শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

শীত নক্ষত্রবীথি জ্বলছে

0

স্মৃতি-উৎসের অভিমুখ
লাল টকটকে মাটির প্রলেপমথিত উজ্জ্বল নিস্তব্ধতার ভেতর একজন অলক্ষে দেখছেন নিষ্প্রদীপ জীবনের আনাচকানাচ। আর তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টির তরঙ্গবলয়ে অনন্ত অন্ধকার সমুদ্রে জ্বলে উঠছে তরলাবালাদের ভাসমান নক্ষত্রের বিষাদবীথি, বর্শাবিদ্ধ নীল যাপন।

ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়া রক্তের মতো সেইসব দগ্ধ, স্বেদমাখা, গুঁড়ো গুঁড়ো শব্দরাশির দিকে তাকিয়ে আমি স্মৃতি ঘষে শিউরে উঠি। ছবিশিকারী, অটোগ্রাফের মতো নিঃশব্দ আত্মবিবৃতি এবং বইয়ের ব্লার্ব রচনার জন্য ভিখারির নির্বিরোধ অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে চলেছিলেন অনেকে— আমি সেই নীল রাত্রির মুখরিত বিহাসের উজানে ছিলাম। নিঃসঙ্গ শীত এসে উঁকি দিয়েছিল অস্ফুটে। বছরটা ছিল শূন্য দশকের মৃতপ্রায় সূর্যে আটকে। চুল এবং কথার ঢেউয়ের উপর দিয়ে তিনি নেমে এলেন, আমার দিকে। কিংবদন্তিচ্যুত হাপূর্ণধারীদের এড়িয়ে তিনি জানতে চাইলেন, মুখচোরা আমাকে, এই আমি; নিশ্চুপ, কথা খুঁজে না পাওয়ায় প্রায় অদৃশ্য এবং অনাড়ম্বর— ‘তুমি কিছু বলছ না কেন? তোমার লেখা পড়েছি। কী লিখছ এখন?’ এমন টুকরো টুকরো কথার স্বেদ— হয়তো আমাকে উৎসাহিত করতেই বলেছিলেন তিনি!

Strip Ad_E software_Abu Hena Mostofa Enamআমি ফিসফিস করে বলি, যেন বিদীর্ণ চিৎকারে ঘুমিয়ে যাওয়া শীতের নক্ষত্রেরা জেগে না ওঠে— ‘তরলাবালার কী হলো? এটা শেষ করবেন না?’

মৃদু হাসলেন হাসান আজিজুল হক। চারপাশের উৎসুক কোলাহলে হঠাৎ স্তব্ধতার আবছায়ায় বললেন, ‘ওটা কুমিল্লার একটা খুনের ঘটনা নিয়ে লিখেছিলাম। সেখানকার ভাষা, জীবনযাপনের ধরন বোঝার জন্য সেখানে যাওয়া দরকার। এখন বয়স বেড়েছে, সব জায়গায় যেতে পারি না। সেজন্য লেখাটা আটকে গেছে।’

লুপ্ত জীবনের স্বেদ, গন্ধ আর রক্তগুঁড়োর সঙ্গে মিশে গিয়ে হাসান আজিজুল হক গল্প লিখেছেন। বাস্তব যেন তাঁর কথাশিল্পের আধার, কিন্তু সেখানেই তার সমাপ্তি নয়। তিনি বস্তুবিদ্ধ জীবন থেকে ছিঁড়ে উপড়ে নিংড়ে নিয়ে আসেন বাস্তবাতিরিক্ত ভিন্ন এক অভিজ্ঞান।

লুপ্ত জীবনের স্বেদ, গন্ধ আর রক্তগুঁড়োর সঙ্গে মিশে গিয়ে হাসান আজিজুল হক গল্প লিখেছেন। বাস্তব যেন তাঁর কথাশিল্পের আধার, কিন্তু সেখানেই তার সমাপ্তি নয়। তিনি বস্তুবিদ্ধ জীবন থেকে ছিঁড়ে উপড়ে নিংড়ে নিয়ে আসেন বাস্তবাতিরিক্ত ভিন্ন এক অভিজ্ঞান।

ব্যক্তিগত পরিচয় এবং মৃদু আলাপের স্নেহও কখনো এত বিস্ফোরক যে, আমরা প্রায়শই চ্যুত হই, আত্মনিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠি। তাছাড়া ব্যক্তিক সম্পর্ক শিল্পকলা উপভোগের পথে সৃষ্টি করে অদৃশ্য বরফের মতো জমাট, শীতার্ত দেয়াল। আমরা হেঁটে যেতে চাই, ওইসব স্মৃতি-উৎস পেরিয়ে, হাসান আজিজুল হকের শিল্পশিখার আলো-অভিমুখে।

মৃত্যুচিহ্নিত বর্ণমালা
শার্ল বোদলেয়ার যেমন মনে করেছিলেন ব্যক্তিচৈতন্যের অন্তর্গত যন্ত্রণার উৎস তার নিজের চিত্তস্থিত অন্তঃপুরে, এবং নিঃসঙ্গতা ও দুঃখের অন্তঃশীল চেতনাধারাকে তিনি অনুভব করেছিলেন নিজের প্রয়োজনের অনুষঙ্গ রূপে। কিন্তু দুটি বিশ্বযুদ্ধাক্রান্ত ব্যক্তিমানুষের জীবনে দুঃখ ও নিঃসঙ্গতা বিলাস থাকেনি, বরং ক্রমাগত বিষ পানে হয়ে উঠেছে যন্ত্রণায় নীল, ধ্বস্ত, প্রহৃত, অসহায়, নৈরাশ্যতাড়িত ও মৃত্যুন্মুখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে খণ্ড-বিখণ্ড ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি মানুষের রক্তমাংসে আমূল সেঁধিয়ে দিয়েছিল তীক্ষ্ণ তীব্র তরবারি। মাটি থেকে সমূলে উপড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল রক্তাক্ত, অগ্নিদগ্ধ, বিকলাঙ্গ ও তমোহর পঙ্কিলে। ফলে ব্যক্তির মাতৃভাষা হয়ে উঠল ক্ষুধা, নিরাশ্রয়তা, বিষাদময় নিঃসঙ্গতা। রাঢ় বঙ্গের ভৌগোলিক পরিসরে বেড়ে ওঠা ব্যক্তি হাসান আজিজুল হককেও হতে হয়েছিল উদ্বাস্তু এবং ছিন্নমূল জীবনের সামূহিক যন্ত্রণা, অস্তিত্বের সঙ্কট, স্নায়বিক অন্তর্জালজটিলতা এবং অন্তর্গত দ্বন্দ্বের পীড়নে ক্ষতবিক্ষত। তিনি গল্পে কালের এই নিষ্ঠুর রথযাত্রায় পিষ্ট দলিত-মথিত জীবনের বিষ শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নিংড়ে নিয়েছেন— এমনই দুর্দমনীয়, রক্তপাতক্ষম, অশ্রুময়। যেখানে উর্বর মাটি আর কচি সবুজ শ্যামল শস্যের সম্ভার নয়; শুষ্ক কঠিন শীতের কুজ্ঝটিকার অন্ধকার তরঙ্গে রোপিত হয়েছিল হৃদয়ে বিষ বহনকারী করবী গাছ। আর ক্ষুধার যন্ত্রণামুক্তির জন্য আত্মজাকে বিলিয়ে দিতে হয়েছে পুরুষের যৌনতার লোলুপ করতলে। তাই নিঃসঙ্গতার চাইতে নিঃস্বতা, নৈরাশ্য অতিক্রম করে যন্ত্রণার কথামালা পঞ্জরাস্থির মতো গ্রথিত করেছেন হাসান আজিজুল হক।

‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পগ্রন্থের আটটি গল্পে অস্থি ও মাংসের মতো গল্পকার গেঁথে তুলেছেন শীত, বৃষ্টি, অন্ধকারের প্রাকৃতিক শুশ্রুষায় বিষ-জর্জরিত জীবনের অন্তস্থিত কান্নার করুণ অশ্রুপাত। জীবনসন্ধানী এই স্বরকল্পে যন্ত্রণাভারাতুর ক্ষয়িষ্ণু ব্যক্তিমানুষ সমাজ-রাষ্ট্র-সময়ের সামষ্টিক তরঙ্গে, রক্তকণার প্রচণ্ড তোলপাড় এবং অগ্নিসংক্ষোভময় অভিঘাতে হয়ে উঠেছে চুরমার ও অস্তিত্বহীন।

‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পগ্রন্থের আটটি গল্পে অস্থি ও মাংসের মতো গল্পকার গেঁথে তুলেছেন শীত, বৃষ্টি, অন্ধকারের প্রাকৃতিক শুশ্রুষায় বিষ-জর্জরিত জীবনের অন্তস্থিত কান্নার করুণ অশ্রুপাত। জীবনসন্ধানী এই স্বরকল্পে যন্ত্রণাভারাতুর ক্ষয়িষ্ণু ব্যক্তিমানুষ সমাজ-রাষ্ট্র-সময়ের সামষ্টিক তরঙ্গে, রক্তকণার প্রচণ্ড তোলপাড় এবং অগ্নিসংক্ষোভময় অভিঘাতে হয়ে উঠেছে চুরমার ও অস্তিত্বহীন। এইসব উপলব্ধির রসায়নে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের বৃদ্ধের কান্নার ধ্বনি সময়ের ক্রমচাপে তরঙ্গে তরঙ্গে বয়ে চলেছে ‘আমৃত্যু আজীবন’, নিষ্ঠুর নিয়তির মতো অন্ধকার হয়ে আসা বর্ষণমুখর প্রবল বৃষ্টিতে নিশ্চিহ্ন কান্নার অশ্রুধারায়। গল্পগুলোর আপাত-কাহিনির অন্তর্কাঠামোতে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তুমুল ধস, আর্থসামাজিক ও অন্তর্জাগতিক বিপর্যয়ে ক্ষয়িত জীবন ও মূল্যবোধ। কিন্তু গল্পগুলো শেষপর্যন্ত জীবনের অনিঃশেষ সম্ভাবনার দিকেই আমাদের মনোযোগ ও চেতনা আকৃষ্ট করে।

‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ এর কাহিনি ও চরিত্রপুঞ্জে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যেমন সুহাস, ফেকু, ইনামদের গল্প, তেমনি হাঁপানির রুগী কেশো বুড়োর গল্প। তিন তরুণের স্বপ্নহীন জীবনের অন্তর্গত যৌনাকাঙ্ক্ষার মধ্যে বুড়োকে বারবার ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি করে যেতে হয় ‘আমি যখন এখানে এলাম’—এই একই সংলাপের। উদ্বাস্তু জীবনের অসমাপ্ত গল্পের গোপন স্রোতে প্রকৃতপক্ষে ফেনিয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল আঘাতে তৎকাল এবং যুদ্ধ-পরবর্তী কালখণ্ডে বিভাজিত রাষ্ট্রের ব্যক্তিমানুষের চৈতন্যে সৃজিত নতুন অস্তিত্বসংকট, আত্মজিজ্ঞাসা ও সংবেদনার পরিপ্রেক্ষিত। তরঙ্গসঙ্কুল উত্তাল অগ্নিস্ফুলিঙ্গময় ওই কালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার কবল থেকে মুক্তির স্বপ্নে ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছিল চঞ্চল। মুক্তি এলো, কিন্তু তার বার্তা বাঙালির অন্তর্চৈতন্যে এঁকে দিয়ে গেল অমোচনীয় ক্ষতের কালো রেখা। সাম্প্রদায়িক বিভেদের নীতি যে কতটা রূঢ়, নিষ্ঠুর, রক্তক্ষয়ী ও অগ্নিদগ্ধময় হয়ে উঠতে পারে, ’৪৭-এ বাঙালি জাতি অজস্র মৃত্যু আর রক্তনদী সাঁতরে তা উপলব্ধি করেছিল। একদিকে অস্তিত্ব, অন্যদিকে আত্মমর্যাদা—আলো ও নিশ্বাসের মতো পরস্পর এই দৈতানুভব মিশিয়ে দেয়া হলো ধূলিস্তূপে, নিমজ্জিত করা হলো রক্তগুঁড়োয়। একদিকে আজন্ম বেড়ে ওঠা প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিচয় ব্যক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হয়েছে, অন্যদিকে নতুন আবাসভূমিতেও সে আত্মপরিচয়হীন আগন্তুক। ‘পরবাসী’ গল্পের বসিরের ‘চোখের ওপর থেকে অন্ধকার পর্দাটা যেন সরে গেল আর তার চোখের পানিতে ধূসর হয়ে এলো দুটি পৃথিবী—যাকে সে ছেড়ে এলো এবং যেখানে সে যাচ্ছে।’ এই উন্মুলিত বোধের বাস্তবতা থেকে মুক্তি মেলেনি ব্যক্তিমানুষের। তাই ফুল নয়, সৌন্দর্য নয়; মহীরুহের সম্ভাবনা স্তব্ধ হয়ে থাকা যে ছোট্ট বীজ বিষের আধার, রোপিত হয়েছিল সেই করবী গাছ—যদিও নিতান্ত প্রয়োজনেই, কিন্তু শেষপর্যন্ত সবকিছু মিথ্যের অন্ধকারে নিপতিত হয়। সত্য হয়ে ওঠে বেঁচে থাকবার অনিবার্য বস্তুসমগ্রতা নিয়ে জীবনের আর্তনাদ, যেখানে বিষের সঞ্চরণশীলতা আষ্টেপিষ্টে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পরিত্যক্ত করে তোলে জীবনের স্বপ্ন ও স্বাধ—‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ?’ এই কান্না অনিঃশেষ।

কান্নার ধ্বনিসংকেত যাপিত জীবনের বস্তুসংহতিকে রক্তপাতময় ও মৃত্যুন্মুখ করে তোলে, ফলে নিঃশব্দ কান্নার অশ্রু সঞ্চারিত হয় রক্ত ও ইন্দ্রিয়ের সূক্ষ্ম সংবেদনায়। ‘সারা দুপুর’ গল্পের কিশোর কাঁকনের বিমর্ষ আত্মা অন্তর্গত নিঃস্বতা ও একাকীত্বের বোধতাড়িত। মা-বাবার স্নেহবঞ্চিত নিঃসঙ্গ কিশোরের মনোজাগতিক রূপান্তর ও উন্মুল সত্তার সমান্তরালে দ্যোতিত হয়েছে রিক্ত শীতের সর্বগ্রাসী শুষ্কতা ও দাদুর মৃত্যুযাত্রা। কাঁকন উপলব্ধি করে : ‘আহারে—দাদুটা মরে যাচ্ছে—লতাপাতা, ঘাস, আকাশ সব কিরকম করে মরে যাচ্ছে।’ অন্যদিকে মৃত্যুবোধে আক্রান্ত ‘অন্তর্গত নিষাদ’ গল্পের ‘লোকটা/মানুষটা’ একদিন জীবনের সব রং সুখ আবেগ দুঃখ যন্ত্রণা ও স্বপ্নময়তা বিসর্জন দিয়ে ঝুলে পড়ে কড়িকাঠে। লোকটির কোনো নাম নেই। ‘লোকটা’ অথবা ‘মানুষটা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। নাম নেই, অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি নয়, নাম অনুচ্চার্য রেখে কেবল ব্যক্তিমানুষের বৈশিষ্ট্য উল্লেখের মাধ্যমে ব্যক্তিক বোধ উপনীত হয়েছে সামষ্টিক চেতনায়। ‘লোকটা’ অথবা ‘মানুষটা’ ব্যক্তিমানুষের সামগ্রিক, সাধারণ ও সার্বজনীন পরিচয়। আমাদের সবার কষ্ট-গ্লানি-দুঃখলাঞ্ছিত যাপিত জীবনের ওই একই ইতিবৃত্ত। ব্যতিক্রম হচ্ছে, এত গ্লানি এবং ঘুমের মধ্যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন ও স্নায়ুকোষ রক্তাক্ত করে দেয়া সত্ত্বেও নিমফুলের উজ্জ্বল স্মৃতি তাকে আলোড়িত করে এবং সে কামনা করে ওই পুষ্পগন্ধ। নিম্নবিত্ত জীবনের রক্তস্রোতে সঞ্চারমান গরল প্রবাহের মধ্যেও স্বপ্নাক্রান্ত মানুষটি ‘আতাগাছ, ফলন্তনিম, শালিখ, চড়ুই আর’ সম্মুখবর্তী ছোটো মাঠের ‘পথটায় মুক্তোর মত শিশির, সবুজ গঙ্গা ফড়িং’ এইসব নৈসর্গিক শুশ্রুষায় পদচারণে সংবেদ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে এক বৃদ্ধ মৎস্যশিকারীর সমুদ্রযাত্রার চলচ্চিত্র দেখার দ্যুতিময় অভিজ্ঞতা নিয়ে স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের জন্য পোশাক, স্নো-পাউডার কিনে মানুষটি উৎসবের কোলাহলে মেতে ওঠে। পরদিন সকালে তার আত্মহনন। চলচ্চিত্রের বৃদ্ধ মৎস্যশিকারী—সম্ভবত হেমিংওয়ের সান্তিয়াগো—সমস্ত বৈরি প্রকৃতিজগৎ, দুঃখ, যন্ত্রণা, দারিদ্র্য, আত্মীয়পরিজনহীন জীবনে যে অদম্য, অপরাজেয় এবং বিপুল বস্তুবিশ্বব্যাপী যে অপ্রাপনীয়তা, নৈরাশ্য বিস্তৃত হয়ে রয়েছে তার মধ্যে বৃদ্ধ যেন নিজেই জীবনের সামূহিক শক্তিসমগ্রতায় অস্তিত্বের জ্যোতির্ময় প্রতীক। কিন্তু হাসান আজিজুল হকের ‘লোকটা/মানুষটা’ চলচ্চিত্র দেখবার এবং মূল গ্রন্থটি পাঠের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও জীবনানন্দীয় চৈতন্যের দুর্জ্ঞেয় রহস্যে জীবনের উত্তাপ জ্বালা ক্ষোভ অনুতাপ প্রশান্ত করেছে ব্যাখ্যাতীত স্বেচ্ছামৃত্যুর অন্ধকারে আত্মনিমজ্জনে।

তবে কি পরিপ্রেক্ষিতের স্বাতন্ত্র্যই ব্যক্তির অন্তর্গত মনোজগত ও চৈতন্যের বস্তুসংহতি ক্ষয়ের দারুণ বিষাদে মৃত্যুময় হয়ে উঠেছিল?

তবে কি পরিপ্রেক্ষিতের স্বাতন্ত্র্যই ব্যক্তির অন্তর্গত মনোজগত ও চৈতন্যের বস্তুসংহতি ক্ষয়ের দারুণ বিষাদে মৃত্যুময় হয়ে উঠেছিল? ঔপনিবেশিক শোষণের কাল পেরিয়ে নতুনতর সাম্প্রদায়িক ও বুর্জোয়া সামরিক রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা, শোষণ, নিপীড়ন ব্যক্তিকে স্বদেশেই করে তুলেছিল ‘পরবাসী’। তাই ‘তোর বাপ কটো? এ্যাঁ—কটো বাপ? একটো তো? দ্যাশও তেমনি একটো। বুইলি?’—ওয়াজদ্দি ও বশিরের এই সংলাপ ও আক্ষেপ বিনিময়ের পরও একজন বশিরের অভিজ্ঞতায় ছেড়ে আসা এবং আশ্রয়দাতা দেশ—দুটোই ধূসর হয়ে আসে অবিরল অশ্রুপাতে। বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্পেষণে প্রতিনিয়ত নিঃসঙ্গ, অবসাদগ্রস্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত ব্যক্তিচৈতন্য প্রকৃতপক্ষে বাস করে মৃত্যুর অভিজ্ঞতার মধ্যে। ব্যক্তিমানুষের অন্তর্জাগতিক বিচ্ছিন্নতার উপলব্ধি ‘উটপাখী’ গল্পের লেখকের রক্তস্রোতে সংমিশ্রিত করে দেয় ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো মৃত্যুবোধ। ব্যধিগ্রস্ত হয়ে লেখক তার বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিযাপন কালে অবলোকন করলেন—‘মৃত্যু জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকল, ঘরের অন্ধকারের সঙ্গে মিশে আত্মগোপন করে রইল কিছুক্ষণ এবং একটু পরেই অন্ধকার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে চৌকির নীচে ঢুকে গুড়ি মেরে বসল। লেখক স্পষ্ট দেখলেন এবং আঁতকে উঠতে ভুলে গেলেন।’ যিনি তার লেখায় ‘পিচকিরি দিয়ে কেবলই হতাশা আর অবিশ্বাস ছড়িয়ে যাচ্ছেন’, অথচ লেখক নিজে ‘বেশ মসৃণ, গোল, তৈলচিক্কন এবং হাসিখুশী’—এই স্যাটায়ারের পরেই চিতার মোহবিস্তারী অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো লেখকের মাংসে রক্তে শিরায় কোষে সঞ্চারিত হয়ে যায় জীবনের প্রতি অসম্ভব বিতৃষ্ণা। জীবন তার কাছে মনে হয় ‘মদের মতো, একবার পান করলে সে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে। পিপাসা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তখন আরো নারী, আরো খাদ্য, আরো সম্মান, অর্থ এবং স্বাস্থ্য চাইতে হয় জীবনের কাছে। জীবনের এইটাই ছ্যাবলামি… জীবন ক্রমাগত ছল করে’; কিন্তু মৃত্যু অসম্ভব সততায় জীবনের নোংরা ক্লিন্ন দুর্গন্ধময় পুঁজ রক্ত ক্লেদে আকীর্ণ পাত্র ফাটিয়ে চৌচির করে দেয়। জীবন যখন নিঃশব্দে লেখকের নিশ্বাসে স্বপ্ন, মায়া এবং মোহ বিস্তার করে তখন তিনি মৃত্যুর ছায়ায় আক্রান্ত পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ করেন। মৃত্যুলাঞ্ছিত পৃথিবীতে লেখকের বিরামহীন রোগ—এই আত্মবিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা তার মস্তিষ্কে তরঙ্গায়িত হয়। এবং তিনি উপলব্ধি করেন ‘সব চাইতে নোংরা ব্যাপার হলো বেঁচে থাকতে থাকতে মরে যাওয়া বা মৃত্যু বোধ দ্বারা আক্রান্ত হওয়া।’ মৃত্যু এবং জীবনের এই দার্শনিক অভিজ্ঞতার উপলব্ধি, অপ্রাপনীয়তা, স্বপ্নবিনাশ এবং শেষ পর্যন্ত প্রণয়িনীর নিকট প্রেমে লাঞ্ছিত হলে তিনি দেখতে পান ‘মৃত্যুর ছায়ায় আবছা শহর কাঁপছে, দুলছে, ভেঙে পড়ছে তাসের ঘরের মত।’ এভাবে হাসান আজিজুল হক নিষ্ঠুর মৃত্যুর বোধ পাঠকের চেতনাস্তরে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন, হৃদয়লোকে প্রবিষ্ট করে দিয়েছেন জীবন সম্পর্কিত এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কালো রক্তের শীতল স্রোত। কিন্তু এ তো জীবনের প্রতি ঘৃণার পরিচয় নয়, বরং তুমুল আগ্রহ এবং আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের অপ্রাপনীয়তায় গল্পের ‘লেখক’ চরিত্রটি বিচ্ছিন্নতার নিঃশব্দ রক্তপাতে নিমজ্জিত, মৃত্যুচিহ্নিত। প্রকৃতপক্ষে ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদী সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্তূপীকৃত অবক্ষয়, অসহিষ্ণুতা, হঠকারিতা ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত প্ররোচিত করে বিষণ্নতা, বিচ্ছিন্নতা ও নৈরাশ্যের পথে। মূল স্রোতের সঙ্গে একদিকে অন্তর্গত বিযুক্তচৈতন্য অন্যদিকে অঙ্গীভূতকরণের অন্তর্লীন আগ্রহ—এই দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাক্রান্ত ব্যক্তি ধনবাদের নিত্যনিষ্পেষণে ক্রমাগত হতে থাকে উন্মুলিত। বোদলেয়রের মতো দুঃখকে করে তোলে জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ রূপে, গ্রহণ করে স্বেচ্ছামৃত্যু অথবা বিতাড়িত হয় মৃত্যুবোধে।

পুঁজিবাদী কর্তৃত্বশীল শ্রেণি-সমাজকাঠামো ব্যক্তির জীবনকে অনিবার্য বিনাশের দিকে ঠেলে দেয়, বরণ করে নিতে হয় মৃত্যুবোধ অতিক্রম করে নিয়তির মতো মৃত্যুকে। একাকী ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের সংগ্রাম বিচূর্ণ, বিভ্রান্ত ও আপাতব্যর্থ হয়ে ওঠে—‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পের করমালির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিণামচিহ্নিত হয়ে উঠেছে ওই গূঢ়ার্থটি।

পুঁজিবাদী কর্তৃত্বশীল শ্রেণি-সমাজকাঠামো ব্যক্তির জীবনকে অনিবার্য বিনাশের দিকে ঠেলে দেয়, বরণ করে নিতে হয় মৃত্যুবোধ অতিক্রম করে নিয়তির মতো মৃত্যুকে। একাকী ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের সংগ্রাম বিচূর্ণ, বিভ্রান্ত ও আপাতব্যর্থ হয়ে ওঠে—‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পের করমালির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিণামচিহ্নিত হয়ে উঠেছে ওই গূঢ়ার্থটি। বাংলার কৃষিজ জীবনের সংগ্রাম চিরন্তন এক সত্য। এদেশের কৃষককুল ক্ষুধা-তৃষ্ণায়, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়, ক্ষয়-ক্লান্তিতে ওই অনিঃশেষ সংগ্রামে প্রত্যক্ষ করে জীবনের স্বপ্নবিন্দু। ‘কঠোর কোমল এই বাংলাদেশ এবং পদ্মা মেঘনা ধলেশ্বরীর তেতো, পোড়া, ভিজে হাজার বছরের পুরনো জীবনে’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষিজ জনমানুষের বিপন্ন ক্ষয়িষ্ণু স্বপ্নবিনাশী প্রবঞ্চিত প্রত্যহযাপনের অস্তিত্ব সংকট অতিক্রম করেই কৃষকের জীবনপরম্পরা প্রবহমান। সুদীর্ঘ কালের সামন্ত ও ঔপনিবেশিক শোষণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধপূর্ব কৃষিজ বাংলাদেশে কৃষকের স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা ছিল অপূরণীয়; বরং অনেকাংশে ছিল নতুন শোষণের অন্তর্জাল বিস্তারী। পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির শোষণের ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত ও প্রকৌশল একই ঐতিহ্যে শ্রমসর্বস্ব কৃষকের সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেয়। আমাদের মনে হয়, সেখানে মৃত্যু করুণ এক আত্মহত্যারই প্রতিচিহ্ন।

করমালির জীবনে জমিকেন্দ্রিক স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা পল্লবায়নের সঙ্গে সঙ্গে গ্রিক ট্র্যাজেডির অখণ্ডনীয় নিয়তির মতো বিষাক্ত ভয়ঙ্কর ফণা বিস্তারী গোখরোটি গল্পাংশে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কাহিনিতরঙ্গে অনুপ্রবিষ্ট হয় মৃত্যু। বাড়িতে গোয়াল ঘরে সর্পদংশনে মৃত্যুবরণ করে বলদ গরুটি এবং পরদিন চোদ্দ বছরের কিশোর সাদেক। কৃষি কাজের বড়ো হাতিয়ার গরুটি মৃত্যুবরণ করলে এই সংকট অতিক্রমের প্রচেষ্টায় রহমালি আর তার মা নিজেদেরকে যেভাবে জমিকর্ষণে শ্রমসংশ্লিষ্ট করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে তা কৃষিভিত্তিক দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামীণ সমাজ, পরিবারের প্রবঞ্চিত জীবনের প্রাত্যহিক সংগ্রামকে উন্মাচিত করে। গ্রামের তরুণ জনগোষ্ঠি সাপটিকে হত্যার পরিকল্পনায় জমি ও আগাছার জঙ্গলে অনুসন্ধানী হলেও শেষ পর্যন্ত সকলে অনুধাবন করে সাপটি বধযোগ্য নয়, নিয়তির মতো সরিসৃপটি জীবন ও সংস্কারের অংশ—‘…চাষবাস—ভাগে আবাদ, দুঃখ কষ্ট, অনটন—বিধিলিপি, হাটবাজার ফসল ইত্যাদির আলোচনায় দলটা মগ্ন হয়েছিল এত বেশি যে জমিতে না পৌঁছুনো পর্যন্ত তারা তার অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়েছিল। যদিও সে তার [সাপটি] কাজ করে যাচ্ছিল। এ থেকেই বোঝা যায় তার প্রভাব কত গভীর ছিল ওদের মনে।’ শেষ পর্যন্ত একমাত্র সম্বল ক্ষুদ্র জমিটুকু বন্ধক বা বলা যেতে পারে বিক্রি করেও করমালির জীবন অস্তিত্বময় হয়ে ওঠেনি। প্রবল বৃষ্টির প্রাকৃতিক সয়ংক্রিয়তার মধ্যে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু গল্পের ঘটনাপুঞ্জে ফিরে ফিরে হিংস্র সাপের অস্তিত্ব যেভাবে ভয়, শঙ্কা এবং পরিণামে মৃত্যুকে অনিবার্য করে তুলেছে—এটি এই গল্পের প্রতীকী পরিচর্যা সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতাকে ভাবিত করে। একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে আমাদের ভাবনা বিন্যাস করা যেতে পারে :

‘করমালি তার চোখের দিকে চোখ রাখার চেষ্টা করল—কিন্তু সাপটার ধূসর ম্লান ঠান্ডা বিষণ্ন চোখদুটি সম্পূর্ণ বিনা চেষ্টায় দৃষ্টির প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরাস্ত করে, ফলে দ্বিতীয়বার করমালি সেদিকে চোখ তুলে তাকাবার প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয়। সে কি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে? কণ্ঠরোধ করা শংকা? বুক ভেঙে দেওয়া উদ্বেগ? কিন্তু আশংকা ঘৃণা বিবমিষা ভীতি স্নেহ বা ভালোবাসা কোন পরিচিত মনোভাবই জন্ম নিল না তার মধ্যে। কেবল সে তার ভাগ্যকে নিয়তিকে এবং তার সংগ্রামকে—যে সংগ্রামের শেষ নেই, উত্তেজনা নেই এবং যে সংগ্রামে বার বার পরাজয় এসে করমালির সাহস দেখে লজ্জা পায় সেই সংগ্রামকে প্রত্যক্ষ করল।’

ব্যক্তির একাকী নিজস্ব সংগ্রাম ‘ভাগ্য’ ও ‘নিয়তি’র অবস্যম্ভাবী অভিঘাতে বিচূর্ণসত্তায় পরিণামচিহ্নিত। অস্তিত্বের পরম্পরা রক্ষার জন্য যে সামষ্টিক ঐক্যবদ্ধ লড়াই প্রয়োজন হয়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠির সম্মিলিত সংগ্রামে তা মূর্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু যে একাগ্রতা, দীর্ঘসূত্রতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, লক্ষ্যাভিমুখী অবিচল ধৈর্য এবং সর্বোপরি কর্মপন্থা সম্পর্কে স্থিরজ্ঞান কোনো সংগ্রামের সম্মিলিত প্রয়াসকে একটি বিজয়ের বাস্তবতা দান করতে পারে, তা ওই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ছিল না। হাসান আজিজুল হক গল্পের ঘটনাক্রমে তুলে এনেছেন ব্যক্তিমানুষের এই মনস্তত্ত্বটি :

‘কথাবার্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে একাগ্র মনে হারানো ধনের মত তাকে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছিল এবং এইভাবে খুঁজতে গিয়েই তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল—বিশ্রী বিশৃঙ্খলা দেখা দিল তাদের মধ্যে। …দলের বিচ্ছিন্নতা চূড়ান্ত হয়ে এলে—কেউ জমির বাইরে গিয়ে ইতস্তত ঘুরে ঘুরে বেড়াতে থাকলে—বালকেরা অনুসন্ধান ছেড়ে দিয়ে খেলা শুরু করলে এবং প্রত্যেকে নিজস্ব সত্তায় ডুব মেরে একদম পৃথক হয়ে গেলে শূন্য থেকে স্তম্ভের মত একটা ঘূর্ণি বাতাস প্রমত্ত গর্জন করে নিচে নেমে এলো। তখন তাকে দেখা গেল। পিছনে ছায়া ছায়া অন্ধকার গ্রামের পটভূমিকায় এবং বিপুল বিলকে সামনে ধারণ করে তার আজকের তেজস্বী ছিমছাম স্বর্ণবর্ণের শরীর অপূর্ব ভঙ্গীতে ওদের আহ্বান করছিল।’

বাস্তুসাপ সম্পর্কিত মিথিক চিন্তানুষঙ্গ এই গল্পের আন্তর্তরঙ্গে ক্রিয়াশীল কি না, এ প্রসঙ্গ উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিসমূহে বা গল্পে দৃষ্ট নয়। বরং ‘সোনালী রঙের’; ‘শরতের সকালের সূর্যের মত উজ্জ্বল’; ‘উজ্জ্বল রং মেটে মেটে’ এবং গল্পের অন্তিমে ‘বদলে গেল সাপটির উজ্জ্বল রং—তাকে মাটির মত কালো দেখালো এবং তার হালকা তারুণ্য পরিহার করে বিকট বৃহদাকার হয়ে উঠছিল—’ এই বর্ণনা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেশবিভাগ-পরবর্তী পাকিস্তানি রাষ্ট্রনায়কদের—জিন্না-আইয়ুব-ইয়াহিয়া খান—এই প্রতিচ্ছবি চলচ্চিত্রিত করে। অনেক স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে দেশ বিভাজিত হলেও ‘পূর্বপাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রটি ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব ও আত্মসম্মানকে নিরঙ্কুশ, নির্দ্বন্দ্ব, প্রশ্নহীন, দুঃস্বপ্নমুক্ত অথবা নূন্যতম মানবিক ও মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। অতিদ্রুত স্বপ্নভঙ্গ হল। দুই দিনের কাল-পরিসরে ঘটমান গল্পের সরীসৃপটির মতোই পাকিস্তানি স্বৈরসামরিক শাসকেরা সম্পন্ন করে তাদের চরিত্র, মতাদর্শ, শাসনের রাজনৈতিক ছকের রূপান্তরক্রিয়া।

হাসান আজিজুল হক ‘মুখের কথা : লেখার ভাষা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘কথা তো শুধু কথা নয়, কথা চিন্তাও তো বটে।’ হাসানের গল্প কেবল ‘কথা’র প্যাঁচ থাকেনি, চিন্তার স্ফুরণ ‘কথা’কে সচল জীবন্ত ও ইন্দ্রিয়স্পর্শী করে তুলেছে। ফলে ব্যক্তিমানুষের দিনানুদৈনিক কর্মস্পৃহা, নৈসর্গিক জগৎ ও বস্তুসংহতির সমস্তই তাঁর তীব্র তীক্ষè ভাষায় সরব বাকস্ফূর্তি লাভ করেছে। যদিও ‘নিউমোনিয়া রোগীর শ্লেষ্মার মত জমে বসেছে কুয়াশা’; ‘যুদ্ধক্ষেত্রে অগণিত মৃত সৈনিকের মত মোটা মাথার আঁটিগুলি জমিতে পড়ে রইল কিছুদিন’; ‘বাড়ীটাও রোদে থির থির করে করে কাঁপছিল’; ‘হৃদয়ের বাসস্থান মাংসপি-টি বুকের দেয়ালে ক্রুদ্ধ সিংহের মত লেজ আছড়াতে লাগল’; ‘মনের মধ্যে ছিলাছেঁড়া ধনুকের মত উজ্জ্বল হরিণেরা খেলছে, কমনীয় নারীদের মুখ পদ্মের মত ভাসছে’ ইত্যাদি সুপ্রচুর উপমাসমৃদ্ধ কাব্যিক বাক্য ছড়িয়ে রয়েছে এ গ্রন্থের গল্পসমূহে। এসব বাক্য সম্পর্কে হাসানেরই ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিষবৃক্ষ’ প্রবন্ধের উক্তি ঋণ করে বলতে হচ্ছে, ‘এরকম ভালো কবিতার ভাষা বক্তব্যের ব্যঞ্জনা বাড়ায়, লেখাকে শাণিত করে, লেখায় নানা মাত্রা এনে দেয় সত্যি। কিন্তু …উপরের ঝোঁক যখনি মাত্রাহীন দেখা দিয়েছে, তখনি তাঁর গল্পের ক্ষতি হয়েছে।’ তবে এসব তথ্য ও বক্তব্য স্বীকার করেও বলা যায়, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ এবং ‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পদুটি উপর্যুক্ত আপত্তি থেকে মুক্ত। [তদুপরি পরবর্তী গল্পগ্রন্থসমূহে হাসান আজিজুল হক ভাষা ব্যবহারে ততধিক তীব্র, তীক্ষ্ণ, ঋজু, নির্মেদ এবং সতর্ক।] ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পে তিন কিশোরের যৌনাকাঙ্ক্ষা, শীতার্ত রাত্রির বিবিধ প্রাকৃতিকতা ও উদ্বাস্তু বুড়োর জীবনের জটিল বাস্তবতা এবং ‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পে করমালির বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে বর্ষা ঋতু ও বিষধর গোখরো সাপের অপ্রতিরোধ্য সংহারপিপাসু চলচ্ছবি আলো ও বাতাসের মতো অবিমিশ্র রসায়নে নকশি কাঁথার নিপুণ সেলাইয়ে বুনট করা।

এইসব নিপুণ বুনট কখনো প্রতীকী, কখানো চিত্রকল্পময়। অবশ্য এসব গল্প পড়তে পড়তে দুটি বিশ্বযুদ্ধ-অন্তর্বর্তীকালে সামগ্রিক শিল্প-আন্দোলনে যে রূপান্তর সংঘটিত হয়েছিল, ওই চিন্তা হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে উন্মোচিত হয়।

এইসব নিপুণ বুনট কখনো প্রতীকী, কখানো চিত্রকল্পময়। অবশ্য এসব গল্প পড়তে পড়তে দুটি বিশ্বযুদ্ধ-অন্তর্বর্তীকালে সামগ্রিক শিল্প-আন্দোলনে যে রূপান্তর সংঘটিত হয়েছিল, ওই চিন্তা হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে উন্মোচিত হয়। হিটলার-ফ্রাঙ্কোর গণহত্যা, স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং ফ্যসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যক্তির অনিকেত; অনিশ্চয়তাবোধ, উন্মুলিত সত্তার বৈনাশিকতা, ক্রমাগত আত্মগ্লানির যন্ত্রণায় মৃত্যুন্মুখ ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতা ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, এক্সিসটেনশিয়ালিজম ইত্যাদি শিল্পরীতি ও দর্শনের সৃষ্টি ও সূচনা অনিবার্য করে তুলেছিল। যার অভিঘাত পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’ [১৯৩৭], আলবেয়ার কামুর ‘মিথ অব সিসিফাস’ [১৯৪২], ‘দ্য প্লেগ’ [১৯৪৭]-এর বাস্তবতা অতিক্রম করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রক্তোচ্ছ্বাসময় দিনগুলোতে এসে উপনীত হয়েছিল। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ [১৯৪৮], ‘চাঁদের অমাবস্যা’ [১৯৬৪] ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ [১৯৬৮] উপন্যাসত্রয় উল্লিখিত শিল্পরীতির পরিচর্যায় বাংলা সাহিত্যে অনতিক্রম্য। যুদ্ধ ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শিল্পকলার ওই উত্তাপ হাসানের গল্পে :

১ এখন নির্দয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে, হিম আর চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। …গঞ্জে রাস্তার ওপর উঠে আসে ডাকু শিয়ালটা মুখে মুরগী নিয়ে। ডানা ঝামড়ে মুমূর্ষু মুরগী ছায়া ফেলে পথে, নেকড়ের মত ছায়া পড়ে শিয়ালটার, …—চাঁদের আলোর মধ্যে দেশলাই-এর আগুনটা দেখালো ম্যাড়মেড়ে আর ফেকুর বিতিকিচ্ছি মুখটা দেখা গেল, কপালের কাটা দাগটা, মুরগীর মত চোখ, নীচে ঝোলানো ঘোড়ার মত কালো ঠোঁট। [আত্মজা ও একটি করবী গাছ]

২ …নিউমোনিয়া রোগীর শ্লেষ্মার মত জমে বসেছে কুয়াশা। সারাদিনের ঝড়ো বাতাসের জায়গায় এসেছে কুয়াশা। সেই কুয়াশা এবং ম্লান রং-এর আকাশ ও বাসি মড়ার মত জলো অন্ধকারের নীচে তার চারিপাশের পৃথিবীটা স্তব্ধ হয়ে গেল। [পরবাসী]

৩ করমালি অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে। জোনাকীর দিকে চেয়ে আছে। বৃষ্টির দিকে। হাওয়ায় গাছের মাথা দুলছে। সেইসব অন্ধকার, গাছ, আকাশ, হাওয়া ইত্যাদি পেরিয়ে দুর্জ্ঞেয় বিল পড়ে আছে বিশাল। সে এখন জীবনকে ছুঁড়ে দিল আকাশে এবং তারপরে আবার লুফে নিল এবং মৃত্যুকে ছুঁড়ে দিল। [আমৃত্যু আজীবন]

৪ করমালি ফিকে অন্ধকারের মধ্যে চেয়ে দেখল বিল দিগন্তের কাছে এখন স্থির হয়ে ঝুলছে—তারপর তার দক্ষিণ পশ্চিম কোণের নীচের দিকটা সামান্য কাঁপল এবং রংহীন, অবয়বহীন বিকট একটা অস্তিত্ব এখন দ্রুত আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। কখনো সেটা সমস্ত আকারহীনতাকে অতিক্রম করে সূক্ষ্ম দ্যুতিময় তীরের ফলার মত শূন্যতায় বিঁধে দিল, কখনো বেঢপ কল্পনাতীত বৃহৎ হাতীর শুঁড়ের মত অস্পষ্ট নড়েচড়ে বেড়াচ্ছিল এবং নীচে পৃথিবীতে নিশ্চলের মধ্যে মাছের খোলা চোখে।

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিসমূহের প্রথম ও দ্বিতীয়টিতে ‘গোয়ের্নিকা’র ছেঁড়া, খণ্ড-বিখণ্ড, বিচূর্ণ, বিকৃত মানুষ ও পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিত্রাত্মক উপস্থাপনা আমাদের অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়কে করে তোলে সচকিত। নির্দয় শীতে যেখানে প্রকৃতির প্রায় সমস্তই রিক্ত, শুষ্ক ও জরাগ্রস্ত; তখন কলার পাতার এপিঠ-ওপিঠ প্রদর্শন কি বিভাজিত ভারতবর্ষের দুই প্রান্ত, যার উভয় খণ্ডেই পুঁজি-সম্পর্ক ও রাজনৈতিক কৃৎকৌশলে ইনাম, ফেকু, সুহাস এবং কেশো বুড়োর জীবনচক্র বাঁধা এবং একই ঘূর্ণিপাকে উত্থত ও পতিত? তাই চাঁদ ফুটে থাকে—এ যেন ভয়ঙ্কর এক পরিহাস। নৈসর্গিক বস্তুবৈচিত্র্যের এই পরিহাসের মধ্যে ব্যক্তিঅস্তিত্বের গ্রন্থনা রং, শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের প্রেক্ষাপটে প্রমূর্ত হয়ে ওঠে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকল্প। চাঁদ ও দেশলাইয়ের অস্বাভাবিক আলোয় চরিত্রের অন্তর্জগত ও বহির্জগতের বিকৃত আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নব্যাকরণময় রূপালেখ্য পরস্পরিত হয়ে রক্তস্রোতে তরঙ্গায়িত ও উন্মোচিত। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটিতে আতঙ্কিত, ভীতিবিহ্বল সন্ত্রস্ত এবং অস্তিত্বসংহারী শীতার্ত নৈসর্গিক পরিপার্শ্বজনিত ব্যক্তিসত্তার অভিব্যক্তিতে বিকীর্ণ কুয়াশায় নির্বস্তুক অন্ধকার হয়ে উঠেছে জীবন্ত ও অনুভূতিপ্রবণ। তৃতীয় ও চতুর্থ উদ্ধৃতি, ব্যক্তির আবেগ-আতঙ্ক-উপলব্ধির রূপায়ণে বস্তু ও নিসর্গলোকের যে রূপান্তর সাধিত হয়েছে তা এক্সপ্রেশনিজমের রীতিচিহ্নিত। তৃতীয় উদ্ধৃতির বাক্যসমূহ ক্রমশ হ্রস্ব এবং পুনরায় দীর্ঘ ও সুদীর্ঘ হয়েছে। অর্থাৎ হাওয়ার মৃদু দোলা দিগন্ত পেরিয়ে নিঃসীম আকাশম-লে ব্যপ্ত এবং শেষাবধি তা জীবনের সীমা অতিক্রম করে স্পর্শাতীত অদৃশ্য মৃত্যু পর্যন্ত লোফালুফি করে চলেছে। সর্বাপেক্ষা হ্রস্ব বাক্যটি ক্রিয়াপদবর্জিত। অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষ এখানে নিষ্ক্রিয়, ক্রিয়াশীল নিসর্গ ও বস্তুবিশ্ব। নিছক ক্রিয়াশীল নয়, ক্রীড়নকও বটে। চতুর্থ উদ্ধৃতিতে ভৌগোলিক বস্তুপরিসীমা শূন্যে ঝুলন্ত। এই বস্তুঅস্তিত্ব বর্ণহীন, অবয়বশূন্য এবং প্রকৃত বস্তুসংহতিহৃত, বিকৃত—বস্তুর এই রূপান্তর আমাদের পরাচৈতন্যের স্মৃতি, দৃশ্য ও কল্পনাকে করে তোলে বিমূঢ় এবং নতুনতর অভিজ্ঞতায় স্পন্দমান।

‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গ্রন্থের গল্পসমূহে শীত ও বর্ষা ঋতু এবং নির্বস্তুক ‘অন্ধকার’ লেখকের শিল্পদৃষ্টির সংবেদনায় হয়ে উঠেছে ব্যঞ্জনাবহুল। অবশ্য ‘দৃষ্টিকোণ’ প্রসঙ্গের জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র প্রবন্ধ, তবে ঋতু-প্রসঙ্গটিই এখানে ইঙ্গিতে উল্লেখ্য।

‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গ্রন্থের গল্পসমূহে শীত ও বর্ষা ঋতু এবং নির্বস্তুক ‘অন্ধকার’ লেখকের শিল্পদৃষ্টির সংবেদনায় হয়ে উঠেছে ব্যঞ্জনাবহুল। অবশ্য ‘দৃষ্টিকোণ’ প্রসঙ্গের জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র প্রবন্ধ, তবে ঋতু-প্রসঙ্গটিই এখানে ইঙ্গিতে উল্লেখ্য। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’; ‘পরবাসী’; ‘সারাদুপুর’ গল্পে ব্যক্তির রূঢ় বাস্তবতা, অন্তর্জটিলতা, টানাপড়েন ও আতঙ্কিত অস্তিত্বজিজ্ঞাসার সঙ্গে শীতার্ত নিসর্গের বিবিধ অন্ধকার, বস্তুবৈচিত্র্য ও কুয়াশা নিশ্বাসে প্রবিষ্ট হয়েছে। শীত যেমন বিবর্ণ, রিক্ত, বিষণ্ন, শুষ্ক এবং সর্বোপরি মৃত্যুর সংকেতবাহী। [স্মরণীয়, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ‘এই শীতে’ : আমি যদি ম’রে যেতে পারতুম/এই শীতে,/গাছ যেমন ম’রে যায়,/সাপ যেমন ম’রে থাকে…] এই গল্পত্রয়ীর ঘটনাংশ জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দোদুল্যমান। [যদিও ‘অন্তর্গত নিষাদ’ গল্পের কাল কোকিলের ধ্বনি, নিমফুলের ঘ্রাণে বসন্তের প্রতিই ইঙ্গিত দেয়, তবু আবেগ-উন্মোচিত বসন্তে স্বেচ্ছামৃত্যুই অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। ‘মারী’; ‘উটপাখী’ ও ‘সুখের সন্ধানে’ গল্পের সময় ক্রমশ ধূসর তামাটে ধূলিবিকীর্ণ রৌদ্রের স্মৃতিতাড়িত।] শীতের রিক্ততার অনিবার্য সত্যের তরঙ্গে বিষপূর্ণ, ক্লেদাক্ত, তিক্ত কান্নার আবেগের মধ্য দিয়ে যে জীবন ভবিষ্যৎসঞ্চারী; ‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পে হাসান আজিজুল হক অন্তর্নিহিত ওই রূঢ় কঠিন ম্যাড়মেড়ে নিষ্ঠুর আনন্দশূন্য মৃত্যুময় বাস্তবতাকে অঙ্গীভূত করে সেই জীবনের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। তাই তাঁর বার্ষবন্দনা। বর্ষা বাংলার মাঠপ্রান্তর উর্বর এবং সবুজ শস্যশ্যামল করে তোলে। নিসর্গের এই ঋতু যতই গভীর অন্ধকার রূপালেখ্যে বর্ষিত হোক না কেন, ‘মেঘের মত কালো মেঘ’; ‘সুর্মা রঙের মেঘবাহিনী’; ‘অতি বলশালী কৃষ্ণকায় মেঘ’ কৃষিজীবনের উর্বরতারই প্রতীক। তাই ‘বৃষ্টি এখন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল’—এই শব্দপুঞ্জের মধ্যে ব্যক্তিমানুষের অন্তর্জাগতিক আকাঙ্ক্ষা অতীতের অন্ধকার গহন ছেড়ে ঘোরলাগা থমকানো বর্তমানের নিবিড় বর্ষণে রহমালির জীবন সিক্ত হয়ে ওঠে আরেক বৃষ্টিক্লান্ত অন্ধকারে।

হাসান স্যারও ফিরবেন শীতকুয়াশা বিকীর্ণ নতুন কিশলয়ে? বৃষ্টিমগ্ন কোনো নিসর্গে?

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক, সাহিত্যসমালোচক। জন্ম ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে, মেহেরপুর শহরে। লেখাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে। ‘ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী’ [২০০৫] প্রথম গল্পগ্রন্থ। ২০১০ সালে প্রকাশ হয় দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘নির্জন প্রতিধ্বনিগণ’। তারপর ‘প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প’ [২০১১], ‘জোনাকিবাবুই’ [২০১৮] এবং উপন্যাস ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’ [২০১৪]। সম্পাদনা : ‘মাহমুদুল হক রচনাবলি’ [বাংলা একাডেমি, ২০২০] সমালোচনামূলক বই ‘মাহমুদুল হক : সৃষ্টি ও শিল্প’ [২০২১]।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।