শুক্রবার, মার্চ ২৯

জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ : ১ম পর্ব

0

০১.
একটা বাস নাকি আসার কথা!

সেই বাসটার জন্য চৌরাস্তার এক কিনারে দাঁড়িয়ে আছে সে। অনেকক্ষণ হয় দাঁড়িয়ে আছে।

তাকে বলা হয়েছে, চৌরাস্তার যে-কোনো দিকে দাঁড়ালে চলবে না। দাঁড়াতে হবে এইখানের—এই যে দক্ষিণমুখা পথটার— বাম কিনারে।

তাইলে সে আর রাস্তার অন্য কোনোদিকে দাঁড়াবে কেন! যেখানে দাঁড়াবার ফরমাশ এসেছে, সেখানেই তো দাঁড়াবে! সেইখানেই দাঁড়িয়েছে সে। তবে তার আগে—অনেকখানি পেরেশানি অনেকখানি বেদিশা অবস্থা—ভোগ করে নিতে হয়েছে তাকে!

Ad Strip_Akimun Rahman_e Software_EP 1

কারণ চৌরাস্তার কাছে এসে, সে কিনা বিষম খটমট ধন্দে পড়ে যায়!

দক্ষিণমুখা রাস্তাটাকে তো পরিষ্কার চিনে ফেলা গেল! কিন্তু সেই রাস্তার তো আছে দেখো দুই কিনার!

এখন, এই পথের বাম কিনার বলে ধরবে সে কোনটাকে? যাওয়ার পথের বাম দিক, না, আসার পথের বাম দিক? কোনটা?

তাইলে সেই দক্ষিণের রাস্তাটায় এসে—ভোম্বল দশায় কি সে না পড়ে পারে? সেই রাস্তার দুই দিকেই থতমত চোখে তাকিয়ে না থেকে, সে তখন আর কী করতে পারে!

কে তাকে তখন সঠিক করে বলে দিবে, কোন মুড়ার বাম কিনারে দাঁড়াতে হবে তারে? কেউ কি পারবে সেই কথাটা পরিষ্কার করে বলতে তখন? কেউ পারবে না।

এক পারলে পারবে সেই জন, যে কি না এইখানে তাকে আসতে বলেছে!

সেইজনকে তখন কোথায় পাওয়া যাবে? কে জানে কোথায় গেলে তার খোঁজ পাওয়া যায়! সে নিজে তো সেইটা জানেই না!

সেই হুকুমদার জনকে কি সে চেনে? চেনে না।

নাকি কোনোদিন তারে সে চোখের দেখাটাও দেখেছে? কোনোদিন দেখে নাই! সে শুধু মাঝেসাঝে তার আদেশ-ফরমাশটা শুনতে পায়।

তখনই কিনা সেই আদেশ মোতাবেক নানাজাতের নাই-কর্ম করতে যায় সে।

এই যেমন এখন, এই ভর সন্ধ্যাকালে, সে এসেছে এই চৌরাস্তার দক্ষিণমুখা রাস্তায়। তারপর খাড়া হয়ে আছে সেই বাসটার জন্য! এখন এমনটা করারই ফরমাশ পেয়েছে কিনা!

কে একজন জানি আছে! সেই একজন করে কী—আলগোছে আড়ালে থেকে—এমন নানাজাতের—কতো কর্মই না তারে করতে বলে!

কে একজন জানি আছে! সেই একজন করে কী—আলগোছে আড়ালে থেকে—এমন নানাজাতের—কতো কর্মই না তারে করতে বলে!

যখন সেই হুকুম মাফিক কাজ করার সুযোগটা থাকে তার, তখন সে কোনো কিছু পরোয়া করে না! দমাদ্দম করে ফেলে কাজটা!

আবার এমন অনেক দিনও আসে, যখন, ফরমাশ এলে কী! ফরমাশ মোতাবেক কিচ্ছু করার রাস্তা পাওয়া যায় না তখন! সেইসব দিনে হাজার চেষ্টা করেও সেই হুকুম পালন করার উপায় পাওয়া যায় না!

কেমনে করবে!

সেইসব দিনে, হয়তো তখন, সে আছে কোমরে শিকল বাঁধা অবস্থায়! সমস্তটা দিনের কোনো একটা ফাঁকেও তখন, হয়তো সে, একটুও ছাড়া-পাওয়া অবস্থাটা পায় না! তখন, সে নিজেরে, কেমন করে শিকল-বান্ধা অবস্থা থেকে মুক্ত করে? হাজারবার চেষ্টা করলেও কী শিকলের বেড় খোলার শক্তি তার হয়? হয় না তো! তাইলে, সেইসব দিনে, সে কেমন করেই বা হুকুম তামিলটা করতে যায়?

তখন সে নিজের কোমর-বাঁধা অবস্থাটা দেখে, আর হুকুম পালন করতে না পেরে মনে মনে গোমড়ায়! গোমড়াতে গোমড়াতেই বলতে থাকে, ‘এতো ফরমাইশই যুদি দিতে পারো, তাইলে আইয়া আমার বান্ধানী খুইল্লা দিতে পারো না? পারোই না যুদি, তাইলে হুদাকামে আমারে ডাক পাড়ো ক্যান? ফাজিল জানি কোনহানের! আমার লগে আজাইরা কুয়ারা দেহাইতে আহে!’

তবে তার এই কথাগুলা সেই হুকুম দেনেঅলায় শোনে কি না, আর শুনে তা বোঝে কি না; সেটা সে জানে না!

তার কথা তার বাড়ির লোকেই তো বোঝে না! তাইলে কি সেই না-দেখা, অচেনা লোকে বুঝতে পারবে? কেমনে বুঝবে!

বাড়ির লোকে তার কোনো একটা কথা বুঝতে পারে না! অথচ দেখো, সে কিন্তু সকলজনের প্রতিটা কথা বোঝে! সকল কথার উত্তর পর্যন্ত দেয়। কিন্তু ঘরের কোনোজনেই নাকি তার কোনো কথারে—কিছুই বোঝে না!

তারা নাকি শুধু শোনে যে, সে গোঙাচ্ছে! তার কথা নাকি কথা হয় না! খালি গোঙানি হয়!

সে যখন সেই না-দেখা হুকুমকারীকে অতোসব কথা বলতে থাকে, সেইসব শুনে তখন, ঘরের সকলে তারে নিয়ে, কীসব মন্দছন্দ বলাবলি করতে থাকে! ‘দ্যাখ! দ্যাখ! কেমুন আজাইরা কামে গরজাইতাছে, বুবীয়ে! অর আবার অখন কোন মরা মরলো! এমুন বেধুম গোঙানী দেওয়া ধরলো ক্যান! বাড়ির হগলতের কানাপট্টি দেহি বয়রা কইরা দিবো—এই বুবী! অহন গোঙাইতাছে ক্যান উয়ে? হাইগ্গা মুইত্তা নান্দিনাশ করছে নি আবার! আছতাগফেরুল্লা! আছতাগফেরুল্লা! তাইলে তো কাম সারছে!’

ঘরের মানুষের কেমন আক্কল! কেমন নাদান তারা! সে কেন এমন ডাক-চিৎকার দিতে থাকে, কেন এমন আওয়াজ সে দিচ্ছে— সেই বিষয়খানা পরিষ্কার করে জানতে পর্যন্ত আসে না কোনো একটা জনে! এমনি সে যখন চুপচাপ পড়ে থাকে, তখনও তো কোনোজনে ওর ধারে-কাছে পর্যন্ত আসে না! ভাই-বোনগুলার কোনো একজনেও তো—সারা দিনে একবারও—ওর দিকে আসে না! যখন সে একা একা কথা বলতে থাকে, অই যে-যেই কথা বলার বিষয়টারে সকলে বলে গোঙানী—সেই সময়ও কেউ আসে না—ওর আশেপাশে!

ইই! আসবে! ওরে কি অন্যরা মায়া করে নি? আসবে ক্যান তাইলে? অই সময় এমনকী আম্মায়ও আসে না! একটুও আসে না! খালি দূর থেকে ওর ওই কথা বলাটারে নিয়ে অমন কতো নিন্দামান্দা করতে থাকে! আম্মায়ও করতে থাকে! নাদানের গুষ্টি! সবগিলি নাদানের গুষ্টি!

একদিন তার একটা নাম ছিলো! একেবারে তার দশ বছর বয়স পর্যন্ত—তার একটা নাম ছিলো! তার দশ বছর বয়স পর্যন্ত সেই নাম ধরে সকলে ডাকতো! নানী যে তারে নাম ধরে ডাকতো তখন! তাইলে অন্যরা না ডেকে পারবে? নানী তাদের ছেড়ে দিবে?

সেই আগে, সে একটুখানি চক্ষের আড়াল হলেই, নানী মস্ত বেচইন হয়ে যেতো তার জন্য! সেই তখন নানি তাকে খুঁজে খুঁজে, তার নাম ধরে ডেকে ডেকে, পুরাটা পাড়া কাঁপাতো! তখন ফড়াত করে করে আওয়াজ করে উঠতো নানির গলা! যখন-তখন। তার নাম ধরে ডেকে ওঠার আওয়াজ তখন, সারাদিনে কতোবার যে উঠতো! এখন একবারও ওঠে না! একবারও না!

হঠাৎ ওঠা সেই ডাক শোনার জন্য সে এখনও অপেক্ষা করেই যায়! দিনরাত অপেক্ষা করেই যায়। কিন্তু আর কেউ তাকে ডাকে না! কেউ তাকে সেই নামে ডাকে না!

একদিন তার নাম ছিলো দিলরুবা! এখন তার নাম হয়ে গেছে—অই! ঘরের সকলে তাকে সকল সময় ডাকে— অই! অই! অই!

তবে সকলে আর কই তারে ডাকে! ডাকে কেবল আম্মায়। সেটাও শুধু ভোর সকালের কালে! অন্যরা সেই ‘অই’ বলে তো ডাকে কালেভদ্রে! আতকা কোনো বেদম ঠেকায় পড়লে তবেই! নাইলে কেউ তার দিকে তাকায়েও দেখতে চায় না!

একদিন তার নাম ছিলো দিলরুবা! এখন তার নাম হয়ে গেছে—অই! ঘরের সকলে তাকে সকল সময় ডাকে— অই! অই! অই!

তবে সকলে আর কই তারে ডাকে! ডাকে কেবল আম্মায়। সেটাও শুধু ভোর সকালের কালে! অন্যরা সেই ‘অই’ বলে তো ডাকে কালেভদ্রে! আতকা কোনো বেদম ঠেকায় পড়লে তবেই! নাইলে কেউ তার দিকে তাকায়েও দেখতে চায় না!

আম্মা যখন তারে কোনোকিছু করতে হুকুম দেয়, তখন বলে, ‘অই! ওঠ!’ নাইলে বলে, ‘অই! কতা কানে যায় না? অই!’

এই এমনেই চলছে!

এই তো সে এখন চৌরাস্তার দক্ষিণমুখা পথের বাম কিনারে খাড়া হয়ে আছে। সে একটা বাসের জন্য অপেক্ষা করে আছে! কতো কতো বাসই তো একটু পর পর আসছে যাচ্ছে! লোক নামছে ধকর ধকর! লোক উঠছেও তাতে ছুটুর-পুটুর! কিন্তু সে কোনোটার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে না। কোনো বাসের কন্ডাক্টরদের কোনোজনই তাকে বাসে ওঠার জন্য ডাকও দিচ্ছে না!

তার আউলা-ঝাউলা চুল আর ন্যাতা ন্যাতা কাপড়-চোপড়ের দিকে এক ঝটকা তাকায়েই তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, এটা একটা পাগল বেটি! পাগলটার হাতে একটা শেকলের গাট্টিও যেনো দেখা যায়।

এমন পাগল শহরের পথে-ঘাটে বিস্তর চোখে পড়ে না নাকি? পড়ে!

পাগলি খাড়া আছে রাস্তার কিনারে, তো সে খাড়া থাকুক! তারে দিয়া বাস কন্ডাক্টরের কোন কাম!

এসব বাসের কোনোটাই যে তার বাস নয়, সেটা সে এক ঝলক তাকায়েই বুঝতে পারছে! তার বাস এলে সে ঠিকই চিনতে পারবে! কাউকে কিচ্ছু বলে দিতে হবে না! সে আপনা থেকেই বুঝে নিতে পারবে—এই যে এটা তার বাস! এই কথাটা সে জানে!

তো, এমন অপেক্ষা সে এই প্রথম করছে নাকি?

নাহ!

কতো কতো কিছু নিয়ে অমন অপেক্ষা সে করে যাচ্ছে— সেই ছোটোকাল থেকেই! সেই নানাবাড়িতে থাকার টাইম থেকেই—কতো রকমে অপেক্ষা করে আসছে সে!

সে জানে—একদম ছোটোকাল থেকেই জানে—এমন যখন অপেক্ষা করতে হয়, তখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায় হঠাৎ! তখন দিন-দুনিয়ারে খারাপ লাগতে থাকার একটা ব্যাপারও হয়। অপেক্ষা করতে করতে মাথা-ঘুরানি শুরু হয়ে যেতে পারে। নয়তো মেজাজ টংফং হতেই বা কতোক্ষণ! তখন ধৈর্যহারা হয়ে লোকে অপেক্ষা করা ছেড়ে দেয়। আর, তখনই আসল জিনিসটারে আর দেখার কিসমত পায় না!

না না! এইসব কথা সে নিজে নিজে জানে না! এমনকী নানিও তারে শেখায় নাই! এই বিষয়টা তারে জানিয়েছে—তার সই-দোস্তরা!

অনেকদিন আগেই তার সই-দোস্তরা তারে এই কথাটা জানায়ে রেখেছে! তারা তার ছোটোকালের সই-দোস্ত! এই কথাটা জানাবার সাথে সাথে, তারা আরেকটা গোপন কথাও বলে দিয়েছে এই তাকে!

বলেছে, অপেক্ষা করতে জানলে—ধৈর্যটা ধরে রাখতে জানলে—উপকার পাওয়া যায়ই যায়! কেমনে ধৈর্যটা বহাল রাখতে হবে? সই-দোস্তরা সেই নিদানের সন্ধানও দিয়েছে। পটিপটি-পইপই করে বিষয়টা বুঝায়ে রেখেছে তারা!

কী সেই নিদান? নিদান হলো, এমন অপেক্ষার সময়ে তুমি নিজেরে পরান-কথা শোনাতে থাকবা! শোনাতে থাকবা পরস্তাব-কথা!

যা মনে লয়, যেইটা ইচ্ছা করে, সেই পরণ-কথাই শোনানো শুরু করো না? শোনাও!

তখন তুমি যেমন থাকবা তোমার মতন ফুরফুরা, ওদিকে অপেক্ষায়ও কিনা থাকবে তার মতন ঝরঝরা!

এই যে নিদান—এটা কি সে এতোদিন ধরে ব্যবহার করে আসে নাই? নিত্যি-খোদার তিরিশটা দিন ধরে ধরে—এই নিদান ব্যবহার করে আসছে সে!

এই যে এখন—এখনও—অই অচিন বাসটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে—সেইটাই করবে সে! নিজেরে পরণ-কথা শোনাবে! সে পরণ-কথা জানে তো!

তবে কি না শুধু একটা পরণ-কথাই জানা আছে তার! শুধু একটা!

সেই কারণে, সকল সময়ের অপেক্ষার কালে, নিজেরে সেই একটাই শোনাতে থাকে সে! ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই একটাই শোনায়!

আর কী আশ্চর্য! কোনোবারই কিন্তু সেই কথারে পুরোনো লাগে না তার কাছে! শুনতে ভেজাল লাগে না! বরং শুনতে শুনতে কখন জানি তার দুই চক্ষুই জল-টুবুটুবু হয়ে একশেষ হয়! সে জানে, এই এখনও তেমনই লাগবে!

ব্যস! তাইলে বাসটা আসতে যতো দেরিই হোক না কেন, তার ধৈর্য একটুও টলকাবে না! সে খাড়া হয়ে থাকতে পারবেই!

০২.
আমার নাম দিলরুবা! এখন আমার বয়স বাইশ বচ্ছর! তবে আমারে দেখায় য্যান এগারো-বারো বচ্ছরের একজোন! টিঙটিঙা হাতপাও আমার। এদিগে পুরাটা শরীর জিরজিরা শুকনা! এমন যে খালি অসুখের কারণে দেখায় আমারে, আমার সেইটা মনে বিশ্বাস হয় না!

বাড়িতে আমারে একদিনও পেট ভইরা খাইতে দেয় না! একদম কম কম খাইতে দেয়। অনেক কম কম! ইচ্ছা কইরাই যে আমারে কম খাইতে দেয়—সেইটা কী আর আমি বুঝি না? বুঝি। আমি কতো খাইতে চাই—বেশি বেশি খাইতে চাই! কিন্তু আম্মায় আমারে চোখ রাঙানি দিয়া ওঠে বারেবার! ঠাস ঠাস চটকনা তো অষ্টখোন দিতেই থাকে এমনে-সেমনে! আম্মায় দেয়, আবার লগে লগে ভাই-বইনটিয়েও দেয়!

যাউক গা! আমি সেইগুলারে গোণায় ধরিনি? ধরি না! আমি বুঝি তো! আমারে নিয়া তাদের সকলের কতো অসুবিধা হয়! কতো রকমের শরমের তলে পড়তে হয়! লোকসমাজে কতো টিটকারি খাইতে হয়! আমি বুঝি তো সেই কথা!

আমি একদম ভালো কইরাই বুঝি, আমি মইরা গেলেগাই ভালা হয়!

নানিও আমারে পরিষ্কার কইরা এই কথাটা কইয়া গেছে! সেই অনেকদিন আগেই এই কথাটা বইল্লা গেছে সেয়!

নানি যেই সময় অই কতাটা বলছে, তখন সেয় তার মউতের বিছানায় পড়া! তার মধ্যেই ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন আমারে কোনোরকমে বলে, ‘জীবেরে মরতে হয়ই বইন! এই যে আমি মরতে যাইতাছি! আমি গেলে গা তো তুমি পোথের ফকির হইয়া যাইবা! আল্লা ছাড়া তহন তোমার আর কেউ থাকবো না! সেই কারণে তুমি করবা কী! আল্লা-পাকের কাছে হাত তুইল্লা মিন্নতি দিবা সারা দিন! কইবা, মাবুদ গাফুরুর রহিম! আমারে তুমি তুইল্লা নেও!

নানি যেই সময় অই কতাটা বলছে, তখন সেয় তার মউতের বিছানায় পড়া! তার মধ্যেই ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন আমারে কোনোরকমে বলে, ‘জীবেরে মরতে হয়ই বইন! এই যে আমি মরতে যাইতাছি! আমি গেলে গা তো তুমি পোথের ফকির হইয়া যাইবা! আল্লা ছাড়া তহন তোমার আর কেউ থাকবো না! সেই কারণে তুমি করবা কী! আল্লা-পাকের কাছে হাত তুইল্লা মিন্নতি দিবা সারা দিন! কইবা, মাবুদ গাফুরুর রহিম! আমারে তুমি তুইল্লা নেও! আমারে মউত দেও! আমার মউত দিয়া আমারে বাছাও মাবুদ!’

নানির সব কথা আমি স্পষ্ট করে বুঝি নাই তখন! তবে আমার নিজের মউত যে চাইতে হইবো—সেটা বুঝেছি! তার কথা শুইন্না আমার চোখে তখন দুনিয়ার কান্দন আসছিলো! কেউ দেখে নাই—কেমন কান্দনের ঢলটা আসছিলো আমার চোখে! নানিও যেনো দেখতে পায় নাই!

কিন্তু আমি কী নানির কথার অবাধ্য হইতে পারি! সেইটা হইতে পারি না! কোনোদিনই তো হই নাই! সেই জন্যই না সেইদিন আমি নানির হুকুম মতোন কর্ম করা শুরু করি! চক্ষে তখন আমার কী কান্দনের কান্দনই না আইতে থাকে!

সেইদিন—একদিক দিয়া আমি আমার কান্দনের তুফান—ছোলাটা সামলাইতে থাকি, আরেকদিক দিয়া করি কী—আল্লার কাছে আমার মউত চাইতে থাকি!

কিন্তু আজকা কতোদিন হইয়া গেছে! মউতে ক্যান জানি এখনও আসে নাই! ক্যান সে আহে না— আমি জানি না! এদিকে দিন নাই রাইত নাই—আমার ডাক পাড়া কিন্তু বন্ধ করি নাই! বন্ধ করমু কেমনে? বন্ধ করলে, নানীর কতার অমান্যি করা হইয়া যাইবো গা না তাইলে? তেমুন অমান্যি করোন যায়?

এট্টুও যায় না!

তয়, মউতরে ডাকতে গিয়া কিন্তুক—এখন আর আমার চক্ষে—কোনোরকম কান্দন আসে না! অখন পুরাটা দিন কতো মতে আল্লারে ডাকতে থাকি, ‘আমারে নেও গা আল্লা! ও আল্লা! আমারে নেও গা! মউত দিয়া নেও গা! নানির কাছে নেও গা!’

কিন্তু আল্লায় নেয় না তো! আমার কতা কি হেয়ও বোজে না?

আমার এই যে অসুখ, এইটা কিন্তুক আমার জন্ম তেনে হওয়া অসুখ না! জন্মের পরে চার বছর বয়স পর্যন্ত আমি আছিলাম—পুরা সয়সুস্থ! আছিলাম একদম ঠায়-ঠিক একটা মেয়েবাচ্চা!

মায়ের মেজো বাচ্চা। আগে একটা পুত মায়ের, আমি তারপর! মাইজ্জা জন! তারবাদে আরেকটা বইন আমার তখন! তাইলে আমি মাইজ্জা না?

আব্বা অফিসে চাকরি করে! তার জিন্দিগীর একেবারে পরথম কাল তেনেই সেয় অফিসে চাকরি করে! সেইটা যে কোন অফিস-আমি তা জানি না! তয় চাকরিটা যে ছোটোমোটো একটা কিছু—সেইটা আমি বুঝি!

বুঝি,কারণ আব্বায় দিনরাইত—অই ছোটো চাকরি থাকার কষ্টে খ্যানখ্যানায়! মিজাজ করে! খালি মিজাজ করে! যহন তার মোনে লয়, তহনই আমার ভাই-বইনটিরে হেয় মাইর-ধইর করে। আর, আমারে তো নিত্যি সকালে ঠাসঠাস চটকানা দেয়! নিত্যি দেয়! হুদা কামে মারে আমারে! মারুক গা!

আল্লায়ই জানে— সেই ছোটো চাকরির কারণেই— না কোন কারণে—আম্মারে বছরের দশ মাসই তার মায়ের বাড়িতে নাইওর করতে হইতো! সেই আগেকার কথা কইলাম এইটা! তহন, বছরের আট নয় মাস—অই এক ব্যাপারই হইতো! কি? না কিনা—আম্মারে লইয়া আমরা থাকতাছি নানির বাড়িতে! থাকতাছিই! আর, আব্বায় থাকতাছে তার নিজের বাপের বাড়িতে! তয় কিনা সেয় আমাগো নানির বাড়িতে মাঝে-মইদ্যে যাইতাছে আমাগো দেখতে!

আমাদের খাদ্যখানা, অসুখবিসুখ, সাধ-আহ্লাদ—এতো সবকিছু তখন কে সামলানি দেয়? দেয় নানিয়ে!

সে হইলো বিধবা মানুষ! থাকার মধ্যে আছে কেবল তার অই মেয়ে! আমার আম্মা!

আছে দুইটা ঘর! আর আছে একটা চালাঘর! সেই ঘরের সবদিক খোলা। খালি মাথার উপরে চাটাইয়ের মতন কিছু একটা পাতা আছে! সেই চালাখানই রান্ধনঘর! বরষার কালে সেইখান, খালি একটা রান্ধনেরই জায়গা! আর শুকনার দিনে সেইটাই রান্ধনের জায়গা, সেইটাই খাওয়ার জায়গা!

সেই বিধবার না আছে একটা পুত-ক্ষেত, না আছে একটা কোনো ভাই-বইন! সে যে কোন কায়দা-কসরত করে তার নিজের মুখে, আর নিজের মেয়ের পোলাপানটির মুখে ভাত দেয়—সেই কথা—সে একটা দিনও মুখ ফুটে বলে না! কিচ্ছু বলে না! কোনোদিনও কাউরে কিচ্ছু বলে নাই সেয়!

বচ্ছরের মধ্যে মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্র—এই তিন মাস আম্মারে থাকতে হয় তার শ্বশুরের ভিটায়। এই কয়মাস কড়া খটখটা রোদ থাকার মাস। তখন বাড়ির ঘরগুলার ভিটি-পিড়া-উঠান লেপাপোছা করতে হয়। ঘরের তামা-কাঁসার কলসী-মলসী যা আছে—সব তেঁতুলমাজা দিতে হয়! লেপ-খ্যাতা-গরম কাপোড়— যেট্টুক আছে, সেইগুলারে বারেবারে রইদ দেখানের কর্মটাও সারতে হয়; সেই তিনমাসের মধ্যেই।

বছরের মধ্যে বাল-বাচ্চা নিয়া এই তিন মাসই কেবল আম্মার—একটানা কাটে তার শ্বশুরের ভিটায়। আর বাদবাকি দিন কাটায় সেয় তার মায়ের উপরে ভর কইরা! থাকে সেয় তার মায়ের সংসারে!

সেইবার বচ্ছরের সেই কড়কড়া তিনমাস পার কইরা, আম্মায় করে কী, বৈশাখ মাসের পয়লা দিনে তার মায়ের বাড়িতে নাইওর আসে।

নানি চাইছিলো, এইবার তার মাইয়ায় আর কয়টা দিন পরে নাইওর আসুক! অন্তত আর সাতটা দিন পরে আহুক! তাইলে বড়ো ভালা হইতো!

তাইলে নানি অই সাতদিনের মধ্যে ছইয়াল ধইরা, বড়ো ঘরের চালটা একটু মেরামত কইরা নিতে পারতো!

সেই বড়ো ঘরে সম্বৎসর তো মেয়েই বাস করে। মস্ত টানা একটা পালঙ্ক পাতা আছে সেইখানে! একদম পুরান-ধুরান, ঘুটঘুইট্টা কালা দেখতে সেইটা! কিন্তু হইলে কী! সেইটা পালঙ্ক তো! সেই পালঙ্ক-নানির দাদিশাশুড়ির আমল তেনে-অইঘরে পাতা আছে!

অই পালঙ্কে নিজে থাকার কোনো ফুরসত পায় না এখন আর নানিয়ে! সেইটাতে এখন দখল নিয়ে নিছে তার নাতি-নাতনীরা!
সেই ঘরেরই টিনের চালের দশা তখন একেবারে কাহিলের কাহিল! চালের কোনো কোনো জায়গার টিন একদম ঝুরঝুরা হইয়া শেষ! ছিদ্রি-মিদ্রি হইয়া সেই চাল আর য্যান চাল নাই! তারে এইবার মেরামতি না দিলে আর রক্ষা নাই! কিন্তু অতো মস্ত চালের—পুরাটা তো বদলানের তওফিক—অই বিধবা মাতারীর নাই! তবে ছইয়াল দিয়া সেইটারে জোড়াতালি দেওয়া যাইতে পারে সহজেই!

টুকরা-টাকরা টিন দিয়া দিয়া, অই জোড়াতালি দেওয়ার কর্মখান সারতেও লাগবে কমের পক্ষে তিন দিন!

চৈত্রমাসে কোনো মিস্তিরিরই হাত ফাঁকা পাওয়া যায় নাই! সেই কারণে নানীরে এই বৈশাখ মাসেই কাজ ধরার জন্য অপেক্ষা করতে হইছে! নাইলে কোন আগেই অই কর্ম শ্যাষ কইরা—মাইয়ারে নাইওর আসতে বলতো মাতারিয়ে! অখন না ঠেকায় পইড়া কয়টাদিন পরে আসতে বলতাছে? চালখান মেরামতির কাজটা ভালোমতো শেষ হওয়ার পরে যদি মাইয়ায় নাইওর আসতো এইবার! বড়ো ভালা হইতো!

জামাইয়ের কাছে মিনতিখান পাঠায় শাশুড়ি।

তাতে জামাই গোস্বা আর অপমানে খিজলি-বিজলি খাইয়া ওঠে!

কী! এত্তা বড়ো অপমানি! মাইয়া-পক্ষ হইয়া কি না মাতারি এই জামাইবাড়ির লগে অমন গুমোর দেখানের সাহস করে! এই হাউড়ি—কোন মুখে—নাইওর যাওনের দিন ধার্য করার আস্পদ্দা দেহায়! ভালা-বুরা বিবেচনা করতে কয়—এই বিধবা মাতারি? নাইওর যাওয়া-যাওয়ির বিষয় সাব্যস্ত করবো জামাইবাড়ির লোকে! জামাইবাড়ির মাইনষে বোজবো, কহন তারা কী করবো! মাইয়ার মা অইয়া এই মাতারি—কেমনে—এমুন বেলাইনের কারবার করতে চায়?

এহন যুদি পোলাপানটি কাইড়া রাইক্ষা, এই মাতারির মাইয়ারে, জনমকার লেইগা খেদাইয়া দেয়-জামাইয়ে? তহন? তহন কেমুন হইবো? সেই কথা মাথায় আছে অই রাঁড়ী-বেওয়া বেটির? দেখবো তো জামাইয়ে, কেমনে কী চলে দুনিয়ায়!

নানি সেই গরজানির গুঁতায় একেবারে থেতলা-ধেতলা হইয়া যায়! তারবাদে, নিজের গলায় আঁচল পেঁচায়ে নিয়া সেয় করে কী-নিজ মেয়ের জামাইয়ের কাছে গিয়ে মাফ চাওয়া শুরু করে। একবার নিজের দুইহাত জোর কইরা নিয়া সেয়—নিজের ভুলের লেইগা—শরমিন্দা হইতে থাকে। একবার খপ কইরা জামাইয়ের হাত ধইরা মাফ চাইতে থাকে! তারপর আবার জামাইয়ের মাথা-পিঠ নিছতে—পোছতে থাকে!

হায় হায় হায়! কী থেইক্কা কী সর্বনাশ না হইয়া যাইতাছিলো! মাবুদ! রহম করো! রহম করো!

এমনে এমনে পাও-হাতে ধইরা, তবে না কোনোরকমে, জামাইয়ের দীল ঠান্ডা করা যায়! তবে গিয়া সে রাজি হয়, বাল-বাচ্চাসুদ্ধা নিজের পরিবাররে নাইওর পাঠাইতে!

এমনে এমনে পাও-হাতে ধইরা, তবে না কোনোরকমে, জামাইয়ের দীল ঠান্ডা করা যায়! তবে গিয়া সে রাজি হয়, বাল-বাচ্চাসুদ্ধা নিজের পরিবাররে নাইওর পাঠাইতে!

এখন, ঘর পুরা খালি না থাকলে তো ঘরের চাল মেরামতি করার কোনো নিয়ম নাই দেশে! দেশের দশজনে এই নিয়মরে খুব কড়াভাবে মাইন্না চলে!

নিচে ঘরের ভিতরে ঘরের লোক থাকতাছে-চলতাছে, আর চালের উপরে ছইয়াল-মিস্তিরি কিনা মেরামতির কর্ম করতাছে! এইটা হইবো না! এইটা করোনের কোনো উপায় নাই! এমুন হইলে সর্বনাশ! এমুনটা হইলে সংসারে অমঙ্গল আইবোই আইবো! হয়, গৃহস্থের সংসারে বালামুসিবতটা আসবো; নাইলে আসবো ছইয়াল-মিস্তিরির সংসারে! হাতে ধইরা বিপদরে কে টাইন্না আনে গো? কেউ নি আনে? কেউ চায় সেইটা? চায় না!

নানি তাইলে এখন কী করে! মেয়ে তো তার তিন পোলাপান নিয়া—এই ঘরেই আইসা উঠছে! আর এদিগে ঘরের চালের হালটা কী? সেইটা ছিদ্রিতে ছিদ্রিতে ছ্যারাভ্যারা। আবার কোনো কোনো দিকের চাল ভেঙেভুঙে তে-খেচড়া হয়েও শেষ!

এই বৈশাখ মাসের তুফাইন্না ঢলরে কি এই চালখানে সামাল দিতে পারবো? এট্টুও পারবো না!

এখন কী করা!

ছইয়ালরা বলে, নাতি-নাতকুড় নিয়া এই বুড়াবেটি আর তার ঝিয়ে কয়টা দিন বাড়ির ছোটো ঘরটাতে বসত করুক না? সেই ঘর বেড়ার। সেইটার চালের উপর হাছামিছা কয়টা টিন আছে, তবে সেই টিনগুলাও ছন দিয়া ঢাকা দেওয়া! সেই ছোটোর ছোটো ঘরটাতে কয়টা দিন বসত করুক সকলে! তাইলেই তো হয়।

তাইলেই কালকা সকাল তেনে ছইয়াল-জোগালিরা আইসা চাল মেরামতি শুরু করতে পারে! তাইলে এখন, একটা রাতেরই তো ব্যাপার! থাকুক আজকা নাতি-নাতকুঁড়, এই ছনের ঘরখানাতেই।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।

আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।