বুধবার, এপ্রিল ২৪

জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ : ২য় পর্ব

0

.০৩.
বিকালের আসমানটা সেইদিন একদম রইদে ভরা আছিলো! দমদমা রইদে ভরা।

সেইটা দেইক্ষা দিলরুবার আম্মায় মনে করে, দিনের এই শেষ বেলাখানও ভালাভালিই পার করা যাইবো! উঠানের তারে ভিজা কাপড়-চোপড় শুকায়ে করকরা হইতাছে! আসমানের যেই দিকে চক্ষু যায়, সেইদিকেই খালি নজরে আসে—কটকটা রইদ! রইদের ভিতরেও য্যান রইদ ঝলকানি দিতাছে সবখানে!

এই রোদ তো বলে যে, সব ঠিক আছে! আসমানের কোনোখানে কোনো মেঘ জমে নাই! কোনো দূর কোণায়ও টুটাফুটা, ছিঁড়া ছিঁড়া কোনো প্রকার কালো মেঘের জমাজমি হইতাছে না!

Ad Strip_Akimun Rahman_e Software_EP 2মুরগিরা হেইল্লা-দুইল্লা উঠানের এই মুড়া তেনে ওই মুড়ায় সোন্দর চইরা বেড়াইতাছে! তাদের চলাচলতিতেও মেঘ-বিষ্টি নিয়া কোনো ডরভয়ের নিশানা দেখা যায় না! তাইলে আম্মা খামাখা কীসের চিন্তা করবে! কোনো চিন্তা নাই!

মনেরে এমন বুঝ দিয়া, আম্মায় করে কী, নিজের কোলের ছাওটারে জাবড়ায়ে নিয়া বিছানায় কাঁৎ হয়। অন্য দুই পোলাপানরে নিয়া ভাবনার কিছু নাই। একজনের ছয়, একজনের চাইর বচ্ছর হইলে কী-অরা মিলমিশ কইরা চলতে জানে।

দুই ভাইবোন— সালাউদ্দিন আর দিলরুবা! আম্মারে ঘুমাইতে যাইতে দেইক্ষা, বিরাট ফাঁপড়ে পড়ে যায় তারা। উঠানটা বিরাট। সেই উঠানে মুরগিরও সীমাসংখ্যা নাই। এতো বড়ো উঠানে, এতো এতো মুরগির পিছনে পিছনে— কতোক্ষণ দৌড়াইবো তারা!

দুই ভাইবোন— সালাউদ্দিন আর দিলরুবা! আম্মারে ঘুমাইতে যাইতে দেইক্ষা, বিরাট ফাঁপড়ে পড়ে যায় তারা। উঠানটা বিরাট। সেই উঠানে মুরগিরও সীমাসংখ্যা নাই। এতো বড়ো উঠানে, এতো এতো মুরগির পিছনে পিছনে— কতোক্ষণ দৌড়াইবো তারা!

তারপর তাদের দৌড়ানির ঠেলায় সবকয়টা মুরগি যদি উঠান ছাইড়া, একেবারে পুকুরঘাটায় যায় গা; তখন তারা দুই ভাইবোনে কি করবো? পুকুরঘাটে যাইবো? যাইবো নি অরা দোনোজোনে, মুরগিগো পিছন পিছন?

ভাই তার না-বুঝ বোনটারে বলে, না না না! পুষ্কুনীর কাছেপিঠেও যাওন যাইবো না! অইনে যাইতে না নানি নিষেধ দিয়া গেছে? অইনে যামু না আমরা!

সেই কোন দুপুর তেনেই—নানি বাড়িতে নাই সেইদিন। একটা কোন ঠেকার কর্ম সারার জন্য তারে কোনখানে জানি যাইতে হইছে! সেয় থাকলে, এই দুইজোনের এমুন মন-বেজার লাগার কোনো সুযোগই আসতো না!

নানি কোন আগে কতোকিছু কইরা থুইতো—এই দুইজোনের লেইগা! সেয় সবার আগে দিতো ঝুলনি বাইন্ধা! উঠানের একদম মাঝখানেই তো আছে বিরাট আমগাছখানা। নানি সেইটার ডালে একটা ঝুলনি বাইন্ধা দিতোই দিতো এতোক্ষণে! সেইটাতে ঝুলতে ঝুলতেই তো ভাই-বইনে কূল পাইতো না! মন বেজার করবো আবার কখন!

সেই ঝুলনীর কথা দুজনেরই মনে আসে বলে, তারা গাছটার অতি নিকটে যায়। একটুখানি ঘাড় উঁচালেই দেখা যায়, ডালে ডালে কতো আমের গুটি!

কইচ্চা কইচ্চা, গুঁড়াগুঁড়া কতো গুটি। সেইসব দেইক্ষা, ভাইয়ের তখন মন চায় গাছে উঠতে। বইনরে সে বলে, এই দেখ আমি কেমনে গাছে উঠি!

ভাইয়ে গিয়া গাছের গুঁড়ি জাবড়াইড়া ধইরা ধুস্তাধুস্তি করতে থাকে, আর তার পিছে দাঁড়াইয়া— সেই চাইর বছরের বইনটায় অনেক হাসতে থাকে। অনেক হাসতে থাকে।

এমন সময়, কোনখান তেনে জানি ঘুটঘুট্টা আন্ধার মেঘ দমদমাইয়া ছুইট্টা আইতে থাকে। আতকার মধ্যে আসতে থাকে তারা! তার লগে লগে আহে শনশনাইন্না বাতাস! অনেক জোর বাতাস!

সেই বাতাসটায় করে কী—ভাইবোন দুইটারে—অনেক অনেক জোরতে ধাক্কা দেয় দেওয়া ধরে! অনেক জোর ধাক্কা! সেই ধাক্কা খাইয়া তারা দোনোজনেই মাটিতে হুমড়ি দিয়া পইড়া যায়। ও মাগ্গো মা!

ভাইবোনে খুব ডরায়ে গিয়া ঘরের দিকে ছুটতে থাকে। আর তখন কালো আসমানে চিলিক-বিলিক কইরা ঝিলকাইয়া ওঠে—একখান বিজলি!

বিজলির ঝলকে চোখ য্যান আন্ধা হইয়া যায় তাগো দুইজনের। সামনের কোনো কিচ্ছু দিশা করতে পারে না তারা!

তাও বেদিশা হেঁচোড়টা দিয়া তারা ঘরের দরোজাটা ডিঙায়। কিন্তু তারা ঘরে ঢুকেও সারে না, আবার কঠিন তেজি একটা বিজলি চিলিক দিয়া ওঠে!

আম্মা! আম্মা গো! আম্মা!

চিলক দেওয়া বিজলিটা তখন করে কী—য্যান নাইম্মা আসে তাগো ঘরখানার পিছনের আমগাছটার উপরে! তারবাদে সেই আমগাছের তেনে—এই ছোট্ট এক টুকরা বিজলি—য্যান ছুল্লুত কইরা ঢুইক্কা যায় ঘরের ভিতরে! ঢোকে সেইটায়—অই যে ভাঙা চালের কোন জায়গা দিয়া জানি—ঢুইক্কা যায়!

চিলক দেওয়া বিজলিটা তখন করে কী—য্যান নাইম্মা আসে তাগো ঘরখানার পিছনের আমগাছটার উপরে! তারবাদে সেই আমগাছের তেনে—এই ছোট্ট এক টুকরা বিজলি—য্যান ছুল্লুত কইরা ঢুইক্কা যায় ঘরের ভিতরে! ঢোকে সেইটায়—অই যে ভাঙা চালের কোন জায়গা দিয়া জানি—ঢুইক্কা যায়!

তারবাদে, য্যান মাটির দিকে, য্যান অগো দোনো ভাইবইনের দিকে—নাইম্মা আহে সেই ঝিলিকটা! ছিল্লাত কইরা য্যান নাইম্মা আইয়া পড়ে সেইটায়!

সালাউদ্দিনে এট্টুখানি আগানো ছিলো। সে আছিলো পালঙ্কের কাছে। দিলরুবা খাড়া আছিলো দরোজার চৌকাঠের নিকটে!

সালাউদ্দিনে পালঙ্কের লগে বাড়ি খাইয়া—কখন কেমনে দাঁতি যায়—সে বোঝেও না! কাঠের লগে ধাক্কার কারণেই হউক বা অন্য যে কারণেই হউক—ঠাটায় তার শইল্লে কোনো সর্বনাশ ঘটাইতে পারে না!

কিন্তু কী কারবার! দিলরুবারে ঠাটায় এমনে এমনে ছাইড়া দিয়া যায় না। ঠাটায় চৌকাঠের নিচের মাটি ভেদ কইরা, খিজলি দিয়া উইড়া গিয়া পড়ে পুষ্কুনির পানিতে! পুষ্কুনির মাছগিলি চক্ষের পলকে, মইরা কি না পানির উপরে ভাইস্সা ওঠে!

ওদিগে, দিলরুবার কি হয়? ঠাটাটায় দিলরুবারে কেবল কঠিন একটা ধাক্কা মাইরাই যায় না! ছাওটার মাথাটারেও কড়ারকমে জখমি কইরা যায়!

আল্লা! মাইয়ার মাথার দিকে চাওন যায় না! তাকাইলে, পরান য্যান ডরে দগপগাইয়া ওঠতে থাকে। দেখলে মনে অয়, ছেড়ীর মাথার তাউল্লার অনেকখানি য্যান এক কোপে কাইট্টা লইয়া গেছে গা ঠাটাটায়!

কাঁচা দগদগা মাথা নিয়া দিলরুবা পইড়া থাকে, চৌকাঠের সামনে! দাঁতি খাওয়া!

পোড়া মাংসের গন্ধ আর ধোঁয়ার গন্ধের মধ্যে, অচেতন পইড়া থাকে চাইর চাইরটা প্রাণী!

তার মধ্যেই ঝুড়মুড় ঢল নামে। বৃষ্টির তোড়ে দুনিয়া য্যান ভাইসসা যাইতে থাকে। কিন্তু চাইর জন—তার কিছুই টের পায় না! তারা অবশ অজ্ঞান আধমরা হইয়া পইড়া থাকে!

সেই সন্ধ্যায় দিলরুবার নানির পরানটা কেমুন অকামেই খালি কু-গাইতে থাকে! সেই কারণেই সেয় কিনা অই জোর বৃষ্টি মাথায় নিয়াই—বাড়িতে ফিরা আসে। ওমা! সন্ধ্যা নাইম্মা গেছে সেই কোন কালে! অখনও বাড়িতে একটা বাত্তি জ্বলে নাই! মাইয়ায় কী জনমের ঘুম ঘুমাইতাছে নি?

একটুখানি গোস্বা নিয়া নানি কয়েক কদম আগায়। তারপর সেই কেমুন জানি পোড়া পোড়া গন্ধটা তার নাকে আইসা লাগে! পোড়া গন্ধ আহে কোনখান তেনে? কীয়ের মিদে কী অইলো আবার!

হায় হায়! খোদামাবুদ! বাইত দেহি ঠাটা পড়ছে! সত্য সত্যই দেহি ঠাটা পড়ছে খোদা!

তারপর সেই টাসকি-খাওয়া, বেবোধা দশা থেকে তিনজনে রেহাই পায় অল্প কয়দিনের মধ্যেই! শুধু ডাক্তর-কবিরাজের পিছে লৌড়াইতে থাকতে হয় দিলরুবারে নিয়া।

আহা রে! মাসুম পোলাপাইন! সেয় কি না এমুন পোড়োনটা পুড়ছে! ওফ! আবার দেখো, পুড়ছে তো পুড়ছে—মাথার তাউল্লটাই পোড়ছে! এখন বাঁচন-মরোণ খোদার হাতে! কিন্তু নানি নি এই কইলজার টুকরাটারে বিনা চেষ্টায় দুনিয়া ছাইড়া যাইতে দিবো!

নানি একদিকে অই চাইর বছুইরা নাতিনটারে কোলে নিয়া হাসপাতালে আর কবিরাজের বাড়িতে লৌড়াইতে থাকে, অন্যদিকে দিলরুবার বাপে আইসা কী অপমানির অপমানিটাই না করতে থাকে! এই বুড়া মাতারিটারে—বুড়া বইল্লাও এট্টু মাফ দেয় না সেই বেটায়!

সেয় নিজের মাইয়ার খোঁজ নিবো কী, বুড়া হাউরিরে গাইল্লাইয়াই তো কূল পায় না! ধুম গালি দিতে থাকে সে! ‘এই বাড়িত—এমুন গজব পড়বো না—তো কই পড়বো? এই মাতারির দীল তো সাফা না! হেয় তো চায় নাইক্কা—মাইয়ায় নাইওর আহুক! জোর কইরা না মাইয়ায় আইছে? তাইলে কে কইতে পারে যে, মোনে মোনে এই মাতারি অভিশাপ দিয়া থোয় নাই? এই যে এমুন গজব নামছে! হেইটা আর কিছু না! এই মাতারির অভিশাপের কারণেই নামছে! কই? হের তো কিছু অইলো না? অইলো খালি আমার পরিবারের? এইটা দিয়া কি কিছুই বোজায় না? বোজায় বোজায়!’

ক্রমে ক্রমে দিন যাইতে থাকে। ক্রমে ক্রমে নাতিনের বাঁচোনের সকল আশা জলাঞ্জলি দিয়া, নানী খালি আল্লারে ডাক পাড়তে থাকে। আল্লায় জানে, এই নাতিনের হায়াত আছে কি না! কতোদিন অইয়া গেল, চোখ মেইল্লা চাইয়াও দেখে না আর দিলরুবায়! একটাবারও চাইয়া দেখে না! ছেড়ীটার নড়োন নাই চড়োন নাই! মরার মতোন নিসাড় পইড়া আছে তো আছেই! খালি ছেড়ীর বুকটার মিদে কান ঠেকাইলে বোঝা যায়-বুকটা ধুকুর ধুকুর করতাছে ঠিকই।

তাইলে তো তার নাতিনে জ্যাতা! তাইলে এরে কেমনে মাটি-মঞ্জিল দিয়া দিবো! দশজোনে দশ কথা কইলে কী! জ্যাতা মানুষরে কব্বর দেওয়ার লাহান গুনার কামে—এই সোনাভান বিবিরে কেউ পাইবো না!

সকলে তখন সোনাভান বিবিরে ভেঙাইতে ভেঙাইতে কতো জাতের কুকথাই না বলতে থাকে! বলে, ‘দেখা আছে—দেখা আছে সব! এককালে আছিলো এক বেহুলায়! মরা লইয়া ভাসছিলো গাঙে! আর এই কালে দেখা গেল এই সোনাভান বিবিরে! সেয় মরা কোলে কইরা—ঘরে বসত করতাছে! কী পেখনা! কুয়ারার দেখো শেষ নাই বুড়ির! তোবা তোবা তোবা! এমুন পিশাইচ্চা কাম আর আছে! মরাটারে মাটি দিতে দেয় না!’

লোকের লগে কাইজ্জা-ফ্যাসাদ কইরা কইরা সোনাভান বিবির যখন একেবারে মাটিতে লুটাইয়া পড়ার হাল হয়, তখন কি না দেখা যায়—মরা নাতিনে চোখ মেইল্লা চাইছে! সোন্দর চোখ খুইল্লা পিটপিট কইরা দেখতাছে নানির মোখ! আল্লা! কী কুদরত তুমি দেখাও! কী তোমার লীলা মাবুদ!

বাইচ্চা ওঠে সোনাভান বিবির নাতিনে। কিন্তু আস্তে আস্তে নানিও বোঝে, উয়ে য্যান না বাঁচলেই ভালা হইতো! মইরা গেলেই য্যান এই নাতিনে আসলে বাঁচতো! এহন যে বাইচ্চা আছে, এই বাঁচোনের কোনো দরকার নাই। এইটা হইয়া গেছে মরার বাড়া!

ঠাটা পড়োনের আগে কী আছিলো এই দিলরুবায়! কী সোন্দর চটর-পটর কথা কওয়া ধরছিলো! কী সোন্দর টুকটাক টুকটাক কইরা বাড়ি ভইরা হাঁটতো ছাওটায়! এখনও হাঁটে, তয় হাঁটতে গেলে পাও দুইটা বেঁকাবোকা হইয়া শেষ হয়। সোজা, শক্ত, সহজ কদম সে আর ফালাইতে পারেই না! এখনও কথা কয়, কিন্তু মুখের ভিতরে কথাগুলা য্যান জাবড়ায়ে যাইতে থাকে। জড়ায়া যাইতে থাকে! খুব কান দিয়া শুনলে, একটু য্যান বোঝা যায় সেই কথা! কিন্তু তার বেশি কিছু না!

হায়রে নসিব! এইটা তো মাইয়া বাচ্চা! এর এখন ভবিষ্যৎ কী! এরে কেমনে কী করা যাইবো গো আল্লা!

ডাক্তরে পরিষ্কার কইয়া দেয়, এর বেশি আর কিছু আশা করোন যাইবো না! এই মাইয়া যতদিন বাঁচবো, এই হালেই তার দিন যাইবো! তবে পাড়ায় যে বুড়ার বুড়া কবিরাজ মশাই আছে, সেয় কয় অন্য কথা! সে কয়, ‘আশা নাই-এমুন কই না!

ডাক্তরে পরিষ্কার কইয়া দেয়, এর বেশি আর কিছু আশা করোন যাইবো না! এই মাইয়া যতদিন বাঁচবো, এই হালেই তার দিন যাইবো! তবে পাড়ায় যে বুড়ার বুড়া কবিরাজ মশাই আছে, সেয় কয় অন্য কথা! সে কয়, ‘আশা নাই-এমুন কই না! ভগবানে চাইলে সারতে কতোক্ষণ! লও বইন! এট্টু চেষ্টা কইরা দেখি!’

আইচ্ছা তবে, নানি সেই চেষ্টাটা করতে ছাড়বে না! এমন না যে, নাতিন এখন তার বাপমায়ের লগে থাকে! ঠাটা পড়ার হুজ্জোত শেষ হওয়ার পরে, জামাই কিনা আইসা তার অন্য সবটি পোলাপান আর তাগো মায়েরে নিয়া গেছে!

খাড়ার উপরে আইসা, খাড়ার উপরে গেছে গা সেয়।

তবে যাওনের সময়; এই ঠাটার ঝাপটা খাওয়া, আধা-মরা মাইয়াটারে সে কিছুতেই নেয় নাই! কইছে, ‘অর যে এই দশা-এইর মূলে তো এই মাতারির দেওয়া অভিশাপ? নাকি? তাইলে সেই কর্মের ফলভোগ এই কাদির মিয়ায় করবো ক্যান! এই মাতারিরেই সেইটা করতে হইবো!’

তারপর সেই নির্বইংশায়—আর একটা দিনের লেইগাও—দিলরুবার মায়েরে এই বাড়িতে আসতে দেয় নাই! সেই চামারে আর সোনাভান বিবির মাইয়াটারে—একদিনের লেইগাও—এই রাঁঢ়ি-ধুরি মায়ের মুখ দেখতে আসতে দেয় নাই! আইচ্ছা, না-আসতে দিছে তো নাইই! অখন এই অসুইক্ষা নাতিনটারে লইয়াই জিন্দিগি পার কইরা দিতে পারবো সোনাভান বিবিয়ে! আর, আল্লায় তো আছে!

০৪.
কবিরাজ মশাইয়ের চিকিৎসার বন্দোবস্ত একেবারে সাদাসিধা! কতোখানি নিমপাতা আর একমুষ্টি দূর্বা বেটে নিয়ে, তাজা তাজা লাগায়ে দিতে হবে মাথার মাঝখানের সেই পোড়া জায়গাটায়! তারবাদে আখের গুড়-ভিজানো পানি এক দমে খাওয়ায়ে দিতে হইবো। তারপরে দিলরুবারে নিয়া পুষ্কুনিতে খাড়া কইরা রাখতে হইবো! একদম গলা পানি পর্যন্ত ডুবানো থাকে য্যান মাইয়ার শইল!

এই্ই এখনকার চিকিৎসা! এইভাবেই অখন শইল্লের ভিতর তেনে ঠাটার ধাকটারে বাইর করোনের চেষ্টাটা চালানো! এই চিকিৎসায় তরাতরি ফল পাওনের আশা করোন দুরাশা! বরং কোনো ফল পাওনের আশাসুদ্ধা করোন যাইবো না! খালি চোখ বুইজ্জা নিয়ম-বিধানটা পালন কইরা যাওন লাগবো! তাইলে হয়তো উপকার মিললে মিলতেও পারে!

প্রথম কয় বছর নানি কি না নাতিনের লগে লগেই থাকে! ভোর-আন্ধারের কালে গলা পানিতে নাতিনরে খাড়া কইরা দিয়া, নানি বইয়া থাকে ঘাটলার তক্তায়!

তারবাদে ক্রমে নাতিনে দশ বচ্ছরের হয়। এখন সে বুঝাইলে বুঝে। বারণ দিলে বারণ মানে। তখন নানির ভাবনা কমে। সেয় ভোর আন্ধারের কালে তরাতরি পাটাপুতায় ঘসা দিয়া পাতাগুলা বাটে। নাতিনের মাথার তালুতে সেইটা লেপটানি দেয়। তারবাদে নাতিনরে গলা পানিতে খাড়া করায়া দিয়া—নানি যায় সংসারের অন্য কাজ সারতে!

এতাগিলি বচ্ছর হয়—নাতিনে মুখ বুইজ্জা অই নিয়ম পালন কইরা চলছে! নানী যেমনে কয় সেমনে লড়ছে চড়ছে! চক্ষে ঘোম নিয়াও, সোন্দর গিয়া, পানিতে খাড়া হইছে! কোনো রকম হুজ্জোত করে নাই। কোনোদিন কোনো হুজ্জোত সে করে না! উল্টা কিনা সেয় হুকুমের লগে লগে যায় গা পুষ্কুনিতে। পানিতে নামে। খাড়ায়া থাকে। এইটা কী যাহা-তাহা বিষয়!

নানি মনে করে, এইটা বড়োই ভালা লক্ষণ! নাতিনের বুঝবুদ্ধি ফিরত আসার নিশানা এইটা!

অন্য সকলদিন, সেই আন্ধার ভোরে, দিলরুবারে গলাপানিতে খাড়া কইরা দিয়া নানি ফিরা যায় সংসারের কর্মে! তারবাদে পুকুর ঘাটে সেয় আবার যায়—একেবারে আসমান ফর্সা হইলে! যায় একদম সুরুজ ওঠার পরে।

অন্য সকলদিন, সেই আন্ধার ভোরে, দিলরুবারে গলাপানিতে খাড়া কইরা দিয়া নানি ফিরা যায় সংসারের কর্মে! তারবাদে পুকুর ঘাটে সেয় আবার যায়—একেবারে আসমান ফর্সা হইলে! যায় একদম সুরুজ ওঠার পরে। নাতিনরে গলাপানির তেনে তুইল্লা আনোনের লেইগাই যায় তহন—তার নানি!

এইর মধ্যে সেইদিন কী মনে হয়, নাতিনটারে খাড়া করাইয়া আসার পরে, মাঝখানে একবার নাতিনেরে দেখার কথা মনে আসে তার! তখন নাতিনরে দেখতে যায় নানি।

এই যে এমুন বোবা মুখে এতো সহ্য কইরা যাইতাছে ছেড়ীটায়, এইটা কি কম কথা? এমুন মাইয়াটার লেইগা মায়া না-লাইগ্গা পারে?

সেইদিন অমন মায়ার টানে নানি ঘাটলার যায়।

গিয়া দেখে—সর্বনাইশ্যা কারবার! তার নাতিনেরে তো কোনোদিগে দেখা যায় না! তারে না গলা পানিতে খাড়া কইরা থুইয়া গেছে নানিয়ে! রোজই তো তেমনে থুইয়া যায়! তারবাদে রইদ ওটলে আইসা তারে তুইল্লা নিয়া যায়! আজকা, এমুন আধা-আন্ধারের সোমে, দিলরুবায় নাই ক্যান এইনে! হায় হায়! বেশি পানিতে গিয়া নি ডুইব্বা মরছে উয়ে!

অমন আন্ধারে যেদিন পইল্লা দিন, নানি অরে একলা খাড়া কইরা থুইয়া গেল, সেইদিন ডরে ডরে অর কইলজাটা অনেক ধুকপুকাইতাছিলো! একবার তখন তার বলতে ইচ্ছা করতেছিলো যে, নানি যাইয়েন না গো! আমার ডর করে নানি!

কিন্তু সেই আন্ধারের মধ্যেই নানির মুখটার দিকে তাকাইয়া, দিলরুবার কেমুন জানি লাগা ধরে! আহারে! কতো কাহিল দেখাইতাছে নানির মুখটারে! তারে আবার ক্যান কষ্ট দিবো সেয়! কেমনে কইবো—নানি আপনে যাইয়েন না? থাউক! যাউক গা নানিয়ে! দিলরুবায় ডরাইবো না একটুও!

ওমা! নানি সেইদিন গিয়াও সারে নাই, তখন একদম আচানক একটা ব্যাপার ঘটে!

দিলরুবায় দেখে কী, পুষ্কুনির পাড়ে কি না আইসা খাড়া হইছে তিন-চাইরটা পোলাপান! দিলরুবার মতনই তাগো সবটিরই খালি গা! তয় সকলের পিন্ধনেই আছে হাফ প্যান! এই দিলরুবায় যেমুন উদাম শইল্লে হাফ প্যান পিন্ধা পানিতে খাড়া হইয়া রইছে, অগোও পিন্ধনে আছে তেমুন হাফ প্যান!

তারা চুপ হইয়া খাড়া থাইক্কা কতখোন—দিলরুবারে দেখতে থাকে! দেখতেই থাকে! তারপর আতকাই তাগো একজোনে কয়, ‘আয়রে আমার বাত্তি!’

অমনেই দিলরুবাগো ঘাটলার তক্তার সামনে, কেমুন একটা ধবধবা বাত্তি জ্বইল্লা ওঠে! সেই বাত্তির আলোয় দেখা যায়, পোলাপানটি কালা কুচকুচা। একদম এই পুষ্কুনির পানির মতন কালা চকচকা—দেখতে তারা! তাগো সবটিরই খালি পা। আর চোখগিলি দেখতে কেমুন জানি! য্যান নীলা নীলা! দিলরুবার মতন কালা না—তাগো চক্ষের মণি!

দিলরুবা তরাস-ভরা চোখে তাগো দিকে চাইয়া থাকে! অরা নি আমারে মারে! আমারে নি অরা সগলতে মিল্লা মাইর ধইর করে!

অমন সময় আরেকজনে কইয়া ওঠে, ‘আয়রে আমার হিজল বাগান!’

অমনেই পুষ্কুনির উঁচা পাড়ে দেখা যায়—কেমুন সব গাছ! সেইসব গাছের তেনে ফুলের বাস উইড়া আসতে থাকে দিলরুবার দিগে! ফুলের গন্ধ কিমুন সোন্দর! অনেক সোন্দর গো!

তারবাদে সেই পোলাপানগিলির একজনে দিলরুবার দিকে হাত বাড়ায়া দিয়া কয়, ‘লও! আমরা খেলি গা!’

‘তোমরা কেটায়?’ দিলরুবা ডরে ডরে জিগায়!

‘আমরা না তোমার সই-দোস্ত? চিনো না আমাগো? মনে নাইক্কা হেই কতা?’ তারা সব কয়জন একলগে হুড়ামুড়ি দেয়! ‘লও লও! খেলি গা আমরা! আহো!’

কী খেলা খেলবো তারা? দাড়িয়াবান্ধা? এক্কা দোক্কো? দিলরুবায় কেমনে খেলবো সেইগিলি? উয়ে তো নড়তেই পারে না ঠিকমতোন! খেলবো কেমনে সেয়?

কী খেলা খেলবো তারা? দাড়িয়াবান্ধা? এক্কা দোক্কো? দিলরুবায় কেমনে খেলবো সেইগিলি? উয়ে তো নড়তেই পারে না ঠিকমতোন! খেলবো কেমনে সেয়?

‘না না! এইগিলি না! আমরা খেলমু রান্ধন-বাড়ন খেলা!’ তাগো মধ্যে সকলের বড়ো যে, সে কয়! তারপর বলে, ‘আয়রে আমার টোপামুছি!’ অমনেই হিজল গাছের নিচের হালকা ঘাসভরা জায়গাটাতে এত্তা গিলি মাটির হাড়িপাতিল—কেমনে জানি আইসা পড়ে!

আহা! চলো এখন কতো খেলা যায়—খেলবো সকলে! লাল হিজল ফুলের পোলাও রান্ধা যায়? হলুদ হিজলের জর্দা? গুলাপী হিজল ফুলের মুরগির সালুন রান্ধো তো দেখি!

রান্ধতে রান্ধতে, হাসতে হাসতে, দিলরুবা কুটিপাটি হতে থাকে। তার লগে লগে সেই সই-দোস্তরাও হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে একজনে হঠাৎ বলে, ‘আয়রে আমার উড়াল বাতাস!’

অমনেই একটু জোরে য্যান বাতাস বওয়া শুরু করে! এতোক্ষণ হাওয়া আসতাছিলো হালকা-পাতলা। সেই বাতাসে হিজল ফুলেরা দুলতে দুলতে মাটিতে ঝইরা পড়তাছিলো! যেই না একজনে উড়াল বাতাসেরে ডাক দেয়, অমনেই সব ফুল উইড়া উইড়া আসতে থাকে দিলরুবার দিকে!

কোনো ফুল আর মাটিতে নামার সুযোগই পায় না। সোজা আইসা ঝাঁপায়ে পড়তে থাকে দিলরুবার মাথায়! আরে! আরে! কী সোন্দর! দিলরুবার আউলা-মাউলা চুলে কতো কতো হিজল ফুল রে! য্যান মুকুট! য্যান সেয় আর দিলরুবা না! য্যান সে রানি!
দিলরুবার কতো যে খুশি হইতে থাকে! সে হাসতে থাকে, সই-দোস্তরা হাসতে থাকে! বাতাসে হাসতে থাকে। মাটির টোপামুছি-হাড়িপাতিলটি হাসতে থাকে!

হাসতে হাসতেই সই-দোস্তগো আরেকজনে কইয়া ওঠে, ‘আয়রে আমার আমিত্তি!’

অমনেই দিলরুবায় দেখে, সেইজনের হাতে আস্তা একটা আসল আমিত্তি ধরা আছে! মিষ্টি! মিষ্টিরে ডাইক্কা আনছে অরা! এই আমিত্তি মিষ্টি খাইতে দিলরুবার কেমুন যে ভালা লাগে। অনেক ভালা লাগে! কিন্তুক নানিয়ে আমিত্তি কিন্না আনতে পারে না! অনেক টেকা লাগে যে!

আইচ্ছা! আমিত্তি খালি একটাই তো? সেইটা তাইলে সই-দোস্তেই খাউক! দিলরুবায় অই আমিত্তির দিকে চাইবোই না! উয়ে চাইলে যুদি নজর লাইগ্গা যায়! নিজের চোখ অন্যদিকে ফিরায়ে নেয় সে। ওম্মা! চোখ ফিরাইলেই বা কী! আমিত্তিটা তো দিলরুবার হাতেই ধরাইয়া দেয় সই-দোস্তে!

তারপর আস্তে কইরা আসমান খালি একটু সাদা হয় কী হয় না—সই-দোস্তরা কেমনে জানি—কই যায় গা! যাওনের আগে অরা দিলরুবারে এট্টু কইয়াও যায় না! কেমনে যে কোনদিগ দিয়া অরা যায় গা, দিলরুবায় সেইটা বোঝেই না! অত্তা বড়ো হিজল বাগিচাটা! সেইটাও কই যে নাই-হইয়া যায়! দিলরুবায় সেইটারে আর বিছরাইরা পায় না! খালি তখন দিলরুবায় দেখে, সেয় খাড়াইয়া রইছে সেই গলা পানিতে!

এইভাবে এইভাবেই না এত্তাগুলা দিন গেছে! নানি কিচ্ছু জানে নাই!

সেইদিন দেখো কিছুর মধ্যে কিছু না, আন্ধারের মধ্যে নানি আইসা দিলরুবারে খোঁজ করে! ক্যান আইতে গেল সেয়?

সেইদিন ডরে কাঁপতে কাঁপতে নাতিনরে বিছরাইতে থাকে নানি। শেষে সেয় দেখে, তার নাতিনে কিনা নিঃসাড়ে পইড়া রইছে বাড়ির পুবের ভিটির গয়াগাছের তলে! এতো দূরের পেয়ারা গাছের তলে-কেমনে আইলো নাতিনে?

সেইদিন ডরে কাঁপতে কাঁপতে নাতিনরে বিছরাইতে থাকে নানি। শেষে সেয় দেখে, তার নাতিনে কিনা নিঃসাড়ে পইড়া রইছে বাড়ির পুবের ভিটির গয়াগাছের তলে! এতো দূরের পেয়ারা গাছের তলে-কেমনে আইলো নাতিনে? কই রইছে পুষ্কুনি! আর কই আইসা দাঁতি-খাইয়া পইড়া রইছে মাইয়ায়!

এইটা কিসের আলামত? নানির বোঝার আর কিছু বাকি থাকে? এট্টুও থাকে না!

সে তুরিত গিয়া মসজিদের হুজুরের কাছ তেনে তাবিজ আনে। সেই তাবিজ দিলরুবার ডাইন ডেনায় পিন্ধায়! তারপর আর একদিনের লেইগাও, ভোর রাইতে, সেয় নাতিনটারে পুষ্কুনিতে খাড়া করতে নিয়া যায় না!

আহহারে! সই—দোস্তেরা কতো জানি অপেক্ষা করছে-কতো জানি বার চাইছে—দিলরুবার লেইগা! আর কোনোদিন তাগো লগে দেখা হয় নাই! ক্যান তারা আর আহে নাই?


Motifআরও পড়ুন
জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ : প্রথম পর্ব


 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।

আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।