বসিয়ে কবিগানের সবগুলো বিষয় একটা একটা শিখিয়ে দিলেন।

আমার জীবন সত্যি সত্যি ধন্য হয়েছিল সেদিন। শুধু শেখানো নয়। কবিগান তো আসরের গান। তিনি শুধু কথা দিয়ে শিখান নাই; আমাকে আসরে কবিগান করার সুযোগ দিয়েছিলেন। কবিগানে কবিয়ালকে আসরে গাইতে না পারলে কিছুই শেখা হয় না।

কবিয়াল আবুল সরকারও তখন অস্তগত। অসুস্থতায় ঘরবন্দী। তাই, উনার শিষ্য কলমাকান্দার চেংটি গ্রামের নারায়ণ সরকারকে নিয়ে তিনি তখন আসরে আসরে কবিগান করেন। সেরকম একাধিক আসরে তিনি আমাকে কবিগান করার সুযোগ দিছেন।

কবিয়াল আবুল সরকারও তখন অস্তগত। অসুস্থতায় ঘরবন্দী। তাই, উনার শিষ্য কলমাকান্দার চেংটি গ্রামের নারায়ণ সরকারকে নিয়ে তিনি তখন আসরে আসরে কবিগান করেন। সেরকম একাধিক আসরে তিনি আমাকে কবিগান করার সুযোগ দিছেন। মনে হয়, প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন ঠাকুরাকোণা বাজারে। কংস নদীর তীরে উনার সাথেই আমি আসরে কবির লড়াই করছি।

শ্রী শ্রী বাকদেবীর এই বন্দনা গানটি গুরুই আমাকে দিয়েছিলেন। কবিয়ালরা অবসর সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে গান রচনা করে রাখতেন। আমারও ইচ্ছা হলো কিছু গান রচনা করি। আমার সে ইচ্ছার কিছু কথা গুরুর কাছে নিবেদন করি। তখন গুরুদেব নিজের খাতা থেকে এই বন্দনা গানটি মুখে মুখে বলেন। আমি লিখে নিই। শুধু বন্দনা গান নয়; কবিগান কীভাবে লিখতে হয়, কতটুকু লিখতে হয়, ত্রিপদি ছন্দ কি-সব বিষয়ে একটা ধারণা দিলেন।

(মোক্তারপাড়া মাঠের কোণায় উনার বাঁধাইখানায় এই কথাগুলো বলেছিলেন আবদুর রহমান বয়াতি)

 

শ্রী শ্রী বাকদেবীর বন্দনা

stob.

 

টীকা
কবিগানের শুরুতে এধরণের বন্দনাগানের রীতি ছিল। এধরণের গানকেই কবিগানে উদ্বোধনী গান বলা হয়। উদ্বোধনী গানের কোনো জবাব হয় না। প্রতিদ্বন্দ্বী উভয় দলই আসরে অবতীর্ণ হয়ে একটি গান করেন। এই বন্দনাগান কিংবা প্রার্থনাসংগীত কিংবা উদ্বোধনী সংগীতকে কবিগানে ‘ডাক’ বলা হয়। ‘ডাক’ গান এবং মালসী গানকেই কবিগানে মঙ্গলাচরণ বলা হয়। গবেষক স্বরোচিষ সরকার কবিগান, ইতিহাস ও রূপান্তর গ্রন্থে ‘ডাক’ সম্পর্কে বলেছেন ‘কবিগানের সুচনা-সংগীত হলো ডাক গান। এই গান কোথাও কোথাও ডাকসুর, বন্দনা ও নান্দী নামে পরিচিত। বিশ শতকের সুচনায় কবিগান সাধারণত গভীর রাত বা ভোর রাতে শুরু হতো। ডাক গানের উচ্চ সুর বাদ্যযন্ত্রের ঐকতানের সঙ্গে মিলে যে উচ্চরব সৃষ্ট করে, কবিগানের আসরে তা শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে। এভাবে ডেকে আনার কাজ করার মধ্য দিয়ে ডাক গান তার নামকরণের সার্থকতা পায়। ডাক গান সাধারণত চিতান এবং অন্তরা— এই দুই তুক দিয়ে তৈরি।…

ডাক শব্দের অর্থ আহ্বান। এই জাতীয় গানের কথাবস্তুতে আরাধ্যের প্রতি আহ্বানমুলক বা আবাহনমুলক বাক্য থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কালী অথবা দুর্গা এই গানের আরাধ্য। তকে বিশ শতকের সুচনায় অন্যান্য আরাধ্য দেবদেবীকে নিয়ে এবং কখনো কখনো ঈশ্বরকে নিয়েও ডাক গান রচিত হয়।’ (কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি, পৃষ্টা-১২-১৩)

 

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭৬; নেত্রকোণা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশায় শিক্ষক। গদ্য ও পদ্য লেখায় সতত সচল। প্রকাশিত কবিতার বই— সকাল সন্ধ্যার বীজতলা [ ২০১০] কাগজে সমুদ্র লিখি [ ২০১২] হলুদ খামের হিমঘর [ ২০১৫] সম্মিলিত কাব্যগ্রন্থ 'হট্টিটি গুচ্ছ' [ ২০০০] সম্পাদিত ছোটকাগজ : 'অনুধ্যান'। ই-মেইল : soroj76@gmail.com

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।